#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৫.
দানীন পর্দা সরিয়ে জানালার থাই গ্লাসটা টেনে দিলো। দিবালোকের নরম আলো ঘরে ঝুপ করে প্রবেশ করলো। এলইডি বাল্বের সঙ্গে অকৃত্রিম প্রভাতালোকের আলতো মিশ্রণ রুমের শ্বেতবর্ণের দেওয়ালকে গোধূমবর্ণে রূপান্তরিত করলো। দানীন জানালার গ্রিলের অভিরাম নকশার শূন্যস্থান দিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো।
আকাশ শব্দটি শুনতেই যেনো আমরা মনের চোখ দিয়ে নীলাভ রঙের সাথে সাদা বা হালকা ধূসর রঙ মিশ্রিত দৃশ্য কল্পনা করি। নীল জলের স্বচ্ছ পানি বিহীন সমুদ্র, সেই সঙ্গে সাদা ফেনা তোলা উল্লাসের হাসি। তবে আজ আকাশ-রঙ্গী আকাশ তার নিজস্বতা অতিক্রম করে পা ফেলেছে। রূপ ধারণ করেছে শ্বেতপরিচ্ছদধারী আকাশমণ্ডল হিসেবে। গভীর সমুদ্রের নির্মল নীল জলের চাদরের উপর যেনো সাদা রঙের চাদর দ্বারা মুড়ানো হয়েছে। এই চাদরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরিমাপনের অসম্ভাব্যতা উপলভ্য। গোলাকার সূর্যও তার ঔষ্ম সঙ্গে নিয়ে অদৃশ্য। প্রখরতা ছড়িয়ে প্রখরত্ব বিদিত করতে আজ তার বড্ড অলসতা।
“ভালোবাসি কি না বাসি বন্ধু টেরাই করো আমারে, কতো ভালোবাসি তোমারে।”
রানিয়া তার সিঙ্গেল বেডে হাত-পা ছড়িয়ে খর্খরে স্বরে গান গেয়ে ওঠলো। কণ্ঠে ঘুমের রেশ এখনও বিদ্যমান। তাসনিম, তাদের ক্লাসমেট, তার বিছানা থেকে, ‘মারহাবা, মারহাবা’ বলে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে ওঠলো। তাসনিম ও রানিয়া ছাড়াও এই রুমে আরও ছয়জন মানুষ থাকার ব্যবস্থা আছে। রানিয়া ও তাসনিম একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী।
দানীন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে দাঁড়িয়ে আছে। তার এখানে আসার কারণ রানিয়ার মৃত ব্যক্তির ন্যায় নিষ্প্রাণ ঘুম। দানীনের প্রাত্যহিক রুটিনের অন্তর্ভুক্ত– পাঁচ তলাবিশিষ্ট হলের দুই তলায় অবস্থিত হয়ে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে লাথি-উষ্টা যেকোন উপায়ে বান্ধবীর বিছানার সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কের অন্তিম ঘটানো।
দানীন কিছু বলার পূর্বেই রানিয়া বলে ওঠলো,
“না, এভাবে আর থাকা যায় না। অতি শ্রীঘ্রই প্রেমিক নামক মুরগি শিকার করতে হবে। ভেবেছিলাম আয়মান স্যারের সঙ্গে সমধুর প্রণয় গড়ে তুলবো। বাচ্চা বয়সী স্যারটা সিঙ্গেল শুনলেই বুক চিড়ে হাজার মাইল সমান দীর্ঘশ্বাস নিগর্ত হতো। কিন্তু শালা আয়মান স্যারের বদমাইশির কাহিনী জানার পর টিচার থেকে মন উঠে গেছে। শালা হতচ্ছাড়া!”
গালে হাতের করতল ঠেকিয়ে হতাশ গলায় বললো,
“কিন্তু এখন পূত-পবিত্র মোরগছানা কোথা থেকে শিকার করি?”
রানিয়া কৃত্রিম উদ্বেগপূর্ণ চেহারা তৈরি করে চিন্তায় নিমগ্ন হলো।
দানীন হেসে জিগ্যেস করলো,
“তাহলে তোর প্রেমিক খাতার লিস্ট থেকে টিচার বাদ?”
রানিয়া তালির শব্দ উৎপন্ন করে বললো,
“ইয়েস! একজনকে দেখেই বিতৃষ্ণায় আমার আলসার হয়ে গেছে দোস্ত।”
দানীন হেসে ওঠলো।
তখনই পাশ থেকে তাসনিম বলে ওঠলো,
“সব টিচার যে খারাপ মানুষ এরকম তো নয়। আর মেয়েটারও দোষ ছিলো। স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সুশীল পরিবারের আয়ত্তে থেকে কি করে স্যারের কথায় সম্মতি জানায়?”
রানিয়া দুই ভ্রু কুঁচকে বললো,
“এটা কেমন কথা। আমরা ছোটবেলা থেকে শিক্ষালাভ করে এসেছি মা-বাবা পর শিক্ষক যার শিক্ষায় শিক্ষিত হই, যার আলোয় আলোকিত, তাই নয় কী? এখানে যদি মদখোর কিংবা বিগ্রে যাওয়া পথের ছেলের সঙ্গে মেয়েটা জড়িয়ে পড়তো তখন মেয়েটার উপর শতভাগ দোষ বর্তানো যেতো। কিন্তু শিক্ষক! পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের থেকে অধিক আমরা শিক্ষকমন্ডলী ও বন্ধুমহলের সঙ্গে পরিচিত। ছোটবেলা থেকে পথনির্দেশক সূত্র হিসেবে শিক্ষক ও তার শিক্ষাদানকে বিশ্বাস করতে শিখে এসেছি। এই ভরসাস্থল এতো ধারালো যে, এর প্রখরত্ব আমাদের সর্বসেরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে রূপদান করতে পারে। অন্যথায়, এর তীক্ষ্ণতা দলিতমথিত করে সারাজীবনের জন্য ঐ ভরসাস্থলকে বিদীর্ণ করতে পারে। সেই হিসেবে খারাপ পরিজ্ঞাত করা কী যৌক্তিক নয়?”
তাসনিম হঠাৎ ক্রোধিত কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“একজনের জন্য সবাইকে খারাপ ভাবার রাইট তোকে কে দিয়েছে!”
তাসনিমের ধমকের গলা শুনে দানীনের মাথাটা একলহমায় ধপ করে ওঠলো। সে জানালার পাশ থেকে সরে এলো। সরে এসে রানিয়ার বিছানায় তার পাশে পা ঝুলিয়ে বসলো।
“রাইট না? অলরাইট! ধর, একটা মেয়েকে পাশের বাসার আন্টি কিংবা তার খালা কুপিয়ে হত্যা করলো। জানা-অজানা যেকোন এক কারণেই হোক। আর সেটাকে সাধারণত খুন হিসেবেই তুই, আমি এবং আমরা সবাই দেখবো। কিন্তু একই ঘটনার সূত্রে এগিয়ে মা কুপিয়ে মেয়েকে ভয়ানকভাবে হত্যা করেছে। এই খবর যখন কানে আসবে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। তুই মায়ের নেউটা হয়ে মায়ের দিকে আড়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চিন্তা করবি, ‘মায়েরাও কী এরকম করতে পারে? কোনো মায়ের হাত দিয়ে সন্তানের জীবননাশ করা আদৌ সম্ভব?’”
তাসনিম যেনো থতমত খেলো খানিক।
দানীন আবার বলতে শুরু করলো,
“বাবা-মা শব্দজোড়ায় যেই গভীরতা বিদ্যমান, শিক্ষক শব্দটিতেও সেই নিবিড়তা বিরাজমান। কারণ ছোটবেলা থেকে শিক্ষাদান করা হয় উভয়েই আমাদের উপদেষ্টা, অগ্রদূত। সমাজে যেসব মানুষরূপী জানোয়ারের বিচরণ অব্যাহত; আমরা বিশ্বাস করি তাদের চেনার উপায় আমাদের বাবা-মা নামক শিক্ষক এবং যাদের সান্নিধ্য হই শেখার প্রয়াসে, সেই শিক্ষকমন্ডলী শেখাবে। কিন্তু যাদের থেকে শিক্ষালাভ করবো তাদের মধ্যেই যদি অসাধুতা, শয়তানি নিহত থাকে? খবরে শুনিস না বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্কের ভয়ঙ্কর পরিণতি? ধর এখানে তীরটা বাবা-মা থেকে নিক্ষেপণ হলো। কি আশ্চর্য! ‘মা-বাবা মানেই ভালোবাসা, মা-বাবা মানেই সর্বোচ্চ ভরসাস্থল’ এই বাক্যগুলো তটস্থ করার পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে মা-বাবা জানোয়ার? ওহ, দুঃখিত! ঐ তোর প্রশ্ন করা রাইট অনুযায়ী নির্দিষ্টভাবে ভাবতে হবে, ‘কিছু কিছু মা-বাবা অকুলীন ও বেজন্মা’? বুকটা ধক করে উঠে না? শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠে না? প্রশ্ন আসে না কিছু কিছু মা-বাবা হলেও কেন হবে মা-বাবা এরকম!”
রানিয়া তার দিকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। আর তাসনিম, তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার অক্ষিগোলক হতে এখনই চোখ দুটো টেনিস বলের মতো ঝাঁপ দিয়ে ফ্লোরে পড়বে।
দানীন আরও বললো,
“শিক্ষকের ক্ষেত্রে ঠিক সেরকমই ঘটে। এখানে সব শিক্ষককে খারাপ অভিহিত করা হচ্ছে না। কিন্তু ‘শিক্ষক’ শব্দটির উপর সহজাত সে বিশ্বাস তৈরি হয়, সেই বিশ্বাসের নোংরা দশা জাহির করা হয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষকের জায়গায় কোনো রিকশাওয়ালা, বাস কন্টাক্টর বা গাঞ্জাখোর থাকলে আমাদের রাইট নিয়ে প্রশ্ন করতি না। তুই-ও সঙ্গে সমস্বরে একই বাণী আওড়াতি। কারণ তো জানিসই। তারা জন্মগত অশিক্ষিত। তাই কামলা খাটে। তারা তোর সম্মানীয়, মহিমান্বিত টিচারের সান্নিধ্যের অভাবে এবং ব্লা ব্লা ব্লা..আরও কত বুগি-জুগি। তাই না তাসনিম?”
তাসনিম নিজের মতামত দাঁড় করার জন্য নিচু গলায় কিছু বলার চেষ্টা করলো,
“কিন্তু তবুও, মেয়েটা কি অবুঝ..”
রানিয়া বিরক্ত কণ্ঠে বিছানা হতে উঠে বললো,
“সবচেয়ে বড় অবুঝ তুই। চরম গর্দভ! আপনি মাশাআল্লাহ যা চিন্তা-ভাবনা গড়ে তুলেছেন নিজের মধ্যে, দেখবেন আপনিই একই ঘটনা ঘটিয়ে বসে আছেন। যা দৃষ্টির সামনে থেকে দূর হ!”
রানিয়া তাকে ধমকে ওঠলো।
দানীন ফুস করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
“বুঝলি রানিয়া অন্ধ বিশ্বাসের ফলে মানুষ নেতিবাচক জিনিস এবং নিজের ভুলত্রুটি উপলব্ধি করতেও অক্ষম। কেউ বর্তমান ভ্রান্তি সম্পর্কে, কেউবা সেই ভ্রান্তির নিজের মধ্যে পোষণ করে অদূর ভবিষ্যতে একই রচনা রচিত করবে যে সেই উপলব্ধিবোধে।”
আমরা এখন যাকে তাকে বিশ্বাস করায় অভ্যস্ত। অদূর ভবিষ্যতে অবিশ্বাস করায় অভ্যস্ত হবো। কিন্তু এই বিশ্বাসের গুরুত্ব উপলব্ধি ও মূল্যায়ন করলে শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে, বাবা-মার সম্পর্কে বিষাক্ততা আছড়ে পড়তো না। কখনোই না..
দানীন ও রানিয়া হল থেকে বের হয়ে কলেজ রোড দিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে হেঁটে চলছে। রানিয়া দানীনের মেঘমেদুর কেশ হাতে সর্পিলাকারে প্যাঁচিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো।
দানীন রানিয়াকে ঠেলে দূরে সরাতে সরাতে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“আহ! মাথা থেকে চুল ছিঁড়ে ফেলবি নাকি? শুধু টানাটানি।”
রানিয়া ছলাকলাহীন স্বরে বললো,
“সুন্দর চুলের অধিকারী বলে এরকম হামকি-ধামকি দিচ্ছিস? এই আমার প্রতি তোর ভালোবাসা। আজ চেহারা শ্রীহীন, চুল কাকের বাসা বলে, হুহ।”
দানিয়া রানিয়ার বাহুতে ঘুষি মেরে বললো,
“অতি সুন্দরীরা ভঙ্গিমা না করলে তো তাদের পেট খারাপ করে। যেমন-তুই। ধবল রোগীর মতো ফরসা, টিকালো নাক। সাহিত্যিকদের বর্ণনানুযায়ী পটলচেরা, লাউ-কুমড়োচেরা আর কিসের কিসের মতো যেনো চোখ। এরপরও নিজেকে অসুন্দর হিসেবে দাবী করতে লজ্জা হয় না? বেয়াদপস!”
রানিয়া নাক-মুখ সঙ্কুচিত করলো। ঘেঙচানো মুখমণ্ডলে বললো,
“ধবল রোগী? ডু আই লুক লাইক অ্যা ধবল রোগী?”
“আরে এটা তো ফর্সার মাত্রা বুঝানোর জন্য বললাম। অসুন্দর বলবি আমাকে। আ’ম অ্যা ব্ল্যাক গার্ল।”
বলতে বলতে দানীনের মুখ কালো হয়ে গেলো।
রানিয়া তা খেয়াল করে তাকে হাসানোর প্রযত্নে বললো,
“আজকাল ছেলেরা রূপবতী কন্যা দেখলেই বুকের বামপাশ খামচে ধরে। পূর্বে অনুরাগে, বর্তমানে ভয়ে। কারণ তারা জানে– রূপবতী কন্যারা তাদের রূপের প্রতি এতটাই যত্নশীল যে এই রূপ প্রদর্শন করে যতজন থেকে বাহবা নেওয়া যায়, তার সব করে। এখন নাইন্টি পার্সেন্ট ছেলেকে জিগ্যেস করলেই প্রত্যুত্তরে বলবে, আমার শ্যামলা, শ্যামলবতী কিংবা শ্যামলতা পছন্দ।”
দানীন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো। সেই সঙ্গে আরও কিছু উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ কানে এলো। পিছন থেকে কেউ, ‘ঠিক ঠিক’ বলে আবারও সশব্দে হেসে ওঠলো। দানীন, রানিয়া উভয়ই হাসির আওয়াজ অনুযায়ী পিছন ফিরে তাকালো।
দানীনের শ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। সেই ক্ষণকালীন দর্শনপ্রাপ্ত শ্যামবর্ণা। তবে আজ ভ্রূকুঞ্চিত আঁখির কষাটে চাহনি নেই। দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা জানান দিচ্ছে যে সে দানীনকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। দানীন রানিয়ার হাত খাবল মেরে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।
রানিয়া তার লজ্জা রাঙা কুণ্ঠিত মুখ ঠাহর করে ভ্রূ নাচিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কি করে, ভয় পাচ্ছিস নাকি লজ্জা পাচ্ছিস?”
“অহেতুক ভয় বা লজ্জা পাওয়ার তো কারণ দেখছি না।”
“সেটাই তো প্রশ্ন।”
দানীন তীর্যকভাবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রানিয়াকে দেখার চেষ্টা করলো। দেখলো রানিয়ার সমক্ষ দৃষ্টি তার উপরই নিবদ্ধ। পিছন থেকে আবার হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। মাথা ঘুরিয়ে দানীনের সেই শ্যামবর্ণাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার প্রচেষ্টা করলেই রানিয়া বাঘিনীর মতো তার ঘাড় চেপে ধরে আসল কাহিনী জানতে চাইবে।
তার মতো বোকাসোকা মানুষের এরকম রাক্ষসীর মতো বান্ধবী যে কিভাবে কপালে জুটল।
(চলবে)