#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#৬ষ্ঠ_পর্ব
অন্নার কথায় হতবিহ্বল হয়ে গেলো অর্জুন। কিছু সময় লাগলো মেয়েটির কথাগুলো মস্তিষ্কে ধারণ করতে। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“তুই আবার আমার জিনিসে হাত দিয়েছিস?”
অর্জুনের প্রশ্নকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে অন্না সাবলীল কন্ঠে বললো,
“হ্যা দিয়েছি, কি করবে? তার আগে আমাকে এটা বলো কে ওই মায়াবিনী যার জন্য তোমার মনে এতো আবেগ?”
অন্নার প্রশ্নে বেশ চমকালেও ভড়কালো না অর্জুন। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিনিট দুয়েক। মেয়েটার শ্যামমুখখানা কেমন লালচে লাগছে, চোখজোড়ায় এক অদ্ভুত অস্থিরতা। সে উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে অধীর আগ্রহে। অর্জুন এবার ঠোঁট বাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসি হাসলো। যার অর্থ অন্না বুঝলো না। সে তার হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“তোকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে বুঝি? কে তুই? আমার উপর কিসের এতো অধিকার?”
প্রশ্নটা শুনেই হকচকিয়ে উঠলো অন্না। ভুল তো কিছু বলে নি অর্জুন, কে সে! সামান্য ভাড়াটিয়া, যার সাথে কথা বলতেও অনিচ্ছুক অর্জুন। আর ছাত্রী, সেই ট্যাগটা থাকা বা না থাকা একই কথা। অর্জুনের কাছে অন্না কেবল ই একটি অসহনীয় যন্ত্রণা যার থেকে পালাতে পারলে তার রক্ষা। একটা ধি’ঙ্গি, চঞ্চল, মহাবিরক্তিকর, অভ’দ্র, অকালকুষ্মাণ্ড এই উক্তিগুলোই সে ব্যাবহার করে অন্নার ক্ষেত্রে। সেখানে তাকে প্রশ্ন করাটা নেহাৎ বোকামি বই কিছু নয়। অন্না বুঝলো সে সীমা লঙ্ঘন করছে। তাই মলিন কন্ঠে বললো,
“ছাড়ো, ভালো লাগছে না। বাড়ি যাবো”
“কি হলো উত্তরটা দে! ফটফট অন্নার কথা ফুরিয়ে গেছে?”
“যে উত্তর আমার কাছে নেই সেই প্রশ্ন নিয়ে আমার সময় নষ্ট করি না”
কথাখানা বলেই দোকানের অন্যদিক চলে গেলো অন্না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, যে রাগ পরিমাপ করা যায় না। আচ্ছা, রাগ পরিমাপক যন্ত্র থাকলে ভালো হতো। তাহলে সূক্ষ্ণ পরিমাপ করে বলা যেতো কতটুকু রাগ হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য স্থানে, এটা বড় কথা নয় যে অন্নার রাগ হচ্ছে বরং মুল প্রশ্নটি হলো রাগটি হচ্ছে কার উপর! নিজের উপর নাকি অর্জুনের উপর। যার উপর ই হোক, এখন সে নিয়ে ভাবতেই চায় না অন্না। বুকের ভেতরের সূক্ষ্ণ ব্যাথাটা একটু একটু করে ছড়াচ্ছে, অসহনীয় চিনচিনে ব্যাথা____
মধ্যাহ্নের শেষ লগ্ন, পুজোর সকল কেনাকাটার কাজ শেষ করেছে অন্না এবং অর্জুন। পেটে যেতো ইঁদুরেরা রীতিমতো দৌড় প্রতিযোগিতা করছে তাদের। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলো সকালের পর থেকে এই নির্বাক পেটে একটি দানাও।দেওয়া হয় নি। অর্জুন তাই ব্যাগগুলো অন্নার হাত থেকে নিতে নিতে বললো,
“কি খাবি?”
“খাবো কেন? বাড়ি যাবো না? বাড়ি যেয়েই খাবো।”
অন্নার কন্ঠে অভিমানের সূক্ষ্ণ প্রলেপ৷ অর্জুন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অন্নার দিকে। তার শ্যামমুখে ক্ষুধার ছাপ স্পষ্ট। তবুও তার মুখে এক বুলি “বাড়ি যাবো”। অর্জুন হুট করে তার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
“কখন থেকে এই বাড়ি যাবার গান কানের কাছে গেয়ে যাচ্চিস! আর একবার শুনেছি তো দেখবি কি করি! খেতে বলেছি মানে খেতে যাবি। নাকি আমার সাথে খেতে গেলে তোর মান সম্মান যাবে?”
অর্জুনের কথায় ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো অন্না। একটু ভালো করে কথা বললে যেনো তার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। অন্না যে তার চক্ষুশূল ব্যাপারখানা প্রতিটি পদে পদে যেনো প্রকাশ করতেই হবে। বললেই হয় “আমার ক্ষুধা লেগেছে, খেতে যাবো”। নাহ! বাঁকা বাঁকা কথা বলে মেজাজ খারাপ করাবে। অন্না চোখ মুখ খিঁচে ফেললো, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“ভালোভাবে কথা বলতে কি তোমার কষ্ট হয় অর্জুনদা? কাকীমা বুঝি জন্মের সময় তোমাকে মধু খাওয়াই নি, তাই তো এতো তেতো তুমি”
“আহা রে আমার মিষ্টভাষী! তোকে তো কাকীমা মধুতে স্নান করিয়েছিলো! মুখে আঙ্গুল দে, মাথাটা একেবারে ধরিয়ে দিলো কথা বলতে বলতে। আর একটা কথা না। মুখে আঙ্গুল দিয়ে হাটবি এখন”
অন্না হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারলো না, বেশি কথা কি সে বলছে নাকি এই খ’চ্চ’র লোকটি তাকে দিয়ে বলাচ্ছে! অন্না ঠিক করলো সে আর কথা বলবে না। মুখে এবার সত্যি ই তালা লাগাবে। লোকটির ত্যাড়া কথা গা জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট, প্রতিটি লোমকোষে বিরক্তি ঝরে, তবুও সে অর্জুনদার কথার উত্তর দিবে না। অন্নার মুখখানা দেখার মতো লাগছে, সে রাগে ঈষৎ কাঁপছে, মুখখানা রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু মুখে কথা নেই, শুধু চোখ দিয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্জুনকে পু’ড়ি’য়ে দেবার বৃথা চেষ্টা চলছে। অন্নার এমন মুখখানা বেশ প্রশান্তি দিলো অর্জুনকে। এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। দৈত্যের মতো হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। তাহলে তার তেজী মুখখানা মিলিয়ে যাবে। তখন আর মেয়েটি তাকে দাম দিবে না। অর্জুন ব্যাগগুলো নিয়ে হাটা শুরু করলো। অন্না কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অন্নাকে পাশে না পেয়ে অর্জুন পেছনে তাকিয়ে বললো,
“ম্যাডামকে কি মাথায় নিয়ে হাটতে হবে?”
অন্না গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বিনাবাক্যেই পিছু নিলো অর্জুনদার।
একটা মোটামোটি খাবারের দোকানে খাবার খেলো অর্জুন এবং অন্না। খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার পালা। বড় রাস্তা পার হয়ে রিক্সায় উঠতে হবে। অর্জুন যথারীতি রাস্তা পার হয়ে গেলো। কিন্তু পাশে তাকাতেই দেখলো অন্না নেই। অন্নাকে না দেখেই মূহুর্তেই বুকটা অস্থির হয়ে উঠলো। উগ্রীব চোখজোড়া দেরি না করেই খুঁজতে লাগলো তাকে৷ তখন ই দেখতে পেলো ব্যাস্ত রাস্তার ওপারে অন্না বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এক পা এগোচ্ছে, আবার পিছিয়ে আগের স্থানে চলে যাচ্ছে। মেয়েটির কাছ মিনিট দুয়েক পর্যবেক্ষণ করলো অর্জুন। মেয়েটি এই দুই মিনিটে প্রায় বার দশেক একই কাজ করছে। অর্জুন না পেরে ছুটে গেলো অন্নার কাছে। অন্নার কাছে যেয়ে অবাক কন্ঠে শুধালো,
“বে’কু’বের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? একবার এগোচ্ছিস, আবার জায়গায় যাচ্ছিস। সমস্যা কি?”
“আমি রাস্তা পার হতে পারি না”
অন্নার অসহায় স্বীকারোক্তিতে ঠিক কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না অর্জুন। অন্না অসহায় মুখখানা দেখে বকতে ইচ্ছে হলো না। ফলে তার কোমল হাতখানা গলিয়ে নিলো নিজের হাতের ফাঁকে। বিনা বাক্যে হাত ধরেই রাস্তা পার করলো অর্জুন। রুক্ষ্ণ, উষ্ণ হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো অন্না। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণের স্রোত। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হলো। ঢেউ খেলে গেলো কিশোরী অন্নার নিষ্পাপ হৃদয়ে। গোল গোল চোখে দেখছে সে অর্জুনদার দিকে। লোকটি তার সামনে হাটছে। বৃহৎ কায়া তাকে ঢেকে রেখেছে সূর্যের তেজহীন রশ্নি থেকে। অন্নার অবুঝ মনটা হুট করেই যেনো বুনতে লাগলো নিষিদ্ধ কিছু অভিলাষ। সেই অভিলাষের বীজ এখনো ভেজা মাটিতে রোপিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। অজান্তেই রংধনুর সাত রঙ্গে রঙ্গিন হলো মনের একলা আকাশ। রাগ, অভিমানগুলো গলতে লাগলো, বৃষ্টিরুপে বর্ষিত হলো মনমন্দিরের ভেজা মাটিতে। রাস্তা পার হয়ে যখন রিক্সায় উঠলো তারা তখন ও অন্নার হাত অর্জুনের হাতের ফাঁকে। অন্না ধীর কন্ঠে বললো,
“হাত ছাড়বে না?”
সাথে সাথেই হাতটা ছেড়ে দিলো অর্জুন। বেশ বিব্রতবোধ ও করলো সে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। অন্নাও বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিলো। তার ঠোঁটে এখনো স্নিগ্ধ হাসি লেপ্টে রয়েছে। ঠিক তখন ই অর্জুন বললো,
“আমি কবিতাটা হেমনলিনীকে লিখেছি”
হঠাৎ এমন কথায় অন্না বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“কোন হেমনলিনী?”
“আমার শ্বশুরের স্ত্রীর ভাইয়ের পিসতোতো বোনের বোনঝি”
অর্জুন দায়ের কথায় আরোও একবার ধাক্কা খেলো অন্না। অর্জুন তার বিমূঢ় মুখখানা দেখে বললো,
“আ’হা’ম্ম’ক, উপন্যাসের নায়িকা হেমনলিনী”
কথাখানা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লো অন্না। মুখ বাকিয়ে বললো,
“আমার মাথায় কি সত্যি আ’হা’ম্ম’ক লেখা? মশকরা করছো? তুমি উপন্যাসের নায়িকার জন্য কবিতা লিখেছো এটা বিশ্বাস করতে হবে?”
“কেনো? উপন্যাসের নায়িকার জন্য কবিতা লেখা কি অন্যায়?”
“কাল্পনিক চরিত্র সে, তার জন্য কেউ কবিতা লেখে?”
“কবি যদি কাল্পনিক চরিত্রের জন্য উপন্যাস লিখতে পারে, আমি কবিতা লিখতে পারবো না কেনো? আমিও চাই আমার জীবনে হেমনলিনীর মতো কেউ আসুক, যে আমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারে, যে আমাকে আমার থেকেও ভালো বুঝবে। যে শত বাধা অতিক্রম করেও আমার জন্য অপেক্ষা করবে! আমি চাই আমার জীবনে সে আসুক। আমার হেমনলিনী, আমার একলা আকাশের সেই ধ্রুবতারা যাকে আমি পুজি, আমি ভালোবাসি। আমার মনের একলা আকাশ জুড়ে শুধু তার ই বিস্তার, তাই তাকে নিয়ে হাজারো কবিতা লিখিতে পারি আমি”
অর্জুনের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে অন্না। এই মুগ্ধতার মাঝে চাপা বেদনাও রয়েছে। বেদনাটির নাম হয়তো আক্ষেপ। আক্ষেপ কেনো সে হেমনলিনী হয়_________
******
দেখতে দেখতে সপ্তমী চলে এসেছে। হিমুলেনের পুজো এবার ধুমধাম করেই পালিত হচ্ছে। পাড়ার সনাতন যুবসমাজ ধুতি পাঞ্জাবীতে নিজেদের সাজিয়েছে। তবে সকলের চোখ শুধু অর্জুনের দিকে। সাদা পাঞ্জাবীতে ছেলেটিকে রাজপুত্রের ন্যায় লাগছে। মাঝে রবিন ভাই, সামির ভাই এসেছিলেন। রবিন ভাই ইশারা করে বললো,
“কি ভায়া কেমন চলছে?”
“তুমি আমায় শান্তি দিবে না, তাই না রবিন ভাই?”
“শান্তি তোমার তানি আপু কেড়ে নিয়েছে। এখন আছে শুধু বেদনা”
বলেই হো হো করে হাসলো রবিন ভাই। তখন ই হাজির হলো অন্না। মেয়েটি আজ শাড়ি পড়েছে, সবুজ রঙ্গের সুতি শাড়ি। কোকড়ানো চুল গুলো বেধেছে খোপা। চোখে কালো কাজল। দূর থেকে মনে হলো যেনো রবীঠাকুরের চারুলতা হেটে আসছে। পাড়ার সকল যুবকের মুখে কথা নেই। গাছে উঠা, ছুটে বেড়ানো অন্নাকে শাড়িতে দেখে যেনো তারা অবাক। এ কি একই অন্না! নাহ, মেয়েটি সত্যি সুন্দর। শুধু শুধু অর্জুন তার দেবদাস নয়। রবিন ভাই অর্জুনের পেটে গুতো দিয়ে বললো,
“আসলেই তোমার পছ
অন্না প্রসাদ নিয়ে বের হতেই দিপ্তী এবং লাবণ্য ধরে বসলো। মীরজাফরের অর্ধেক দলের বেশ আগ্রহ অন্নার প্রতি। অন্না বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
” কি চাই?”
“তুই তো বললি না কিছু। ওই যে সেদিন অর্জুনদার সাথে সেদিন ঘুরতে গেলি কি হলো?”
“বলেছিলাম তো!”
“ধুর, পুরোটা বলিস নি তো!”
এবার বিরক্তি যেন বাড়লো অন্নার। চোখ মুখ কুচকে বললো,
“কি শুনতে চাস? যে অর্জুনদা আমার হাত ধরে হেটেছে?”
অন্নার কথাটা শেষ হবার পূর্বেই অর্জুনের মোটা পুরুষালী কন্ঠে কানে এলো,
“এই অন্না, শুনে যা”
পেছনে ফিরতেই দেখলো শক্ত মুখে অর্জুনদা দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি সব শুনে ফেললো সে!……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি