বিষ_করেছি_পান সূচনা পর্ব

0
1862

#বিষ_করেছি_পান

সূচনা পর্ব __________

(কপি করা নিষেধ)
রাত একটা বারো। আকাশে কালো মেঘ জমেছে। উত্তর থেকে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্বাভাস। যেকোন মূহুর্তে বৃষ্টি শুরু হবে। সোফার পাশে ফকফকে সাদা টাইলসের উপর হাটু ভাঁজ করে বসে আছেন রুম্পা আহমেদ। তার চোখে মুখে অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। একবার জানালার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার সিঁড়ির দিকে। আরেকবার স্বামীর দিকে । এক মিনিট , পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট চলে গেলো আর নিশ্চুপ থাকা সম্ভব না। সোফার কোনা ধরে উঠে দাঁড়ায়।
— মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে । আকাশে ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেয়েটা যে ছাদে দরজা বন্ধ করে আছে তোমার দেখি কোন হেলদোল নাই।
ছানোয়ার আহমেদ রুম্পা আহমেদের দিক আড় চোখে তাকালো । পরক্ষনেই টেলিভিশনের দিকে চোখ ফেরিয়ে নিলো । স্কিনে ন্যাশনাল জিওগ্ৰাফি চ্যানেল চলছে। দুটো লায়নকে দেখানো হচ্ছে । একটা বাচ্চা লায়ন আরেকটা মা লায়ন । মা লায়নের উপরে উঠে বাচ্চা লায়ন ক্রমাগত লাফাচ্ছে। এতেই বোধ হয় সে মজা পাচ্ছে।
— কি বলি কানে যায়না?মেয়েটাকে নামতে বলবাতো? আমার ডাকে তো সাড়া দিচ্ছে না।’ আহত গলায় শুধায় রুম্পা আহমেদ। ছানোয়ার আহমেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কর্কশ গলায় বলে,
— মারার সময় বুঝতে পারো নাই? এখন এতো দরদ কই থেকে আসছে?
— তো শাসন করবোনা?
— ঘ্যান ঘ্যান করবানা। যাও এখান থেকে। টিভি দেখতে দাও।
রুম্পা আহমেদ প্রত্যাখ্যান হয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটলো ছাদে। দরজা ধাক্কিয়ে কয়েকবার ডাকলো ছুটিকে।
— ও ছুটি!দরজা খুল মা। ঝড় আসতাছে। জিদ করিসনা আর। দরজা খুল। তোরে আর মারবোনা। হাজার বার ফেল করবি কিচ্ছু বলবোনা। দরজা খুল মা।
রুম্পা আহাজারি করতে লাগলো। যদিও তার প্রত্যেকটা কথাই মিথ্যা তিনি ভালো ভাবেই জানেন। এখন যতই মাথা নুয়াক সময়মতো সিংহী আচরন তিনি ঠিকই দেখাবেন।

সাড়া না পেয়ে ছুটলেন রিতীর ঘরে। অন্ধকারে হাতিয়ে লাইট জ্বালালেন। বিছানায় শুয়ে আছে রিতী। তার বুকেই আঁটোসাঁটো হয়ে শুয়ে তমাল। রাতের খাবারের পর যখন ছুটিকে স্কেল দিয়ে পেটাচ্ছিলেন তখন হাউমাউ করে কাঁদছিল তমাল। ভয়ে বাবার পেছনে লুকিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতেই রিতীর রুমে এসে শুয়ে পরেছে। রুম্পার কাছে যাবেনা সে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ঘুমানোর সময় বার বার হিক তুলতে তুলতে রিতীকে বলছে,
— মা রাক্ষসী। মা মারে।
রুম্পা নিচু স্বরে রিতীকে ডাকে।
– এই রিতী উঠ। উঠনা।
– মা!কি হয়েছে?
– ছুটি নামেনি ছাদ থেকে।
রিতী চট করে উঠে বসে । কাঁচের জানালা ভেদ করে বিদ্যুত চমকানো দেখে ভয়ার্ত মুখে রুম্পার দিকে তাকায়। খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটে ছাদের দিকে। পেছন পেছন রুম্পাও ছুটে। অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে চলছে রিতী। চিৎকার করে ডাকছে। কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুম্পা এবং রিতী। দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে কোথাও যেনো বাজ পরে। বাজের শব্দে বিল্ডিং ও কেঁপে উঠে। সাথে সাথে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কানে হাত চেপে ধরে রুম্পা ছুটি__ বলে বিভৎস এক চিৎকার দেয় ।

ছানোয়ার আহমেদ উঠে দাঁড়িয়েছে। তার কলিজায় যেনো কেউ আচর কেটে দিয়েছে। ছোট মেয়ের উপর অত্যন্ত রাগে জেদে দুর্যোগ অবস্থা দেখেও বসে ছিলো। গণিতের টিচারের মেয়ে হয়ে যদি গণিত সাবজেক্টে একশতে বিশ পেয়ে ফেল করতে পারে তাহলে তারও এতোক্ষণ বসে থাকা ঠিক কাজ হয়েছে। কিন্তু তার এই ঠিক কাজটি এখন বেঠিক মনে হচ্ছে। কারন সে বাবা। আর তার মেয়ে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ছাদে বন্দী আছে।

ছানোয়ার যখন ছাদের দরজায় পৌঁছলেন তখন বিদ্যুত চলে এসেছে। শহরের বিদ্যুত ব্যবস্থার এই একটি সুবিধা। ঝড়ের মাঝেও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে তুফান। দুর্বল চিত্ত রিতী মায়ের গলা ধরে কাঁদতে শুরু করেছে। ছানোয়ার নিজেও চেষ্টা করলেন। শক্ত স্ট্রীলের দরজা ভাঙা সম্ভব না। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
— ও রিতীর বাবা, মেয়েটা আমার ঠিক আছে তো? বাজ পড়লো যে। বাজে মেয়েটা ভয় পায় যে!
ছানোয়ারের মুখে আধার নেমে এসেছে। ছাতা ছাড়াই সদর দরজা খুলেই চললো বাইরে। দুতলার ছাদের চারপাশে খুঁজলো কোথাও ছুটির দেখা নেই। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।
— রুম্পা ছুটি ছাদে আছে তো ? আশেপাশে কোনো বাড়িতে যায়নিতো?
— কোথায় যাবে? ও তো ছাদে।
— তোমার মেয়ের কাছে ছাদ আর মাটি একই কথা। লম্ফঝম্প তো কম জানে না!আশে পাশের বাড়ি গুলোতে ফোন দাও কোথায় আছে?
— এতো রাতে মানুষ কি ভাববে?
— আগে আমার মেয়ে তারপর তোমার ভাবনা।

হাতে ফোন নিয়েই দরজায় কড়া নাড়লেন বীনা।ভেতর থেকে আওয়াজ এলো।
— কি হয়েছে?
— দরজা খোল বাঁধন।
ঢিলে ঢালা ট্রাউজার টা গোড়ালী অব্দি টেনে টি শার্ট গলা দিয়ে নামিয়ে দরজা খোললো বাঁধন। মায়ের দিকে তাকিয়ে হাই তুলে বললো,
— এতো রাতে কি হয়েছে মা।
— বাইরে ঝড় হচ্ছে রে বাঁধন।
— হুম। তুমি কি ভয় পাচ্ছো? বাবা কই?
— শোন রিতীর বাবা ফোন করেছিলো। ছুটিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কারো বাসায় যায়নি। ছাদে গিয়ে দরজা দিয়েছে। এতো ডাকাডাকির পরেও দরজা খুলছে না। তুই একটু যা না বাবা।
— এই বৃষ্টিতে?
— রিতীর বাবা একা মানুষ কি করবে?
বাঁধন আর কথা বাড়ালো না। ছাতা নিয়ে রিতীদের বাসার সামনে উপস্থিত হলো। এই বৃষ্টিতেও প্রতিবেশীরা ‌অনেকেই এসেছে। কি হলো? কি হলো? গুন গুন আওয়াজ উঠেছে। বাঁধন কে দেখেই ছানোয়ার প্রায় কেঁদে ই ফেললেন।
— একটু সাহায্য করোনা বাবা। মেয়েটা মনে হয় ছাদেই আছে।
বাঁধন শিপ্রু রতনকে নিয়ে বাইরে এলো। ঝুম বৃষ্টি। উপরে তাকাতে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই সাথে বাতাস। বাঁধন বললো,
— রতন, শিপ্রু তোরা পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়া। এদিক দিয়ে মনে হচ্ছে ছাদে কোনভাবে উঠা যাবে।
বাঁধনের কথা অনুযায়ী রতন এবং শিপ্রু তাই করলো। ওদের পিঠে পা রেখে বাঁধন বাউন্ডারির দেয়ালে উঠে গেলো। খুব কষ্টে যখন ছাদে উঠতে সক্ষম হলো তখন বৃষ্টির প্রকোপে চোখ খুলা দায়! এদিক ওদিক খুঁজে গোলাপ গাছের নিচে ছুটিকে পাওয়া গেলো। লাশের মতো পড়ে আছে। বাঁধন দ্রুত গিয়ে ছুটিকে কোলে তুলে নিলো। ঠান্ডা বরফ একটি দেহ। পালস চেক করলো। নিশ্বাস বেশ ধীরে ধীরে পড়ছে। বিলম্ব না করে অর্ধমৃত দেহটাকে কাঁধে তুলে নিলো।

চলবে,

~ লাবিবা_তানহা_এলিজা

ছবিয়াল: ফারজানা জামান তরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here