#বেলাদোনা (১৪)
ট্রাক ভর্তি চকলেট ডেলিভারি দিয়ে হেবা যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন। এতো সময় যাবত ধরে রাখা পেসেন্স ভেঙে বেলা বলল–
” তুমি একাই সব টা সামলালে মা? ”
” একা নয় তো ফ্লাওয়ার। আমাকে প্রথম থেকে জেসন আর সামারা সাহায্য করেছে। ওরা না থাকলে আমি পারতাম না এসব। ”
বেলার মুখ টা কালো হয়ে গেল। মেঘে ছেয়ে গেছে পুরো টা। হেবা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে চলে গেলেন। নিশ্চিন্তে ঘুম হবে আজ। হৃদয় টা ব্যকুলতা কাঁটিয়ে নিয়েছে।
এলিজা আর বেলা দুজনেই সোফা তে বসে। টিভি চলছে তবে কেউ দেখছে না। দুই বোনের মনোযোগ ই হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও। কিছু সময় পর বেলা অনুভব করে রাত্রী বেড়েছে। তাছাড়া হেবা এখন ঘুমে। এলিজা সন্ধ্যা থেকে কিছু খায় নি এখন অব্দি। এই মুহূর্তে না খাওয়ালে আর খাবে ও না। বাচ্চা টি বার বার ঝিমুনি দিচ্ছে। বেলা তাগাদা দিয়ে বলল–
” উঠো এলিজা। এখন ঘুমানোর সময় নয়। খাবার খেতে হবে তো। ”
” আমার ঘুম আসছে আপুই। ”
” আহা এলিজা, আসো আমার সাথে। ”
” আপুই। ”
” কোনো কথা নয় আসো। ”
কিচেন টা নোংরা হয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করেছে। দুদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। যদি ও বা বেলার ব্যস্ততা তেমন ছিলো না তবে হেবা খুব ব্যস্ত ছিলেন। আর এলিজা তো বাচ্চা মানুষ। সেই হিসেবে পরিষ্কার করার মানুষ নেই। বেলা আমেরিকার জাতীয় খাবার হ্যামবার্গার বানাচ্ছে। বার্গার এর ফ্রেস ব্রেড , কিমার কাটলেট, চিজ, পেয়াজ, টম্যাটো, সস রেডি করার পর দেখা গেল লেটুস নেই। এলিজা লেটুস ছাড়া বার্গার খায় না। অগত্যা বেলা কে গার্ডেনে যেতেই হবে। কিচেনের এক পাশে টুলে বসে বসে এলিজা ঝিমুচ্ছে। হেসে ফেললো বেলা। এলিজার মাথায় হাত রেখে বলল–
” এলিজা, প্রিয় বোন আমি গার্ডেনে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থেকো। ”
” আচ্ছা। ”
ঘুমে ঘুমে উত্তর করলো এলিজা। বেলা সব কিছু সাইট করে কিচেন থেকে বের হলো। দরজা খুলতেই হঠাৎ ই মনে হলো ওর পায়ের কাছ দিয়ে কিছু একটা ঘরে প্রবেশ করেছে। যাঁর শরীরের উপরের অংশ নরম আর শীতল। বেলা চটজলদি ঘুরে তাকালো লাইট না থাকায় স্পষ্ট নয় কিছু। নিশ্চিত হতে কয়েক পা এগিয়ে লাইট অন করলো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে কিছু পেল না। হয়তো ভ্রম ছিলো এটা। নিজ মাথায় টোকা মেরে বেলা লেটুস তুলতে বের হলো।
কয়েক দিন যাবত ইথান বেশ চিন্তিত। হাতে তাঁর লুসির প্রতিরূপের রোবট। সেটার ভেতর থেকে একটা মেমোরি বের করলো ইথান। এই ফুটেজ টা কতো বার দেখেছে হিসেবে নেই।সব টা ওর কাছে রহস্য লাগছে। ও নিজেই সব বিষয়ে কনফিউশড। সেই কারনে মেজাজ এখন প্রচন্ড তিক্ত। পাশে বসা লুসি কে ওর অসহ্য লাগছে। বিষয় টা আশ্চর্যজনক হলে ও ইহা সত্য। লুসি স্বীয় মালিকের মনোযোগ পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলে গেল। এবার যেন নিজ সত্তা ফিরে পেল ইথান। চট করেই ধরে নিলো লুসি কে। গাঁয়ে হাত বুলিয়ে বলল–
” স্যরি স্যরি লুসি। আমি আসলেই খুব দুঃখিত। ”
লুসি নির্বাক। কি সুন্দর মৌনতা দিয়ে নিজের অভিমান প্রকাশ করে। ইথান চুমু খেল বিড়াল টার গাঁয়ে। ওমনি গলে জল হলো লুসি। ম্যাও ম্যাও করে লজ্জা জানান দেয়। ইথান এবার গম্ভীর স্বরে বলল–
” তুমি কি মেয়ে লুসি যে লজ্জা পাও। এটা কিন্তু ঠিক না। আমায় চিন্তায় ফেলে দিলে। ”
লুসি ইথানের গাঁয়ে মিশে গেল। বিড়াল টার গাঁয়ের উষ্ণতা মেখে নিলো ইথান। এক মাত্র প্রকৃত বন্ধু এই বিড়াল ছানা। গত দেড় বছর যাবত ওর এক মাত্র প্রিয় সঙ্গী। নিঃসঙ্গ জীবন টাকে পরিপূর্ণ করা ছাড়া ও ওর সমস্ত কাজের স্বাক্ষী।
ফুল বেলার খুব পছন্দের মধ্যে পরে। সেই কারনেই দিগন্ত বিস্তৃত ফুলের বাগান করা হয়েছে। খুব ছোট সময়ে বেলা এখানে সময় কাটাতো। এলিজা হওয়ার পর থেকে খুব একটা আশা যাওয়া নেই। হেবা অধিক ব্যস্ত থাকায় বাগান টা নোংরা হয়ে আছে। সেই সুবাদেই বেলা আজ বাগানে এসেছে। এখান থেকে বাড়ি টা পুরনো কুঠুরি মনে হয়। তবে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। কাঠের দোতলা হলে ও খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করা। জীবনের বেশ অনেক গুলো বছর এখানে কাঁটিয়েছে বেলা। এর আগে অবশ্য ভাড়া বাড়ি তে থাকতো ওরা। তবে এই বাড়ি টা আগে থেকেই ওদের ছিলো। পারিবারিক সূত্রে হেবা পেয়েছেন। মেরামতে চলে যায় দীর্ঘ বছর।
মাটি খুড়ছিলো বেলা। তখনি লুসি এলো। বেলার স্কাফ টা টানতে লাগলো। বেলা আকস্মিক আতঙ্কিত হয়ে লুসি কে কোলে তুলে নিলো। চারপাশে নজর বুলিয়ে সাবধানে শুধালো–
” লুসি ক্যাট তুমি এখানে কি করে! তোমার স্বীয় কর্তা কোথায়? ”
” এখানে বেলা। ”
ফট করেই পেছনে তাকালো বেলা। ইথান গাছের ডালে বসে আছে। সেখান থেকে চোখ নামিয়ে সর্তক করলো।
” মা দেখলে সর্বনাশ ঘটে যাবে। আপনি দ্রুত নেমে চলে যান। ”
” কিচ্ছু হবে না। তোমার মা ই আমাকে ডেকেছেন। ”
” মা! এটা কি সত্যি? ”
” বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করো। ”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ালো বেলা। ঝপ ঝপ করে গাছের ডাল থেকে নেমে এলো ইথান। বেলা খুব একটা চমকায়িত নয়। লুসি ম্যাও ম্যাও করে নিজ মালিকের বীরত্ব জানান দিচ্ছে। এমন বিরল মনের প্রানী বেলা এর আগে কখনোই দেখে নি। একদম ই মালিকভক্ত।
হেবার আয়োজন দেখে বেলা নিশ্চিত হলো যে ইথান মিথ্যে বলে নি। তবে এতো দ্রুত এদের মেলবন্ধন দেখে বেলা একটু অবাক ই হলো। তবে চিন্তা করার জন্য বিশেষ কারন পেল না। হেবা আর ইথানের আলোচনা থেকে যা বোঝা গেল এতে করে বেলার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস নেমে এলো। এরা দুজনে ব্যবসায়িক আলোচনা করছে। ইথান খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে হেবা কে ম্যানেজ করে নিলো। অবশেষে ঠিক হলো নেক্সট বেকারি টা এখান থেকে দুটো বাড়ি পর খালি জায়গায় গড়ে তোলা হবে। যা ইথানের নামে করা।
” কাছে এসো ফ্লাওয়ার। ”
সামনে এগোলো বেলা। হেবা মেয়ের হাত ধরে বললেন–
” আমরা নতুন বেকারি লঞ্চ করতে চলেছি। খুব দ্রুত এর সফলতা ছড়িয়ে পরবে আশা করি। ”
” শুভ কামনা মা। ”
” ধন্যবাদ ফ্লাওয়ার। এখন চট জলদি কিছু বানিয়ে নিয়ে এসো তো। ”
বেলা চলে গেল। আশে পাশে কেউ নেই। ইথান পা দুটো টেবিলের উপর তুলে দিয়ে আরাম করে বসলো। হেবা দাঁতে দাঁত চেপে সব টা সহ্য করছেন এতোক্ষণ। মুখের ভঙ্গিমা প্রচার করে অগ্নিগর্ভ। বিগলতি হাসলো ইথান। পরক্ষণেই ফিস ফিস করে বলল
” সময় কখনো এক দিকে চলে না। আমি কিন্তু সব টা ধরে ফেলেছি মিসেস হালদার। ”
” আগে থেকেই সাবধান করছি তোমায়। বদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে ফেঁসে যাচ্ছো মনে হচ্ছে। তোমাকে আমার ভালো লাগছে না। আমার বেলার থেকে দূরে থাকো ছেলে। ”
” সে তো একটু ফেঁসে যেতে হবেই। তবে এবার খেলা বদলে গেছে। আপনার স্টোর রুমে কিসের সুড়ঙ্গ! ”
হেবা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ললাটে তাঁর চিন্তার খাদ। খুব বেশি সময় লাগলো না বেলার। চট জলদি গরম গরম স্যুপ নিয়ে হাজির হলো। স্যুপের বাটি হাতে তুলে প্রশংসা করলো ইথান।
মারিয়া এই প্রথম বিশ্বাস ভেঙেছে। ইচ্ছাকৃত করেছে এমন নয়। বাধ্য হয়েই করেছে এমন টা। হেবা খুব নরম ভঙ্গিমা তেই বলল–
” কাজ টা তুমি ঠিক করলে না মারিয়া। এতো দিনের বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিলে কয়েক সেকেন্ডে।”
” আমায় ক্ষমা করো হেবা। আমি নিরুপায় ছিলাম। ”
” বড্ড বোকামি করেছো মারিয়া। এমন নয় যে এতে তুমি ছাড় পেয়ে যাবে। চরম মূল্য চুকাতে হবে তোমায়। তুমি ভাবতে ও পারছো না কি হতে চলেছে। তুমি কি বুঝতে পারছো বেলার সাথে সাথে নিজের ও ক্ষতি করে দিলে। ঐ ছেলেটা নিশ্চয় আততায়ী। ”
” আমি দুঃখিত হেবা। সত্যিই আমি বুঝতে পারি নি। তবে আমার কি করার ছিলো। ”
হেবা নিশ্চুপ। টেবিলে মাথা চেপে বসে রইলেন কিছু মুহূর্ত। অনিশ্চয়তা গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে গড়ে তোলা দীর্ঘ দেয়াল আজ ছোট হয়ে গেল। অতি সহজেই নাগাল পেয়ে যাবে এবার। বেলা কে বাঁচানোর জন্য তিনি সব টা করবেন। প্রয়োজনে অন্য পরিকল্পনা করবেন।
ভরা রাত্রি তে এলিজা কে নিয়ে বেরিয়েছে বেলা। হেবা এখনো বাড়ি ফিরে নি। রাত অনেকটা। ভয় ডর কে তুচ্ছ করে হেঁটে চলেছে দুই বোন। চিকন জঙ্গলের মাঝ থেকে সু সু আওয়াজ আসে। সে শব্দ কেমন লোমকূপ জাগিয়ে দেয়। এলিজা চেপে চেপে হাঁটছে। পথিমধ্য এলিজা বার কয়েক কেঁপে উঠলো। ঝোপ থেকে শব্দ হচ্ছে। কোনো প্রানী রয়েছে হয়তো। বেলা দ্রুত গতিতে হাঁটা লাগালো। বাসা থেকে বেকারির দূরত্ব প্রায় কিলোমিটার। আরো কিছু সময় হাঁটার পর বেকারি তে পৌছে গেল।তালাবদ্ধ! এলিজা শীতের প্রকোপে কাঁপছে। হুটহাট আবহাওয়া পরিবর্তন বড্ড ভোগায়। বেলা মারিয়ার বাড়ির পথে এলো। মারিয়া বেলা কে দেখে ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়ে বললেন–
” এই সময়ে তুমি এখানে? ”
” মা বাড়ি ফিরে নি মারিয়া আন্টি। ”
” সেকি, অনেক আগেই তো ফিরে গেছে হেবা। ”
” কোথায় গেল তাহলে? ”
মারিয়া আশ্বস্ত করে বসতে বললেন ওদের। ভেতর ঘর থেকে রুগ্ন শরীরে বেরিয়ে এলো ক্যাথি। বেলা কে দেখেই ছুট লাগালো। বেলা মারিয়া কে উদ্দেশ্যে করে বলল–
” ক্যাথি চলে গেল কেন? ”
” এমনি হয়তো। তুমি বসো আমি হেবার খোঁজ নিয়ে দেখছি। ”
মারিয়া বের হয়ে গেলেন। বেলা একবার ভাবলো ক্যাথির কাছে যাবে। তবে কি মনে করে যেন আর গেল না। প্রায় ঘন্টা খানেক পর ফিরে এলেন মারিয়া। এলিজা তখন ঘুমোচ্ছে। বেলা ও পাশে বসেই ঝিমুচ্ছে। দ্বার খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল। বেলা দাঁড়িয়ে পরলো। মারিয়া ভাঙা গলায় বললেন
” হেবা হসপিটালে ভর্তি বেলা। খুব ই অসুস্থ সে। জানি না কি থেকে কি হয়ে গেল। ”
চলবে