মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩৪
সাবিবা তখন থেকে ছটফট করছে।
অনেকক্ষণ হয়েছে মেঘলার জ্ঞান ফিরার কোনো নামই নেই।
চোখে মুখে বার কয়েক পানির ছিটা দিলো।হাতে পায়ে মালিশ করছে।
কিন্তু তাও তার জ্ঞান ফিরেছে না।
মাথায় অনবরত পানি ডেলেই চলেছে সাবিবা।
বেশ অনেকক্ষণ পর মেঘলা পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো।তার মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে।কিছুক্ষণ সময় লাগলো কোথায় আছে বুঝতে।কিন্তু সেতো দুপুরে গোসল করে বের হয়ে বারান্দায় কাপড় নাড়ছিল।তখনই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছিল।তারপর…তারপর আর কিছু মনে করতে পারছে না।আর বিছানাই বা কখন এলো।মেঘলা মাথা উঠানোর চেষ্টা করতেই বুঝলো ওর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে।কিন্তু কেনো??তবে কি সেন্সলেস হয়ে গেছিলাম??আপু আমাকে এইখানে এনেছে??
মেঘলা নড়ে উঠতেই সাবিবা তড়িৎ গতিতে মেঘলার সামনে এসে বসলো।চট করে মেঘলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রায় আর্তনাত করে উঠলো।
কি হয়েছে তোর???
মেঘলা আবার পিটপিট করে তাকালো।আপুর চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠেছে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে।
কিরে কি দেখছিস??কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল।
আপু…
হ্যাঁ,বল….
আমার কি হয়েছে??
সেটা তো তুই আমাকে বলবি।কি হয়েছিল তোর??অজ্ঞান হয়ে গেলি কিভাবে??
জানি না আপু।হঠাৎই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো।খুব দূর্বল লাগছিল।আস্তে আস্তে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসছিল।তারপর….আর কিছু মনে নেই।
সাবিবা আরও শক্ত মেঘলার হাত চেপে ধরে বলল,কিচ্ছু হয়নি।ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস না তারই ফল।তুই বস আমি তোর চুলটা মুছে দেই।
সাবিবা যেই উঠতে যাবে তখনই মেঘলা আবার হাতটা আকড়ে ধরে বললো,
আপু আমার কিছু বলার আছে।
সাবিবা হাসলো।আমি জানি।আমারও তোকে কিছু বলার আছে।কিন্তু তার আগে তোর চুলটা মুছে দিতে হবে,টাওয়েলটা নিয়ে আসি।
সাবিবা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফিরে এলো।
মেঘলার চুলগুলো মুছে দিতে দিতে বলল,
একটা কথা বলবি??
কি কথা আপু??
তোর…
আপু,আগে আমার কথাটা শুনো।
ঠিক আছে বল।বলে সাবিবা মেঘলার সামনে বসলো।
সাবিবা ভালো করে মেঘলার দিকে তাকালো।এতটা চেঞ্জ সারাশরীরে,মুখে কি করে??তিন মাস আগের ঘটনায় আঘাত পেয়ে কি এত পরিবর্তন???নাকি অন্যকিছু সে ঘটনার সম্পর্কিত???
কি ভাবছো আপু??
মেঘলার কথায় স্মিতি ফিরে এলো সাবিবার।সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,কিছু না।কি যেনো বলবি??
আপু আমি কিভাবে বলবো….
বল এতো অসস্তি পাসনা।আমাকে সব কিছু মন খুলে বলবি।
মেঘলা ক্ষানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললো,আপু সেদিনের…
সেদিনের ঘটনা তো জানি।সেটা নিয়ে এত ভেঙ্গে পড়ার কিছু হয়নি…
না আপু আমি ভেঙ্গে পড়ছি না।
তাহলে নিজের এই হাল হলো কি করে!!
আপু ঐদিনের পর থেকে আমার…
কি??
আমার…
বল…
আমার…রেগুলার…
পিরিয়ড হচ্ছে না।তাই তো??স্বাভাবিক শীতল কণ্ঠে বলল সাবিবা।
মেঘলা ক্ষানিকটা মাথা নিচু করে বললো,হুমম।
এতে তুই মাথা নিচু করছিস কেন???
জানি না আপু।
আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম তোকে দেখে।আর সেটাই হলো।
মেঘলা সাবিবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো।আপু আমি এইবার কি করবো?আপু কি হবে এখন??
তুই এমন করছিস কেনো??তুই তো কোনো পাপ করিসনি।যে আসছে সে তোর বৈধ সন্তান।তোর বরের আর তোর অংশ।
আপু সে কি কখনো মানবে আমার সন্তানটাকে??
না মানার তো কিছু নেই।কিন্তু..
মেঘলা চোখ তুলে তাকালো।কিন্তু কি আপু??
এই নরকে বাচ্চাটাকে কিভাবে রাখবো???আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেখানে একটা বাচ্চা!!আর অমানুষটা যখন জানতে পারবে তখনই বা কি করবে??
মেঘলা আতকে উঠে,আপু আমার সন্তানকে যদি সে আসতেই না দেয় পৃথিবীতে?সাবিবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে হাপড়ের মত বুক উঠা নামা করছে।
সাবিবার চোখেও শঙ্কা ফুটে উঠল।সীমান্ত পারে না এমন কোনো কাজ নেই।সাবিবা যখন কন্সিভ করেছে শুনেছিল তখনকার সে বিভৎস দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো।শেষ পর্যন্ত সাবীবার সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখেনি।
আপুকে চুপ করে থাকতে দেখে মেঘলা আবার বললো,আপু আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি হলে আমি মরেই যাবো।
সাবিবা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,তুই ভাবিস না।আমি আছি তো।তোর বড় বোন এখনো বেচেঁ আছে।তোর বা তোর সন্তানের কিছু হবে না।আমি কথা দিচ্ছি।বলেই মেঘলার মাথাটা বুকে নিল।
মেঘলা পরম ভরসায় বোনের বুকে মাথা রাখলেও তার মনে ভয়েরা ডানা ঝাপটাচ্ছে।তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
নতুন নতুন সংসার।কি ভালোই না যাচ্ছে দিনগুলো।স্বামীর ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছে এক একটা দিন।
সে ভালো দিনগুলোকে আরও আনন্দে ভরে ওঠে যখন সাবিবা বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে।আর সীমান্ত বাবা।
সে কি আনন্দ হচ্ছিল।আয়নায় বারবার দেখছে আর পেটে হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইছে এই খানেই তাদের ভালোবাসার অংশ চুপটি করে বসে আছে।
এইসব ভাবতেই তার সমগ্র দেহ মনে ভালো লাগারা ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
সীমান্ত যখন জানবে সেও অনেক খুশি হবে।ভাবতেই আরও কিছু ভালো লাগা ছুঁয়ে দিলো।
জানার পর কি করবে ও??আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে পেটে মাথা ঠেকিয়ে নিজের অংশকে অনুভব করতে চাইবে??ভাবতেই লজ্জায় মিয়ে যাচ্ছিল।
নিজের পেটে হাত রেখে বলল,তোর বাবা কিন্তু আমাকেই বেশি ভালোবাসে বুঝলি।তোকেও ভালোবাসবে তবে আমার থেকে বেশি নয়। সাবিবা স্মিত হাসলো।আমি কি সেলফিশ মা নিজের সন্তানের সাথে হিংসা করছি!
দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাবিবা প্রচন্ড খুশি,সুখ,আনন্দ,আবেগ নিয়ে স্বামীর বুকের উষ্ণ আবেশে মাথা রেখে লজ্জা লজ্জা মুখ করে থাকে।
সীমান্ত বুঝতে পারে না এত নেকামি কি মানে?খানিক বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ না করে বলে,আমার বউটার লজ্জা বুঝি এখনো কাটেনি??আজ হটাৎ এত ঘটা করে লজ্জা পাচ্ছো।ঘটনা কি??
সাবিবা মুখ না তুলেই এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,আমি এখন যেটা বলবো না সেটা শুনলে তুমি এক্ষুনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে।
সীমান্ত ফোড়ন টেনে বলল,আমার আত্নহারা হওয়ার কোনো স্বাদ নেই।আমি আমার বউয়ের মধ্যেই আত্নহারা হয়ে থাকতে চাই।
সাবিবা হাসে।সমগ্র মুখে সে হাসি প্রসারিত হয়।
সীমান্ত এইবার ভালো করে লক্ষ্য করে বলল,আজ তোমাকে একটু বেশিই প্রস্ফুটিত লাগছে।
সাবিবা জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে একনাগাড়ে বলে ফেললো,তোমার আমার ভালোবাসার অংশ আসতে চলেছে।তুমি বাবা হবে।বলেই সীমান্তর বুকে মুখ লুকালো।
সীমান্তর কিছু সময় লাগলো বুঝতে।
তারপর কি হলো ওর সাবিবাকে এক ধাক্কায় বুক থেকে ফেলে দিল।
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো সাবিবার বুঝতে।কোনো রকমে সোজা হয়ে চোখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল সীমান্তর দিকে।
সীমান্ত ওর রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইছে।কোনো রকমে নিজেকে সামলে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলল,আমি বাচ্চাটা চাই না।
সাবিবার যেনো পৃথিবীটা থমকে গেল।কি বলবে বুঝতে পারছে না।গলায় কান্নারা এসে দলা পাকাচ্ছে।কিন্তু চোখ ফেটে অশ্রু আসছে না।
দুজনই নিশ্চুপ।
সীমান্ত নিজেকে সামলে নিয়ে সাবিবার দুই কাধে হাত রেখে আগের চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,আমি এক্ষুনি বাচ্চা চাই না।কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
সাবিবার দুচোখ গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দ অশ্রু।কি ভেবেছিল আর কি হলো।চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে ওর।কিন্তু পারছে না।
ঠিক দুদিন পর সীমান্ত এসে জানায় কাল সকালে আমার সাথে হসপিটালে যাবে।সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে,কালই বাচ্চাটা অবর্শন করানো হবে।
সাবিবার দুনিয়া কেপে উঠল।এত বড় পাপ সে করতে পারবে না।নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার মতো নিকৃষ্ট কাজ সে করবে না।কাঠ কাঠ গলায় বলল,আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনবো।আর আনবো মানে আনবই।
সীমান্ত সে কথার উত্তর দিল না।চুপ করে চলে গেল।
এরপর আরো কদিন কেটে যায় কিন্তু সীমান্ত আর এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।সাবিবা খুব খুশি হয়।ভেবে নেয় সীমান্ত সবটা মেনে নিয়েছে।হয়তো বুঝতে পেরেছে এক্ষুনি আর কদিন পর বেবী নেওয়া তো একই হলো।কিন্তু ওদের মধ্যে অনেকটাই দূরত্ব বেড়েছে।সেসব ঠিক করে নেওয়া যাবেক্ষণ।
সবই ঠিকই ছিল।কিন্তু হঠাৎই একদিন কি পেটে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হলো।কোনো কিছু বুঝার আগেই যেনো রক্তে চারপাশ ভিজে যাচ্ছিল আর তখনই সাবিবা জ্ঞান হারায়।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে।এবং জানতে পারে তার বাচ্চাটা আর নেই।
সেদিন খুব কেঁদেছিল।খুব কেঁদেছিল।সাবীবা জানে তার সন্তানকে খুন করেছে সীমান্ত।কিন্তু কিভাবে??হয়তো খাবার বা পানির সাথে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল।ওতো সব পারে সব।পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বাবা সে।
চলবে………….