# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব — ৪০
তনয়ার লাল বেনারসি অন্ধকারে হারিয়ে যেতেই পেছন ঘুরে দাঁড়াল শুভ্রব। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে তার। বুকটা অদ্ভুত এক শূন্যতায় ছেয়ে আছে। ভারি বুক নিয়ে এক পা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে আবারও ঝাপটে ধরল কেউ। শুভ্রবের নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে এল। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল,
—-” তনুজা!”
তনয়ার হাতের বাঁধন আরো শক্ত হল। শুভ্রব তনয়ার দিকে মুখ ফিরে তাকাতেই নিচে বসে খপ করে পা চেপে ধরল তনয়া। শুভ্রব আৎকে উঠল। তনয়া অবুঝের মত বলতে লাগল,
—-” আমাকে রেখে যেও না প্লিজ। যেও না আমাকে রেখে। বিশ্বাস করো, একটু বিশ্বাস করো, আমি সত্যি মরে যাব। তোমাকে ছাড়া অন্য একটা লোকের সাথে…..ছি! ছি! আমার ভাবতেও ঘেন্না লাগছে৷ প্লিজ… প্লিজ!”
শুভ্রব নিজেও হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। তনয়ার দু’গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
—-” তুমি বুঝো না আমায়? কেন বারবার ফিরে এসে দুর্বল করে দিচ্ছ আমায়? পাগলামো করে না তনুজা।”
তনুজা খপ করে শুভ্রবের কলার চেপে ধরল। জেদ ধরা গলায় বলল,
—-” আমি তোমাকে চাই। বুঝতে পারছ তুমি?”
এটুকু বলেই শুভ্রবের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ডুকরে উঠলো তনয়া। কান্নাভেজা গলায় বলল,
—-” আমাদের সাথেই এমনটা কেন হল বল তো? আমিই কেন পাবো না তোমায়? আমার ভালোবাসাতেই এতো খুঁত কেন? আমি তোমাকে চাই শুভ্রব। এই তুমিটাকে আমায় দিয়ে দাও না, প্লিজ।”
শুভ্রব মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিল। চোখ দুটো অশ্রুতে ভারি হয়ে আসছে তার। তনয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
—-” আমি তো তোমারই তনুজা। শুধুমাত্র হাতে হাতটা রাখাই হলো না। প্লিজ শান্ত হও। তোমাকে এভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছে আমার। বুঝো একটু… ”
তনয়া বড় বড় চোখ মেলে তাকায়। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—-” কেন ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলে বল তো? সবাই শুধু আমাকেই বাধ্য করে কেন? তুমি ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলে আর বাবা মরে যেতে। আচ্ছা? ওই মোড়ের দোকান থেকে একটা বিষের বোতল এনে দিতে পারবা?”
শুভ্রবের চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বুকটা ভেঙে-চুড়ে হাজারও টুকরোই বিভক্ত হল। বাড়ির পেছন দিকে কাউকে আসতে দেখেই অর্পন আর পুষ্পি তনয়াকে টেনে হিঁচড়ে পেছনের দরজার দিকে নিয়ে গেল। তনয়ার অশ্রু ভাসা চোখ চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘তোমাকে আমার চাই’, ‘তোমাকে আমার চাই, শুনতে পাচ্ছ?’। শুভ্রতা জারুল গাছের ছায়ায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তনয়ার ছায়াটা অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়াল শুভ্রব। নিজেকে সামলে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিল। শুভ্রবের থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে লাগল শুভ্রতা। কাঁচের চুড়ি আর নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রাতের নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পর, হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো শুভ্রব ৷ পেছন ঘুরে বলল,
—-” সমস্যা কি? পেছন পেছন আসছিস কেন?”
—-” তাহলে কি সামনে সামনে আসব?”
শুভ্রব বিরক্ত হয়ে বলল,
—-” সামনে পেছনে কোন জায়গা দিয়েই আসবি না। তোর প্রাণের বান্ধবীর বিয়ে হচ্ছে সেখানে যা। আমার পেছন পেছন আসবি না।”
শুভ্রতা কপাল কুঁচকে তাকাল। শাড়ির আঁচলটা ভাঁজ করে কাঁধে তুলে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,
—-” কেন? রাস্তাটা কি তোর শশুরের নাকি যে তোর পেছন পেছন আসা যাবে না। এই রাস্তা দিয়ে আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারি তাতে অন্যকারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই। নেভার।”
শুভ্রব কিছুক্ষণ লাল চোখে তাকিয়ে থেকে ধমকে উঠে বলল,
—-” বোকার মত কাঁদছিস কেন?”
—-” তুইও তো কাঁদছিস।”
শুভ্রব জবাব না দিয়ে আবারও হাঁটা দিল। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, সত্যিই সে কাঁদছিল! টানা একঘন্টা হাঁটার পর একটা রিকশা দাঁড় করাল শুভ্রব। রিকশায় ওঠে চুপচাপ বসে রইল। সাথে সাথেই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে দৌড়ে এসে রিকশায় উঠল শুভ্রতা। পাদু’টো ভীষণ ব্যাথা করছে তার। শুভ্রব ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটা নিকষ অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকারকে ফুঁড়ে দিয়ে কোথাও কোনো চাঁদ-তারার দেখা মিলছে না। আজ শুভ্রতা পাশে ছিল বলেই হয়ত অন্যায় কিছু করে নি শুভ্রব। শুভ্রতার নুপুরের শব্দ বারবারই মনে করিয়ে দিয়েছে, এই পৃথিবীতে শুভ্রবের আরো অনেক অনেক দায়িত্ব আছে। তার মধ্যবয়স্ক বাবা-মা আর যুবতী একটা বোন আছে। তার ভালোবাসার যন্ত্রণায় কাতর হওয়ার অধিকার নেই। পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে গেলেও মরার অধিকার নেই। অনেকগুলো জীবনকে ভালো রাখতে হবে তাকে। আগলে রাখতে হবে!
বাসায় ফিরে শুভ্রতাকে ঘরে যেতে বলেই রুমে দরজা দিল শুভ্রব। দুটো ঘুমের বড়ি গিলে নিয়ে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। আজকের রাত থেকে প্রতিটি দিন তনয়া অন্যকারো ঘরে থাকবে ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থেকে হঠাৎই মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠল শুভ্রব। অসহায় পাখির মত হাসফাস করতে লাগল সারাটা রাত।
_______________________
ঘড়ির কাটা আটটা ছুঁইছুঁই। মাত্রই অফিস শেষ করে বাসায় ফিরল সাদাফ। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়েই সোফায় গা এলিয়ে দিল সে। কাজের ব্যস্ততায় শুভ্রতার সাথে কথা বলারও সময় হয় নি আজ। সাদাফ ফোন বের করে শুভ্রতার নাম্বারে কল করতেই ওপাশ থেকে কোনোরকম ভূমিকা ছাড়ায় বলে উঠল শুভ্রতা,
—-” আমি তোমাকে দেখতে চাই।”
সাদাফ অবাক হয়ে বলল,
—-” মানে?”
শুভ্রতা অধৈর্য গলায় বলল,
—-” মানেটা বুঝতে পারছ না? আমি তোমাকে দেখতে চাইছি।”
শুভ্রতার কথা বলার ভঙ্গিতে বিস্মিত হল সাদাফ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
—-” ভিডিও কল দেব?”
—-” উহু। তুমি ধানমন্ডি আসো। আমি তোমাকে সামনে থেকে দেখব।”
সাদাফের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
—-” তুমি সিওর?”
শুভ্রতা কাট কাট গলায় জবাব দিল,
—-” হ্যাঁ।”
—-” আমার তোমার বাসার সামনে যেতে যেতে রাত দশটার মতো বাজবে। অতো রাতে বেরুবে তুমি? বাসায় সমস্যা হবে না?”
—-” হলে হলো। আমি তোমার সাথে দেখা করব ব্যস।”
সাদাফ বিস্ময় চেপে চুপ করে বসে রইল। ছোট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
—-” সকালে দেখা করলে হয় না?”
—-” না হয় না।”
—-” এনিথিং সিরিয়াস? তুমি ঠিক আছ? গলার স্বরটা কেমন যেন লাগছে।”
—-” সন্ধ্যা থেকে ননস্টপ কান্না কাটি করেছি বলে গলা বসে গিয়েছে। আহামরি সিরিয়াস কিছু না হলেও এই মুহূর্তে ভীষণ সিরিয়াস বলেই মনে হচ্ছে। তুমি কি আসছ?”
সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” কান্না করেছ কেন? আচ্ছা আসছি আমি। বাসার সামনে গিয়ে কল করব, নিচে এসো।”
—-” আচ্ছা।”
শুভ্রতার বাসা থেকে খানিকটা দূরে ল্যাম্পপোস্টের ঘোলটে আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সাদাফ। গায়ে সবুজ রঙের টি-শার্ট আর হোয়াইট জিন্স। চোখে-মুখে গাঢ় ক্লান্তির ছাপ। ডানহাতে রাখা জ্বলন্ত সিগারেটটা দু’ঠোঁটে চেপে ধরে শুভ্রতার নাম্বারে ডায়াল করল সাদাফ। দু’বারের মাথায় কলটা কেটে দিয়ে ম্যাসেজ পাঠাল শুভ্রতা, ‘ তুমি একটু অন্ধকারে দাঁড়াও। আমি আসছি।’ সাদাফ আশেপাশে তাকিয়ে অন্ধকার মত জায়গা দেখে দাঁড়াল। নিকষ অন্ধকারে সময়ে সময়ে জ্বলন্ত সিগারেটের উঠানামা হতে দেখা গেল। কিছুক্ষণের মাথায় গেইট পেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো শুভ্রতা। সাদাফের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” তুমি সিগারেট খাও?”
সাদাফ সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে হাসল। বলল,
—-” খাচ্ছি যেহেতু তারমানে খাই।”
শুভ্রতা সন্দেহী কন্ঠে বলল,
—-” আগে তো কখনও দেখি নি। আমায় লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে বুঝি?”
—-” একদমই না।”
—-” তাহলে এতোদিনেও দেখলাম না কেন আমি? ”
সাদাফ হেসে ফেলল,
—-” তুমি সামনে থাকা অবস্থায় সিগারেটের খেতে ইচ্ছে করে নি কখনও। আর আমি যখন সিগারেট খেয়েছি তখন তুমি সামনে আসো নি, তাই দেখো নি।”
শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল,
—-” আচ্ছা? হঠাৎ যদি শুনো যে, অন্যকারো সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার। আর তোমার হাতে করার মত কিচ্ছু নেই। তাহলে কি করবে?”
সাদাফ অবাক হয়ে বলল,
—-” হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন? বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?”
—-” আহা! উত্তরটা দাও না প্লিজ।”
সাদাফ হেসে বলল,
—-” তুমি তো কিছু করার অপশনই রাখলে না শুভ্রা। প্রথমেই বেরিগেড দিয়ে বললে, ‘আমার হাতে করার মত কিচ্ছু নেই’। আমার হাতে করার মত কিচ্ছু না থাকলে আর কি করতে পারি?”
শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
—-” বিয়েটা হয়ে যেতে দিবে? আটকাবে না?”
—-” আটকাব না এমন কিছু তো বলি নি। আমার উত্তরটা তোমার প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে ছিল। এর বাইরে কিছুই না।”
—-“তুমি এমন খাপছাড়া উত্তর কেন দিচ্ছ? আমার থাকা না থাকা তোমার কাছে কোনো ম্যাটারই করে না।”
কথাটা বলেই যাবার জন্য পা বাড়াল শুভ্রতা। সাদাফ তাড়াহুড়ো করে শুভ্রতার ডানহাতটা চেপে ধরে বলল,
—-” আরে! এটা রেগে যাওয়ার মত কি হলো? রাগ করছ কেন?”
শুভ্রতা কপট রাগ নিয়ে বলল,
—-” তুমি কি খুশিতে নাচার মতো কোনো উত্তর দিয়েছ, যে নাচানাচি করব?”
সাদাফ জবাব দিল না। পকেট থেকে এক গোছা বকুল মালা বের করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
—-” এগুলো আমার বউয়ের জন্য এনেছিলাম বুঝলে? বউ আমার এমনিতেই ভীষণ অভিমানীনি। তারওপর মালাগুলো কেমন চ্যাপ্টা লেগে গিয়েছে। এই চ্যাপ্টা লাগা মালাগুলো কি তার পছন্দ হবে?”
শুভ্রতা কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই হেসে ফেলল। হাত বাড়িয়ে মালাগুলো নিতে গেলেই তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল সাদাফ,
—-” উহুম। আগে বল আমার একমাত্র বউটাকে সন্ধ্যা থেকে কাঁদালে কেন? এতোবড় অন্যায় তো মার্জনীয় নয়।”
সাদাফের চোখ-মুখের গম্ভীরতা দেখে উচ্ছল হাসি হাসল শুভ্রতা। হঠাৎ করেই ভালোবাসা নামক অনুভূতিটাকে স্বর্গীয় বলে বোধ হতে লাগল। শুভ্রব আর তনয়ার বিচ্ছেদের কষ্টটা সাদাফের ছোট-খাটো ভালোবাসাময় কথার নিচে চাপা পড়তে লাগল একের পর এক!
___________________
শরৎ এর মিষ্টি রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে এয়ারপোর্ট চত্বরে। সূর্যের উত্তাপের সাথে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে ব্যস্ততম শহর। আনিমুল সাহেব এয়ারপোর্টের বাইরে হলুদ রঙা গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে হজ্জের সাদা পোশাক। চোখ-মুখ থমথমে। শুভ্রব ভারি ভারি ব্যাগগুলো গাড়ির ডিঁকিতে উঠাচ্ছে। আনিমুল সাহেব উদাস চোখে চারপাশটা দেখছেন। চারপাশে মানুষের ব্যস্ততা, হাঁটাচলা সবকিছুই কেমন একঘেয়ে আর বিরক্তিকর লাগছে তাঁর। সবকিছুই হয়ে উঠেছে রংহীন,বিবর্ণ। শুভ্রবের লাগেজ তোলা হয়ে গেলে গাড়িতে চেপে বসলেন আনিমুল সাহেব। মনে মনে বিষদ অভিমান জমে আছে তার। অথচ, সেই অভিমানগুলোর মূল কাঠিটাই যেন খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আনিমুল সাহেব ভাবেন। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে সবই বয়সের দোষ বলে চোখ বন্ধ করেন। সাথে সাথেই চোখের পটে ভেসে উঠে কয়েক যুগ আগে হারিয়ে ফেলা মৃত প্রিয়তমার মুখ!
#চলবে…
[ প্যারায় প্যারায় প্যারায়িত হয়ে যাচ্ছি। যখনই ভাবি লিখতে বসব তখনই দুনিয়ার ঝামেলা শুরু!]