#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০২
চিলেকোঠার ছোট্ট একটা ঘর। উপরে টিনের ছাউনি। রুম থেকে বেরিয়েই নজরে আসবে সাদা গোলাপের সাজানো বাগান। পুরো ছাঁদ জুড়ে অন্য কোনো ফুলের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। কেবল সাদা গোলাপ। তপা বিদ্রুপাত্মক হাসল।
” বাহ ফুলেদের বেলায়ও সাদা কালো বাছ বিচার শুরু হয়ে গেছে তবে। কেবল আমিই অবহেলিত নই কালো রঙের জন্য।”
ছোট্ট একটা দোলনা। তার পাশেই শারীরিক কসরতের কিছু জিনিসপত্র। তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখানে আবার কে ব্যায়াম করতে আসে? বাড়িটা নিরাপদ হবে তো আমার জন্য?”
পৃথা তপার নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল। গোছানোর তেমন জিনিসই নেই তার। কেবল একটা সিঙ্গেল বেড, পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার আর রান্নার জন্য কিছু বাসনপত্র। ব্যস আর কিছু নেই। একা থাকতে আর কি লাগে? আপাতত একটু নিরাপত্তাই মূল চাওয়া তপার জীবনে।
তাজমহল।
ঐশ্বর্যের এক জলন্ত উদাহরণ। না না আগ্রার শাহজাহান মমতাজের তাজমহল নয়।তাজওয়ারদের তাজমহল। রায়হান তাজওয়ার একজন সফল ব্যবসায়ী। পায়েল তাজওয়ার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। পায়েল রায়হান দম্পতির একমাত্র সন্তান পলক তাজওয়ার।
দরজা ঠেলে হেলেদুলে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো পলক। পায়েল রান্না ঘর থেকে উচ্চস্বরে বললেন,
“পলক এদিকে এসো। কথা আছে তোমার সাথে।”
অগ্যতা নিজের গতি পরিবর্তন করে মায়ের কাছে গেল পলক।
“রাত্রির সাথে কি করেছো তুমি?”
পলক অবাক না হয়ে কপালে আঙুল চালিয়ে বলল,
“ওহ! খবর পৌঁছে গেছে। তা তোমার রাত্রি তোমাকে বলে নি কি করেছি আমি?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সে জানে এই ছেলে সোজা কথা সোজাসাপটা বলতে পারে না। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“ওকে সবার সামনে অপমান করেছো তুমি?”
পলক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ওর সম্মানবোধ আছে নাকি? থ্যাংক গড তুমি বললে। আমি তো জানতামই না।”
“পলক। ভুলে যেও না আমি তোমার মা। বাইরের অন্য পাঁচটা লোকের মত তুমি আমার সাথেও একই ব্যবহার করতে পারো না।”
পলক একসাথে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা। আমি এমনি এমনি কিছু করি না সেটা তুমিও জানো বাবাও জানে। তবে বাইরের একটা মেয়ের কথা শুনে কেন নিজের ছেলেকে জাজ করো? ও শুধু আমি কি করেছি সেটা বলল। কিন্তু কেন করেছি সেটা বলল না? ও একটা নিষ্পাপ মেয়ের সম্মান নিয়ে টানাটানি করছিল মা। হেনস্তা করতে চেষ্টা করেছিল। সেটা আমি কি করে হতে দেই?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“অন্য কেউ কি করল তা আমার দেখার বিষয় নয়।কিন্তু আমার ছেলে যেন কোনো অন্যায় না করে সেটা তো আমাকে দেখতে হবে তাই না? নয়তো পাছে শুনতে হবে অন্যের সন্তান মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তান মানুষ করতে পারি নি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
“আমাকে দেখে অমানুষ মনে হয় তোমার?”
পায়েল হাসি লুকিয়ে বললেন,
“খবরদার আমার সামনে ভ্রু কুঁচকাবে না। তুমি কি ভাবো তোমার বাইরের চামচেদের মত তোমার কুঁচকানো ভ্রু দেখে আমি ভয় পাব? ভুলে যেও না আমি তোমাকে পেটে ধরেছি। আকাশ থেকে টপকে পড়ো নি। আর একবার এরকম ভাবে তাকালে হাতে খুন্তি দেখেছো তো? পাছে লজ্জায় চামচে না না তোমাদের ভাষায় ফ্যান ফলোয়ার, তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।”
পলকের কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। মাথা নাড়িয়ে বিরবির করতে করতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে।
গায়ে ওড়না জড়িয়ে জানালার পাশে বসল তপা। একফালি চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরময়। জানালা খুলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল চাঁদের দিকে।
” চাঁদ তুইও কি আমার মত নিঃসঙ্গ? তোরও কি ভরসা করে আঁকড়ে ধরার মত একটা হাত নেই? তুইও আমার মত লুকিয়ে বেড়াস তোর দুঃখগুলো? নাহ তোর আবার কিসের দুঃখ। তুই তো সবচেয়ে সুখী। তোর রূপের এত তেজ যে কলঙ্কটা কারো চোখে পড়ে না।কিন্তু আমাকে দেখ কলঙ্ক না করেও কলঙ্কিত আমি। কালো রঙটাই কি আমার কলঙ্ক? এটা কি আমি নিজে গড়েছি বল? আল্লাহ দিয়েছেন আমার কালো রঙ। এতে আমার কি দোষ? তুইও নিশ্চয়ই নাক ছিটকাচ্ছিস? ভাবছিস এই কলঙ্কিত নারী কেন তোর আলোয় আলোকিত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু জানিস তো দিন শেষে আমরা দুজনেই একা। আমাদের দুঃখগুলো এক সুতোয় বাঁধা। তোর যেমন তোর কলঙ্ক নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই তেমনি আমারও নেই। কিন্তু কি বলতো মাঝে মাঝে মানুষের কথায় ভীষণ কষ্ট হয়। সে এক নিদারুণ কষ্ট। তাই তো তোর কাছে বলে নিজেকে হালকা করি। কাল আবার নতুন উদ্যোমে বাঁচতে হবে তো। তুই কি বিরক্ত হোস? কিছু করার নেই রে। বিরক্ত হলেও আমি তোকেই বলবো। তুই ছাড়া কে আছে আমার?”
দু টুকরো পাউরুটি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল তপা। কেনাকাটা করতে হবে। চাল, ডাল, সবজি কিচ্ছু নেই ঘরে। পাউরুটি খেয়ে তো আর জীবন চলবে না। বাজারে পৌঁছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে ফিরতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল সে। হাতের টাকা প্রায় শেষের দিকে। রিকশা নিলে ভাড়া নিশ্চয়ই অনেকগুলো টাকা গুনতে হবে। মামার দেওয়া সামান্য কিছু টাকা রয়েছে হাতে। বাড়ি ভাড়া অগ্রিম দিতে গিয়ে এই ঝামেলায় ফেঁসে গেছে সে। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই নাকি নিয়ম। দু’হাতে বাজারের ব্যাগ তুলে হাঁটা শুরু করল তপা। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আর কুলোচ্ছে না হাতে। নিজেকে অজস্র গালাগালি দিল মনে মনে। এত কিছু কেনার জন্য। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরেই ভাবল এটুকু তো কিনতেই হতো। রোজরোজ তো বাজারে আসতে পারবে না সে। ক্লাসও তো করতে হবে দু’দিন পর থেকে। তাছাড়া পৃথার ধরিয়ে দেওয়া টিউশনিটাও করতে হবে। আরও খুঁজতে হবে। একটা টিউশনি করিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাবে কীভাবে আর খাবেই বা কি? বাড়ি ভাড়াও দিতে হবে মাসে মাসে। টেনশনে দম বন্ধ হয়ে আসে তপার। হাতের ধরে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“জন্মেছাে অভাগী হয়ে আর জীবন কাটাতে চাও ননীর পুতুলের মত? ধিক্কার তোমাকে তিয়াশা তপা।”
“মামা আমাকে নিয়ে ভেবোনা তুমি। আমি এখানে ভালো আছি। এখানে কষ্ট হলেও শান্তিতে ঘুমাতে পারবো আমি। নিজের রোজগারে খোঁটা ছাড়া দু মুঠো খেতেও পাব। এখন থেকে শুধু খাবার হজম করলেই হবে মামা। খোঁটা দেওয়া কথাগুলো হজম করতে হবে না। আমি এখানে সত্যি ভালো আছি। কাল থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তুমি শুধু দোয়া করো আমি যেন বড় হতে পারি মামা। এতটাই উঁচুতে উঠতে পারি যেখানে ওই মানুষগুলো আমাকে ছুঁতেও পারবে না। দেখতে ইচ্ছে করলে চলে এসো মামা। তোমার জন্য আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা। কিন্তু অন্য কেউ যেন না আসে প্লিজ। আমি আর পেছনে তাকাতে চাই না।”
কলেজে পৌঁছে নিজের ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য লিফটের কাছে গেল তপা। দুবার লিফটে চড়া হয়েছে ওর। সাথে মামা ছিলেন একবার, অন্যবার পৃথা। মনে মনে একটু ভয় হচ্ছে। কিন্তু কি করবে সে? ছয়তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে সকালের আলুসিদ্ধ ভাত এখনই হজম হয়ে যাবে। তাই উপায় না পেয়ে উঠে গেল লিফটের ভেতরে। চোখ বন্ধ করে সুইচ প্রেস করার আগেই হনহন করে ভেতরে প্রবেশ করল পলক তাজওয়ার। বাঁহাতে ধরে রাখা ফোনটা কানের সাথে সেঁটে দেওয়া তার। একনজর পলকের দিকে তাকিয়েই সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল । সহসাই হাতটা চলে গেল নিজের ঠোঁটের উপর। মুখ ঢেকে আল্লাহ আল্লাহ করতে শুরু করল তপা।
ফোন কানে লাগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে সে।
” ওরা এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কি করে ইডিয়ট? তোরা আমার নাম ভাঙিয়ে যখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মাস্তি করিস তখন আমার পারমিশন নিস? তাহলে এখন কেন? লাফরা করিস আমার সাথে? ওদের হসপিটালে অ্যাডমিট করে আমাকে ঠিকানা টেক্সট কর। নয়তো তোর গার্লফ্রেন্ড নামটা যেন কি? মিনা না টিনা ওর সাথে কিসিং মোমেন্টের ফটো এক্সিবিশনে পাঠিয়ে দিব। অবশ্যই ওর মুখটা দেখা যাবে না। কিন্তু তোর ওই পঁচা কাঁঠালের বিচি ঠিকই জলরঙে ঝিকঝিক করবে। সো চয়েজ ইজ ইউরস।”
বলে টুক করে লাইন কেটে ফোনটা পকেটে চালান করে দিল।
তপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। লোকটা কি আগাগোড়াই এমন ঠোঁট কাটা?
পলক তপার বিস্ময়ে ভরা চোখজোড়া খেয়াল করল কিনা জানা নেই তার। কিন্তু যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকানো টা খুব করে দেখেছে সে।
চলবে…