কৃষ্ণময়ীর_অলংকার #রাহনুমা_রাহা #পর্বঃ০৩

0
736

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৩

পরপর তিনটা ক্লাস করে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেছে সবাই। তপা লাইব্রেরীতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারের উপর। টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে কাটিয়ে দিল কয়েক প্রহর। এরমধ্যে কখন নেত্রপল্লব এক হয়ে গেছে বুঝতে পারে নি। সকালে না খেয়ে আসার দরুন পেটের ভেতরে ছুঁচোরা ডন মারছে। একহাতে পেট চেপে ধরে মাথা তুলে সামনে তাকাল। ওমা লাইব্রেরী পুরো খালি। মাত্রই তো কত ছাত্র ছাত্রী ছিল। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই মাথায় হাত দিল। তিনটে বেজে গেছে। ক্লাস তো শেষ হয়েছিল দুই টায়। তারমানে পুরো একঘন্টা পার হয়ে গেছে। অসময়ের ঘুমকে লাথি ঝাঁটা মেরে লাইব্রেরীর বাইরে পা বাড়ালো।
লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকায় সিঁড়ি দিয়েই নামতে শুরু করল। তিনতলায় পৌঁছাতেই রাত্রির মুখোমুখি হলো তপা। দলবল নিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে আছে। তপাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“বাহ ঝাসিকি রানী এখনো ক্যাম্পাসেই আছে দেখছি।”
তপা ইগনোর করে বেরিয়ে আসার লক্ষে সিঁড়িতে পা রাখল। কিন্তু রাত্রির শক্ত হাতের বাঁধনে হাত আঁটকে যাওয়ায় তা সম্ভব হলো না। নিজেকে সাহস যুগিয়ে বলল,
“কি চাই আমার কাছে?”
রাত্রি উচ্চস্বরে হেসে বলল,
“তোর কাছে আবার কি চাইব আমি? দেওয়ার মত আছে নাকি কিছু?যে কালির মত চেহারা। দেখতেও তো ফকিন্নি বলেই মনে হচ্ছে। সেদিন পলক কে দেখে খুব সাহস বেড়ে গিয়েছিল না? আজ কি করবি তুই? কে বাঁচাবে তোকে?”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমাকে বাঁচানোর জন্য কোনো কুলক সরি সরি পলক, পলকের প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই নিজেকে বাঁচাতে পারি। এখন ভালোয় ভালোয় সামনে থেকে সরে যান। নয়তো সেদিনের বাকি কাজটা করে ফেলবো।”
রাত্রি ধেয়ে আসল তপার দিকে। তপা দুপা পিছিয়ে যেতেই হাত মুচড়ে ধরে বলল,
“কি করবি তুই? এই হাত দিয়ে মারবি তাই না? সেদিন ভেবেছিলাম একটু র্যাগ দিয়েই ছেড়ে দেব। কিন্তু তোর ব্যবহার আমার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এত সাহস পাস কি করে তুই? এখন মার দেখি।”
তপার হাত ব্যথায় নীল হয়ে আসছে। তবুও রাত্রির ছেড়ে দেওয়ার কোনো নাম নেই। তপা চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে না পেরে পা দিয়ে লাথি মারলো রাত্রির হাঁটুর ঠিক নিচে। রাত্রি সামলাতে না পেরে বসে পড়ল। তপা সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এলো।

তপাকে দৌড়াতে দেখে পলক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তপার ভবনের সামনেই বসে দলের ভেতরের কিছু প্ল্যানিং চলছিল। পলক সেসব রেখে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। লম্বা লম্বা কদম ফেলে দ্রুত বেগে উঠে গেল উপরের দিকে। তিনতলায় পৌঁছাতেই রাত্রিকে নিচে বসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুনে থেমে গেল।সামনে এগিয়ে এসে বলল,
“বাহ! এতদিনে নিজের জায়গাটা বুঝতে পারলি তাহলে। ”
রাত্রি কিছু বলার জন্য মুখ খুলার আগেই পলক গটগট করে হেঁটে চলে গেল নিচের দিকে। রাত্রি নিজের ঘাড়ে উপর পড়ে থাকা চুলগুলো খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো।

পৃথা তপার নীল হওয়া জায়গাটায় মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
” তুই কি করলিরে ওর হাত ভেঙে দিতে পারলি না? আমার সাথে তো এত পারিস। অন্য কারো বেলায় সব হাওয়া ফুস?”
তপা মৃদু হাসল। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না। ও জানে এখন পৃথা অযথাই বকবক করবে। পেটের সব কথা উগরে দিয়ে তবেই দম নেবে।

সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলা অতিক্রম করতেই চোখ পড়ল একটি সাদাকালো নেমপ্লেটে। গোটানো অক্ষরে লেখা ‘তাজমহল’। তপা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। জীবনে প্রথমবার এরূপ নেমপ্লেট দেখল। অবশ্য এখন অনেক কিছুই নতুন দেখছে ও। তাই ব্যাপারটা বেশি ঘাটল না। বড়লোকদের সব বড় বড় ব্যাপার।
ছাদে উঠে রুমে ঢুকার আগ মূহুর্তে মনে হলো ছাঁদে কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল না মুখটা। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা এঁটে দিল। বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ওটা খারাপ কেউ নয়। ভাল মানুষ। ভয় পাস না তপা। রিল্যাক্স।”

পৃথা কেকের স্লাইস মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মুখে সুমধুর আওয়াজ করে বলল,
“তপা কেকটা যা হয়েছে না। একেবারে অমৃত। তুই তো বেকারি খুলতে পারিস। রাতারাতি বড়লোক হতে পারবি। পুরো বাংলাদেশের মানুষ আসবে তোর কেক নিতে। বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবি। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তোকে অ্যাওয়ার্ড দিবে দেখিস।”
তপা কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিল।
পৃথা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“তপা মজা নয়। আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুই অনলাইনে কেকের বিজনেস করতে পারিস তো। আজকাল তো ভালোই চলে অনলাইন বিজনেস। ট্রাই করতে পারিস।”
তপা মন খারাপ করে বলল,
“টাকা কোথায় এতসব কেনার? আর আমার তো ভালো একটা ফোনই নেই। অনলাইনে কিভাবে হবে?”
পৃথা তপার একহাত জড়িয়ে ধরল।
“আমি আছি তো। আমি অনলাইনের যাবতীয় কাজ করে দেব। আর টাকা নিয়ে ভাবিস না। সব আমি কিনে দেব।”
“এটা হয় না পৃথা। আমি তোর থেকে আর সাহায্য নিতে পারব না রে।”
পৃথা দুমিনিট ভেবে বলল,
” ধরে নে আমি তোর ব্যবসায় ইনভেস্ট করছি। যা লাভ হবে তার একাংশ আমার। রাজি?”
তপা পৃথার মুখ চেয়ে অমলিন হাসল। মেয়েটা এত ভালো কেন?

পরদিন যথারীতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে নিয়ে হাজির পৃথা। তপা অবাক হয়ে বলল,
“ওমা! মুখের কথা মুখে রয়ে গেল আর জিনিসপত্র হাজির?”
পৃথা ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” পারলে তো তক্ষুনি এনে দিতাম আমি। এখন সব গুছিয়ে রাখ। আমি ভীষণ টায়ার্ড রে। লেবু আছে? থাকলে একটু শরবত করে দে না। না থাকলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি প্লিজ।”
তপা ঝটপট লেবুর শরবত করে দিল পৃথা কে। পৃথা এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল,
“দোয়া করি এই শরবতের মতই ঠান্ডা ঠান্ডা মিষ্টি মিষ্টি একটা বর যেন তোমার কপালে জোটে।”
তপা হেসে ফেলল এহেন কান্ডে।
“শুধু আমার জন্য চাইছিস যে? নিজের জন্য চাইবি না?”
পৃথা লাজুক হেসে বলল,
“জানিস না অন্যের জন্য চাইলে আল্লাহ তার জন্য দুইটা দেয়। আমি তোর জন্য চেয়ে নিজের জন্য দুইটার ব্যবস্থা করলাম। তুই কি ভেবেছিস? শুধু তোর জন্য চাইছি? আমি এতটাও ভাল নই রে বোকা।”

তপা সবেমাত্র গেইট পেরিয়ে পার্কিং জোনে ঢুকেছে। হাতের বা পাশটায় পলক তাজওয়ারের বাহিনী দেখে দ্রুত পা চালালো। কিন্তু বাংলা একটা প্রবাদ আছে না? যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। এখানে তো আস্ত একটা বাঘ রয়েছেই। সেই পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে ডেকে উঠল,
“তিয়াশা।”
তপার পা দু’টো নিজের চলার গতি থামিয়ে দিল। মায়ের পর এই প্রথম কেউ তিয়াশা বলে ডাকল। নয়তো সবাই তপা বলেই চিনে তাকে। তপা পেছনে ঘুরে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“জ্বি বলুন।”
পলক কিঞ্চিৎ অবাক হলো তপার মাথা নিচু করে থাকতে দেখে। মেয়ে তো এতটাও শান্ত নয়। এর ঝাঁঝ সেদিন দেখেছে সে।
” কাল দৌড়ে চলে গিয়েছিলে কেন? রাত্রি কিছু বলেছিল?”
তপা মুখ তুলে একনজর তাকিয়ে বলল,
” সেটা আপনাকে কেন বলবো?”
পলক কপালে আঙুল চালিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তো কাকে বলবে?”
তপা ঈষৎ কেঁপে উঠল। কিন্তু ভড়কে না গিয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
” কাউকে বলবো না। আমার নিজের জন্য আমি নিজেই যথেষ্ট।”
“তাহলে প্রথম দিন কেন এসেছিলে? চুমু খেতে? ওমাইগড। তোমার আসল উদ্দেশ্য তবে আমার এই সুন্দর ঠোঁটে চুমু খাওয়াই ছিল। আমি আরও ভাবলাম ইনোসেন্ট মেয়ে। এখন তো দেখছি এ মেয়ে আমার মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করতে চাইছে।” আহাজারি করে বলল পলক।
তপার কান গরম হয়ে গেছে। একটা লোক অবলীলায় কিভাবে বলতে পারে এসব কথা তার বুঝে আসে না। চলে আসার জন্য এক পা বাড়াতেই পলক মোহনীয় কণ্ঠে বলল,
“পলক তাজওয়ার কে চুমু খেতে হলে ভালবেসে খেতে হবে। নয়তো পলক তাজওয়ার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”

অগ্রহায়নের এক গোধূলি লগ্ন। তপা গোসল সেরে ছাঁদে জামা কাপড় মেলতে বের হয়। হাঁটু অবধি লম্বা চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো ছিটানো। ভেজা চুলে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। চুল মুছার তাগিদে তাড়াহুড়ো করে কাপড় মেলে দিয়েই রুমের ভেতরে পা বাড়ালো।
ছাদের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকেই অপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল কেউ একজন। না না তার দিকে নয় চুলের দিকে। তপা চলে যেতেই মৃদু স্বরে বলল,
“মাশাল্লাহ।”

গভীর রাত। নিস্তব্ধ প্রকৃতি। নিকষ কৃষ্ণ আধারে নিমজ্জিত ত্রিভুবন। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখিদের ডাক। নিস্তব্ধতায় মোড়ানো রাতে সামান্য পাখির ডাকটাকেই ভয়ংকর মনে হচ্ছে। অতীব ভয়ংকর। হঠাৎই তপার মনে হলো রুমের ভেতরে কেউ আছে। যে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে তপার দিকে। আধো আলো আধো অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল না সে। অবয়ব টা বিছানার উপর ঝুঁকে এলো। তপা নীরব, নিস্তব্ধ। বিন্দুমাত্র নড়ার শক্তি পাচ্ছে না। হঠাৎই শরীরের স্পর্শ কাতর জায়গাগুলোতে শক্ত হাতের এলোপাতাড়ি স্পর্শ পেতেই চিৎকার করে উঠে বসল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here