#শবনম(পর্ব ৫)
সায়লা সুলতানা লাকী
কয়েকদিন ধরেই শবনমের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সারাদিন শুধু মাথা ঘোরায়। কোন কিছুর গন্ধ নাকে গেলেই শুধু বমি করে। নিজে বুঝে উঠতে পারে না এসব কিসের লক্ষণ কিন্তু ভয়ে মুখ খোলে না যদি অসুস্থ জেনে দুলাল ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসে। তবে দুলাল একা কী করে থাকবে! ওর যে একা থাকতে কষ্ট হয় এখন।
এই অবস্থাতেই নিজের ঘরের কাজ করে আর যখন খারাপ লাগে তখন ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে ঘারের এক কোনায়।
শাশুড়ি তার ঘর থেকে সবই টের পায়, শবনম যখন ওয়াক ওয়াক করে বমি করে তখন তিনি নাকে কাপড় চেপে বসে থাকেন। অসুস্থ শ্বশুর তখন করুন কন্ঠে বলেন
“আহা মাইয়াডার বড় কষ্ট অইতাছে, কেউ নাই একটু দেহার। ইশশ এমনই কপাল আমার, সব বুঝি কিন্তু কিচ্ছুই করতে পারি না। কত্তোদিন অইল মাইয়াডা একটু ফুছকিও দেয় না আমার দিকে। দিবো কেমনে, তোমার আর তোমার পোলাপানের যন্ত্রণায় ত্যক্ত অইয়া আছে যে ওর মন।”
“ইশশশিরে দরদ দেইখ্যা আর বাঁচি না, শ্বশুরের কত্তো দরদ হের পোলার বৌয়ের লেইগ্যা। হুনেন, এইসব আদিখ্যেতা আমার সামনে কইরেন না, তুইল্যা এক্কেবারে বৌয়ের ঘরে থুইয়া আমু। তহন সামনে থেইক্যা দরদ দেহাইয়েন বৌরে।”
দুলালের বাপ আর কোন কথা বলেন না ভয়ে। অযথা বৌয়ের কোন উপকারতো করতে পারবে না উলটো দুই এক কথা বলে মেয়েটার আরও অশান্তির কারন হতে মন সায় দিল না।
এভাবেই কয়েকদিন চলে যায়। একদিন ঠিকই বানুর সামনে পড়ে যায় শবনম। ওর বমি করা দেখেই বানু সারাবাড়ি চিৎকার করে এক করে তোলে। সুসংবাদ বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িতে। শবনম বমি করছে এমন খবরেও যে মানুষ খুশি হবে তা ওর ছোট্ট মাথায় প্রথমেই ঢুকে নাই। পরে দাই খালা এসে ভালো মতো পরীক্ষ করে আরও নিশ্চিত হল এই বমির কারন যে সুখবরই। বিষয়টা জানাজানির পর সবাই আনন্দিত হলেও শবনমের শাশুড়ি খুশি হতে পারল না। বানুর লাফালাফিতে তিনি মোটামুটি বিরক্তই হলেন তাই সরাসরি আক্রমন করে বসলেন
“পরের পেট লাগানি দেইখ্যা তোর এত খুশি লাগে ক্যারে বানু? তুইতো এই বাড়িতে ওর আগে আইছোস, তুইতো এহনও কিছুই দিতে পারলি না আমগো।”
“ও আল্লাহ চাচি আম্মা, আপনে বুঝি এত্ত বেক্কল? সহজ হিসাবডাই দেহি বুঝেন নাই।”
“তওবা তওবা! বানু তুইতো এমন আছিলি না? এমন বেতাছির অইলি কবে? কি কস তা বুইঝ্যা কসনি?”
“আমিতো বুঝি’ই তয় আপনেই বুঝেন নাই। আমার আগে যে আপনেগো পোলায় আরেক হাঙ্গা করছে তাতো জানেন? হেই ঘর থেইক্যা কয়ডা পাইছেন? হেই বেডি কয়ডা দিছে আপনেরে? আমার কাছে চাওনের আগে বিষয়ডা একবার ভাবন দরকার আছিল না? আপনেগো যন্ত্রের মধ্যেই ভেজাল আছেগো চাচিআম্মা, যন্ত্রই যে নষ্ট । যতই হাঙ্গা নিকা করুক কিচ্ছু পাইবেন না।” কথাটা শেষ করে বানু হিহিহি করে হেসে উঠল।
“ছি ছি ছি, বানু তুইতো পুরাই নষ্ট অইয়া গেছোত। বাড়িতে একটা বেদ্দপ ঢুইক্যা অহন সব বৌগোই বেদ্দপ বানাইতাছে। এক দুলালের বৌ সব গুলিরে বেদ্দপ বানাইব কইয়া দিলাম।”
“চাচি আম্মা, হুদাই শবনমেরে দোষ দেন ক্যা? অবশ্য আপনের যে ওর লগে কাইজ্যা করনের লেইগ্যা গলা খাউজ্যায় তা আমরা বাড়ির বেবাকতেই জানি। চেষ্টা কইরা লাভ নাই। শবনমের জোর অহন অত নাই যে আপনের লগে লাগব।”
এবারও কথা শেষে বানু হিহিহি করে হাসতে লাগল।
“বুঝছি, এহন থেইক্যা তোর লগেও আর কতা কওন যাইব না। আমার ঠেকা লাগছে ভালা মাইনষের ঝিয়ের লগে লাগতে যামু। আমার ছায়াডাও ওর দিকে মাড়ায় না।” কথাটা বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন।
তার কথাটা পুরোটাই সত্য। বাড়িতে এখন সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। মেয়েরা যার যার শ্বশুর বাড়িতেই আছে। ছেলেরা সারাদিন বাহিরে থাকে বলে নিজের ভাইয়ের দুই মেয়ে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। ওদেরকেও নিষেধ করে দিয়েছেন শবনমের ঘরের আশেপাশে যেন না যায়। শবনমের কোন দরকারে ডাকলেও যেন না যায়। মেয়ে দুইটা ওদের ফুপুর কথা মতোই চলে।
এই সময়তে শবনমের একটু সাহায্যের প্রয়োজন হবে কিন্তু তাদের কাছ থেকে যে কিছুই পাওয়ার আশা নেই তা বাড়ির সবাই বুঝতে পারে।
রাতে দুলাল বাড়ি ফিরতেই ওর ঘরে বড় চাচি আম্মারে দেখে অবাক হয়ে গেল। বড় ভাবি ভাতের হাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে দুলালকে দেখে প্রথমেই সুসংবাদটা দিল। মুহুর্তের মধ্যে দুলালের দুনিয়া ওর কাছে বেহেশত বলে মনে হল। প্রথম কথাটাই হল
“ও চাচি আম্মা, আমার সুখ দেখতে আমার মায় আইতাছে আমার ঘরে। সত্যই দেইখ্যেন আমার মা’ই আইব শবনমের কোলে। আমি আবার আমার মায়েরে পামু। আমার ঘরতো সাক্ষাৎ বেহেশত অইয়া যাইব তহন। ও আল্লাহগো আমার যে কী খুশি লাগতাছে, আমি কেমনে বুঝামু।”
“অইছে আর আমগো বুঝানের লাগব না। তোরডা তুই’ই বুঝ। অহন বৌরে একলা ঘরে রাইখ্যা এত রাইত করিস না। ও ছোড পোলাপান কী বুঝতে কী করব পরে একটা বিপদ অইব। এক কাম কর। আমি কই কী! বৌরে ওর মায়ের কাছে দিয়া আয়। আর নয়ত ওর মায়েরে এই হানে লইয়া আয়। ”
“হ চাচিআম্মা আপনে কতাডা ভালো কইছেন। আমি দেহি আগে হেই বাড়ি খবরডা দেই। আমি কাইলকাই দই মিষ্টি দিয়া খবর পাডামু। এমন খুশির খবরডা এমনে এমনে দেওন যায় না।”
“ওয় দুলাল মিষ্টি শুধু শ্বশুর বাড়িতেই পাডাবি? আমগো খাওয়াবি না?”
“ও বড়ভাবি এইডা কী কইলা? দেইখ্য আমি কাইলকাই সব্বারে মিষ্টিমুখ করামু৷ আমার মায় আইব আর আমি কাউরে মিষ্টি খাওয়ামু না তা কেমনে অয়।”
কথাটা বলেই দুলাল প্রান খুলে একটা হাসি দিল। শবনম চুপচাপ শুয়ে সেই হাসি দেখতে লাগল আর ভাবল “মানুষটা এই খবরে এত খুশি অইব তাতো বুঝতে পারি নাই। কিন্তু আমার ভেতরে এই সুসংবাদ নিয়ে তেমন কোন নড়নচড়ন নাই ক্যা? আমি কী তাইলে খুশি অই নাই?” আবার নিজের মনে নিজেই উত্তর দিল ” আসলে আমি অহনও সবটা বুইঝ্যা উডি নাই, তাই আনন্দও পাইতাছি না। তয় এই মাইনষের আনন্দ দেইখ্যা নিজের মনে কেমন একটু ভয় ভয় লাগতাছে, হেইডার কারন কী অইতে পারে ?”
রাতে দুলাল নিজেই ভাত বেরে শবনমকে নিয়ে খেল। পালঙ্কে উঠতে কষ্ট হবে ভেবে উঠার মুখটায় একটা বড় জলচৌকি রাখল। শবনম চুপচাপ দুলালের কাজ দেখছিল হঠাৎ ওর কথায় সম্বিত ফিরল
“বৌ, আমি কইলাম তোমারে তোমগো বাড়িত দেওনের পক্ষে না। তুমি ওই বাড়ি গিয়া থাকলে আমি তোমারে কেমনে দেহুম। এমন চানমুখ একদিন না দেখলে আমার ঘুম অইব না। ”
“ইশশশ ঢং জানেন কত!”
“বৌ ঢং কও আর যাই কও। আমার কিন্তু এক কতা। আমি তোমারে ছাড়া একদিনও থাকতে পারুম না।”
“তাইলে চলেন আমার লগই থাকবেন আপনে।”
“হায় হায় কও কী! পাটের ব্যাপারী আমি। কাম কাইজ সব ফালাইয়া শ্বশুর বাড়ি পইড়া থাকলে আমার মায় আইয়া খাইব কী?”
“তাইলে অহন আমি কী করুম? আমিতো শরীরে বল পাই না।”
“আম্মারে কও না এই হানে আইয়া থাকতে। তোমার বইনগো কও কেউ আইয়া থাকুক। কোন একজন লগে থাকলেইতো অয়। কামকাইজ লইয়া ভাইব্য না, আমি যদ্দুর পারি কইরা দিমু।”
“আল্লায় জানে মায় আইয়া থাকব কী না তাতো আর আমি জানি না।”
“কি কও আইব না মানে। পরথম নাতিন আইব দুনিয়ায়, আইব না মানে? দেইখ্য আমি কাইল খবর পাডানের লগে লগে আমার মায়ের নানি নাচতে নাচতে আইব।”
কথাটা বেশ জোরের সাথেই বলে দাঁত বের করে হাসতে লাগল দুলাল। কিন্তু ওর কথায় কেন জানি শবনমের হাসি আসে না৷ ও বেশ চিন্তিত মনে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মনে ভয় মা না আসলে দুলালের কাছে ওর মা ছোট হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে দুই হাড়ি রসগোল্লা আর দই সহ খবর পাঠালো এক ছেলেকে দিয়ে শবনমের বাবার বাড়িতে দুলাল। গঞ্জের প্রতিটা আড়ৎদারকেই মিষ্টিমুখ করালো ওর মনের আনন্দ প্রকাশে। সবাই আনন্দিত হল ওর এই বাঁধভাঙা আনন্দে ।
দুপুরে মিষ্টি নিয়েই বাড়ি ফিরল। শবনম হিমশিম খেতে লাগল দুলালকে সামলাতে গিয়ে।
একটা সময় রেগে গিয়ে বলল
“একটুতো শরম করেন। কী শুরু করছেন আপনে? এমন কইরেন না, দাদি কয় এমন করলে বলে মাইনষের চোখ লাগে। আগে আপনের মায়েরে দুনিয়ায় আইতে দেন হেরপর ফুর্তি কইরেন। ”
“বৌরে তুমি আমারে বাধা দিও না। বহুত দিন পর এমন ফুর্তি লাগতাছে মনে। তুমি মাইনষের চোখ লাগনরে ডরাইও না। আমি বড় হুজুররে দিয়া তোমার লেইগ্যা পানি পড়া আনায় দিমুনে। হের ফুয়ের মেলা শক্তি। তোমার কোন ক্ষতি কেউ কোনদিন করতে পারব না।”
“হ আইন্যা দিয়েন। জিন ভুতের লেইগ্যাও দিয়েন। মানুষের শয়তানিতো দেহন যায় কিন্তু ওগুলির কামতো দেহন যায় না। আমার খালি হেগুলির লেইগ্যাই ডর লাগে বেশি।”
“এত ডরাইও না খবর গেছেগা অহন বলা তারা আওনডাই বাকি। তারা আইলে দেখবা তোমার ডর সব যাইবোগা।”
দুলালের কথায় শবনমের মনে শান্তি আসে না।এতদিন নিজেকে অসুস্থ ভেবে বসে থাকা শবনম যখন জানতে পারল ওর ভেতর আরেকটা প্রানের অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে তখন থেকে নিজের চিন্তা ফেলে সারাক্ষন শুধু ওই নতুন প্রানের চিন্তাতেই ডুবে থাকে। একা বাড়িতে এখন নিজের জন্য না বরং নতুন প্রানকে নিরাপদে পৃথিবির বুকে আনতে পারবে কি না সেই ভয়েই থাকে। এখন আর দুলালকে একা রেখে বাপের বাড়িতে যাওয়ার চিন্তায় মন খারাপ হয় না বরং মনে হয় ওখানে গেলেই বুঝি ওর চিন্তা কিছু কমবে। নিজের গেরস্থ ফেলে ওর মা এসে দীর্ঘদিন যে এ বাড়িতে থাকবে না তা ওর মন ভালোই বোঝে । মাকে বাড়ি ছেড়ে কখনও কোথাও দুদিনের বেশি থাকতে দেখিনি জ্ঞান হওয়ার পর।এদিকে দুলালের বিশ্বাসকেও অগ্রাহ্য করতে পারছে না। দুলাল যে পরিমান আশাশ আছে ওর শাশুড়ির আসার জন্য তা শবনমকে থেকেথেকে শংকায় ফেলছে। দুলাল শুধু নিজের আনন্দটাই দেখছে তাই আশেপাশের কোনকিছু চিন্তাও করতে পারছে না। ওর এই উচ্ছাস যে শবনমকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।
এমন এক অবস্থায় মায়ের কাছে খবর চলে গেছে জেনে শবনম আশায় থাকে যে, কোনদিন হয়ত ওর মা আসবে ওর কাছে ওকে দেখতে। আর নয়ত পালকি পাঠাবে ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়, একদিন শবনমের বড় ভাই ওর কয়েক বন্ধু নিয়ে এসে হাজির হয়। ওদের সাথে বাড়ি থেকে অনেক কিছু পাঠিয়েছেন শবনমের মা। এসব দেখেই শবনমের মন খারাপ হয়ে গেল। পালকি পাঠায়নি তার মানে এখন মা ওকে নিতে চাচ্ছে না আর নিজেও আসেনি দেখতে। এখন সবাইকে কী বলবে? কীভাবে এ মুখ দেখাবে দুলালকে, ও যে বেশি আশায় দিন গুনছিল। ওর বিশ্বাস যে বিফলে গেল। এসব ভেবে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ল শবনম ভেতরে ভেতরে।
ভাইদের তেমন কোন সমাদর করতে পারল না। ও বিছানা থেকে উঠতেই পারল না। উঠে বসলে মনে হয় দুনিয়াটা ঘুরছে। হাত পা শুধু ঝিঝি করে।
ভাই যাওয়ার আগে একটা চিঠি বের করে দিয়ে বলল, “বুবু নেও এইটা মা তোমারে দিছে।”
শবনম হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিতেই ওর ভাই বন্ধুদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর বসল না।
মনের কষ্ট মনে চেপে শবনম চিঠি পড়তে শুরু করল।
“শবনম, আমার পরান পাখি,
আমার আদর নিস মা। জামাইয়ের পাডাইন্যা খবর পাইয়া খুশিতে কাইন্দা দিছি। আল্লার দরবারে লক্ষকুটি শুকরিয়া জানাই। তয় মা এহন তোর শরীরডা কেমন? খাইতে লইতে পারোস কিছু? আমি তোর পছন্দের আমড়ার আচার, বরই আচার পাডাইলাম। মুরগির ডিম গুলো সাবধানে রাখিস। পতিদিন দুইডা কইরা সিদ্ধ কইরা খাবি। কয়ডা মুরগি দিলাম, এগুলারে ঝোল কইরা খাবি। পাতিলের শিং মাছ জিয়াইয়া জিয়াইয়া খাইস তাইলে শরীরে রক্ত অইব। মারে তুই যে আমারে কত্তো খুশির খবর দিছোস তা বুঝাইতে পারুম না। মনডা চাইতাছে তোরে কইলজার মধ্যে ঢুকায় রাখি। তোর দাদিও মেলা খুশি অইছে। বুড়া অইলে কী অইব, মনের হাউস কমে নাই বুড়ির। কোমড়ে কাছা বানছিল সবুজের লগে যাওনের লেইগ্যা। দেই নাই। তুই নিজেই এহন অসুবিধার মধ্যে আছোস তার উপর এ বুড়িরে লইয়া পড়বি আরেক বিপদে। তোর বাপে নাতি অইব শুইন্যা মেলা খুশি অইছে।
তোর সুবিধার লেইগ্যা আমি সমিরনের মায়েরে কইছি হের কাম গুছায়লইতে। ঠিক করছি তোর কাছে ওরেই পাডামু। তোর সাহায্য করব আর তোর রানদন ঘরে থাকব। তুই কোন কাম কাইজ করিস না আমার ময়না পাখি।
মনডা আমার কেমন যে আনচান করতাছে তোর মুখটা দেহার লেইগ্যা তা তোরে বুঝাইতে পারুম না। মনে অইতাছে আমি একটা কপালপোড়া মা যে মাইয়ার এমন সময় মাইয়ার কাছে থাকতে পারতাছি না শরমের দায়ে। মারে বড়ই শরমের মধ্যে পড়ছি আমি, এমন পেটটা লইয়া মাইয়া জামাইয়ের সামনে দাঁড়ানের মতো ক্ষমতা নাই আমার। শরমে মাডির লগে মিশ্যা যাইতে মন চাইতাছে। খালাস অইতে আরও তিন চাইর মাস লাগব। হেরপর আমি তোরে আমার কাছে লইয়া আমু। অহন আনলেওতো জামাই আইব তোর লগে। আমি এমন শরমের মুখ তারে দেহাইতে পারুম না। তুই মা আমারে ক্ষমা কইরা দিস। আমি তোর অপরাধী। অহন আমার তোর কাছে থাকনডা দায়িত্ব আছিল কিন্তু পারলাম না। তয় আমার মনডা কিন্তু তোর কাছেই পইড়া রইছে। তুই তোর যত্ন নিস। সকাল বিকাল কোরআন পড়িস। তুই যেই সুন্দর কইরা পড়োস তাতে আর কোন বালা মসিবত তোরে ছুঁইতে পারব না। খাওনদাওন ঠিক মতো করিসরে মা। গরুর দুধ ঠিকমতো খাইস। দুধের মধ্যে খেজুরের ঝোলা গুড় মিশাইয়া লইস তাইলে আর দুধের গন্ধ নাকে লাগব না। আমি তোর লেইগ্যা ঝোলা গুড়ের কলসডাও পাডাইলাম। মারে তুই কিন্তু ঠিকমতো খাইস। তাইলপ শরীটে বল পাবি। আমি কিন্তু অনেক চিন্তায় থাকুম গোর লেইগ্যা । অহন শুধু খাওন দরকার শরীরে ঠিক রাখনের লেইগ্যা। ভালো থাকিস মা। চিঠিডা তোর রানু ফুবু লেইখ্যা দিছে।হেরে পাইতে কয়ডাদিন দেরি হইল তাই সবুজরে পাডাইতে দেরি অইল। রাগ করিস না মা, আমার অক্ষমতাডা একটু বুঝিস, কান্দিস না আমার পরান পাখি। আল্লার হাতে তোরে শইপ্যা দিলাম।হেয়ই তোরে দেইখ্যা রাখব। অহন তাইলে রাখি।
ইতি
তোর অভাগী মা।
শবনম একবার দুইবার করে কয়েকবার চিঠিটা পড়ল। চোখের পানিতে গাল ভেসে গেল কিন্তু কিছুই টেরই পেল না। মনের মধ্যে ভয়টা আরও শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরল। দুলালকে কী বলে বোঝাবে সেটা আরো বাড়তি চাপ হয়ে মনে চেপে রইল। মায়ের লজ্জার কথাটা কীভাবে বুঝায়ে বলবে তাই মাথায় ঢুকছে না ওর। মাশের এই কাজে যে ও নিজেও এখন লজ্জা পাচ্ছে তাই’বা কীভাবে কাকে বলবে।
কাঁদতে কাঁদতে কখন জানি ঘুমিয়েই পড়ল।
দুলাল এসে নিজেই চিঠিখানা রাতে পড়ল শবনমের বালিশের পাশ থেকে নিয়ে। শাশুড়ির অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিল তাকে আর ডাকবে না কারন তার এই অবস্থা বাড়ির মানুষ জানলপ তারাও কানাঘুষা করবে বলে ষয়টা নিয়ে আর তাতে চবনম শুধু লজ্জাই পাবে। শবনমকে কোনভাবেই ও কষ্ট পেতে দিবে না। বড় চাচিআম্মাকে বলে কাজের সাহায্যকারী একজনকে ঠিক করে নিল। আর বাড়ির ভাবিরাও পালা করে শবনমের খোঁজখবর রাখবে এমন আশ্বাস দিল। তাতেই দুলাল কিছুটা সাহস পেল।
পরদিনই দুলাল খবর পাঠালো কাউকে না পাঠাতে শ্বশুর বাড়ি থেকে। আর সেই খবরে শবনমের মা যেন টের পেলেন স্পষ্টভাবে জামাইয়ের রাগগোস্যাকে। এতে তার মনও ভেঙে গেল। নিজের বাড়ি বসেই দিনরাত শুধু মেয়ের জন্য আল্লাহর কাছে পানা চাইতে লাগলেন।
দিন চলতে থাকল আপন গতিতে। শবনমের শরীরে এই তিন চার মাসে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এখন বমিটা হয় না। কিন্তু তাও ঘরের কাজ করতে সাহস পায় না। এই সময়ে প্রতিটা মেয়ে থাকে তার মায়ের কাছে আর ওর সেই সুযোগটা না থাকায় মানসিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে থাকে সবসময়।
এর মধ্যে খবর এল শবনমের বোন হয়েছে। আর সেই খবর বাড়িতে ছড়িয়ে গেল যেন কীভাবে। মুরব্বিরা অনেকেই এ খবর শুনে মুখ টিপে টিপে হাসে। শবনম টের পায় কিন্তু কিছু বলে না। কিন্তু ওর শাশুড়ি আর মুখ টিপে হাসেন না তিনি গলা চড়িয়ে এই খবর নিয়ে রঙ্গ করেন।
“বুইড়া বেডির কত্তো হাউসরে আল্লাহ৷ মাইয়ার লগে নিজেও পেট বাজাইছে। ছিছিছি, এরা বলে আবার ভালা মাইনষের জাত। ধুরো,ধুরো ধুরো৷ লজ্জা শরম এক্কেরে সের দরে বেইচ্যা খাইছে ।
তওবা, তওবা, তওবা আমরা অইলে এমন কাম জীবনও করতে পারতাম না। মাইয়া পোয়াতি অইছে খবর পাইয়া কেন আহে নাই আর কেন মাইরে নেয় নাই তা এত্তদিনে বুঝলাম। ছিছিছি কি শরম, কি শরমগো আল্লাহ।”
চিৎকার করে বলছেন আর শবনমকে শুনিয়ে শুনিয়ে কুটকুটিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছেন ব্যঙ্গ করে।
শবনম এমন লজ্জার ভয়ে এতদিন কষ্ট সহ্য করল কিন্তু তাতে কোন লাভই হল না। শেষ পর্যন্ত এমন অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তেই হল। নিজের বাপ মাকে নিয়ে এমন সব কথা মনের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তুলল। লজ্জায় আর কারো সাথে আর কথা বলতে পারল না। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসেই কান্নাকাটি করে কাটিয়ে দিল।
দুলাল নতুন শালি হওয়ার খবর পেল গঞ্জে গিয়ে। আড়ৎদাররা ঠাট্টা মশকরা করতে কেউ পিছপা হল না। মনের কষ্ট মনে চেপে আবার দই মিষ্টি সহ খুশি হওয়ার খবরটাই পাঠালো শ্বশুরবাড়িতে।
এবারও শাশুড়ি পড়ে গেলেন চরম লজ্জায়। ধরেই নিলেন জামাই তাকে এগুলো পাঠিয়ে নিরব রসিকতা করেছে মাত্র । ঠিক করলেন আর কখনও জামাইয়ের সামনে তিনি যাবেন না।
শবনমের যখন সাত মাস তখন শবনমের মা ওর জন্য আবার শাড়ি চুড়ি সহ অনেক ধরনের খাবার দিয়ে পাঠালেন। সাথে শবনমকে নিতে খুব শীগ্রই পালকি পাঠাবেন সেই খবরটাও দিলেন।
কিন্তু শবনম ওর ভাইকে মানা করে দিল বাড়ি যাবে না বলে। আর নিষেধও করে দিল ওর মা’কে যেন কখনও এখানে না আসতে। জানালো শ্বশুর বাড়িতে ওর বোন হওয়া খবর নিয়ে যেসব রঙ্গ হয়েছে তা। এখানে এলে তারা অনেক লজ্জা পাবেন সে কথাও বলে দিল।
শবনমের ভাইও অবশ্য কিছু কিছু টের পেয়েছে, কারন শবনমের ঘরে ঢোকার আগেই জহিরের সাথে দেখা হয়েছিল উঠানে৷ তখন ও ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেছিল
“কি বিয়াই, আমার কুট্টি বিয়াইনরে নিয়া আইলেন না ক্যা? হেয়তো এহনও বইনের শ্বশুর বাড়ি দেহে নাই। লইয়া আইতেন কোলে কইরা তাতে কোন অসুবিধা অইত না। গ্রামের সব্বাই জানে তাই কেউ উলডা জিগাইত না “কিরে সবুজ বিয়া করলি কবে? মাইয়া অইল কবে? ”
কথাটা বলেই কেমন এক বিটকেইল্যা হাসি দিয়ে সরে পড়ল সামনে থেকে ।
কথাটা শুনেই সবুজের চাপার দাঁত শক্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কিছু বলতে পারে নাই।কারন বাড়ি থেকে ওর মা বারবার হাতে ধরে বলে দিয়েছেন বোনের শ্বশুর বাড়ি যেয়ে যেন মেজাজ গরম না করে। বোনের এখন কঠিন সময় এখন আশেপাশের মানুষের সহযোগিতার দরকার হবে। কাউরে ক্ষেপানো ঠিক হবে না।
শুধু মাত্র বোনের শান্তির কথা মনে করে সবুজ এই অপমান দাঁত খিঁচে সহ্য করে নেয়।
শবনম ওর বাপের বাড়িতে যাবে না। এমন সিদ্ধান্তে শবনমের মা ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকেন। শবনমের বাপ নিশ্চুপ থাকলেও শবনমের দাদি দিনরাতই রাগে গজগজ করতে থাকে শবনম আর দুলালের উপর। কেন ওরা শবনমের মায়ের সমস্যাটা বুঝল না তাই।
যতই দিন যেতে থাকল ততই শবনমের মনে ভয়টা বাড়তে থাকল। পেটের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়াটা ওর মনকেও নাড়িয়ে দিল। ছোট্ট কিশোরী শবনমের ভেতর মাতৃত্বের বীজ বোপন হয়ে গেল ওর অগোচরেই। একলা ঘরে শুয়ে একটা সময় ও ওর পেটের বাচ্চার সাথে কথা বলতে শুরু করে।
মাঝেমাঝে দুলাল এসব দেখে জিজ্ঞেস করে
“বৌ তুমি এইগুলা বিরবির কইরা কী কও?”
শবনম কোন উত্তর দেয় না শুধু একটু হাসে।
ও যে ওর বাচ্চার সাথে গল্পকরে সে কথা বলতে ওর লজ্জা করে। ইয়া বড় এই পেটটা নিয়ে এখন বাড়ির উঠানে যেতেও ওর লজ্জা করে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে ভালোমতো ঢেকে রাখে যাতে কেউ ওর পেট না দেখে ফেলে। কিন্তু বারবারই আঁচল কম পড়ে যায় পুরোটা ঢাকতে গিয়ে।
বাড়ির সবাই বলে শবনম অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। গায়ের রং নাকি এখন সাদা ফকফকা হয়েছে । রুপ বাড়ছে বলেই দুলাল নাকি ওকে শ্বশুর বাড়ি পাঠায় নাই। শবনমের রুপে আটকে গেছে তাই ছাড়তে মন চায় নাই ওর।
শবনম সবার কথা শুনে আর নিজেও হাসে। কারন ইদানিং মানুষটা একটু বেশিই আদরযত্ন করে শবনমকে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরে। হাতে গলায় কোমড়ে এত্তোগুলা তাবিজ ঝুলাইছে তার পরও ওকে একা রাতে পায়খানা প্রসাবের জন্য যেতে দেয় না। প্রতিবার সাথে যায় দুলাল।
রাতে পা কামড়ালে নিজেই সরিষার তেল গরম করে পায়ে মালিশ করে দেয় তখন শবনমের অনেক আরাম লাগে। এই আদরগুলোই ওর মনের কষ্টগুলোকে একসময় সুখে পরিবর্তন করে দেয়।
চলবে