শবনম(৩ পর্ব)

0
222

#শবনম(৩ পর্ব)
সায়লা সুলতানা লাকী

হঠাৎ করেই ভাবি চিৎকার করে উঠল কাউকে দেখে। শবনম নিজের চিন্তা ছেড়ে সেদিকেই নজর দিল।
“ও আল্লাহ বড় ভাবি আপনে আবার আইছেন ক্যা? আমিইতো নতুন বৌ লইয়া যাইতাছিলাম।”

“হ তোর অপেক্ষায় থাকলে সূর্য মাতার উপরে উডব। চাচি আম্মায় চিল্লাইয়া বাড়ি মাতায় তুলছে না আইয়া আর উপায় কী?”

“আইয়া ভালোই করছেন, দেহেন নতুন বৌয়ের হাঁটতে কষ্ট অইতাছে, কেমন চিপায় চিপায় পা ফেলায়। ওর আর হাডোন লাগল না।”
কথা শেষ করেই হিহিহি করে হেসে উঠল।

“বানু এমন বেশ্যরমের মতো হাসিস নাতো। পোলাপান মানুষ পরথম পরথম একটু দুঃখুতো পাইবই, তুই পাস নাই? অহন বগরবগর রাইখ্যা ঘরে ল। কই বৌ আহো তোমার ঘরেই যাই।”
কথা শেষ করে আর দাঁড়ালেন না দুলালের ঘরে ঢুকলেন বড় ভাবি আর তার পেছনে বানু ভাবি আর শবনমও।

“কী, নয়া দুলার ঘুম ভাংছেনি? খাওনদাওন লাগব না কিছু, হুদাই বৌয়ের মধু গিল্লেই অইব?”

“ওইদ্দেহ, বড় ভাবি তুমি আবার কষ্ট কইরা আইছো ক্যা? আমরাইতো যাইতাম ।”

” হ, যাইতি। দুফুর গড়াইলে পড়ে যাইতি। আইজকা গঞ্জে যাবি না? কাম কাইজ কিছু নাই? এহন বৌ পাইছোস, সংসার জোয়ানের আগের জীবন আর অহনের জীবন কী এক অইব?”

“ওরে ভাবি তুমি দেহি হাজারডা প্রশ্ন জিগাইতাছো? কোনডা থুইয়া কোনডার জবাব দিমু।”

” আগে ক, কাইলকা আমগো খাওন মাইষেরে বিলাইছোস ক্যা? আম্মা সহ বেবাক মুরুব্বিরা কইলাম তোর উপর চেতছে। তুই সবাইরে অপমান করছোস তোর শ্বশুরবাড়ির কাছে।”

“হায় হায় কয় কী? আমি এমন কাম জ্ঞান থাকতে কোনদিনও করুম না ভাবি বিশ্বাস করো। আমি বাড়ির মধ্যে কাইজ্যা লাগনের ডরে আর ওই খাওন বাড়িত আনি নাই। একবার চিন্তা কর, ওই খাওন আমি জমিরাগো ঘরে না দিয়া যদি তোমগো সবাইরে বিলাই দিতাম তাইলে জমিরের মায়ে কী তোমগো ছাইড়া দিত? কোমরে কাপড় কাইচ্যা নামতো কাইজ্যা করতে। লগে আরও যোগ দিত হের গুনোধর মাইয়াগুলি।”

” হ, তা অবশ্য তুই ঠিকই কইছোস। অমন খাওন খাওনের চেয়ে না খাওয়াই ভালো। হুনলাম গত রাইতে নাকি তুই নিজের ঘরে রাইনদা বৌ লইয়া খাইছোস, ওই গোলামের পুত গোলাম আমরা কী মইরা গেছিলাম?”

” হেই কতা আবার কই শুনলা?”

” হ, সারা রাইতই তোর আর তোর বৌয়ের হি হি হা হা হুনছে বাড়ির বৌ ঝিয়েরা। সবতো কানে তালা লাগাইছিল যে গোপন থাকব?”

” মা নাই, তাই আর কারো কাছে দাবি করি না। কাউরে জ্বালাইতে মন চায় না। আবার কার কাছে দাবি করুম, আবার কারে কষ্ট দিমু, এই ভাইব্য নিজেই রানছি। জানোইতো ঘর পোড়া গরু সিঁদুর মেঘ দেখলেও ডরায়। আমিতো ঝড় ঝাপটা সহ্য কইরা অভ্যস্ত। কিন্তু এই মাইয়াডা বড় আদুরী ওতো এই সব দেহে নাই জীবনে। তাই চাই নাই ও কোনো ঝড়ের মধ্যে পরুক।”

” ও আল্লারে, বৌয়ের লেইগ্যা কত্ত পিরিত। দেহুমনে এই পিরিত কয়দিন থাহে। ল, এহন বৌরে লইয়া খাইয়া ল। এরপর গঞ্জে যা। মেলা কাম জমছে। তোর কাম তোরই করতে অইব। শুনলাম তোর মামা খালারাও আইব কাইলকা। জমির জব্বইরাও আইব। কিন্তু ওরাতো আর তোর কাম করব না।”

“দূর দূর,দূর। কী কও এইসব। আমি দুলাল কারো আশা করি না। বাপের পোলা অইলেই হেয় আমার ভাই অয় না তা আমি মেলা আগেই বুঝছি। চিন্তা কইর না। বেবাগ কাম আমি সাইরালামু। শুধু একটু সময় দেও।”

” ল, দিলাম অহন খা। আমরা যাই। মুরুব্বিগো রাগ ভাংগাই পরে কুসুমরে পাডামুনে বৌরে নিয়া যাইতে আমগো হিস্যায়। তুই নিশ্চিন্ত মনে কামে যা। ”

বলে আর বসলেন না তারা। ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এবার শবনম উঠে থালা জগ গ্লাস গুছিয়ে খাবার বেরে দুলালের সামনে দিয়ে বলল
“বাইচ্যা গেছেন, আপনে আমার লগে আপনের বাবার সামনে যান নাই।”

” ক্যা, কী অইছে বৌ?”

” আপনেরে পাইলে বাবায় বাশের কঞ্চি দিয়া পিডাইত।” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।

” হা হা হা, ওডি বাবায় মুখেই কয় অহন আর পিডায় না। তয় কতাডা শুইন্যা তুমি মজা পাইছো মনে অয়?”

” না মানে, মনে হইল বাবায় কঞ্চি হাতে আপনের পেছনে দৌড়াইতাছে, আর আপনে —-”

” আর মনে করায় দিও না বৌ, হেইদিনগুলিরে ভুলতে চাই। বহুত কানদাইছে ওই জমিরারা। যেমন কানদাইছে ওর মায় তেমন ওরা। জীবনও হেই কষ্টের দাবি ছাড়ুম না। আল্লাহর দরবারে সব জমা রাখছি। বাবায় আগে বুঝত না, সত্য মিথ্যাও খোঁজতো না, এমন কঞ্চি দিয়া পিডাইয়া রক্ত বাইর কইরা ফালাইত। তয় আমি কিন্তু দৌড়াইতাম না। জায়গায় দাঁড়াইয়া শুধু কানতাম। মেট্রিক পরীক্ষাডা দিতে চাইছিলাম। নাইনে উঠছিলাম, পরীক্ষার লেইগ্যা টেকা চাইয়া পাই নাই বাপের কাছে। বিশ্বাস করো পরীক্ষাডা দিতে পারলে পাস করতাম। খালার কাছে গিয়া ঢাকায় আরও পড়তাম। কত স্বপ্ন দেখছি কিন্তু তা আর পূরণ অইল না। হুনলাম জমিরা হয় করাচি নাইলে লাহোর যাইব উকালতি পড়তে। অহন বাবার টেকার অভাব অইব না। সব শুনি কিন্তু কিচ্ছু কই না। অহন ঢাকায় পড়তে গেছে কলেজে। অহন টেকা নিয়া কোন চিন্তা নাই তাগো। শুধু আমার বেলায় টেকা আছিল না। অহন আর এইসব নিয়া ভাবি না। যা মন চায় তাই করুক আমার কী? ”
কথাটা শেষ করে শবনমের দিকে তাকাতেই দেখল ওর গাল বেয়ে চোখের পানি টপটপ করে ওর থালাতে পড়ছে। কিছুক্ষণের জন্য দুলাল স্তব্ধ হয়ে গেল।

” ও বৌ, আমার কোন কতায় তুমি এমন কষ্ট পাইলা? তুমি কানতাছো ক্যা?”

” আমি আপনের মাইর খাওনের কতাডা না কইলে আপনে এমন কষ্টের কতাডি মনে করতেন না। আমার লেইগ্যা আপনের মনে আবার অনেক কষ্ট লাগল।”

” দূর বেক্কল, কী কয় এইডা! উলডা মনের জমাইন্যা কষ্ট কিছু কমল তোমারে কইয়া, বুঝছো? বেক্কল বৌডারে আমি কেমনে কী বুঝাই। তুমি অইলা আমার পরশপাথর। তোমার ঘষায় আমার সব দুঃখ সুখে বদলায় যাইব, বুঝছোনি কিছু?”

” পরে বুঝুম অহন আগে খান।”
বলে শবনম ওর কান্নাকে সামলাতে চেষ্টা করতে লাগল। জোরপূর্বক মুখে খিচুড়ি ঢোকাল কিন্তু গলাধঃকরণ করতে পারছিল না। দুলালের কষ্টগুলো ধীরে ধীরে ওর ভেতরটাকে এলোমেলো করে দিল।

দুলাল গঞ্জে যাওয়ার পরপরই কুসুম এসে শবনমকে নিয়ে গেল ওদের ঘরে। ওখানে গিয়ে শবনমের মনটা ভালো হয়ে গেল। নিজের বাড়ির মতন এখানে প্রতিটা ঘর মিলেমিশে আছে। এক ঘরে রান্না আরেক ঘরে চলে যাচ্ছে বাটিতে করে। তিন চাচিআম্মার সাথে পরিচয় হতেই বুঝল তারা সবাই খুব ভালো। ছোট চাচি আম্মা শবনমদের বাড়ির গল্প করছিলেন বেশ কৃতজ্ঞতার সাথে। তাদের কোন এক অসময়ে শবনমের বাপ চাচারা তাদেরকে অনেক সাহায্য করেছিল। এসব শুনতে শবনমের খুব ভালো লাগছিল। সমবয়সী ননদ পেল দুই তিনজন। ওদের সাথে পুকুর ঘাট চিনে নিল। দুপুরে খাওয়া সেরে বানু ভাবির ঘরে গিয়ে বসল। কথায় কথায় জানল বানুর স্বামীর কুচরিত্রের কথা। দুলালের কয়েক বছরের বড় শাহ আলম। বরিশালে ব্যাবসা করে। সেখানেই এক বিয়ে করেছে কিন্তু তা বাড়ির কেউ জানে না। এখানে এসে বানুকে বিয়ে করে আবার চলে গেছে বরিশাল। এখন মাঝেমধ্যে এসে দুই একদিন থেকে চলে যায় আবার বরিশাল। এই কাহিনী শুনে শবনমের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুঝল বানু কেন তখন ওই কথাগুলো বলেছিল।
গল্পে গল্পে দিনটা কাটল ভালোই ।

সন্ধ্যার পর উঠানে কয়েকটা হ্যাজেক লাইট জ্বালানো হল। একটা খাসি আর মাথায় চাঙ্গাড়ি ভরে বাজার নিয়ে এল কয়েকটা ছেলে। কতগুলো বাশ সামিয়ানার কাপড়ও এল বিয়ের গেইট বাধার লোকসমেত। বড় চাচিআম্মা উচু জলচকিতে বসে সব কিছুই বুঝে নিচ্ছিলেন এমন সময় শবনমকে বানুর ঘর থেকে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বের হতে দেখে বললেন,
“বাড়িত এহন জব্বইরা আছে, অহন আর একলা ঘরে গিয়ে বিপদ ডাকনের দরকার নাই। দুলাল আইয়াই লইয়া যাইবনে। বেশি ঘুমে ধরলে গিয়া আমার ঘরে ঘুমায় পড়। ”

তার কথায় বেশ দুর্গন্ধ টের পেল কিন্তু এই মুহুর্তে সেসব নিয়ে ভাবতে চাইল না। শবনম এদিক ওদিক চোখ বোলালো কিন্তু কোথাও দুলালকে দেখল না।

“খুইজ্যা লাভ নাই, তোর নাগর অহনও ফিরে নাই।”
বানুর কথায় লজ্জা পেয়ে শবনম মাথা নামাল।
চোখজোড়া ঘুমে ডুবে যাচ্ছিল তাই চাচির ঘরে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়ল।

রাতে দুলাল বাড়ি ফেরার পর শবনমকে ঘরে না পেয়ে চাচির ঘরে গিয়ে দেখল শবনম ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর ওকে ডাকল না। নিজেই সব কাজের তদারকি করে রাতে চাচির ঘরেই খেয়ে শবনমকে তুলে ঘরে নিয়ে ফিরল।

সকালে ঘুম ভাঙতেই শবনম টের পেল ওর প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পাশে দুলাল ওকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে কখন নিজের ঘরে এসেছিল তাই ওর মনে নেই।

চাপকল চেপে এক কলসি পানি নিয়ে শবনম ঘরে ঢুকল। আর তখনই দুলাল ওর হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে একমুঠো লাল রেশমি চুড়ি দিল।
শবনমের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল খুশিতে। কিছু বলার আগেই এক ঠোঙা মুরলী ভাজাও গছিয়ে দিল আরেক হাতে।
“রাইতে ঘুমায় গেছিলা বৌ, তাই দিতে পারি নাই। অহন খাও।”

“আপনে আমার হাতের মাপ পাইলেন কই। চুড়িতো সুন্দর লাগছে। একটু বড়ও না আবার ছোটও না।” চুড়িগুলো হাতে পরে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল।

“আইজকা তোমগো বাড়ি যাইবা? মনডা কী হের লেইগ্যা এত খুশিনি?”

শবনমের মনটা হঠাৎ করেই মলিন হয়ে গেল। কেমন এক অভিমান বাসা বাঁধল মনে,
এই চুড়ি পেয়ে যে ও খুশি হয়েছে তা দুলাল বুঝল না কেন? উলটো ওর খুশিকে বাড়ি যাওয়ার আনন্দ মনে করায় কষ্টটা একেবারে বুকে গিয়ে বিধল। অথচ ওর বাড়ি যাওয়ার কথাটাই মনে ছিল না এতক্ষণ ।

“কী হইল পূর্নিমার আলো হঠাৎ নিভ্যা অমাবস্যা হইয়া গেলোগা ক্যা? যাইবাতো! আজকা তোমগো বাড়িতই যাইবা। বাইন্ধা রাখুম না। অহন একটু হাসো।”

“আমি কী কইছি আমগো বাড়িতে যাওনের লেইগ্যা আমার মন কান্দে?”

“ও আল্লাহ, বৌতো গোস্যও করতে জানে দেহি!”
কথাটা বলেই হা হা হা করে হেসে উঠল দুলাল।
ওর হাসি দেখে শবনম কেঁদে ফেলল আর দুলাল তখন ওকে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আদর করতে লাগল।

সকাল থেকে খান বাড়িতে মেহমান আসতে শুরু করল। চাচাতো ননদরা, ভাবিরা এসে শবনমের ঘর ভরে গেল আর দুলাল সেই যে সকালে বের হয়েছে ঘর থেকে আর ওর চেহারা দেখা গেল না। সকালে খাসি জবাই হল, সেই খবরও শবনম ঘর থেকেই পেল। এর মধ্যে দুলালের সৎবোনেরা ওর ঘরে এসে একবার দেখে নিল শবনমের বাড়ি থেকে কী কী দিয়েছে। সেসব নিয়েও নানান মন্তব্য করল কিন্তু শবনম সেসব কথা গায়ে মাখল না কারন দুলাল আগেই মানা করেছিল রাগ করতে।

বেলা বাড়তেই এল দুলালের খালা মামারা। খালারা এসেই সরাসরি ঢুকল দুলালের ঘরে। মেহমানদের বসার জন্য বাহিরে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে বড় করে। ওখানেই এসে জমছে মেহমান তাদের সাথেই বসল মামারা।
খালাদের পরিচয় পেয়েই শবনম সবাইকে কদমবুসি করল। বড় খালা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার সাথে সুর মেলালো অন্য বোনেরাও। শবনম কিছুই বুঝতে পারল না। কান্না শেষ করে ওকে পাশে বসিয়ে বড় খালা ওর গলায় একটা সোনার চেইন পড়িয়ে দিয়ে বললেন
“আমার বইনে বাইচ্যা থাকলে দেখতা তোমার কত কদর অইত, এমন পুরান জরাজীর্ণ ঘরে থাকতে অইত না। আমগো দুলালরে দিনেরাইতে এত বঞ্চিত কইরা কী ওই হারামিরা সুখী অইতে পারব? কোনোদিনও পারব না। আল্লাহর বিচার আছে, হেই বিচার থেইক্যা কেউ বাঁচতে পারব না।”

“থাক আপা এখন আর এই সব কথা তুইল না। আজকে একটা অনুষ্ঠান, তাও দুলালের। শুভ শুভ অনুষ্ঠানটা হইতে দাও। ওই অমানুষগুলি শুনলে আবার গেঞ্জাম লাগাবে।”

“তুই চাইলি দুলালরে ঢাকায় নিয়া পড়াইতে, তাওতো হারামির বাচ্চারা দিল না। আজরাইলে দুলামিয়ার কান ভারি করল তুই বলে নিয়া দুলালরে তোর ঘরের কামলা বানাবি।”

“আহা! বাদ দাও না বড় আপা, নতুন বৌয়ের মুখ দেখে বল কেমন লাগল? আমার কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। কী মিষ্টি একটা মুখ যেন মায়ায় ভরা।”

“হ ঠিকই কইছোস, বৌ মাশা আল্লাহ খুব সুন্দর অইছে, আমার মনে ধরছে। বৌ হুনো আমগো দুলাল কিন্তু অনেক ভালো পোলা। তুমি ওরে সুখে রাইখ্যা। তোমার বাপ-মায়ের কপাল ভালো যে এমন জামাই পাইছে, তারা পাক্কা জহুরি, ঠিক রত্নডাই চিনছে।”
শবনম চুপ করে শুনছে তাদের কথাগুলো, কেনজানি ওর খুব ভালো লাগছিল তাদের এমন মায়াময় ব্যবহারে।

জোহরের নামাজের পর এল শবনমের বাড়ি থেকে মেহমান। দুলালের খালারাই শরবত পিঠা যা তারা বাড়ি থেকে বানিয়ে এনেছিল সেসব সাজিয়ে সবাইকে পরিবেশন করল। শবনমের ভাই বোনগুলো দৌড়ে চলে এল শবনমের কাছে। বোনকে দেখে জোরে এক চিৎকার দিয়ে উঠল
“ওরে বুবু! তোরেতো এক্কেবারে রাজরানীর মতো লাগতাছে। এত্ত সুন্দর কইরা সাজছোস কেমনে?”

“ছোট খালায় সাজায়ছে। এগুলাও খালায় ঢাকা থেইক্যা আমার লেইগ্যা লইয়া আইছে।” বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

“ও আল্লাহ বুবু! তুইত দেহি ভালোই সুখে আছোস, কেমনে বেটকাইয়া হাসতাছোস। আর ওই দিকে মায় দাদি দিনরাত কাইন্দা কাইন্দা আমগো কান পঁচাইতাছে। অইলডা কী কাম?”

“মায় অনেক কানছে নারে শিউলী? ”

“হ, এহনও কানতাছে। মায়েরে কারা জানি কইছে তোর সৎ শাশুড়ি ননদরা একটুও বলে ভালো না।”

“হ আছাই কইছে। থাক, এইসব লইয়া এহন আর কতা কইস না। হেরা শুনলে কাইজ্যা লাগায় দিব।”
শবনম ওর ভাইবোনদের সতর্ক করে দিল ঝামেলার ভয়ে।

খাওয়া দাওয়া পর মুরুব্বিরা সব সামিয়ানার নিচে বসে আলাপচারিতা একটা সময় দেখল জহির ওর বাবারে কোলে নিয়ে বাহিরে এনে নিদিষ্ট কেঁদারায় আধশোয়া করে বসাল।
শবনমের বাবা চাচারা তাকে কাছে পেয়ে বেশ খুশি হল। তারা ইচ্ছে করেই দুলালের বাবার সাথে দেখা করতে ও ঘরে যান নাই। এখন বেয়াই বাহিরে আসায় তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎটা সম্ভব হল।

“আসসালামু আলাইকুম বেয়াই, শরীরডা ভালোনি?” শবনমের বাবা প্রশ্নটা করল।

“ওয়ালাইকুম আস সালাম, বিয়াই, আমার খবরডা কে নেয়? নিজের পোলাই নেয় না আর তার শ্বশুর বাড়ির কুটুমরা নিব তা আশা করি কেমনে? তাই নিজেই জোর কইরা বাইরে আইলাম।”

“হ, বিয়াই আইয়া ভালো করছেন। আপনে পঁচা শামুকে পাও কাঁটছেন, অহন আবার আমগোরও কাডাইতে চান?” বলে শবনমের ছোট চাচা হা হা হা করে হেসে উঠলেন।

“নাগো বিয়াই, অমন স্পর্ধা আমার নাই যে সৈয়দগো ভুল পথ দেহামু। ”

সামনে দাঁড়ানো জমির আর জব্বর রাগে গজগজ করতে লাগল ওর মায়ের জাত নিয়ে যে কটাক্ষ করা হল তা বুঝতে আর ওদের বাকি রইল না। নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে সামনে এগিয়ে এসে জমির বলল
“কাকা, আপনেতো ঢাকাতেই চাকরি করেন? আমিও ঢাকায় কলেজে পড়তাছি, ভাবতাছি এরপর করাচি বা লাহোর যামু ল’ পড়তে।”

“কস কী জমির? লাহোর, করাচি যাবি ক্যা? ঢাকায় থাকোস আর এই গরম খবর শুনোস নাই? গেল মাসে যে ছয়দফা পেশ করল তাতেতো লাহোরে আগুন লাগছে। আইয়ুব খান ডরাইছে। লাহোরের আগুনের তাপ করাচি ক্যা পুরা পশ্চিমে ছড়ায় গেছে। ঢাকায় বইয়াতো আমরা হেই তাপ পাই, তুই পাস না?”

“ধূর কাকা, এইসব ছয়দফা নয়দফা দিয়া মুজিব কিছুই করতে পারব না। এইসব নিয়া আমি ভাবি না। আমি যামু পড়তে, পইড়া সার্টিফিকেট নিমু।”

“ঢাকার থেইক্যা নেওন যায় না ব্যাডা? এত টেকা বেশিনি তোর বাপের?”

“কাকা, ঢাকারডার চেয়ে করাচির সার্টিফিকেটের ওজন বেশি, কদর বেশি।”

“আহম্মকডা কয় কী? বিয়াই এমন আহম্মকরে কেমনে জন্ম দিলেন? ব্যাডা জ্ঞান বুদ্ধি কী সের দরে বেইচ্যা খাইছোস? কতা যা কস তা হুশ কইরা কইস। নাইলে থাবরা একটাও মাডিতে পরব না। আমারে আইছোস ওজন শিগাইতে। বেশি ফাল পাড়িস না। বিপদে পড়বি। জানোসতো পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।”

জমির আর কোন কথা বলতে পারল না। তার আগেই দুলালের বাবা বলে উঠলেন
“বিয়াই এই পোলাপানগুলি বড় স্বার্থপর, নিজের ভালোমন্দ ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝে না। আপনে জ্ঞানী মানুষ, আপনে যহন কইছেন তহন ও ঢাকাতেই পড়ব। কে দিব ওরে অত টেকা। টেকা কী গাছে ধরেনি যে ঝাকি দিলেই ঝুরঝুরাইয়া পড়ব। গাঙগের স্রোতের মত টেকা নিয়া ঢাকায় উড়াইতাছে। আমি পইড়া রইছি বিছনায়, দেহার কেউ নাই। কী করুম সবই কপাল আমার।”

কথা আর বাড়ল না। শবনমের বাবা দুলালের বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মেয়ে আর মেয়ের জামাই সাথে করে বেলা থাকতেই বেড়িয়ে পড়লেন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

চলবে

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1507744589740563/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here