শবনম( পর্ব ২) সায়লা সুলতানা লাকী

0
280

#শবনম( পর্ব ২)
সায়লা সুলতানা লাকী

শবনম নতুন বালিশে শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল না। ওর অভ্যাস নরম তুলতুলা পাতলা বালিশে শোয়া, সেখানে দেওয়া হয়েছে নতুন তুলায় ঠাসা একটা বালিশ যা বেশ ফুলে আছে। তার উপর গায়ে জড়িয়ে আছে এক মালা শাড়ি, এর জড়িগুলো খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল কিন্তু তাও প্রকাশ করতে পারছিল না। গলার জড়ির মালাটা খুলেছিল গহনাগুলো খোলার সময় তাতেই রক্ষা নয়ত আর বিছানায় শোয়া যেত না। মায়ের হাতের সেলাই করা ফুল তোলা নতুন কাথাটা দেখেই মায়ের কথা, বাড়ির কথা মনে পড়ল। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আর বাড়ির কথা মনে করার ফুরসতই পায় নাই। মায়ের কথা মনে হতেই চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠল। বিদায় বেলায় ওর মা বেহুশের মতো কাঁদতে ছিল। শবনম হাজার চেয়েও ওর মায়ের বুকে থাকতে পারল না। সবাই জোর করে তুলে দিল পালকীতে। চোখের পানি কখন গাল বেয়ে পড়ল তা আর টের পেল না। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল দুলাল একটা হাত পাখা দিয়ে ওকে বাতাস করছে।
মানুষটাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। বান্ধবী যাদের ফোর ফাইভে বিয়ে হয়ে গেছে ওরা বাড়ি এলেই শবনম যেত দেখা করতে। ওদের মুখে যা শুনেছে বিয়ে আর বর সম্পর্কে তার কোনটার সাথেই যেন মিল খুঁজে পেল না। নিজের চোখের পানি মুছতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল দুলালের কাছে।

“কি গো বৌ তুমি কানতাছো ক্যা? ওও বুঝছি বাড়ির কতা মনে পড়ছে? মায়ের কতা? শুনো, আমার সাফ কতা, আমি আমার মায়ের আদর থেইক্যা বঞ্চিত আছিলাম ভাইগ্য দোষে। কিন্তু তোমারে বঞ্চিত হইতে দিমু না। তোমার যহন মন চাইব তুমি যাইবাগা তোমার মায়ের কাছে। এই বাড়ির কে কী কইল তা কানেই তুলবা না। তোমার না আছে শাশুড়ি, না আছে ননদ ননাস। কার কতা গায়ে মাখবা? কারোডাই না। নিজের ভালোমন্দ নিজে বুইজ্যা চলবা। বড় ঘরের মাইয়াতো বাবায় এই লেইগ্যাই বাইছ্যা আনছে যাতে এগো লগে যুদ্ধ কইরা চলতে পারে। জানোতো বৌ এই দুইন্যাডা হইল শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তুমি কইলাম নরম অইয়া থাইকো না এগো সামনে। তাইলে এরা তোমারে কামে লাগাইব, বান্দি বানাইব।”

“হইছে, এইবার পাঙ্খা আমারে দেন। আমি বাতাস করি।”

“ইশশ কয় কী আমার নয়া বৌ। আইজই আমারে সেবা করতে মন চায় তোমার? থাউক, আইজ না, আজকা আমিই করি। আমার যে কী আনন্দ লাগতাছে বৌ তোমারে তা কেমনে বুঝাই। এতকাল আমি একলা একলাই গপসপ করছি নিজের লগে , শুননের কেউ আছিল না। আজকা আমার পাশে তুমি আছো। কী সুন্দর কইরা আবার হাসতাছো, মনডায় কয় সাক্ষাৎ চান্দের আলো টিনের ফুডা দিয়া ঢুইক্যা পড়ছে আমার ঘরে। ”

“হিহিহি কি কন এইসব?”

“হ বৌ সত্য কই, তুমি এক্কেবারে চান্দের মত চমকায়তাছো আমার আন্দার জীবনে ঢুইক্যা। একটুও মিথ্যা কই না। ”
কথাটা শেষ করেই দুলাল শবনমের কপালে একটা চুমু খেল। শবনম লজ্জায় নুয়ে পড়ল। কিন্তু বান্ধবীদের শেখানো মতো ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল না। দুলালকে কেন জানি ওর সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। মনে হল মানুষটা বড় ভালো, বড় আপন, একেবারে নিজের একজন। আস্তে আস্তে ও বন্দি হল দুলালের বাহুডোরে।

****
“বৌ আমি জানি তোমার এই শাড়ি পইরা চলন ফিরনে অনেক কষ্ট অইব। কিন্তু অহনতো তোমার এইগুলাই পরতে অইব। পরথম পরথম একটু কষ্ট অইব,কয়দিন গেলে পরে অভ্যাস অইয়া যাইব। তয় আমি তোমারে একটা বুদ্ধি দেই–”
শবনমকে নতুন কাপড় পড়তে সাহায্য করতে গিয়ে বলল দুলাল।

“কী বুদ্ধি? ”

“তুমি কাপড়ডা একটু উঁচায় উডাইয়া পরো তাইলে আর পায়ে বাইজ্যা পরনের ডর থাকব না।”

“হিহিহি আপনেরতো মেলা বুদ্ধি! উঁচা কইরা কাপড় পরে বাইদ্যানীরা। আমি কী বাইদ্যানি?”

“ওরে আল্লাহ, আমার বৌতো ভালো কতা জানে, তুমি আমার বৌ, বাইদ্যানী অইবা ক্যা? ”

“অইছে, এহন কন সকালের রান্দনের ব্যবস্থা কী?
এই ঘরেই কী সবসময় রান্দেন আপনে?”

“একলা মানুষ আছিলাম, এই কেরোসিনের স্টোভেই রানতাম। আর কিছুতো আমার নাই।”

“হিহিহি, তাইলে এহনও আপনেই রানদেন। আমি এই চুলায় রান্দি নাই কোনসময়।”

“আহো আজকা আমি তোমারে শিখাই কেমনে রানতে হয়। এই উসিলায় তোমারে কাছে পামু আরও কিছু সময়।”

শবনম দুলালের কথায় একটু লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিল কিন্তু কথা আর বাড়ল না দুজন থেমে গেল দরজায় ধাক্কা শুনে-
“কিরে দুলাল এত বেলা কইরা ঘরের দুয়ার দিয়া রাখলে চলব কেমনে? উঠ দুয়ার খোল।”
চাচতো ভাবির ডাকে এবার দরজা খুলে দেয় দুলাল। শবনম নতুন কাপড়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে লোহাকাঠের কারুকাজ করা পুরাতন বড় পালঙ্কে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে যে ঘরে ঢুকেছে তার দিকে।

“হায় হায় নতুন বৌ এমন ড্যাবড্যাবাইয়া তাকায় আছো ক্যা? জামাইয়ের লগে রঙঢঙ করলে কী আর পেট ভরব? খাওন লাগব না?—”
কথাটা শেষ করতে পারল না ঘরের কোনাটা ভেজা দেখেই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল ভাবি

“কি সর্বনাশ দুলাল, এইডা করছোস কী? তোর বৌরে ঘরের মধ্যেই গোসল দিছোস? ও আল্লাহ, তুইতো পুরাই ডুইব্যা গেছোস বৌয়ের মন্ত্রে। বৌ ভেউরা বেডা হইছোস এক রাইতেই? ওগো ভালা মাইনষের ঝি, আমগোও একটু শিগায় দেও, কেমনে জামাইরে ভেউরা বানাইতে অয়।”

শবনম লজ্জায় একেবারে মাথা নুইয়ে রাখল হাঁটুর উপর। কী জবাব দিবে তা বুঝল না।

“ভাবিসাব এইডা তুমি ঠিক কইলা না, ও পুলাপান মানুষ ও কী শিখাইব তোমারে, তুমিই বরং ওরে সংসার করন শিখায় দেও। আমারতো আর মা বইন কেউ নেই, কে শিখাইব ওরে এইসব।”

“হ তোর বৌতো কচি খুকি, নাক টিপলে দুধ পড়ে যে হেরে আমি শিগাইমু। আমরা বাড়ির হগ্যল বৌ ঝিয়েরা ঘাটে গিয়া গোসল দিতে পারি আর তোর বৌয়ের লেইগ্যা ঘরের ভেতরে পানি টানন লাগে, আহ্লাদের আর সীমা রইল না।”

“আরে তুমি এত চিল্লাইতাছো ক্যা? দেহো না ও শরম পাইতাছে।”

“হ জামাইয়ের লগে শুইতে শরম করে নাই আর আমার কতা শুনতে শরম করে তোর বৌয়ের। ”

“জামাইয়ের লগে শুইব না তয় কার লগে শুইব তুমি তাইলে তা কইয়া দেও”।

“দুলালের বৌ কইগো? তোমারে তোমার শ্বশুর খোঁজ করে- -”
ঘরের বাহির থেকে দুলালের আরেক চাচির চিৎকার এবার শবনম নড়েচড়ে উঠল। কী করবে তা জানতে দুলালের দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল।
দুলাল হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে শবনমের হাতটা ধরে বলল
“চল বৌ আমিই তোমার লগে যাই। তুমি একলা চিনবা না পথঘাট ।”

“ওরে কী পিরিতরে! হইছে, এইবার ক্ষান্ত দে। শোন দুলাল, তোর যাওন লাগব না। থু, এ চিন্তা বাদ দে ভাই, কাইলকা একটা অনুষ্ঠান আছে বাড়িতে, হুদাই গেঞ্জাম লাগাইছ না। তোরই অশান্তি হইব। তোরই শ্বশুরবাড়ির লোকজন আইব। হুদাই কামে ভেজালে পড়িস না। তুই থাক আমিই তোর পিরিত লইয়া চাচারে দেহায় আনি।”

শবনম স্তব্ধ হয়ে গেল ভাবির কথায়। এতক্ষণ ওনাকে শত্রু বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু এখন আর তেমন মনে হচ্ছে না। কেমন এক আজব ঘটনা বলে মনে হল সবটা।

“ভালো কতা কইছো, যাও তাইলে তুমিই যাও। আমি ভাত চড়াই চুলায়।”

“কয় কী নয়া দুলায়? তোর রানদন লাগব না। মেঝু চাচি খিচুড়ি রানতাছে নতুন বৌয়ের লেইগ্যা। তুই বরং ঘর মুছ, ঘর। বৌয়ের গোসলের পানি মুছ।” কথাটা শেষ করেই খিলখিল করে হেসে উঠল ভাবি এর পর শবনমকে নিয়ে বের হয়ে গেল।

শ্বশুরের ঘরটা বেশ বড়। দোতলা ঘর। বাহির থেকে
দেখতে অনেকটা জমিদার বাড়ির মতো লাগে। দুলালের ঘর থেকে বের হয়ে মাঝের বড় উঠান পেরুতে হয় ওই ঘরে যেতে। রাতে এতটা দুরত্ব বোঝা যায়নি। শবনমের হাতটা হেঁচকা টেনে সামনে এনে ভাবি ফিসফিস করে বলল

“শোন শবনম, ওইহানে যাওনের পর চাচি আম্মা অনেক আকতা কুকতা কইব, তুই কিন্তু জবাব দিবি না। তোর তিন ননদ ননাসও আইছে বিয়ানবেলা৷ হেরাও হেসেডেসে কতা কইব তুই চুপ থাকবি। তারা যেন কোন কাইজ্যাকীর্তন লাগাইতে না পারে। এইডা মাতায় রাখবি।”

শবনম ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল আর প্রতিটা কথা সযতনে গলাধঃকরণ করে ভাবির পেছন পেছন খুব আস্তে ধীরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল।

“এই লন চাচাজান আপনের দুলালের বৌ। কী কইবেন জলদি কন, নয়া বৌ এহনও কিছু খায় নাই। হেরে মাইঝ্যা চাচি আম্মার ঘরে লইয়া যামু।”
শবনম মাথা নিচু করে শ্বশুরের সামনে দাঁড়াল।

“আরে মাইয়া শ্বশুররে সালাম কর, এইডা কইয়া দিতে অইব?” ভাবি ফিসফিস করে বলল।

“আসসালামু আলাইকুম,”
ওয়ালাইকুমুস সালাম।
“কেমন আছো বৌ?”
“জি ভালো,আপনের শরীরডা ভালো?” শবনম খুব আস্তে করে বলল।

“ও আল্লাহ, খানদানি মাইয়া দেহি আদব কায়দাই জানে না। শ্বশুররে যে পায়ে ধইরা সালাম করন লাগে তাইতো শিগে নাই। হায় হায় হায়! এমন খানদান ধুইয়া পানি খাইবনি মানুষ? ওমা এইডা কী করছো? নিজের না হোক সতিনের পোলা হইলেও তারে তুমি এমন বেদ্দবের লগে বিয়া দিলা কী বুইজ্যা?” তাসলিমা শবনমের ছোট ননদ চিৎকার করে বলে উঠল।

“বিয়া কী আমি দিছিনি? দিছে তোর বাপে? আমারে একবার জিগায়ও নাই। যা করে আল্লাহ ভালোই করে। যেমনডার ঘরে হেমনডাই মিলছে। দুলাইল্লা কোন জায়গার আদব তমিজ রাখে? বাদ দে ওগোডা ওরাই বুঝক, আমগো কী? দুলাইল্লার কপালে যে বৌ জুটছে তাই দেইখ্যা আমি টাশকি খাই , হের আবার এত বাছ বিচার কী?”

শবনমের কান গরম হয়ে উঠল কিন্তু বুঝল এখন কিছুই বলা যাবে না।

“আহা জমিরের মা, তুমি দিন শুরু হইতেই শুরু করলা? একটু থামো। বৌডা ঘরে আইল ওরে কিছু খাইতে দেও, শুনলা না এহনও কিছু খায় নাই বৌ। রাইতেও কিছু দিলা না। এমন পাষান হও কেমনে?”

“হ, আমিতো পাষানই, আর আপনের পোলায় অইল দয়াবান। আমগো কিসমতের খাওন এতিমখানায় আর গোরস্তানের ফকিরগো খাওয়ায় আইছে, নিজের মায়ের কব্বরে ছোয়াব ঢাইল্যা দিয়া আইছো। আপনের পোলার মত দিলদরিয়াতো আর আমরা না।”

“দুলাইল্যা হারামজাদায় এহন কই? শইল্যে জোর থাকলে এহন উইঠ্যা দুইডা দিতাম বাড়ি জংলার কাঁচা বাশের কঞ্চি দিয়া। হারামী আমারে জ্বালাইয়া এক্কেরে ভাজা ভাজা করল। এইডা এমন ঘাউড়ামি কইত্তে যে পাইল, বুঝলাম না। ওর মায়তো এমন আছিল না। এক্কেরে মাডির মানুষ আছিল।”

“আহ্হারে পিরিতরে, মইরা ভুত অইয়া গেছে তারপরও হের লেইগ্যা আপনের পিরিত কমে না। আর যত দোষ আমার খুইজ্যা বাইর করেন।”

“আরে তুমি আবার নতুন বৌয়ের সামনে কী শুরু করলা?”

ভাবি অবস্থার বেগতিক দেখে শবনমের হাত ধরে টেনে বাহিরে চলে এল, শুধু বলল
“চাচাজান এহন যাই, আমার মেলা কাম পইড়া রইছে, বৌরে মাইঝ্যা চাচির ঘরে দিয়া নিজের কামে যাই।”

ঘরের বাহিরে এসে যেন শবনমের জান বাঁচল। স্বস্তিতে একটু দম ছাড়ল আর তা দেখে ভাবি ফিক করে হেসে উঠল
“কি ডরাইছোস? চাচি আম্মার কামই হইল ফুরুৎ কইরা চেইত্যা উডা। অহন চাচাজানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করব তাই তোরে লইয়া সইরা পড়লাম। ডরাইস না, এইডাই জীবন, আমগো মাইয়াগো জীবন। এক ঘাট থেইক্যা আরেক ঘাটে নাও ভিড়াইলেও মাঝি ঘাটটা ভালোমতো দেইখ্যা লয়, কিন্তু আমগো এমনই কপাল বাপ মায় তাগো কোল ছাড়াইয়া আরেক ঘরে দেওনের আগে একটু জোগজিগ্যাসও করে না। যেমনে পারে অমনে ধইরাই তুইল্যা দেয়। আমগো মাইয়াগো জীবনের দামডা নিজের ঘরের বাপ মায়ে ঠিক মতো দেয় না আর পরের বাড়ি দিব হেইডা আশা করনডাই পাপ।”
কথাটা শেষ করে ভাবি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
শবনম কিছুই বুঝল না শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকায় রইল। আর ভাবল ওর বাবায়তো ভালোমন্দ খোঁজ খবর নিয়াই ওরে বিয়ে দিছে তাইলে ভাবি এ কতা কইল ক্যা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here