শবনম (পর্ব ১)

0
691

#শবনম (পর্ব ১)
সায়লা সুলতানা লাকী

শবনম বৌ বেশে বসে আছে সেই বিকেল থেকেই এখনও কেউ বলে দিচ্ছে না কোন ঘরে থাকবে ও। ঠিক এখন যে ঘরটায় বসে আছে সেইটা ওর শ্বশুরের। অসুস্থ শ্বশুরের পাশে এনে বসিয়েছে ওকে। তার অনেক খায়েশ ছিল মনে, মা মরা তার এই বড় ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে যাওয়ার। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যখন আবার বিয়ে করেছিলেন তিনি তখন তার আবার আরেকটা সংসার হয়েছে ঠিকই কিন্তু মা মরা ছেলেটার কপালে আর দ্বিতীয়বার মা জুটেনি। চোখের সামনেই একা একাই কাটিয়ে দিল বিশটা বছর। এখন ছেলের একজন সঙ্গী দরকার এটা খুব ভালো বোঝেন খান সাহেব। তাইতো চারপাশে ঘটক লাগিয়ে এই শবনমকে খুঁজে বের করেছেন ছেলের বৌ করার জন্য। খানদানি ঘরের মেয়ে শবনম, বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছে, বিয়ের বয়সটা নেহাৎ কম না। ফাইভের থেকেই বিয়ের ঘর আসতে শুরু করেছিল কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে আর বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি ওই সম্বন্ধগুলো। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বলে গ্রামেও বেশ নাম ডাক রয়েছে ওর।
আজ এখানে বসেও বুঝতে পারল ওর খানদানের ওজনটা কত। যে আসছে সেই ওর মুখটা দেখে এক বাক্যে বলে যাচ্ছে “জাতের মাইয়া কালাও ভালো, নদীর জল ঘোলাও ভালো।”
ওর জাত যে ভালো তাতে ওর কোন সন্দেহ নাই কিন্তু ওর গায়ের রং যে কালো এতে বরং ওর সন্দেহ হচ্ছে। এর আগে কেউই বলেনি যে শবনম তুই কালো। অন্য দুই বোনের মত অত ধবধবে সাদা অবশ্য ও না তবে একদম কালোও না।
কিন্তু এখানে এসে নিজের গায়ের রংকে নতুন করে আবিস্কার করল কালো বলে।
শ্বশুর একবার গলা খেঁকালী দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন, বলেছিলেন “কালো দেখছো কোথায় তোমরা, মা আমার উজ্জ্বল শ্যামল বরন। মায়ের চেহারার কাটিং দেখছো তোমরা? কত্ত সুন্দর বৌ পাইছে আমার দুলাল। সবই ওর মায়ের দোয়া। ওর মা কবরে শুইয়া শুইয়া কেবল পোলার লেইগ্যা দোয়া করে। তাইতো আমার দুলাল এই বয়সে এত ভালো কারবার জোয়াইছে। এহন আলা বৌ ভাগ্যে আরও আগায় নিব ইন শাহ আল্লাহ। ”

“হ, এহন তোমার পোলায় বৌ ভাগ্যে স্বর্গে উঠব। সারাক্ষনতো আছো শুধু দুলালরে লইয়াই। তোমার যে আরও তিনডা পোলা আছে তাগো নামডি জানোনি তুমি? যত্তসব আদিখ্যেতা। এইসব আর সহ্য হয় না। এগুলা দেখতে দেখতে বুড়া হইলাম।”
রাগে গজগজ করতে করতে খান সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা পানের বাটা নিয়া বসল পাটির উপর।

“আহা! জমিরের মা, তুমি আবার অহন পান লইয়া বইলা ক্যা? নতুন বৌরে খাওন দাও। ওরে দুলালের ঘরে দিয়া আহো কেউ? ও কতক্ষণ আর এমনে বইয়া থাকব?”

“আপনের যহন এত দরদ তহন আপনেই খাওন দেন, আর আপনেই দুলালের ঘরে নিয়া দিয়া আহেন। আমারে কন ক্যা?”

“আরে রাগ করো ক্যা? আমি কী দরদ দেহাইলাম? নতুন আইছে মাইয়াডা, ওর বাপ মায় জানলে মান ইজ্জত থাকব না। তুমি বিষয়ডা বুঝলা না।”

“হইছে হইছে আর বুঝানের দরকার নাই। খানদানি ঘর দেইখ্যাই এমন কালা মাইয়া গছায় দিতে পারছে আপনেরে। তয় দুলাল দেইখ্যা আর কতা কই নাই, তয় বিষয়ডা যদি আমার পোলাগো অইত তাইলে আর চুপ থাকতাম না। ওই খানদানের আর ডর দেহাইয়েন না আমারে।”

শবনম চুপচাপ বসে শ্বশুর শাশুড়ির কথপোকথন শুনছিল। শ্বশুরের জন্য বড্ড বেশি মায়া জন্মাচ্ছিল মনে। বুঝে গেল তিনি কতটা অসহায় অবস্থায় আছেন এই সংসারে।

“ও ভাবিসাব দুলালতো ওর ঘরের দুয়ারের সামনে দাঁড়ায় আছে, দেও ওর বৌরে ওর ঘরে দেও।”
চাচতো জায়ের ডাকে এবার নড়েচড়ে বসেন জমিলা বেগম।

“নিয়া যা, আমি কি কোলে কইরা নিয়া যামুনি? এত জোর নাই যে এমন খানদান কোলে উডামু।”

শবনম এতক্ষণ বেশ মজা নিয়েই এসব উপভোগ করছিল কিন্তু এখন যেই শুনতে পেল ওর বর দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে ওর জন্য। এখন ওকে যেতে হবে তার কাছে, তখনই ভেতরে কেমন এক চাপা উত্তেজনা কাজ করতে লাগল এই স্বামী নামক মানুষটাকে দেখার জন্য। এখনও দেখেনি মানুষটা কেমন, জানেও না তার আচার-আচরণ সম্পর্কে। অথচ বাবা মা কীভাবে হাত পা বেঁধে উঠিয়ে দিল পালকিতে। বাড়ি থেকে বের করে দিল সারা জীবনের জন্য। ওই বাড়ি থেকে এই পর্যন্ত যতজন মেয়ে ওই পালকিতে চড়ে বের হইছে তারা আর কেউ কোনদিন ফেরেনি আপনালয়ে। যে যায় সে সব বাঁধন মনে হয় ছিন্ন করেই যায়। কিন্তু শবনমতো কারে সাথে কোন বাঁধনই ছিন্ন করে আসেনি, তবে কী ও আর কখনও ফিরতে পারবে ওর নিজের আপনালয়ে? এসব আবোলতাবোল ভাবছিল আর তখন একজন এসে ওর হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে নিল।
শবনম একবার মুখ ফোটে বলতে চেয়েছিল “আস্তে টানেন আমিতো শাড়িতে পা বাজাইয়া পইড়া যামু।”
কিন্তু না কেন জানি কিছুই বলতে পারল না। তার আগেই দুলাল এসে পাশে দাঁড়াল
“ভাবিসাব আর কষ্ট করতে হইব না, অহন আমি পারমু। আহো শবনম আহো। তুমি আমার পিছন পিছন আহো। বলেই কুপিটা এগিয়ে ধরে পথ দেখাতে লাগল।
শবনম কী বলবে তা বুঝতে পারল না, শুধু চুপচাপ দুলালের পেছন পেছন হেঁটে এগিয়ে গেল নিজের ঘরে। পাটাতনের দোচলা ঘর, পাশে একটা ছোট বারান্দাও আছে। ঘরে ঢুকে দেখল ঘরটা কাগজের ফুল আর ঝড়ি দিয়ে সাজানো। শবনমের গলায় ঝুলানো জরির মালায় আলো পড়ায় কেমন চিকচিক করছিল তার উপর এখন ঘরটার জরিগুলোও চিকচিক করছে সব মিলে এক অন্য রকম ভালো লাগায় একাকার হল ওর মন।

“তুমি কিছু খাইছো বৌ?”
দুলালের হঠাৎ এমন প্রশ্নে মনে পড়ল শবনমের যে ওর আসলেই অনেক ক্ষুধা লেগেছে। বিয়ের ঝামেলায় আজ বাড়ির কেউ খেয়াল করে নাই যে ওর সকাল থেকেই বিশেষ তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। আর এ বাড়িতে আসার পরও কেউ কিছু খেতে দেয়নি।
কিন্তু দুলালকে নিজের ক্ষুধার কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছে। তাই চুপ করে রইল। শবনমের নিরবতা দেখে দুলাল হেসে উঠল।

“বৌ, এমন চুপ থাকলে অইব না, কতা কওন লাগব। এইহানে আমার কেউ নাই যে তোমার ডাক খোঁজ নিব, নিজেরডা নিজেরই কইরা খাইতে অইব বুঝছো?”

শবনম হ্যা না কিছু বলল না শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকায় রইল দুলালের দিকে।

“তাকায় আছো ক্যা বৌ? শুনতে খারাপ লাগতাছে? লাগলেও কিচ্ছু করনের নাই, এইডাই চরম সত্য। বাপ আর তুমি ছাড়া আমার এই তিনকুলে কেউ নাই। এহন খালিপেডে খিদার কষ্ট না কইরা নেও এইহানে কিছু মিষ্টি আনছিলাম তোমার লেইগ্যা তাই খাও। আমি ততক্ষণে রান্দনের সরঞ্জামাদি গুছাই।”

“আপনে রানবেন?”
এতক্ষণে শবনম মুখ খুলল।

“হ, আমারডা আমিই রাইদা খাই। এক্কেবারে খারাপ হয় না,তয় খুব স্বাদেরও হয় না। ডরাইও না, তুমি মুখে দিতে পারবা।”

“আমারে শিখায় দেন আমি রানদি।”

“রানবাগো বৌ রানবা। রানদনের লেইগ্যা সারাডা জীবন পাইবা। আজকার দিনডা কী আর পাইবা? আজকা তুমি বৌ সাইজ্যাই বইসা থাহো। আমি রানদুম আর তোমারে দেহুম। কী সুন্দর লাগতাছে আমার বৌডারে। এত্ত সুন্দর চেহারাডা পাইছো কই? কার মতো হইছোগো তুমি?”

“হিহিহি, আপনে আমারে সুন্দর কইলেন? এই বাড়ির হগ্যলে দেহি আমারে কালা দেখল?”
“থুওতো এগো কতা, এরা কী বুঝে সুন্দরের? পাগলে কী চেনে হাগ না কচু।”

“হিহিহি, আপনেতো মানুষডা বড় মজা কইরা কতা কন।”
“বৌ প্রথম দিন তোমারে গরুর গোস্ত দিয়া ভাত খাওয়ামু। তোমগো বাড়ি থেইক্যা খাওন দিছিলো, আমি সব গরিবগো মধ্যে বিলায় দিছি শুধু একবাটি গোস্ত তোমার লেইগ্যা উডায় রাখছিলাম। তোমার দাদি কইল তুমি মিষ্টি পছন্দ কর, তাই গঞ্জে গিয়া মিষ্টি আনছি। তুমি খাও।”

“হায় হায়, আপনে সব খাওন বিলায় দিছেন ক্যা? এগুলিতো বাড়ির লোকজনের লেইগ্যা পাডায়ছে মায়।”
“এতক্ষণেও বুঝো নাই, এ বাড়ির লোকজন কেমন? এতক্ষণ তোমারে খালিমুখে বহায় রাখল দুইডা মোয়া, আমের মোরব্বা দিলে কী এমন কমত সম্পদ। এগো লেইগ্যা আমার মনে কোন টান নাই। বাদ দাও, আজকার দিনে আর এগো কতা কইয়া মন নষ্ট না’ই করি। লও ভাতের তো বলগ উঠছে। তুমি আর একটু অপেক্ষা কর। আমি বাকি সব বন্দোবস্ত করি।”

শবনম মিষ্টি হাতে একটু একটু করে মুখে দেয় আর নতুন এই মানুষটাকে দেখে। এই বাড়িতে আসার আগে মানুষটাকে নিয়ে ভীষণ রকমের দুশ্চিন্তা ছিল মনে, কেমন জানি একটা ভয়ও ছিল। এখন মনে হচ্ছে সব দুশ্চিন্তা ভয় গায়েব হয়ে গেছে। মানুষটাকে কেনজানি খুব আপন বলে মনে হতে লাগল।

দুলাল ভাতের মাড় গেলে ধুয়া উঠানো ভাত দুইটা কাসার থালায় বেড়ে নিয়ে এল শবনমের সামনে। গরম ধোঁয়াটা মুখে লাগতেই শবনম “উফ” করে উঠল।
“ওরে আল্লাহ বৌ, তুমি দেহি গরম ধোঁয়াই সহ্য করতে পারো না। আমার ঘরে সংসার বানবা কেমনে?”
কথাটা শেষ করেই দুলাল হোহোহো করে হেসে উঠল।
শবনম কোন কথা বলতে পারল না। এতক্ষণে সামনে বসে দুলালের মুখটা খুব ভালো করে খেয়াল করল আর আনমনে বলে উঠল
“এর লেইগ্যাই বাড়ির মানুষ আমার গায়ের রংরে কালা দেখছে। বেডা মানুষ আবার এত সুন্দর হয় কেমনে?”

“কী বৌ কী দেহো এমনে চাইয়া, আহো আগে দুইডা খাইয়া লই। তোমগো বাড়িত বইয়া আস্ত একটা মোরগ খাইছি বুঝছো? আর সারাদিনে কিছু মুখে দিতে ইচ্ছা করে নাই। অহন আহো আমরা দুইজন মিইল্যা খাই। তোমার লগে বইস্যা খাওনের বড় লোভ লাগতাছে, সারাজীবন পইড়া আছে আমারে দেহনের লেইগ্যা, বুঝছো বৌ। ”

শবনম লজ্জায় পড়ে গেল দুলালের কথায়। চোখ নামিয়ে ভাতের থালার দিকে দৃষ্টি দিল। কাসার থালা দুটো চকচক করছে। কাসার পানির গ্লাস জগটাও। আস্তে করে বলল
“এগুলো কী আপনে মাজেন? এত্ত চমকায় কেমনে?”
“আরে নাহ, আমার কাম না। এডি অনেক পুরান। সকালে এগুলিরে নিয়া পালেগো কাছে গেছিলাম। বেডারা কয় বেইচ্যা দিতে, আমি দেই নাই। কেমনে দেই কও দেহি বৌ? এগুলি আমার মায়ের শখের জিনিস। আমি কত যত্ন কইরা রাখছি, তা কেমনে বেচি? ওগোরে দিয়া নতুন করায় আনছি। আজকা তোমারে এ থালায় ভাত খাওয়ামু বইল্যা। ”
দুলাল কথা শেষ করে একটা আনন্দের হাসি দিল। কিন্তু শবনম খেয়াল করল ওর হাসি আসছে না। কেন জানি ওর খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কেন পাচ্ছে তা বুঝল না।

ভাত খেতে খেতে দুলাল আবার বলতে শুরু করল
“শোন বৌ, অহন থেইক্যা আমরা দুইজন এক লগে বইস্যা ভাত খামু। একলা একলা ভাত খাওনের কোনো মজা নাই। খাওনের স্বাদও বেস্বাদ হইয়া যায়। এতদিন হেই বেস্বাদই গিলছি। অহন আর দুঃখ নাই। তুমি আইছো না? অহনতো আর আমি একলা না।”

“আপনে একলা খাইতেন ক্যা? আপনের বাবার লগে বইস্যা খাইতে পারেন নাই?”

“নারে বৌ, মা মরলে বাপ অয় তালোই। তাওতো আমার বাপ বাপই আছিল, এর বেশি আর কী চাই? এ দুইন্যায় যার মা নাই তার কিচ্ছু নাই। মা মরনের কালে তার পুলাপাইনের অর্ধেক দুইন্যাই লইয়া যায়গা। আমিও তেমনই একজন। অহন তুমি আইছো, তুমি আমার দুইন্যাডা পুরা কইরা দিও। কি বৌ দিবা না? আমার লেইগ্যা খিদা পেডে অপেক্ষা করবা না? কসম খোদার আমি কাম শেষ না অইলেও খাওনের সময় ঠিক দৌড়াইয়া বাড়ি ফিরুম।”

এইবার শবনম আর ওর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। দুলালের কথায় কী এমন জাদু ছিল যা দ্বারা ও ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে লাগল।

চলবে

(চলে এলাম নতুন ধারাবাহিক নিয়ে। পাঠক যারা প্রতিনিয়ত তাড়া দিয়েছেন তাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। কারন এমন তাড়া না পেলে হয়ত এখনও শুরু করতে পারতাম না।)
পর্ব একদিন পরপর দিব ইন শাহ আল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here