তৃনভূমি,সূচনা পর্ব

0
384

#তৃনভূমি,সূচনা পর্ব
কলমে ঃ- #ফারহানা_কবীর_মানাল

সকালবেলা সুমনা ভাবি একটা বাটি হাতে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাসায় ছুটে আসলো। বাটি থেকে এক টুকরো ইলিশমাছ আমার স্বামীর প্লেটে তুলে দিতে দিতে বললো,

–” যাক ভাগ্য ভালো আপনার খাওয়া শেষ হয়ে যায়নি। আপনার জন্য আমি নিজের হাতে ইলিশ মাছ রান্না করেছি। গতকাল রাতে বললেন না আপনার ইলিশ মাছ পছন্দ। তাই সকাল সকাল রান্না করে নিয়ে এসেছি। ”

আমার স্বামী মুচকি হেসে খাবারটা মুখে তুলতে যাবে এমন সময় আমি গিয়ে ও-র সামনে থেকে প্লেটটা কেঁড়ে নিলাম। সোহাগ সবেমাত্র খেতে বসেছিলো। আমার এমন কাজ দেখে রেগে বলে উঠলো, ” কি হলো প্লেট কেঁড়ে নিলে কেন? আমি তো এখনও খাওয়া শুরুই করলাম না।

আমি ও-র কথার জবাব না দিয়ে সুমনা ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” ভাবি সোহাগের বউকে আল্লাহ দুইটা হাত দিয়েছে, সোহাগের যদি এতোই ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করে আমি ও-কে রান্না করে খাওয়াতে পারবো। আপনি দয়া করে নিজের বাটি নিয়ে এখান থেকে বিদায় হন।

সুমনা মুখ বেঁকিয়ে বললো, ” দেখেছো ভাই সোহাগ তোমার বউটা আমার সাথে কেমন ব্যবহার করছে। এমন মেয়েকে নিয়ে কেমন করে সংসার করো তুমি?”

সোহাগ রেগে বলে উঠলো, ” আচ্ছা মোনালিসা তুমি এতোটা ছোট মনের হলে কবে থেকে? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এতো সিনক্রিয়েট করছো কেন? ”

আমি সোহাগের কথায় উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। যেতে যেতে কানে এলো সুমনা ভাবীর কাছে সোহাগ ক্ষমা চাচ্ছে আমার এমন ব্যবহারের জন্য। ব্যাপারটা আমার একদমই ভালো লাগলো না। আমি থাকতে সোহাগ কেন অন্য কারো কাছে নিজের ইচ্ছার কথা বলবে। তাছাড়া আপন কেউ হলে হয়তো মেনে নেওয়া যেতো। একটা অন্য মহিলার সাথে ও-র কিসের এতো প্রেম! সুমনা ভাবীর বর বিদেশে থাকে। কয়েক বছর পর পর দেশে আসে। দুই তিন মাস থেকে আবার চলে যায়। বাড়িতে সুমনা একাই থাকে। শুনছি শশুর শাশুড়ি আছে কিন্তু তাদের সাথে তেমন ভালো সম্পর্ক না। কালেভদ্রে কখনো তাদের এ বাড়িতে আসতে দেখা যায় না। এই মহিলাকে আমি এমনই তেমন একটা সহ্য করতে পারি না। সোহাগকে দেখলেই মুচকি মুচকি হাসে, রোজ বিকালে সোহাগ ছাঁদে গেলে তখনই তার ছাঁদে যাওয়া লাগে। এসব আমার খুব একটা ভালো লাগে না। প্রথম দিকে সোহাগ এই মহিলার সাথে তেমন কথা বলতো না। কিন্তু দিন দিন সুমনা ভাবির সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। আগে উনাকে দেখলে এড়িয়ে চলে আসতো এখন প্রায়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই চার মিনিট গল্প করে।

রান্নাঘরে গিয়ে সবজি কাটতে শুরু করলাম। সোহাগ আর সুমনার রাগটা সবজির উপর দেখাচ্ছি । এতো সময় হয়তো সুমনা চলে গেছে, আবার দাঁড়িয়েও থাকতে পারে। ইচ্ছে করছিলো সুমনা ভাবীকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে কিন্তু নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে এসেছি। সকাল সকাল ঝামেলা করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। সবজি কাটা শেষ করে ফ্রিজ থেকে মাছ বের করতে গিয়ে দেখলাম সোহাগের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। প্লেটটা ধূয়ে রেখে দিয়েছে। সুমনা ভাবীও নেই, হয়তো চলে গেছে। নাকি সোহাগের সাথে বসে গল্প করছে। ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখলাম সোহাগ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম। সোহাগ অফিসে যাওয়ার আগে রান্না শেষ করতে হবে। নয়তো টিফিন রেডি করতে পারবো না। সোহাগ বাইরের খাবার খুব একটা পছন্দ করে না। তড়িঘড়ি করে রান্না শেষ সোহাগের দুপুরের খাবার গুছিয়ে দিলাম।

–” এই যে তোমার টিফিনবাক্স। দেখো ভুলে যেও না যেন!”

সোহাগ ফাইল গোছাতে গোছাতে বললো, ” এতো কষ্ট করার কি দরকার ছিলো! আমি বাইরে থেকেই খেয়ে নিতাম না হয়।”

সোহাগের কথায় আমি বেশ অবাক হলাম। যে ছেলে বাইরের কোনো খাবার খেতে চায় না সে নাকি বাইরে দুপুরে খাবার খেয়ে নিবে। হঠাৎই সোহাগে অচেনা মনে হলো। কারণটা হয়তো নিতান্তই ছোট, তবে আমার খুব একটা ভালো লাগলো না। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দেখে সোহাগ হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বললো, ” আরে মজা করছিলাম। তুমি তো জানোই আমি বাইরের খাবার তেমন একটা খেতে পারি না। তোমার তো সবদিকে নজর থাকে। ”

–” জানতাম।”

এক কথায় উত্তর দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। সোহাগের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অন্যের সামনে আমাকে ছোট মনের বলেছে, আমি চাইলেই ঝগড়া করতে পারতাম। রাগ দেখাতে পারতাম। দিনশেষে হয়তো আমারই লোকসান হতো। লাভ ক্ষতির ব্যাপারটা আমি খুব একটা বুঝি না। তবে নিজের স্বামী ভাগ অন্য কাউকে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা আমার নেই। সকালবেলা উঠে কষ্ট করে রান্না করবো আমি আর অন্য একজন এসে তার পাতে খাবার তুলে দেবে এটা হয়তো কোনো মেয়েই মানতে পারবে না। সোহাগের দুপুরের খাবারটা গুছিয়ে দিলাম শুধুমাত্র দায়িত্ববোধ থেকে। সংসার জীবনে প্রেম ভালোবাসা, চাহিদা, আবদার -আল্লাদ, বিশ্বাস -অবিশ্বাস, চাওয়া-পাওয়া এসবে বাইরেও দায়িত্ব মিশে থাকে।

–” মোনালিসা আমি বের হচ্ছি। তুমি দরজাটা আটকে দেও আর ঠিক মতো খেয়ে নিও। নিজের খেয়াল রেখো। ”

আমার উত্তরে অপেক্ষা না করে সোহাগ বেরিয়ে গেলো। আমি গিয়ে দরজা আটকে আসলাম। সিড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সুমনা দাঁড়িয়ে আছে। সারা শরীর রাগে জ্বলে উঠলো তবুও কিছু না বলে চলে আসলাম। মেয়েটা হয়তো এমনই গায়ে পড়া স্বভাবের। সোহাগ যদি ঠিক থাকে তাহলে হয়তো কোনো সমস্যা হবে না।

সারাদিন নানান কাজের ব্যস্ততায় সময় পার করলাম। কাজের ফাঁকে সোহাগের কথা মনে পড়লো। আনমনে কিছু হিসাব কষে আবার নিজের কাজে মন দিলাম। গোসল শেষ করে নামাজ পড়ে খেতে বসলাম। কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছে না। সোহাগ অন্য একটা মেয়ের জন্য আমাকে কথা শোনাতে পারলো, কোনো সম্পর্ক আছে নাকি ওদের মাঝে! নানান চিন্তা এসে মাথায় ভিড় জমাতে লাগলো। সম্পর্কে হারানোর ভয় থাকবে এটা স্বাভাবিক তবে সন্দেহকে জায়গা দেওয়া উচিত নয়। মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ছেড়ে ফেলে খাওয়া শেষ করলাম।
বিছানার চাদর, বালিশের কভার আর আমার কয়েকটা শাড়ি কেচেছি, একটু ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।
আছরের আজান কানে আসতে ঘুম ছেড়ে উঠে পড়ালাম। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর ছাঁদে চলে গেলাম। কাপড়গুলো হয়তো এতো সময় শুকিয়ে গেছে।

চারদিক রোদে ভরে আছে, কিন্তু কাপড়গুলো পানিতে ভরে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টির পানি জমে আছে জায়গায় জায়গায়। হয়তো বৃষ্টি হয়েছিলো কিন্তু ঘুমের কারণে বুঝতে পারিনি। অগত্যা আবার কাপড়গুলো শুকাতে দিয়ে নিচে চলে আসলাম। এখন রাতের রান্নাটা শেষ করে রাখলে মন্দ হয় না। মানুষ বলতে আমি আর সোহাগ। শশুর শাশুড়ি গ্রামে থাকে। সোহাগের চাকরি সূত্রে আমাদের শহরে থাকা। সোহাগ আমাকেও গ্রামে থাকতে বলেছিলো কিন্তু শশুর আব্বুর এক কথা বউ ছেলের সাথেই থাকবে। শাশুড়ি মা অতিরিক্ত স্বামী ভক্ত। স্বামীর কথাই তার জন্য শেষ কথা, তাছাড়া সে সামর্থ্যবান বলে আর অমত করেনি। মাঝে মাঝে আমাদের এখানে বেড়াতে আসে কিছু দিন থেকে আবার চলে যায়। সোহাগ ছুটি পেলে আমরাও গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।

রান্না শেষ করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। আকাশে আবারও মেঘ জমেছে, ছাঁদের কাপড় তুলতে হবে। দূত পায়ে ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু ছাঁদে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। সুমনা ভাবী আর সোহাগ পাশাপাশি বসে আছে। সোহাগের পরনে তখনও অফিসে পোশাক। দুইজনের মধ্যে ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। আমাকে দেখে ওঁরা দু’জনেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। সোহাগ সুমনা থেকে কিছুটা দূরে সরে বসলো। আমি তার কিছু বলার শক্তি পেলাম না। কেউ হয়তো আমার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে, হয়তো এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। শেষ পর্যন্ত কি সোহাগ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লো। সুমনার সাথে কি সত্যি ও-র সম্পর্ক আছে নাকি আমি ভুল ভাবছি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here