পুরে যাওয়া হাতটা দিয়ে লঙ্কাবাটা দিয়ে ভাত মাখছে তুলতুল। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে আছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে। জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবুও থামছে না। ভাত মাখা শেষ করে কাঁপা কাঁপা হাতে ভাতের লোকমা সায়ানের মুখের সামনে ধরে।
সায়ান প্রচন্ড রেগে তাকিয়ে আছে তুলতুলের মুখের দিকে। ভাত মুখে নিচ্ছে না।
“খেয়ে নিন
ধরে আসা গলায় রিনরিনিয়ে বলে তুলতুল। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।
” আমাকে খাইয়ে দিতে তোর এতোই অসুবিধা হয়? হাত কাঁপছে তোর? গলা কাঁপছে। মনে মনে বিরক্তও হচ্ছিস। এতো অবহেলার খাবার সায়ান মাহমুদ খায় না।
খাবারের প্লেটটা ফেলে দেয় সায়ান। মুহুর্তেই কাঁচের থালাটা ভেঙে গুড়িয়ে যায়। কেঁপে ওঠে তুলতুল। চোখ থেকে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে শ্রাবণ ধারা। ভয়ে হাত পা কাঁপছে। হেঁচকি তুলে কান্না করে ওঠে তুলতুল। এবার আর সয্য করতে পারে না।
“আবার ভাত নিয়ে আসবি আমার জন্য। চোখে মুখে খুশির ঝলক থাকতে হবে আর হাত কাঁপা যাবে না। তবেই খাবো আমি। নাহলে খাবো না।
বলেই হনহনিয়ে চলে যায় সায়ান। তুলতুল পুরে যাওয়া হাতটার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
সকাল বেলায় ভাতের মার ঝাড়তে গিয়ে পুরো মারটা তুলতুলের হাতে পরেছিলো ফলে পুরো হাতটা ঝলসে গেছে।
চোখ মুছে আবারও লঙ্কা পোরাতে থাকে তুলতুল। হাত দুটো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণার থেকে মৃত্যুই ভালো মনে হচ্ছে তুলতুলের কাছে।
” তুলতুল ওঠ তো তুই। একদম ভাইকে খাওয়াতে যাবি না। কি পেয়েছে ভাইয়া? হ্যাঁ
রাগে গজগজ করতে করতে বলে সায়ানের বোন সুমু। তুলতুলকে টেনে তুলে।
“চল হাতটা ধুয়ে নিবি। আমি মলম নিয়ে আসছি। কি পেয়েছে কি হ্যাঁ ভাইয়া? মা বাবা আসুক তারপর বলবো আমি সব।
তুলতুলের বা হাতটা ধরে টেনে নিতে নিতে বলে সুমু। তুলতুল থামিয়ে দেয় সুমুকে।
” থাকনা সুমু। ধুয়ে ফেললে হয়ত আমার হাতের জ্বালাবা কমে যাবে কিন্তু মনের জ্বালা কমবে না। আর মানসিক অশান্তির কাছে এইটুকুনু জ্বালা কিছুই না।
তাচ্ছিল্য হেসে বলে তুলতুল।
“তুলতুল তুই
তুলতুল সুমুকে থামিয়ে দেয়।
” তোমাদের বাড়িতে থাকছি। তোমার ভাইয়ের এতো কষ্ট করে রোজগার করা টাকায় গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছি। তার জন্য তো আমাকে এইটুকু করতেই হবে। বলো?
আবার মরিচ পুরিয়ে পেঁয়াজ লবন দিয়ে মাখিয়ে থালা ভর্তি করে ভাত বেরে নেয়। তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে থালাটা হাতে নিয়ে সায়ানের রুমের দিকে যেতে থাকে তুলতুল।
সুমু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে সায়ান চোখে মুখে বেশ বিরক্ত ফুটে উঠেছে। বিরক্তির কারণটা তুলতুলের দেরি করে আসা। বিশ মিনিট হয়ে গেছে। এতখনে লাগে শুধুমাত্র লঙ্কা বেটে ভাত আনতে? রাগের কারণে কোনো কাজেও মন বসছে না।
“আসবো
মুখে এক রত্তি মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বলে তুলতুল।
সায়ান হাতের ইশারায় আসার পারমিশন দেয়। তুলতুল গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে সায়ানের পাশে দাঁড়ায়।
” আআসলে মরিচ….. বাটতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো…. সরি
মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে তুলতুল।
সায়ান তুলতুলের হাত ধরে টান দিয়ে একদম পাশ ঘেসে বসায়। তুলতুল চমকে ওঠে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে।
“চোখ খোল
দাঁতে দাঁত চেপে বলে সায়ান।
পিটপিট করে চোখ খুলে তুলতুল। সায়ানকে একদম কাছে দেখে ভরকে যায়। হাত পা কাঁপতে থাকে। দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। ভীষণ ভয় পায় এই লোকটাকে।
সায়ান তুলতুলের সারাশরীরে চোখ বুলায়। তুলতুল কাঁদো কাঁদো ফেস করে তাকায়।
” আমি ইচ্ছে করে কালো ড্রেস পড়ি নি। আমি জানতাম না আপনিও কালো শার্ট পড়ছেন। এই আপনার মাথা ছুঁড়ে বললাম।
তুলতুল সায়ানের মাথায় হাত দেয়।
“স্টুপিট
বলেছি সেটা আমি?
গম্ভীর গলায় বলে সায়ান।
তুলতুল মাথা নিচু করে ফেলে।
” এখুনি বলতেন।
“আর কখনোই লাল লিপস্টিক লাগাবি না। নাহলে থাপ্পড়ে টমেটোর মতো গাল দুটো পেয়ারার মতো বানিয়ে দেবো।
তুলতুলের গালে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিতে দিতে বলে সায়ান।
” আচ্ছা
সায়ান সরে যায়। তুলতুল হাফ ছেড়ে বাঁচে। ওড়না ঠিকঠাক করে সোজা হয়ে বসে।
“খাবো তো না কি?
সায়ান ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। কর্কশ গলার বলে। আবারও চমকে ওঠে তুলতুল।
“ভাতে মাখানো জন্য কি আবেদন করতে হবে?
বিরক্ত নিয়ে বলে সায়ান।
তুলতুল তারাহুরো করে ভাত মেখে আদির মুখের সামনে নেয়। সায়ান মুখ ফিরিয়ে নেয়। তুলতুল কেঁপে ওঠে। আবারও কি ওকে লঙ্কা বাটতে হবে।
“কককি হয়েছে? এই তো হাসছি আমি। খুব খুশি আমি। এবার খান।
থেকে থেকে জিজ্ঞেস করে তুলতুল।
” আগে তুই খা। বলা তো যায় না আবার বিশটিশও মিশিয়ে আনতে পারিস।
কর্কশ গলায় বলে সায়ান।
কান্না পায় তুলতুলের। এতো অবিশ্বাস করে লোকটা ওকে?
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায় তুলতুল। কান্না করলে লোকটা খাবে না। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে একটু হাসার চেষ্টা করে। তারপর এক লোকমা ভাত নিজের মুখে পুরে নেয়।
লঙ্কা খেতে পারে না তুলতুল। অসম্ভব গলা জ্বলে। প্রচন্ড ঝাল হয়েছে। ভাত গুলো গিলতে পারছে না।
“এবার খাওয়া যায়।
সায়ান বলে।
তুলতুল না চিবিয়েই ভাত গুলো গিলে সায়ানকে খাইয়ে দেয়। খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতে থাকে সায়ান। মনে হচ্ছে অমৃত খাচ্ছে।
গলায় অসম্ভব জ্বালা পোরা শুরু হয়ে গেছে তুলতুলের। এখন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না তুলতুল। টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নেয়।
“আমি কাঁদছি না। আসলে প্রচন্ড ঝাল তো তাই চোখে পানি এসে পড়েছে।
একটু হেসে বলে তুলতুল।
সায়ান আড়াআড়ি ভাবে ভ্রু কুচকে তাকায় তুলতুলের দিকে। কিছু বলে না। ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাটতে থাকে।
লঙ্কা বাটা সায়ানের প্রিয় খাবার। সপ্তাহে একবার করে খায় সে। আর এই লঙ্কা বাটার দায়িত্বটা তুলতুলের।শুধু এই দায়িত্বটাই না সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যতটা সময় সায়ান বাসায় থাকবে ততখন ওর যা যা প্রয়োজন সব তুলতুলই দেবে ওকে।
হাতের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে। গলায়ও জ্বালাপোড়া করছে। সায়ানের মুখে ভাত দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তুলতুল। বসে থাকতে পারছে না। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে প্রাণ পাখিটা এখনই উড়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে তুলতুল। কিন্তু পারে না। বসে থাকাটা দুষ্কর।
হাতে থাকা ভাতের প্লেটটা ধরে রাখতে পারে না তুলতুল। পরে যায়। ঝনঝন শব্দ ভেসে আছে। সায়ান ফোন দেখছিলো আর খাচ্ছিলো। এবার ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুল পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেলে। বুকের ভেতর জাপ্টে ধরে।
তুলতুলও নিজের শরীরের ভর সায়ানের ওপর ছেড়ে দেয়।
কয়েক মুহুর্তে বুকের মাঝেই জাপ্টে ধরে থাকে তুলতুলকে। সায়ান একটুও অবাক হয় নি এভাবে তুলতুলের ঙ্গান হারানোতে। যেনো ও আগে থেকেই জানতো এমনটাই হবে।
সায়ান খুব যত্ন করে তুলতুলকে শুয়িয়ে দেয় বিছানায়। হাতটা বাজে ভাবে পুরে গেছে সেটা এতখনে খেয়াল করে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
“স্টুপিট একটা। আগে বললে কি হতো হাত পুরে গেছে? আর আমিও রেগে থাকলে হুশ থাকে না।
সায়ান নিজের মাথার চুল টেনে বলে।
” মা বা সুমুকে ডাকলে ওরা ডাক্তারকে কল করতে বলবে। ডাক্তার এসে স্পর্শ করবে তুলতুলকে। হাত ধরবে। মুখে হাত দেবে। এটা তো হতে দেবে না সায়ান।
তুলতুলের নিশ্চয় ভালোই লাগবে ডাক্তারের স্পর্শ। স্টুপিট বলে কথা ভালো তো লাগবেই। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলি। না থাকলো তুলা আর না থাকলো আমার জ্বালাপোরা। কিন্তু সেটাও পারি না। ভীষণ বিপদে আছি আমি।
দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে থাকা তুলতুলের দিকে তাকায় সায়ান।
“ইডিয়েট
ইচ্ছে করছে থাপ্পড়াতে থাপ্পড়াতে জাগিয়ে তুলি। ডিসগ্রাসটিং
ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি এনে হাত ধুয়িয়ে দেয় তুলতুলের।
তারপর সায়ানের একটা বন্ধুডাক্তার তার থেকে পরামর্শ করে কি ঔষধ দিলে ঠিক হয়ে যাবে। সে একটা ইনজেকশন আর কিছু মেডিসিনের নাম বলে।
কিন্তু সায়ান তুলতুলকে একা রেখে যাবে কি করে?
তাই ওই বন্ধুকেই ঔষধ নিয়ে আসতে বলে।
ফ্রিজ থেকে বরফ এনে তুলতুলের হাতে ধরে রাখে।
তুলতুল বিরবির করে কিছু বলছে। সায়ান শুনতে পাচ্ছে না। শোনার জন্য মুখ এগিয়ে দেয় সায়ান। একদম কাছাকাছি চলে যায় তুলতুলে।
ধপ করে চোখ খুলে তুলতুল। সায়ানকে এতে কাছে দেখে ভরকে যায়।
কোনো কিছু না ভেবে চোখ মুখ খিঁচ বন্ধ করে জোরে চিল্লানি দেয়।
সায়ান এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তুলতুলের চিল্লানিতে ধরফরিয়ে ওঠে ঠাস করে খাটের নিচে পড়ে যায়। কোমরে ভীষণ ব্যাথা পায়।
কিছু পড়ার শব্দে সায়ান চোখ বড় বড় করে তাকায়। কি হলো এটা?
মাথাটা খানিকটা উঁচু করে দেখে সায়ান কোমরে হাত দিয়ে কপাল কুচকে তুলতুলের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” তুলতুল এবার তুই শেষ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালা
মনে মনে বিরবির করতে করতে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে এক দৌড় দেয়।
দরজা ওবদি যেতেই কারো সাথে জোরে সরে ধাক্কা খায় তুলতুল। পরে যেতে নিলে সামনের মানুষটি ধরে ফেলে তুলতুলকে।
সায়ানের মাথায় আগুন জ্বেলে ওঠে।
তুলতুল তো চোখ খোলার সাহসই পাচ্ছে না।