গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ২৭

0
500

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭

“কিন্তু তার সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে কি হাসিল করতে চাইছো তুমি, বিগ ব্রাদার?”

নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে হতাশা। মুখটা কেমন জানি ভার হয়ে যায়। গাম্ভীর্যের সাথে বলে ওঠে,
“আমার মনে হচ্ছে আমি বড় কোন ভুল করে ফেলেছি। তার মতো মেয়েকে আমি সন্দেহ করেছি। আমি মনে করেছি সে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত। ট্রেনে থাকা সেই আই উইকনেসের স্কেচ অনুযায়ী তাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু রাগিনী তাজরীন নামক মেয়েটিকে যত কাছ থেকে দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। সে কখনো কারো প্রাণ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। সে মানুষের জীবন বাঁচায়। এমন কি সে ছোট্ট একটা প্রাণীর জীবনও বাঁচাতে অস্থির হয়ে ওঠে। সে কখনো মানুষের চোখে ভয় দেখতে এমনটা করবে না।”

“তাহলে এখনো তুমি কি কারণে নিজেকে তার সামনে নিয়ে আসো নি? আমি কিন্তু অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছি।”

কথাটুকু বলেই সন্দেহের নজরে তাকালো নয়নতাঁরা। নির্জন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। নয়ন জোর করে নির্জনের চিবুক ধরে তার দৃষ্টি নিজের সামনাসামনি করে। নির্জন যেন নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
“কারণ পুলিশের প্রমাণ দরকার। আমরা প্রমাণে বিশ্বাসী। আমার বিশ্বাস বা ধারণাই কেউ বিশ্বাসী নয়। উই নিড প্রুফ।”

চোখ জোড়া সরু হয়ে আসে নয়নতাঁরার। ঠোঁট কামড়ে হেসে তার ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল দুটো টেনে বলে ওঠে,
“তোমার বাহানা তুমি নিজের কাছে রাখো। সামান্য আমার ধাক্কায় তুমি যেভাবে তাকে হাত দিয়ে আগলে ধরেছিলে সেটাও কি শুধুই তদন্ত সংক্রান্ত কারণে? এখন অন্তত এই কথা বলো না। তাহলে কিন্তু তদন্ত নামক শব্দটি লজ্জা পাবে।”

“বড্ড বেশি কথা বলতে শিখে গেছো তুমি, নয়ন। দেখি সরো। আমার কাজ আছে।”

বলেই নির্জন প্রসঙ্গ পাল্টাতে নয়নকে জোর করে তুলে দেয়। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নির্জন চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
“যেন আস্ত একটা আলুর বস্তা কোলে বসেছিল। পা দুটো একেবারে অবশ হয়ে গেছে‌।”

এবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় নয়নতাঁরা। সে না হয় দেখতে একটু গোলুমোলু। একটু গোলগাল। তাই বলে কি তার ভাই এভাবে কথা শোনাবে? এটা মানা যায় না। নয়ন তড়তড় করে বলে ওঠে,
“নিজেকে একবার দেখেছো? মনে তো হচ্ছে সুন্দরী মেয়েটার সেবা পেয়ে কয়েক বছর ধরে জিম করো না। ভুঁড়ি বাড়তে শুরু করেছে। দৈত্য, ডেভিল একটা।”

কথাটা শুনে নির্জন চটে গিয়ে নয়নের দিকে তেড়ে যেতেই দরজায় আবারও টোকা পড়ে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভেতরে এসো।”

মেহরাজ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখ নয়নতাঁরার দিকে পড়া মাত্রই সে কিছুটা চমকে বলে উঠলো,
“মিস. আহমেদ! স্যারের প্ল্যানটা তাহলে কাজ করেছে।”

নয়নতা্ঁরা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি চুপ করুন। আপনাকে যতবারই ফোন করেছি কোন কাজের কাজই হয়নি।”

“আমাকে বলে কী লাভ? স্যার আপনাকে ইচ্ছে করে কল ব্যাক করতেন না।”

নয়নতাঁরা বাঁকা হাসল এবার। সামনের ছোট ছোট চুলগুলোতে ফুঁ দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“তাতে কি এমন লাভ হয়েছে? আমাকে কী আঁটকাতে পেরেছে? সি! আমি দেশে এসে পড়েছি।”

মেহরাজ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, যেমন বোন তার তেমন ভাই! কেউ কারোর থেকে কম যায় না।”

“কথা কম কাজ বেশি। আমি তোমাকে যা যা বলেছিলাম সেসব কি কালেক্ট করেছো?”

এবার নিরবতা ভেঙে মেহরাজের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে উঠল নির্জন। মেহরাজ একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। আর এক নিঃশ্বাসে বলে,
“ইয়েস স্যার। এটা এয়ারপোর্ট আর তার আশেপাশের ক্যামেরাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ।”

নির্জন পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি দিয়ে তার ল্যাপটপ খুঁজতে থাকে। বেডের বালিশের উপর ল্যাপটপের দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় সেটা দেখিয়ে নয়নতাঁরাকে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“ল্যাপটপ নিয়ে এসো।”

নয়ন ছুটে গিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে আসে বেশ আগ্রহের সাথে। তার এসব তদন্ত দেখতে দারুণ লাগে। কেমন একটা উত্তেজনা কাজ করে। নির্জন এবার গিয়ে ঘরের উত্তর দিকের টেবিলটার উপর ল্যাপটপ রেখে চেয়ার টেনে বসে। জড়ো হয় মেহরাজ ও নয়নতাঁরা। পেনড্রাইভ কানেক্ট করে একের পর এক ফুটেজ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখেও কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না নির্জন বা মেহরাজের। আচমকায় চেঁচিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। লাফিয়ে বলল,
“এই সিনটাতে স্টপ করো!”

তাড়াহুড়ো করে সিনটা স্টপ করল নির্জন। সিনটায় দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক আছে নাকি! কিছুই চোখে না পড়ায় ঘাড় বাঁকিয়ে নয়নের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টির ধরণ দেখে বুঝতে সময় লাগলো না সে রায়ানের জন্য সিনটাকে স্টপ করতে বলেছে। সোজা হয়ে নির্জন আবারও স্টার্ট করতেই মুখটা ভার হয় নয়নতাঁরার। নির্জন ফুটেজ দেখতে দেখতে বলে,
“দ্যা গ্রেট ইন্সপেক্টর রায়ানকে দেখার সময় আমার। মুখটা বন্ধ রাখবে নয়ত নিজের ঘরে যাও। অনেকদিন নিজের রুমকে দর্শন দাওনি। রুমটা শান্তিতে আছে। রুমটাকে অশান্তি দিয়ে এসো।”

“ধুর! তুমি সবসময় এমন করো কেন বলো তো? জন্মের সময় মা তোমার মুখে মধু দেয়নি তাই না? মনে হয় নিমের রস দিয়ে গিয়েছিল। কি কিউট লোকটা! একবার মনোযোগ দিয়ে দেখো তুমিও প্রেমে পড়ে যাবা।”

ফুটেজ আবারও স্টপ করে নির্জন। থম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কঠিন সুরে বলে,
“আমি ছেলে, নয়ন।”

নির্জনের কন্ঠসুর আর কথা শুনে ঢক গিলে নয়নতাঁরা। তাই তো! তার ভাই তো ছেলে! ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়লে ব্যাপারটা কেমন লাগে? ছিঃ ছিঃ! সে নিচু সুরে জবাব দেয়,
“আর একটাও কথা বলব না। প্রমিস!”

নির্জন এবার নিজের কাজে মন দেয়। একটা জায়গায় সিন স্টপ করে সে। তার তীক্ষ্ণ নজর পড়ে অভিরূপকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। তার গাড়ির সামনে হঠাৎ করেই একটা বাচ্চা ছেলের আগমন ঘটল। আর একটা মেয়ে তাকে খপ করে ধরল। সেখানে স্টপ করল সে। সিনটা বেশ দূরের। তাই মেয়েটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বেশ অস্পষ্ট! মুখটা অর্ধেক ঢাকা। দূর থেকেই অস্পষ্ট মুখটা দেখেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো নির্জনের। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কেমন চোখের ধরণটা চেহারা। আবারও ফুটেজ স্টার্ট করতেই এবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মেয়েটির মুখের কাপড় যখন নেমে গেল তখন চমকে উঠল নির্জন। সারা অঙ্গ কেঁপে উঠল। দ্রুত জুম করল মুখটার উপর। কাঁপতে থাকল টেবিলের উপর রাখা হাত। ঘেমে একাকার হলো এতটুকু সময়ের মাঝেই। মেহরাজ হতবাক হয়ে বলল,
“আরে ইনি তো রাগিনী তাজরীন!”

নয়নতাঁরা কিছুক্ষণ ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে থাকে ফুটেজের দিকে। অতঃপর সেও জোরে বলল,
“হ্যাঁ। তাই তো। এটা তো সে! রাগিনী…”

“এটা অসম্ভব! এটা হয় না। রাগিনী এখানে উপস্থিত থাকতে পারে না।”

কাঠকাঠ গলায় বলল নির্জন। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখটা এখনো অস্পষ্ট হলেও রাগিনীর মুখশ্রী সকলের কমবেশি চেনা। বিশেষ করে নির্জনের। যে ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীর দিকে কতবার যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে তার ঠিক নেই। তাই রাগিনীর সঙ্গে অন্য কোনো মেয়েকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভবনা নেই। মেহরাজ নিজেও অবিশ্বাস্য হয়ে জবাব দেয়,
“স্যার, কেন হতে পারে না? চোখের সামনে এই ফুটেজ কি মিথ্যে? এটা রিয়েল ফুটেজ।”

“হোক রিয়েল ফুটেজ। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এটা রাগিনী তাজরীন নয়। কারণ তাকে আমি সবসময় নজরে রেখেছি। এসময় সে একটা বাচ্চা ছেলেকে হসপিটালে ভর্তি করতে ব্যস্ত ছিলো। তার এখানে আসার সময় কোথায়? তার ফোনের লোকেশন এয়ারপোর্টের ধারের কাছেও নেই। আর মেয়েটার পোশাকে এতোটা ভিন্নতা। রাগিনী এমন পোশাক পড়েনি।”

“তাহলে এটা কে স্যার? রাগিনীর মতো কেন দেখতে? আমার তো মাথা আর কাজ করছে না।”

নয়নতাঁরা এতোক্ষণ চুপচাপ তাদের কথোপকথন শুনছিল। এবার যেন কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করতে থাকল। ফট করে সে বলেই ফেলল,
“আরে ভুলে যাচ্ছো কেন? পৃথিবীতে জমজ শব্দটাও এক্সিস্ট করে।”

নয়নতাঁরার কথাগুলো অযৌক্তিক হলেও এবার টনক নড়ে নির্জনের। গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। হাতটা মুঠো করে থুতনির কাছে রেখে চোখজোড়া স্থির রাখে ল্যাপটপে। একে একে মিলাতে থাকে সব হিসেব। যদিও বা রাগিনীর মতো আরেকজন থাকে তাহলে সে-ই কি রায়ানের গাড়ির ব্লা’স্ট ঘটিয়েছে? রায়ানের কথা অনুযায়ী সেও রাগিনীর মতোই দেখতে। একটু একটু করে হিসেব মিলিয়ে চলেছে নির্জন। ঘরে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নির্জন উঠে দাঁড়াল। চেয়ার ছেড়ে একটু দূরে পায়চারি করতে করতে বলল,
“যদি রাগিনীর মতো অন্য একজন মেয়ে এক্সিস্ট করে থাকে আর সে যদি রাগিনীর বোন হয় তাহলে প্রশ্ন অনেকগুলো বেরিয়ে আসছে। প্রথম প্রশ্ন, রাগিনীর জমজ বোন থাকলে রাগিনীদের সঙ্গে থাকে না কেন? দ্বিতীয়ত, ট্রেনে দুটো রাগিনী তাজরীন নামে টিকিট কাটা হয়েছিল। একজন রাগিনী আর অন্যজন রাগিনীর বোন হলে সে কেন রাগিনীর নামটা ইউজ করবে? আর দ্যা গ্রেট সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদের মেয়ে হয়ে সে কেন এই পুরো টে’রোরিস্ট চক্রের সাথে যুক্ত হবে? আর ফুটেজ দেখে যদি বিচার করি তাহলে মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে অভিরূপের গাড়ি থামানোর জন্য এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। হিসেব আরো গোলমেলে হয়ে গেল!”

মেহরাজের মাথা এবার ভনভন করে ঘুরছে। আর একটু হলেই যেন জ্ঞান হারাবে। নিজের মাথাটা ধরে নিয়ে একটু ঝাঁকুনি দেয় সে। নির্জন এবার থেমে থেমে বলে,
“মেহরাজ! একটা কাজ করে। শাহ্ রাশেদ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ করো। বিশেষ করে উনার স্ত্রী যখন প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখনকার সময়টা আমার জানা প্রয়োজন। আদেও কি দুটো জমজ মেয়ের জন্ম হয়েছিল?”

মেহরাজ মাথা নাড়ায়। রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায়। নয়নতাঁরা চুপ করে তার ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুক্ষণ। নির্জন ধীর পায়ে বেডের দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মুখ নিচু করে বসে। দৃঢ় ও সুগভীর চোখটা নিমিষে বন্ধ করে। নয়নতাঁরা বুঝেছে এবার তার ভাইয়ের মনে এই মূহুর্তে কি চলছে। সে পা টিপে টিপে গিয়ে নির্জনের সাথে গা ঘেঁষে বসে। খপ করে নির্জনের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলে,
“কী ভাবছো এতো?”

“উফফ…নয়ন, এখনো আর উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলতে এসো না প্লিজ!”

বিরক্ত হয়ে বলে নির্জন। নয়নতাঁরার কোনো হেলদোল হয় না। সে আগের মতোই থেকে বলে,
“তুমি তাকে নিয়ে ভাবছো তাই না? গিল্টি ফিল করছো?”

চোখ মেলে তাকায় নির্জন। দৃঢ় সুরে বলে,
“গিল্টি ফিল করার কী আছে?”

“তুমি বুকে হাত রেখে বলতে পারবে? যে সেই রাগিনী তাজরীনের দিকে তুমি কখনো মুগ্ধ হয়ে তাকাও নি? এটা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারবে? যে তার প্রতি তোমার একটুও টান নেই? এটা তুমি কঠিন সুরে বলতে পারবে যে তাকে তুমি তোমার ভাবনায় কখনোই নিয়ে আসো নি? এটা বলতে পারবে, যে সে তোমার কাছে অন্য সব মেয়েদের মতোই? এটা বলতে কি তোমার কণ্ঠস্বর কাঁপবে না? যে তার সামান্য আঘাতে তোমার কিছুই যায় আসে না?”

“আমি বলতে পারবো না কখনোই যে তার প্রতি আমি মুগ্ধ ছিলাম না। সে সম্পূর্ণটাই মুগ্ধতায় ঘেরা আমার কাছে। আমি তার নিকটে গেলেই দুর্বল হয়ে পড়ি। হৃদয় কম্পন ধরে যায়। সে আমার সামনে থাকুক বা না থাকুক আমার ভাবনায় সবসময় তারই বিচরণ। সে আমার কাছে অন্য কোনো মেয়ের মতো নয়। তাকে আমার নিজের একান্ত জীবন্ত কাঠগোলাপ মনে হয়। যে আমার নিজস্ব। তার সামান্য আঘাতে না চাইতেও এই অবাধ্য মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এক গোধূলি বেলায় এসে এমন অঘটন কেন ঘটালো মেয়েটা?”

নয়নতাঁরা ঠোঁট টিপে হাসলো। তবে হাসিটা লুকিয়ে কিছুটা নরম গলায় বলল,
“তার আর কী দোষ বলো? সব দোষ তোমার মনের। অযথা তাকে দোষারোপ করছো কেন?”

এতক্ষণ যেন অন্য ঘোরের মধ্যে ভেসে ছিল নির্জন। নিজের ভাবনা ভাঙতেই মনে হলো সে বেশ কিছুটা দেরি করে ফেলেছে। গড়গড় করে এই বাচাল মেয়েটাকে অনেক কথা বলে ফেলেছে। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। চোখে মুখে কঠিন ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে সে বলল,
“সরো তো। তোমার সাথে বকবক করে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”

বলে নির্জন উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিছু ডাকে নয়নতাঁরা। মলিন সুরে বলে ওঠে,
“কেন যে ওমন সুইট একটা মেয়েকে সন্দেহ করলে কে জানে!”

“সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। এডিশনাল এসপি স্যারের বাড়ি যখন ব্লা’স্ট হয়। সেদিন রাতে রাগিনীর ফোনের লোকেশন স্যারের বাড়ির আশেপাশে ছিল। ফ্যাক্টরিতে ব্লাস্ট হওয়ার রাতেও তার লোকেশন ফ্যাক্টরির আশেপাশেই ছিল। আমি নিজের সন্দেহ দমিয়ে রাখতে পারিনি।”

“আজকে যখন প্রমাণ পেয়ে গিয়েছো তখন বলে দাও তোমার পরিচয় তাকে। বলে দাও তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। বলে দাও তুমি তা নও সে যেটা ভাবছে।”

“তার বিশ্বাস যে ভেঙে যাবে, নয়ন। আজকে সে আমায় বলেছিল, তার বিশ্বাস কখনোই না ভাঙতে। তাহলে সেও ভেঙে যাবে। সে তো আর আমাকে বিশ্বাস করবে না।”

নির্জনের কন্ঠে মলিনতা। যেন সে নিরুপায়। নয়নতাঁরা দমে না। আবারও বলে,
“হোক যা হওয়ার। সত্যিটা চাপা থাকে না। সে অন্য কোনোভাবে জানার আগে তুমি জানিয়ে দাও। বুঝিয়ে বলো।”

“বুঝবে না। তখন আমার প্রতি তার মনে ঘৃণা জাগবে।”

নয়নতাঁরার মুখটাও কালো হয় এবার। মিনমিন করে বলে,
“যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। শেষে তোমাকে পস্তাতে না হয়।”

রাতটা বেড়েছে। রাগিনীর ঘরে টিমটিম করে ল্যাপশিটের আলো জ্বলছে এখনো। উর্মিলার দেওয়া পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট সম্মন্ধে সব তথ্য ঘেঁটে দেখছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। নিঝুম রাতে সে একা জেগে নেই অবশ্য। সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট রিও। চুপটি করে রাগিনীর পাশে একমনে বসে রয়েছে লেট গুটিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাগিনীর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগিনীর কাজকর্ম দেখছে। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে রাগিনী না ঘুমোলে সেও ঘুমোবে না। বিগত দুই ঘন্টা ধরে সব তথ্য জানার পর ক্লান্ত চোখে রিও এর দিকে তাকালো রাগিনী। তার ছোট্ট লোম ভর্তি মাথায় আলতো করে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
“চোখে ঘুম নেই কেন সুইটি? অনেক বেজে গিয়েছে!”

রিও রাগিনীর দিকে একটু নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে নিজের গা চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাগিনী মুচকি হেঁসে তার পুরো শরীর বুলিয়ে দিতেই রিও উঠে এসে তার হাতের সাথে শরীর ঘষতে থাকলো। এবার বোধহয় ছোট্ট মহারাজের ঘুম পেয়েছে। রাগিনী তাকে কোলে নিয়ে আস্তে করে যত্নের সাথে সারা শরীর বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল। শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে ফাইল আর ল্যাপটপের দিকে খেয়াল করল। হাসতে চাইতেও মনটায় কেন যেন বিষণ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোহিনূর নামক ব্যক্তিটাকে এবার সন্দেহের নজরে দেখছে। তার বিশ্বাসের পরিণাম কি তবে বিষাক্ত হয়ে উঠবে? চোখমুখ জড়িয়ে আসে রাগিনীর। সৃষ্টি হয় মনের মাঝে অজানা এক ভয়ের। আঁতকে ওঠে। সে যে চায় না মানুষটা ভুল প্রমাণিত হক!
“কোহিনূর! আপনি কি নিজে ধরা দিচ্ছেন নাকি ভুল করে ধরা দিয়ে ফেলছেন নিজেকে? আপনি নাকি এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাহলে তো নরমালি যানবাহন দেখে ভয় পাওয়া উচিত আপনার। কারণ যেখান থেকে পেশেন্টদের অসুস্থতার সৃষ্টি হয় সেটাই পেশেন্ট ভয় পায়। অথচ আপনি সেদিন গাড়ি সামলে নিলেন খুব সহজে। আপনার কথায় আমি সেই বাচ্চামো আর দেখতে পাই না। এসব কীসের ইঙ্গিত?”

কথাগুলো আনমনে আওড়াতে আওড়াতে রাগিনী দেখে রিও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সে খুব সাবধানে রিও কে বেডে রেখে হালকা করে গায়ের উপর চাদর তুলে দেয়। রিমোট দিয়ে এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে তার করা কোহিনূরের স্কেচের সামনে আসে। ল্যাম্পশিটের হালকা আলোয় জ্বলজ্বল করছে স্কেচ। সে একহাতে স্কেচটা স্পর্শ করে বলে,
“আপনাকে সন্দেহ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করে না। কিন্তু আপনার ব্যবহার আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। আপনি স্বাভাবিক মানুষ হলে অস্বাভাবিক পরিবেশে কেন এসেছেন? কী উদ্দেশ্য আপনার? নাকি বরাবরের মতো সব আমার হ্যালুসিনেশন? আমিই কি কোনো ট্রমার মাঝে আটকা পড়েছি? আবারও বলছি, কোহিনূর সাহেব! বিশ্বাসটাকে বিষে পরিণত করবেন না।”

রাত হলো। নিস্তব্ধতা বাড়লো। রাগিনীর ভাবনা কমলো না। ঘুম সহজে এলো না। একদিকে রাজ্য জুড়ে থাকলো কোহিনূর এবং বিশ্বাস। অন্যদিকে অবিশ্বাসের বীজ বুনে গেল তার মনের অভ্যন্তরে।

সকালবেলা। বদ্ধ ঘরে এসি চলছে। ঘরের ভেতর থাকা বিছানায় ঘুমন্ত নোমান ও অভিরূপ। নোমানের ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। কারণটা হচ্ছে অভিরূপ। তার সাথে ঘুমানো বেশ মুশকিল ব্যাপার স্যাপার। বর্তমানে বিছানার ছোট্ট এক জায়গায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে নোমান। এসিতে ঠান্ডা লাগছে। উপায় নেই তবুও। ব্ল্যাঙ্কেট পুরোটা অভিরূপের কাছে। মাঝরাতে দুজন ব্ল্যাঙ্কেট নিয়ে তৃতীয় বি’শ্বযুদ্ধ লেগে অভিরূপ জিতে গিয়ে পুরোটা নিয়ে নিয়েছিল। নোমান অন্য কোনো ব্ল্যাঙ্কেট আনায় নি আর। সে জানে সেটাও অভিরূপের দখলেই যাবে। অভিরূপের ঘুমানোর স্টাইলটাও দেখার মতোই। হাত-পা ছড়িয়ে মাথা নোমানের পেটে উপর রেখে দেদারসে ঘুমাচ্ছে।

দরজায় টোকা পড়ল। নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুজনই। নোমানের ঘুমটা বেশ হালকা হলো। পেটে ভারি কিছু অনুভব করল। বুঝতে সময় লাগলো না এটা অভিরূপের মাথা। পা উপরে তুলে অভিরূপকে পা দিয়ে হালকা লা’ত্থি মে’রে ঠেলে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় থাকলো সে। দরজায় আবারও টোকা পড়ল। নোমানের ঘুমটা এবার পুরোপুরি ভাঙলো। পাশ ফিরে দরজার দিকে তাকালো। অভিরূপ তখনো ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে ঘুমে আধম’রা। হঠাৎ ঘুমের মাঝেই চেঁচিয়ে সে গেয়ে উঠল,
“ও ক্রিং ক্রিং বাজে রে এই মনের কলিংবেল!”

নোমান উঠে বসলো এবার। অভিরূপকে পা দিয়ে আবারও জোরে ঠেলা মে’রে বলল,
“তোর মনে না। দরজায় কেউ বাজাচ্ছে।”

এবার জোরে জোরে দরজায় টোকা পড়ায় নোমান বিরক্ত হয়ে উঠে গেল দরজা খুলতে। সকাল সকাল সার্ভেন্ট গুলো রুম পরিষ্কার করতে চলে আসে। আর কোনো কাজ নেই বোধহয়। দরজাটা খুলেই না খেয়াল করেই নোমান অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে,
“এখনি আপনাদের রুম পরিষ্কার…. ”

কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এক অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে। নোমান লোকটির আপাদমস্তক দেখে নেয়। পরনে ভেতরের সাদা শার্ট ইন করা। উপরে এ্যাশ কালার কোট। পায়ে দামি জুতো। হাতে দামি ঘড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। নোমান বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“সরি। আমি ভেবেছিলাম…! যাই হোক। আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”

“হ্যালো ইয়াং ম্যান। আই এম শাহ্ রাশেদ। এটা অভিরূপের রুম না?”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পর্বটা খাপছাড়া লাগতে পারে। গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here