গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ২৮

0
336

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮

“হ্যাঁ, এটা তো অভিরূপের রুম। বাট আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”

রাশেদ সাহেব প্রশস্ত হাসেন। ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
“তুমি নোমান তাইতো? অভিরূপের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু?”

নোমান কিছুটা হতবাক হলো। সে আবারও রাশেদ সাহেবকে মনোযোগের সহিত দেখে নিল। সে তো চেনে না লোকটাকে। তবে লোকটা বেশ স্মার্ট। কথাবার্তা এখনো বেশ স্পষ্ট আর অন্যরকম ঝাঁঝ রয়েছে। রাশেদ সাহেব নোমানের দৃষ্টি দেখে বুঝে নিলেন সে কী ভাবছে। তিনি তৎক্ষনাৎ আগের সুরেই বললেন,
“আমি অভিরূপের বাবার বন্ধু। আমাকে দেখে কি সন্দেহ করছো? আবার নতুন বিপদের আগমন নিয়ে আসা ব্যক্তি ভাবছো?”

নোমানের স্মরণে এলো এবার। গতকাল নাদিম সাহেবের সাথে তার কথা হয়েছিল। তিনি রাশেদ সাহেবের কথা বলেছিলেন। নোমান ঘুমের ঘোরে তা ভুলে গিয়েছে। দ্রুত দরজার সাইডে দাঁড়ালো সে। পথ ছাড়লো। সৌজন্যমূলক হাসি হেঁসে বলে উঠলো,
“সরি আঙ্কেল। আমার আসলে খেয়াল ছিল না। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ভেতরে আসুন, প্লিজ।”

রাশেদ সাহেব ভেতরে প্রবেশ করলেন। নরম সুরে বললেন,
“ইটস ওকে। এমনিতে যত বড় ঝড় তোমাদের উপর দিয়ে গিয়েছে এমন সতর্ক থাকা ভালো। আমি বোধহয় সকাল সকাল এসে পড়েছি।”

“না, না আঙ্কেল। আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন।”

“সেটা তোমার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছে। আর ঘুমন্ত অভিরূপকে দেখেও বুঝতে পারছি।”

নোমানের চোখ এবার চলে যায় অভিরূপের দিকে। ছেলেটা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কোনোরকম হুঁশ নেই তার। নোমান নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো,
“আপনি বসুন। আমি ওকে উঠাচ্ছি। ও একটু অলস ধরনের। তার উপর সারাদিন জার্নি। তাই এখনো ঘুমাচ্ছে।”

রাশেদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে বসেন। নোমান বিছানার দিকে ধাবিত হয়। হাত দিয়ে অভিরূপকে ঠেলে বলে ওঠে,
“এই অভি! সকাল হয়েছে উঠে পড়। রাশেদ আঙ্কেল এসেছেন।”

অভিরূপ হাত দুটো ছড়িয়ে শরীর টানা দিয়ে নোমানের কথায় কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে অন্যদিক ফিরে আবারও নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে থাকল। এই ছেলের ঘুম ভাঙ্গানো বেশ দায়ের। আবার ঘুমের মাঝে নিজের আর নোমানের ইজ্জতের ফালুদা না করে দেয়। নোমান একটু ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,
“অভি! একটু চোখ মেলে দেখ। আঙ্কেল এসেছে। রাশেদ আঙ্কেল তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস।”

অভিরূপ এবার সোজা হয়ে ফিরে। স্ট্রেইট শুয়ে আলতো করে চোখ মেলে। নোমান স্বস্তি ছাড়ে এই ভেবে এট লাস্ট ছেলেটা কোনোরকম কান্ড না করে ঘুম ভাঙ্গানো গেল। সে সরে আসার আগেই ফট করেই তার গাল চেপে ধরল অভিরূপ। থতমত খেলো নোমান। চোখটা কপালে উঠে গেল। অভিরূপের চেহারায় কেমন যেন অন্যরকম ভাবসাব। একদম সুবিধার নয়। সে আবার চোখ বুঁজেছে। কেমন যেন মিটিমিটি হাসছে। নোমানকে আরেক দফা চমকে দিয়ে অভিরূপ বেশ মুগ্ধতার সাথে বলল,
“সেই চোখ‌! সেই লুকিয়ে রাখা মুখ। মুগ্ধতায় ঘেরা।”

ঢক গিলে নেয় নোমান। কীসব বলছে এই ছেলে? মাথায় তো কাজ করছে না নোমানের। কার কথা বলছে? অভিরূপ থামে না। আবারও ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলে,
“তুমিই বলো! এটা কি লাভ এট ফার্স্ট সাইট? তুমি কি এসবে বিশ্বাস করো? আমি কিন্তু করি না। তাহলে এটা কি লাভ না অ্যাট্রাকশন?”

নোমান চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে। লজ্জায় পড়ে গেছে। উপর থেকে দড়ি পড়ে না কেন? আর এজগতে থাকতে মন চাইছে না। এই চোখ দিয়ে আর রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাতেও পারবে না। ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ আর লজ্জা দুটোই লুকানোর চেষ্টা করে। অলরেডি ইজ্জতের দফারফা শেষ। নিশ্চয় আঙ্কেল ভাবছে, যে ছেলে ছেলের প্রতি লাভ বা এট্র্যাকশন কি করে হয়? কী বিশ্রী কান্ড! সঙ্গে সঙ্গে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই নোমান তাড়াহুড়ো করে এক থাবা মেরে সরে গিয়ে জোরে বলে ওঠে,
“এই শালা লাভ অ্যাট্রাকশনের বাচ্চা কী শুরু করেছিস কাল থেকে আমার সাথে? চোখ মেলে একবার তাকা। আমি তোর লাভ না অ্যাট্রাকশন বুঝতে পারবি।”

এতো জোরালো কন্ঠ শুনে আর ঘুমে মগ্ন থাকা হয়ে উঠল না। চোখ মেলতে অভিরূপের চোখের সামনে থেকে যেন সেই সাহসী দৃষ্টি হারিয়ে গেল। সেই লুকিয়ে রাখা অপরূপ চেহারাটি কোথাও গা ঢাকা দিল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে কিছু বুঝতে না পেরে তাল না পেয়ে বলল,
“লাভ অ্যাট্রাকশন? কোথায় লাভ অ্যাটেনশন?”

এবার নোমানের ইচ্ছে করে নিজের কপাল ঠুকতে। দাঁতের কিড়মিড় করে ইশারায় দেখিয়ে দেয়,
“ওই যে তোর লাভ অ্যাট্রাকশন।”

চোখ দুহাতে ডলে সামনে তাকায় অভিরূপ। সোফায় বসে থাকা অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আরে এটা কেমন লাভ অ্যাট্রাকশন। দেখে তো মনে হচ্ছে উনি লাভ অ্যাট্রাকশনের শ্বশুর।”

কথাটা নোমানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র দ্রুত অভিরূপের মুখ চেপে ধরে। চাপা সুরে বলে ওঠে,
“চুপ, চুপ। মাথাটা কি তোর একেবারেই গিয়েছে?”

নোমান নিজের দৃষ্টি রাশেদ সাহেবের দিকে আনার চেষ্টা করলে রাশেদ সাহেব তাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁসে বলে ওঠেন,
“ইয়াং ম্যান, কোনো স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি? নিশ্চয়ই নোমান ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে তোমার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে?”

অভিরূপ এবার ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো। রাশেদ সাহেবকে চেনার চেষ্টা করল। মস্তিষ্কে কিছুটা চাপ পড়তেই তার মনে পড়লো। অনেক আগে একবার রাশেদ সাহেবকে দেখেছিল সে ভিডিও কলে। চেহারা তার এখনো মনে রয়েছে। অভিরূপ দেরি না করে তাড়াতাড়ি ব্ল্যাঙ্কেট রেখে দাঁড়িয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আই এম এক্সট্রিমলি সরি, আঙ্কেল। কী বলতে কী বলে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না। আই নো, আপনি কিছু মনে করতেই পারেন না। দরকার হলে ভেবে নেবেন আপনার কাছে প্রতিদিন যত মানসিক রোগী আসে আমিও ঠিক তেমনি একটা রোগী।”

রাশেদ সাহেব এবার শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। অভিরূপের এবার ভালো লাগছে। অন্তত প্রসঙ্গ ঘুরাতে সক্ষম হয়েছে। হাসতে হাসতে রাশেদ সাহেব জবাব দিলেন,
“তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। নো চেঞ্জ।”

অতঃপর তিনি নিজের পাশে বসালেন অভিরূপ এবং নোমানকে। গল্পে মেতে উঠলেন।

আজকের আকাশটা মেঘলা। সাদা আকাশে কালো রঙের এক ধরনের স্নিগ্ধ মেঘের আনাগোনা। আকাশটা থম মে’রে আছে। কখন যেন ঝুম বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ করেই বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। জানালার পাশে থাকা চারকোনা টেবিল থেকে সাদা রংয়ের স্বচ্ছ কাগজটি নিচে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বিরক্তি জমা হলো কোহিনূর ওরফে নির্জনের মুখে। নিজের ঝুঁকে কাগজটি তুলে নিয়ে হাতে কলম নিয়ে বসলো। প্রায় আধঘন্টা ধরে কালো মেয়ের কালি সে স্বচ্ছ কাগজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে মনে আসছে না শব্দ। হাতে পাচ্ছে না জোর। এই পরিকল্পনাটি নয়নতাঁরার। মেয়েটা ছোট হয়ে স্পষ্ট নির্দেশ করেছে যেভাবেই হোক রাগিনীকে সবটা জানাতে। কিন্তু মুখে বলতে গেলে এ জীবনে হয়তো কখনোই তা বলে উঠতে পারবে না কোহিনূর। তাই নয়নতাঁরার বুদ্ধি অনুযায়ী একটা পৃষ্ঠা এবং কলম নিয়ে বসেছে। মেয়েটা মাথামোটা হলেও একটু তো বুদ্ধি বের করতে পেরেছে এটা ভেবেই কোহিনূর আপ্লুত। অনেক ভেবে কলমটা পৃষ্ঠায় ঠেকিয়ে লিখতে শুরু করল কোহিনূর।
‘হয়তো আমি তোমার বিশ্বাসের যোগ্য নই। আমি মানুষটা খুব একটা সুবিধার নই। এই অসুবিধাজনক মানুষ ভয়া’বহ অন্যায় করে ফেলেছে তোমার সাথে। তবে আমার উদ্দেশ্য তোমাকে ঠকানো ছিল না। বিলিভ অর নট! আমি চেয়েছিলাম…”

হাতটা থেমে গেল। অনবরত কাঁপতে থাকলো। কোথাও একটা তোলপাড় সৃষ্টি হলো। মনে হলো এই সামান্য চিঠি দূরত্বের মতো ভয়া’বহ অ’স্ত্র দ্বারা ক্ষ’তবি’ক্ষত করে দেবে এই সুন্দর সময়গুলোকে। বিলীন করবে তার জীবন্ত কাঠগোলাপের হাসিমাখা মুখটাকে।

“কী করছেন আপনি ওখানে সকাল সকাল, কোহিনূর সাহেব?”

বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠল কোহিনূর। সর্বাঙ্গে যেন তড়িৎ বয়ে গেল। কাগজে নিজের ছোট ছোট লেখাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রাগিনীর কাছে এগিয়ে আসার শব্দ তীব্র হচ্ছে। মূহুর্তেই হাতে দুমড়েমুচড়ে ফেলল কাগজটি কোহিনূর। রাগিনী ততক্ষণে টেবিলের বেশ নিকটে। কোহিনূরের এমন কাজে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কী করছেন? কী আছে কাগজে?”

চোর চুরি করতে ধরা পড়লে যেমন মুখের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনই এক প্রতিক্রিয়ার ছাপ পড়লো কোহিনূরের মুখে। ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কিছু না। তুমি এতো সকাল সকাল?”

“সকাল সকাল কোথায়? আমি তো এই সময়েই আসি। আপনার হাতে কীসের কাগজ?”

“বললাম তো তেমন কিছু না।”

রাগিনীর মনের খচখচানিটা কমে না। কোহিনূরের চোখমুখে স্পষ্ট এক সংকোচবোধ। সে দেখাতে চাইছে না। তবে রাগিনী দেখবে। দ্রুততার সাথে সে কোহিনূরের হাতের মুঠো থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ফলাফল শূন্য। কোহিনূর নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারও ধপ করে বসে পড়ে। হাতটা জোরে মুঠো করে থাকলো। কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল,
“এতো জেদি কেন তুমি, রাগিনী?”

“আশ্চর্য! জেদ আপনি করছেন আর আমাকে বলছেন আমি জেদ করছি। কী এমন আছে কাগজে?”

জেদি সুরে বলে উঠল রাগিনী। নিজের চোখটাও সুদৃঢ় ভাবে রাঙালো। মূহুর্তেই দারুণ লাগলো কোহিনূরের কাছে সেই চাহনি। তবে রাগিনীর এতো সময় নেই। সে জোর কদমে ছাড়িয়ে চলেছে কোহিনূরের হাতের মুঠো। কাগজটা দেখতে হবে মানে দেখতেই হবে। তবে কোহিনূরের সামান্য এক হাতের জোরে কি রাগিনী পারে? পুরুষ মানুষের হাতের জোর সবসময়ই বেশি। অস্বাভাবিক কিছু না। ইতিমধ্যে বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সূচনা হয়েছে। কোহিনূর হাতটা আরো শক্ত করে মুঠো করতেই ক্লান্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রাগিনী। কোহিনূর মৃদু হেঁসে বলে,
“এতো আগ্রহ কেন তোমার?”

“আপনার চোখে ভয় দেখেছি তাই।”

রাগিনীর অকপটে উত্তর। কোহিনূর হাসি প্রসারিত করে নিচু সুরে বলে,
“এটা প্রেম ভয়, মিস. রাগিনী!”

রাগিনীর চোখমুখ কুঁচকে যায়। কথাটা প্রথমেই বোধগম্য হয় না তার। পরক্ষণেই চোখেমুখে নেমে আসে কিছু লজ্জার আঁধার। কেমন যেন থম মেরে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“প্রেম ভয়? মানে?”

“এই কাগজ পড়লে আমার সর্ব’নাশ হয়ে যাবে।”

“কেন?”

“কারণ এখানে জম্পেশ একটা প্রেমপত্র লিখেছি।”

বেশ উৎসুক হয়ে উত্তরে বলল কোহিনূর। আগ্রহী হলো রাগিনীর প্রতিক্রিয়া জানতে। রাগিনীর মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ কঠিন ভাবনায় ডুবেছে। মুখটায় তাজ্জব ব্যাপারটা এসেছে। কিছুক্ষণ সে মৌনতা অবলম্বন করার পর বলল,
“আপনার প্রেমিকা ছিল বুঝি?”

রাগিনীর ব্যথিত সুর। কোহিনূর যেন আরো দ্বিগুন ব্যথিত সুরে বলল,
“ছিল না। আছে বর্তমানে। খুব নিষ্ঠুর সে। একেবারে হৃদয়হীনা।”

“হৃদয়হীনা কেন?”

কিছুটা মলিনতা কণ্ঠে থাকলেও যোগ হলো বিস্ময়। কোহিনূর কিছু বলতে চাইতেই রাগিনী আগেই দম ফেলে বলে দিল,
“থাক। শুনবো না আর। আপনার প্রেমিকার কথা প্রাইভেট রাখুন।”

“কেন কেন? এক্ষুনি তো শুনতে চাইছিলে।”

রাগিনীর মলিনতায় পরিপূর্ণ মুখটার দিকে একনজরে চেয়ে জিজ্ঞেস করল কোহিনূর। রাগিনী কিছুটা তেতে জবাব দিল,
“অন্যের প্রেমিকার কথা শোনার ইচ্ছে নেই।”

বৃষ্টিটার গতি জোরালো হয়েছে। এই ভ্যাপসা গরমে হুটহাট বৃষ্টি একটু হলেও মনে শান্তি জাগায়। বর্ষার সময় অথচ বৃষ্টির নামগন্ধও ছিল না এতোদিন। এখন বৃষ্টি পেয়ে যেন আনন্দে মেতেছে প্রকৃতি। তৃষ্ণার্ত শহর ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার এক নামি-দামি দালানকোঠার এক ছোট্ট ঘরে বসে থাকা নারীটির মনের আকাশেও নেমে এসেছে কালো রঙয়ের মেঘ। সেই মেঘের প্রতিটি অণুতে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত অভিমানের। যার কোনো অর্থ নেই। কিছু জিনিস অর্থহীন তবুও মনের মাঝে জমে থেকে যায়।

কোহিনূর হাতের মুঠো আস্তে আস্তে করে খুলল কাগজটার অবস্থা করুণ। তবে এখনো ছিঁড়ে যায়নি। রাগিনীর আর হেলদোল নেই কাগজের প্রতি। সে বিছানায় বসেছে স্থির হয়ে। জানালায় তাকিয়ে আছে তো আছেই। অন্যকোনো দিকে তার ধ্যান নেই। মুখে নেই উচ্ছ্বাস। কোহিনূর আর কিছু না ভেবেই জানালার দিকে ছুঁড়ে মা’রল কাগজটি। নিশ্চয় বৃষ্টিতে কাগজটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!

রাগিনীকে উঠে দাঁড়াতে দেখে চকিতে তাকায় কোহিনূর। বরাবরের মতো টিফিনবক্স এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
“খেয়ে নিন। চিন্তা করবেন না আজকে দশ পদের খাবার নিয়ে আসিনি।”

রাগিনী বাহিরের দিকে পা বাড়ায়। কোহিনূর পিছু ডেকে অস্থিরতার সাথে বলে,
“কোথায় যাচ্ছো? বাহিরে তো বৃষ্টি।”

“বৃষ্টি দেখতেই তো যাচ্ছি। বৃষ্টি নাকি সবকিছু মুছে দেয়। নিশ্চয় অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলোও মুছে দিতে পারবে।”

আর বিলম্ব করলো না রাগিনী। প্রস্থান ঘটল তার। তার আক্রোশ ভরা কন্ঠ অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোহিনূরকে। মেয়েটা এমন করলো কেন? ‘প্রেমিকা আর প্রেমপত্র’ এই দুটো শব্দটিতে বুঝি তার অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে? হলেও বা কেন হলো? কিছুক্ষণ নিরব থেকে স্মিত হাসলো কোহিনূর।
“এতো কীসের অভিমান আমার উপর তোমার মিস. রাগিনী? দিন দিন বড্ড অভিমানিনী হয়ে চলেছো তুমি। অভিমান ভাঙানোর দায়িত্ব বুঝি একান্ত আমায় দিয়ে রেখেছো?”

চায়ের টঙ এর সামনের ছাউনির একটা ছোট্ট সিটে বসে রয়েছে রাগিনী। চাওয়ালা চা বসিয়েছে। রাগিনী ছাড়া বর্তমানে কোনো কাস্টমার নেই। কানে ভেসে আসছে বৃষ্টির পড়ন্ত শব্দ। ভুবন জুড়ে যেন শীতলতার ছায়া। রাস্তাটা জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। হুটহাট করে বড় বাস বা ট্রাক চলে যাচ্ছে শাঁই শাঁই করে। রাগিনী নিরব রাস্তায় পানে চেয়ে। মনে লেগেছে বিষণ্ণতার ছোঁয়া। সেই বিষণ্ণতা কাটানোর মতো নয়। চির বিষণ্ণতা যেন কাটে না। কারণ এই মূহুর্তে তার কোনোরকম প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। হয়তবা হবারও নয়। চাওয়ালার কন্ঠে ধ্যান ভাঙে রাগিনী। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“চা কি এখনি দিমু?”

“হ্যাঁ দেন।”

বলেই আবারও মৌনতা রাগিনীর। কোন যেন বইয়ে পড়েছিল বৃষ্টিভেজা দিনে এক চায়ের টঙে বসে মাটির চায়ের ভাঁড়ে বসে হালকা চায়ের চুমুক এবং পাশে প্রিয় মানুষ থাকা মানে এক অদ্ভুত সুখানুভূতি। রাগিনীর কাছে সবটাই উপস্থিত। শুধুমাত্র প্রিয় মানুষটি বাদে।

রাগিনীর পাশে চায়ের ভাঁড় রেখে গেল চাওয়ালা। রাগিনীর হেলদোল হলো না। মুখে এসে বৃষ্টির পানির ছিটা লাগতেই চোখমুখ বন্ধ করে নিল সে। মুখে ভরে গেল বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটায়। চোখ খুলে চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিল সযত্নে। হঠাৎই ঘটল এক আগন্তুকের আগমন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছুটে এসে রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসল সেই আগন্তুকটি। আধভেজা বাহুর ছোঁয়া লাগতেই হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। মূহুর্তেই তার হাত থেকে ছোঁ মে’রে কেঁড়ে নিল চায়ের ভাঁড়। দেরি না করে চটপট নিজের ঠোঁট লাগলো চায়ের সেই ভাঁড়ে। সেই চেনা আগন্তুকটির হাত থেকে চায়ের ভাঁড় তড়িঘড়ি করে নিলো রাগিনী। এক নিঃশ্বাসে বলল,
“কী করছেন? আমি মুখ লাগিয়েছিলাম এতে।”

মানুষটি বিস্তর হেঁসে জবাব দিল,
“ওহ হো! সেকারণেই বোধহয় চায়ে বেশি মিষ্টি লাগলো। আমার ডায়বেটিস হওয়ানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছো তুমি? কী ভয়ানক!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হাতটা চলছে না একদম। খাপছাড়া লাগছে লেখাগুলো। গঠনমূলক মন্তব্যের আশায় রইলাম। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here