প্রিয় বেলা
৭.
আজ আবারও বৃষ্টি হয়েছে ধরণীতে। রাতের আঁধারে কালো মেঘেদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। আদ্রর ঘুম আসছে না। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে দাঁড়ালো সে। বৃষ্টির পানিতে বারান্দার মেঝে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। মাথা ব্যথা করছে ক্ষীণ। এখন একটু কফি খেলে মন্দ হয় না। দরজা ঠেলে রুম হতে বেরিয়ে পরলো আদ্র। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই রান্নাঘরে আলো জ্বালানো দেখতে পেল। অস্পষ্ট খুটুরখাটুর শব্দও হচ্ছে। নিমিষেই কপালে গাঢ় ভাঁজ সৃষ্টি হলো তার। এসময় রান্নাঘরে কে এসেছে? আদ্র এগিয়ে গেল সেদিকে।
চুলা জ্বালিয়ে কেতলিতে পানি গরম করছিল আয়াজ। কারো আসার শব্দে চোখ তুলে সামনে তাকালো। আদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিমিষেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—“ভাই চা পাতা কোথায় রেখেছে জানিস? খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”
বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে আবারও চা-পাতা খুঁজতে লাগলো। আদ্র চুলার কাছে এগিয়ে বললো,
—“জানি না। তুই না ঘুমিয়ে চা বানাচ্ছিস কেন?”
উপরের ক্যাবিনেটের একটু ভেতরে হাত দিতেই চা-পাতা পেয়ে গেল আয়াজ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। বললো, “ঘুম আসছে না। তুই কি করছিস এখানে?”
—“আমারো ঘুম আসছে না। আমাকে একটু কফি বানিয়ে দেয় তো।”
আয়াজ ঘোর আপত্তি করে বললো,
—“এখন আমি কফির পাউডার খুঁজবো কোথায়? চা খেলে বল, ঢালি।”
আদ্র উত্তর দিলো না। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে আয়াজও কিছু বললো না। কেতলিতে চা ওৎরাচ্ছে। দুই কাপে চাটুকু ঢেলে নিলো সে। আদ্র চায়ের কাপ নিয়ে সেখানে আলতো চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“বেলা যাওয়ার পর ওই ঘরে তালা দিয়েছিলি আয়াজ?”
আয়াজের যেন হঠাৎ কথাটা মনে পরলো। দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে হাসার চেষ্টা করে বললো,
—“একদম ভুলে গিয়েছি ভাই। চল এখন যাই। চা খেতে খেতে লাগিয়ে আসব। বৃষ্টি তো মনে হয় কমে গেছে এতক্ষণে।”
আয়াজ আর দাঁড়ালো না। কাপ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে। আদ্র একটু বিরক্ত হলেও কিছু বললো না আর। বাহিরে বৃষ্টি এখনো আছে। তবে আগের মতো না। ঝিরিঝিরি। গায়ে তেমন লাগছে না। তালা লাগাতে গিয়ে দুই ভাই কিছুক্ষণ ওই ঘরটাতেই বসলো। আয়াজ চায়ে চুমুক দিয়ে অনেকটা আগ্রহী গলায় বললো,
—“ভাই, এপর্যন্ত তুই মারাত্বক ভাবে মেরেছিস কাকে, কাকে?”
প্রশ্নটা শুনে আদ্রর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে সে নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো,
—“একজনকেই মেরেছি। পাশের এলাকার একটা ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে।”
—“খুবই ভালো কাজ করেছিস। তা সে বান্দা কি দোষ করেছিল?”
চা খাওয়া শেষ। টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে আদ্র জবাব দিলো,
—“ঠিক মনে নেই। রাজনৈতিক কাজে কিছু উলটাপালটা করেছিল বোধহয়।”
আয়াজ আবারও চায়ে চুমুক দিলো। তার কাছে চা একটু রয়েসয়েই খেতে ভালো লাগে। মুখটাকে একটু গম্ভীর করার প্রয়াস করে সে অকস্মাৎ বললো,
—“ভাই, তোর আর বেলার মাঝে কি চলছে বলতো। শরম-লজ্জা খেয়ে আমার সামনেই কপালে চুমু-টুমু খেলি। আবার কত আদর-যত্ন! সত্যি করে বলতো, কি চলছে তোর আর ওর মাঝে?”
চোখের তীক্ষ্ণতা বেড়ে গেল আদ্রর। ভ্রু যুগল আরও কুণ্ঠিত হলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“ওর সাথে আমার কি হবে?”
আয়াজ ঠোঁট বাঁকালো, “আমিও প্রেম করি ভাই। সত্যি কথাটা বলে ফেল এবার।”
আদ্র সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো না। ঘর থেকে বের হতে উদ্যোগী হয়ে বললো,
—“থাকবি নাকি যাবি? আমি তালা লাগিয়ে দেব এখন।”
শুনে তার পেছন পেছন আয়াজও উঠে এলো। কণ্ঠের জোড় বাড়িয়ে প্রখর আন্দোলন করে উঠলো,
—“তুই কিন্তু উত্তর দিচ্ছিস না।”
আদ্রর সহজ স্বীকারোক্তি,
—“পছন্দ করি আমি।”
__________
টিভি চলছে। সময় সংবাদে দূর্নীতিবিদ এক নেতাকে দেখানো হচ্ছে। তিনি আজ সকালে ভাষণ দিয়েছেন পাশের শহরে। টেলিভিশনের সাউন্ড আরেকটু বাড়িয়ে সায়েদ সাহেব ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সেই ভাষণ। পাশেই বেলা লাল চায়ে পরোটা ডুবিয়ে খাচ্ছে। বিহান খেলছে ওই দূরে। ভাষণ শুনতে শুনতে সায়েদ সাহেব বেশ আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলেন,
—“সব রাজনীতিবিদই এক। প্রচন্ড খারাপ। বুঝলি বেলা? এই ব্যাটা আগে চাদা তুলতো। কিভাবে যে নেতা হলো! এখনকার সব নেতাই গণ্ডমূর্খ। আমার চক্ষূশুল।”
বেলার খাবার গলায় আটকে গেল যেন। মস্তিষ্কে আদ্রর কথা হানা দিলো। আদ্রও তো রাজনীতিবিদ। বাবার মতো সেও তো ভাবতো তারা খারাপ। তাহলে তো আদ্রও খারাপ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই বেলার মন খুব গোপনে প্রতিবাদ করে উঠলো,
—“সব রাজনীতিবিদ খারাপ হয় না বেলা। কিছু কিছু রাজনীতিবিদ ভালোও হয়।”
বহুকষ্টে গলায় আটকে যাওয়া খাবারটুকু গিলে নিলো বেলা। সরব, দরজায় কারাঘাত হলো তীব্র শব্দে। বেলা উঠতে নিলে তাকে থামিয়ে দিয়ে সায়েদ সাহেব বললেন,
—“তুই বয়, আমি দেখছি।”
সায়েদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সদর দরজার কাছে গিয়ে তা খুলতেই চমকে গেলেন উনি। গাঢ় নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা পাঁচ-ছয় জন পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েদ সাহেব হতবাক গলায় কিছু বলবেন, তার পূর্বেই একজন সুঠাম দেহি পুলিশ গম্ভীর গলায় সরাসরি প্রশ্ন করলো,
—“আপনি সায়েদ সাহেব নিশ্চই। মিস্টার আইয়ুব এহতেশামকে কি আপনি চিনেন?”
সায়েদ সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। চোখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে বিহ্বল গলায় বললেন,
—“জি চিনি। আমার বোনের স্বামী হন।”
এবার পুলিশটি আরেকটু গম্ভীর হলো,
—“উনি আপনার নামে থানায় মামলা করেছেন। আপনি নাকি উনার প্রাপ্ত টাকা পরিশোধ করছেন না।”
সায়েদ সাহেব দিরুক্তি করে উঠলেন,
—“মিথ্যা কথা। আমি—।”
সায়েদ সাহেবকে সুযোগ না দিয়ে পুলিশটি জোড় গলায় বললো,
—“যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন। করিম? উনাকে নিয়ে আসো।”
ইতোমধ্যে ছোটোখাটো হট্টগোল সৃষ্টি হয়ে গেছে বাহিরে। আওয়াজ শুনে বেলা খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছে। প্রভা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। তিনিও ছুটে এলেন অচেনা পুরুষের চিৎকার শুনে।
বাহিরে এসে নিজ বাবাকে পুলিশদের কাছে টানাহেঁচড়া হতে দেখে অনেকটা চেঁচিয়ে বললো বেলা,
—“আমার বাবা– আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমার বাবাকে।”
দ্রুত আসতে গিয়ে বেলার মাথা থেকে ওড়না পরে গেছে। মুখশ্রী মুহুর্তেই ভয়ে কাতর, ভীতুগ্রস্ত। চোখ জ্বালা করছে। কান্না আটকে শক্ত গলায় বাবাকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
আশপাশের প্রতিবেশীগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে তামাশা দেখছে। রাস্তার মানুষগুলোও বাদ যায়নি। অনেকে তো ভিডিও করছে। তাদেরই একজন রাহেলা দিলদার। আদ্রদের বাসায় কাজ করেন তিনি। মাত্রই বস্তি থেকে হেঁটে হেঁটে কাজে এসেছিলেন। সায়েদ সাহেবের এই পরিণতি দেখে দৌড়ে গেলেন রেখার কাছে। রেখা তখন স্বপরিবারে টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছিলেন। রাহেলাকে দেখে তিনি বললেন,
—“বাহিরে এত আওয়াজ কিসের রাহেলা? কিছু কি হয়েছে?”
রাহেলা যেন আরও আগ্রহ পেয়ে গেলেন। রসিয়ে রসিয়ে বললেন,
—“ওই আপনাগো পাশের বাড়ি আছে না? সায়েদ মিয়ার বাড়ি। ওইহানে পুলিশ আইছে। সায়েদ মিয়ারে দেখলাম টাইনা টাইনা নিয়া যাইতেছে। উনার মাইয়া বেলা আটকাইতে চেশতা করতাছে। মাইয়ার সে কি কান্না, ইস! আমার এহনই মায়া লাগতাছে।”
আয়াজ সঙ্গে সঙ্গে আদ্রর মুখপানে তাকালো। তার খাওয়া থেমে গেছে। স্থির হয়ে বসে আছে সে। চোয়াল শক্ত। হাত মুঠো করা। রেখা চমকে কিছু বলতে গিয়ে আবারও থমকালেন। আদ্র সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হনহনিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বাড়ি হতে। আয়াজও আদ্রর পিছু নিলো। যেতে যেতে রেখাকে আশ্বস্ত করে বললো,
—“তুমি এখানেই থাকো মা। আমরা দেখি কি হয়েছে।”
জবাবে রেখা মৃদু কণ্ঠে বললেন,
—“তা-ই দেখ। একয়দিন ওদের ওপর কি যে যাচ্ছে!”
__________
বেলার আহাজারি কেউ শুনছে না। পুলিশগুলো কি পাষাণ ভাবে তার বাবাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ধস্তাধস্তিতে বেলার ওড়না এলোমেলো। নেত্রজোড়া জল আটকাতে অক্ষম। তরতর করে গাল জোড়া ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। বেলা আবারো চিৎকার করে উঠলো,
—“আমার বাবাকে ছেড়ে দিতে বলেছিনা আপনাদের? তবুও কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বলেছিনা টাকা দিয়ে দিবো।”
কন্সটেবল করিম বিরক্ত হয়ে এবার ঝাড়ি দিয়ে উঠলো,
—“এই মেয়ে, যা এইখান থেকে।”
বলার মাঝে হঠাৎ করিমের শার্টের কলার শক্ত করে ধরলো আদ্র। হুংকার ছেড়ে উঠলো, “ছাড় উনাকে।”
পুলিশগুলোর হ্যাড রেগে তাকালো। কঠিন গলায় ধমক দিলো,
—“এই ছেলে, এই! কলার ছাড়ো। একজন পুলিশের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হলো কিভাবে তোমার?”
আদ্র উত্তর দেওয়া তো দূর! পুলিশ অফিসারের দিকে তাকালোও না। রক্তলাল চোখে করিমের দিকে চেয়ে আবারো হুঙ্কার ছাড়লো,
—“আয়াজ।”
সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো আয়াজ। পুলিশ অফিসারটির দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। পুলিশটি ভ্রু কুঁচকে ফোন কানে রাখলো। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই দমে গেল সে। আমতা আমতা করতে লাগলো। কথা শেষে আয়াজকে ফোন ফেরত দিয়ে আদ্রর দিকে ভীতু চোখে তাকালো। মাথা নুইয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
—“ক্ষমা করবেন স্যার। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। এই করিম, সায়েদ সাহেবের কলার ছাড়ো।”
করিম বিস্ময়ে হাত ছেড়ে দিলো। আদ্রও কলার ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। পুলিশ আইয়ুব এহতেশামের অভিযোগ বলতেই রাশভারি গলায় সে বললো,
—“আপনারা সবাই চলে যান। আংকেলের যখন সময় হবে তিনি টাকা পরিশোধ করে দেবেন।”
একে একে সবাই চলে গেল। প্রতিবেশীগুলোও এখন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না। রাস্তা আবারও নীরব। প্রভা বেগম সায়েদ সাহেবকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন। বেলা আদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে ডুকরে কাঁদছে। যন্ত্রণায় বুকটা ভীষণ ভারি লাগছে তার। বেলার দিকে ক্ষীণ এগিয়ে এলো আদ্র। গালে আলতো স্পর্শ করে দৃশমান মুক্তোর দানাগুলো বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিলো। থমথমে গলায় আয়াজকে ডাকলো,
—“আয়াজ।”
আয়াজ তৎক্ষণাৎ সারা দিলো,
—“হু, বল ভাই।”
—“আঙ্কেলের ভিডিও যেন সোশ্যাল মিডিয়াতে না বের হয়। সবাইকে ওয়ার্ন করবি এবং নিজে থেকে ভিডিওটা ডিলিট করবি। নয়তো তোকে আস্ত রাখবো না আমি।”
আয়াজ মাথা দুলিয়ে সরে গেল সেখান থেকে। রেখা হয়তো বাড়িতে দুশ্চিন্তা করে প্রেশার বাড়াচ্ছেন। আপাতত উনাকে শান্ত করতে হবে।
আয়াজ চলে গেল। আদ্র বাকি দূরত্বটুকুও ঘুচালো। আবারও ভিঁজে যাওয়া গাল অতি সন্তপর্ণে মুছে দিলো। বেলার ভেঁজা পাঁপড়িগুচ্ছে একদফা হাত বুলালো। বেলা যেন খুব আহ্লাদী হয়ে উঠলো। কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিজের দিকে ফেরালো আদ্র। কোমলস্বরে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,
—“হুশ! আর কাঁদবেন না বেলা। চোখ ফুলে গেছে আপনার। বেশি কাঁদলে মাথা ব্যথা করবে। দেখি, আমার দিকে তাকান।”
__________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা