প্রিয় বেলা
১৫.
আদ্রর ঘোরলাগা দৃষ্টি তখনো স্থির। ঠোঁটের কোণে বাঁকানো হাসির অস্তিত্ব খুব প্রখর ভাবেই আছে। বেলা এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ঘন ঘন পলক ফেলছে। আদ্রর চাহনির পরিবর্তন ঘটছে না। সে অনড়, ক্ষান্তহীন। প্রগাঢ়তায় ভরা সেই চাহনির বিপরীতে প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট বেলা। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
—“অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনার ঘুমানো প্রয়োজন।”
আদ্র শুনলো না বোধহয়। আশপাশটায় একটু তাকালো মাত্র। আরও একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। আদেশ সমেত বললো,
—“ছাদে আসুন।”
রাত্রি গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। বেলার মাথায় ঘোমটা নেই। দিতে ভুলে গেছে সে। বিহান ঘুমের মাঝে নড়চড় করছে বারবার। বেলা সচকিত হলো। মানা করে বললো,
—“আপনি অসুস্থ। সকালও হবে কিছুক্ষণ পর। চলে যান। আমি আসব না।”
বলে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যোগী হলো সে। আদ্র রেলিংয়ে দুহাত রেখে আরাম করে দাঁড়ালো। নভস্থলে গভীর দৃষ্টি মেলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
—“আমি তবুও অপেক্ষা করবো বেলা। কারণ আপনি আসবেন।”
বেলার পা থমকালো না। বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো হালকা শব্দে। দরজার কাঠে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। মুখ থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাসগুলো অবিন্যস্ত হলো। চোখ বুজে এলো। হঠাৎ কি মনে করে জানালার পর্দা অল্প সরালো সে। আদ্র এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে আকাশপানে কি যেন দেখছে। লোকটা কি সত্যিই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাহিরে শীত কম নয়। শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। তারওপর আদ্র অসুস্থ। বেলা আর রুমে থাকতে পারলো না। গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হলো, ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠলো। সর্বশেষে ছাদে এসেই দেখতে পেল আদ্রকে। তার আসার আভাস পেয়ে লোকটা তার দিকে তাকিয়েছে। ঠোঁটে এসে হানা দিয়েছে স্নিগ্ধ হাসি। কি সুন্দরই না লাগছে মানুষটাকে!
বেলা আরেকটু এগিয়ে আসতেই আদ্রর হাসি আরও গাঢ় হলো। অস্থির চোখজোড়া বেলার মুখশ্রী জুড়ে ঘুরতে লাগলো। সে বললো, “আমি জানতাম, আপনি আসবেন।”
আদ্রর পেশিবহুল ফোলা ফোলা হাতের বাহু অনাবৃত। গলা বড় হওয়ায় বুকের ব্যান্ডেজটার ক্ষীণ অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে সে। চোখের ঠিক ওপরে, ভ্রুয়ের কাছ ঘেঁষে লম্বালম্বি দু’টো দাগ দেখা যাচ্ছে। এমন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও লোকটা কেমন দিব্যি হাসছে। বেলা দৃষ্টি লুকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“আমি এসেছি। এবার চলে যান।”
—“আপনাকে জড়িয়ে ধরা এখনো বাকি আমার।”
তৎক্ষণাৎ এক কদম পেছালো বেলা। গলা কাঁপিয়ে লহু চিৎকার করলো, “না।”
আদ্র হেসে ফেললো। মেয়েটাকে ভয় পেলেও দারুণ লাগে। দৃঢ় গলায় বললো,
—“এখানে আসুন বেলা। দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছেন কেন?”
বেলা এবার একটু রাগ নিয়েই বললো,
—“এক্সিডেন্ট করে আপনার মাথা গেছে একদম।”
বিনিময়ে আদ্র আবারও হাসলো। গুরুগম্ভীর নেত্রজোড়াও চঞ্চল হলো। হিমেল হওয়া হঠাৎই থেমে গেল। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ, তারা দু’জন। আদ্র ঠোঁটের হাসি ধূলিস্যাৎ করে ধারালো কণ্ঠে সূক্ষ্ণতা নিয়ে বললো,
—“আপনাকে আমার কাঁদাতে ইচ্ছে করছে বেলা। আপনার কান্নারত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।”
বেলা চমকিত হয়। হকচকিয়ে তাকায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। এত ভয়ংকর কারো ইচ্ছে হয়?
–
ক্লাবে সব দামি দামি জিনিস। দরজা, জানালা সব বন্ধ করা। মাথার ওপর ফুলস্প্রীডে ফ্যান চলছে। সাদা বাতির আলোয় আলোকিত বড়সড় রুমটা। আদ্র টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার সামনেই দলের ছেলেগুলো দাঁড়ানো। তাদের মাঝে মধ্যিকানের তন্ময় নামের ছেলেটি ক্ষীপ্ত গলায় বললো,
—“ভাই, বিপক্ষের ছেলেগুলো এবার বেশি করছে। আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে নিজেদেরগুলো লাগাচ্ছে। কিছু হলেই মারামারিতে এসে যাচ্ছে। আপনি শুধু আদেশ দেন আমরা–।”
তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। হাতের কিউবটা নাড়াতে নাড়াতে শান্ত স্বরে বললো, “নির্বাচনের বেশিদিন নেই। আর কয়েকদিন যাক। ব্যাপারটা দেখব আমি।”
তন্ময় অসহায় কণ্ঠে বললো,
—” ভাই, আমরা কিছু বলছি না দেখে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। আপনার ওপর হামলা করলো। কালকে আবার আমাদের দুজন ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একজনের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনি কি এখনও কিছু বলবেন?”
কিউবটা সশব্দে টেবিলে রাখলো আদ্র। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো,
—“আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?”
—“আপনাকে কল করছিলাম ভাই। আপনি ধরেন নাই।”
আদ্র তবুও রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিকে। রাগ আর প্রকাশ করলো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,
—“আজ রাতেই যা করার করবি। দু’একজন ছুঁড়ি নিলেও প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করবি না। সবাই হকিস্টিক নিবি। যেভাবে পারিস একেকটার হাত-পা ভেঙ্গে দিবি। আর সাবধান। কেউ যেন তোদের চেহারা না দেখে।”
টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো আদ্র। আকিব এগিয়ে আসলো দ্রুত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
—“এখন কোথায় যাবেন ভাই?”
—“বাসায়ই যাবো। আসো।”
আদ্র গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। আকিবও পেছন পেছন আসলো।
জ্যামে আটকে পরেছে আদ্রর গাড়িটা। এসি চলছে। তবুও গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। চুল অগোছালো। বিরক্ত মনে জানালা গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টি ফেলল সে। ফুটপাতে অল্পবয়সী একটা মেয়ে চুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাঁচের চুড়ি। লাল, নীল, কালো, হলুদ, সবুজ। আরও কত রঙের! লাল রঙের চুড়িগুলোয় চোখ আটকে গেল আদ্রর। বেলার কথা মনে পরলো। পাশে বসা আকিবকে ডাকলো,
—“আকিব, শুনো।”
আকিব সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, “জি ভাই বলেন।”
—“ওখানে চুড়ি দেখছো না? লাল রঙের সব চুড়ি নিয়ে আসো। টাকা নিয়ে যাও।”
আকিব মাথা দুলালো। দ্রুত রাস্তার গাড়ি, রিকশা পেরিয়ে ফুটপাতে বসা মেয়েটি থেকে চুড়ি নিতে লাগলো। আদ্র সেদিকে তাকিয়ে জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। বেলার মুখশ্রী ভেসে উঠছে। রাতে না ঘুমানোয় তন্দ্রা এসে জেঁকে বসছে দৃঢ়তার সঙ্গে। আদ্র ঘুমিয়ে যেতে লাগলো। তার আগ অব্দি অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়িয়ে অভিযোগ করে উঠলো, “আপনি আমার সঙ্গে এভাবে মিশে যাচ্ছেন কেন বেলা? পাগল করে দিচ্ছেন আমায়।”
–
১৮ই মাঘ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ঘড়ির কাটায় বিকাল পাঁচটা বাজছে। প্রভা বেগম পায়েস রান্না করেছেন আজ। বেলাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন একবাটি পায়েস যেন রেখাকে দিয়ে আসে। বেলা দিরুক্তি করলে শান্ত গলায় কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“ওরা কিছু বানালে আমাদেরকে দেয় নি এমন কখনো দেখেছিস? আমাদেরও তো দায়িত্বে পরে কিছু বানালে ওদেরকে দেওয়ার, তাই না? যা না মা। এমন অবাধ্য হচ্ছিস কেন?”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রদের বাড়ি উপস্থির হলো বেলা। রেখা ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে ছিলেন। টিভিতে সময় চ্যালেন চলছে। দলনেতা হয়ে স্টেজে স্পিচ দিচ্ছে আদ্র। পরনে মুজিব কোর্ট। সবসময়ের মতো ভ্রু কুঁচকে একের পর এক হাঁড় কাঁপানো বাক্য বলে যাচ্ছে সে। কণ্ঠে সে কি তেজ, কাঠিন্যতা, দাম্ভীকতা! সবাই হইহই করে তালি দিচ্ছে।
রেখা বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠিক হয়ে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,
—“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো। আমার পাশে বসো।”
টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলা সোফায় বসলো। পায়েসের বাটিটা রেখাকে দিয়ে বললো,
—“এটা আপনাদের জন্য মা পাঠিয়েছে।”
এমনিতে হলে রেখা এতক্ষণে উৎফুল্লতায় ভরে উঠতেন। অথচ আজকে মুখটা মলিন। একটু করে হেসে বললেন,
—“তোমার মা ভালোই করেছে পায়েস পাঠিয়ে। খেতে ইচ্ছে করছিল।”
বলে পায়েসের বাটিটা টেবিলে রেখে দিলেন। বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি ঠিক আছেন আন্টি? না মানে, আপনাকে কেমন অসুস্থ লাগছে।”
—“হ্যাঁ। প্রেসার বেড়ে গেছে একটু।” হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।
এর পিঠে বেলা কি বলবে খুঁজে পেল না। ভেতরে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য মন স্থির করতেই হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো আরু। বেলাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। বললো, “কেমন আছো আপু? আমি এখন তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম। তোমাকে ডাকতে।”
বেলা অবাক নয়নে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে ডাকতে? কোনো প্রয়োজন ছিল আরু?”
—“হ্যাঁ, তা তো ছিলই। চলো আমার সঙ্গে উপরে যাবে। আসো।”
বেলা একপলক রেখার দিকে তাকালো। উনি ইতিমধ্যে পায়েস খাচ্ছেন। এদিকে খেয়াল নেই অত। আরুর সাথে উপরে চলে গেল সে। আরু তাকে আয়াজের রুমে নিয়ে এসেছে। সাধারণ, অল্প অগোছালো রুম। স্বাভাবিক ভাবে ছেলেদের রুম যেমন হয়। আয়াজ আগে থেকে বিছানায় বসে ছিল। বেলা আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বিস্তর হেসে বললো,
—“এসেছো? বসো। তোমার মূল্যবান জিনিসটা আগে দিয়ে দেই। নয়তো ভাই আমাকে আস্ত রাখবে না।”
বলতে বলতে সে আলমারি থেকে একটা প্যাকট বের করে ধরিয়ে দিলো বেলাকে। বেলা সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আয়াজ মিটিমিটি হেসে বললো,
—“খুলে দেখো কি আছে।”
বেলার অস্বস্থি হচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে প্যাকেটটার দিকে তাকালো সে। খুললো। অনেকগুলো লালচুড়ি দেখে বিস্ময় যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল। আয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“এতগুলো চুড়ি– কে দিয়েছে?”
উত্তরে আয়াজ আগের ন্যায়ই বললো,
—“ভেতরে একটা কাগজও আছে। বের করে পড়ো। তোমার উত্তর ওখানে আছে।”
বেলা কাঁপা হাতে চুড়িগুলো ক্ষীণ সরালো। হলুদ রঙের কাগজ বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। বেলা কাগজটা বের করলো। কালো কালি দিয়ে খুব সুন্দর হাতের লিখা ভেসে উঠছে সেখানে,
—“আপনার হাতের মাপ আমার জানা নেই বেলা। তাই সবগুলোই নিলাম। একদিন এগুলো পরে আমাকে চমকে দেওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
~আদ্র ইয়ানিদ।”
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা