প্রিয় বেলা
২৭.
আয়নার প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখছে বেলা। গায়ে মায়ের ভারী শাড়ি জড়ানো। লাল রঙের। হাতে আদ্রর দেওয়া চুড়িগুলো। আদ্রর নামে সেজেগুঁজে থাকা তার মুখশ্রী। কপালের পাশ ঘেঁষে এক্সিডেন্টের দাগ এখনো যায়নি। হাতের কনুয়ের ক্ষতদাগ শাড়ির আঁচলে ঢাকা পরে আছে। ঠোঁটে হাসি নেই। ভেতরকার দুর্বলতা, ভয়, জড়তা, সব একসাথে জড় হয়ে দলা পাকিয়ে আছে। অস্থির লাগছে। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো বেলা। উঁকিঝুঁকি করলো আদ্রর বাড়ির ওদিকটায়। বাড়ির প্রবেশ পথে পাঁচ,ছটা দেহরক্ষী পাহারা দিচ্ছে। বাগানের ভেতরে আরও বেশকিছু আছে। হাতে বড় বড় বন্দুক সবার। মুখে কি তীব্র কাঠিন্যতা, রুঢ় ভাব। এদের দেখেই তো শিরশির করে উঠছে বেলার শরীর। আদ্রর অস্বস্থি হয় না?
ভাবনার মাঝেই প্রভা বেগম এলেন রুমে। এগিয়ে এসে বেলাকে খুব করে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
—“ভীষণ সুন্দর লাগছে তো আমার মাটাকে।”
বলে কপালে চুমু খেলেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন,
—“সকাল থেকে তো কিচ্ছু পেটে পরেনি। ক্ষুধা লেগেছে? খাবার আনবো?”
বেলা মাথা দুলালো। অর্থাৎ, খাবে না। প্রভা বেগম পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। চোখে পানি এসে ধরা দিলো উনার। কান্না আটকালেন। মমতাময়ী কণ্ঠে কাতর হয়ে বললেন,
—“দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলি বেলা। এইতো, সেদিনই তো মাত্র আমার কোল জুড়ে এলি। এখন দেখ, আজকে নাকি তোর বিদায় বেলা।”
নেত্রকোণে জলরাশির অদৃশ্য অস্তিত্ব জানান দিতেই আঁচলের ঘঁষায় সেটুকু জল মুছে নিলেন প্রভা বেগম। বেলার দিকে একবার তাকিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, “আদ্রর পরিবার আসতে বেশি দেড়ি নেই। শাড়িটা ভালোভাবে সামলে তুই তৈরি হয়ে থাক।”
অভ্যন্তরীণ পীড়াদায়ক দীর্ঘশ্বাস খুব কষ্টে বেরিয়ে এলো যেন। বেলা বিছানায় গিয়ে বসলো। দোটানায় বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে তার মন। একদিকে তার নেতা সাহেবকে নিজের করে পাওয়ার তীব্র উচ্ছাস আর অন্যদিকে বাবা, মা, ভাই, সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার বিক্ষিপ্ত বেদনা।
–
কলের ওপর কল আসছে আদ্রর। সব ইখতিয়ারের নম্বর থেকে। আদ্র ধরলো না একটাও। কেটে দিলো। ফোন বন্ধ করার পূর্বে শুধু ছোট্ট করে একটা বার্তা পাঠালো, “টাকা পেয়েছি। সকালে কথা হবে।”
ফোনটা আকিবের কাছে দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো সে। আকিব মলিন মুখে পকেটে ভরে নিলো তা। আদ্রর পিছু নিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,
—“আপনি কি সত্যিই ওই বেয়াদপটার সঙ্গ দিচ্ছেন ভাই?”
—“তোমার কি মনে হয়?”
পালটা প্রশ্নে ক্ষীণ ইতস্তত করলো আকিব। আগের চেয়েও অধিক মলিন গলায় বললো, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাই। আপনি খারাপ কিছুতে জড়াবেন না এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু চোখের সামনে যা হচ্ছে সেটাও তো অবিশ্বাস করতে পারছি না।”
প্রতিউত্তরে কেমন করে যেন হাসলো আদ্র। হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে। অদ্ভুদ ভাবে। নির্বিকার স্বরে বললো, “আজকে আমার বিয়ে হচ্ছে আকিব। এমন উদাস হয়ে থেকো না তো। এনজয় ইউর সেল্ফ।”
বলতে বলতে কলিংবেল চাপলো আদ্র। আকিব কথাটা শুনলো ঠিক, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারলো না। আদ্রকে বেশ রহস্যজনক লাগছে তার। বুঝে ওঠার বাহিরে।
ততক্ষণে দরজা খুলে গেছে। সামনে আদ্রকে দেখে সায়েদ সাহেব বিস্তর হাসলেন। প্রফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “এত দেড়ি করে আসলে যে বাবা? আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। কাজী এসে গেছেন। আসো।”
বিয়েটা হয়ে যায় একটু তাড়াহুড়ো করেই। আয়োজন ছাড়া। আত্মীয়-স্বজনহীন। খুব গোপনে। মিডিয়ার কেউ এখন অব্দি অবগত নন। কবুল বলার পূর্বেও বেলার বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রভা বেগমের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। পলক ফেলে আশপাশটা দেখছিল শুধু। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি বাস্তব?
–
মাথার ওপর ভন ভন করে ফ্যান ঘুরছে। তবুও গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে আছে আদ্রর কপাল, ঘাড়, গলা। ভ্রু বাঁকানো। ললাট বাজেভাবে কুঁচকানো। লাল রঙের শার্টটির প্রথম দু’টো বোতাম খুলে ফেললো সে। গলা উঁচিয়ে বললো,
—“ফ্যানের পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দাও তো বেলা।”
বিছানার কোণে বসে থাকা বেলা ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো। নিঃশব্দে উঠে গিয়ে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিলো। নিজ জায়গায় এসে বসতেই আদ্র আবারও আগের মতোই অলস গলায় বললো,
—“খুব পিপাসা পেয়েছে বেলা। পানি দাও।”
জগ থেকে পানি নিয়ে আদ্রর কাছাকাছি হলো বেলা। পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই তা নিলো সে। একনিশ্বাসে সম্পূর্ণ পানি পান করে খালি গ্লাসটা ছুঁড়ে রাখলো বিছানায়। অল্প পানির ছিঁটায় ভিজলো বিছানার চাদর। আদ্র পরোয়া করলো না। বেলার হাত টেনে পাশে বসালো। কোলে মাথা রাখলো খুব অধৈর্য ভাবে। প্রগাঢ় দৃষ্টি ফেললো বেলার মাত্র ধুঁয়ে আসা সাজহীন স্নিগ্ধ মুখপানে। আদ্রর ঠোঁটে হাসি নেই। একটু আগের আলস্য ভাবটাও নিখোঁজ। হাত উঁচিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো সে। শুধালো, “মন খারাপ?”
বেলা উত্তর দিলো না। চুপ রইলো। আদ্র আরেকটু ঘনিষ্ট হলো যেন। বেলার এক হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। ধীরকণ্ঠে বললো,
—“বেশি খারাপ লাগলে তুমি আজকের দিনটা এখানে থাকো। আমি কাল সকালে এসে নিয়ে যাবো। ঠিকাছে?”
সঙ্গে সঙ্গে বেলা দিরুক্তি করে উঠলো, “আমি আপনার সঙ্গে যাবো।”
তার অকপটে বলা নিঃসঙ্কোচ কথার পিঠে সশব্দে হেসে ফেললো আদ্র। বিরতীহীন ভাবে, দীর্ঘক্ষণ। হাসতে হাসতে নেত্রপল্লব বুঝে এলো তার। বেলার লজ্জা বাড়লো। রক্তিম আভায় সিক্ত হলো গাল। অথচ বেহায়া দৃষ্টি ঠিকই একটু পর পর লোকটাকে দেখছে। কি বিশ্রী অবস্থা!
আদ্রর হাসি থামাতেই বেলা মিনমিন করে বললো,
—“একটা প্রশ্ন করি?”
আদ্র ভ্রু কুঁচকালো,
—“জিজ্ঞেস করতে হবে না।”
বেলা আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
—“রাজনীতি বাবা একটুও পছন্দ করে না। আপনি রাজনীতিবিদ। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাবা কখনোই মেনে নিতো না। সেখানে এত সহজে আমাদের বিয়ে মেনে নিলো কিভাবে? আপনি কিছু করেছেন?”
কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো আদ্র। দায়সারা ভাবে বললো,
—“আমাকে বলছো কেন? তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো। উনি বলবেন।”
বেলা গলায় জোড় দিলো, “আমি আপনার থেকে শুনতে চাইছি। বলুন না!”
—“তোমার বাবার পেছনে পুরো চারদিন ঘুরতে হয়েছে আমার।”
কথাটা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো আদ্র। তার মুখ দেখে নিমিষেই হেসে ফেললো বেলা। আদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। হঠাৎ-ই ঝুঁকে এলো বেলার দিকে। বেলা থমকালো। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র দৃঢ় গলায় বললো,
—“তবুও আমি আমার কথার নড়চড় করিনি।”
বেলা পলক ঝাপটালো। ক্ষীণ আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
—“কোন কথা?”
আদ্র গাঢ় চোখে তাকালো তখন৷ টেবিলে পরে থাকা গোলাপগুলোর দিকে ইশারা করে বললো,
—“গোলাপগুলোর পাঁপড়ি পরে যাওয়ার আগে তোমাকে ঘরে তুলবো বলেছিলাম। আমি আমার কথা রেখেছি।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা