হৈমন্তিকা পর্ব – ১১

0
387

হৈমন্তীকা

১১.
‘দাঁড়ান, হৈমন্তীকা’ তুষারের বলা এই একটি বাক্য শুনে ভড়কে গেল হৈমন্তী। তুষার দেখে ফেলেছে তাকে। ডাক শুনেও দাঁড়ালো না সে। বরং পায়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। পেছন থেকে তুষার অনবরত ডেকে যাচ্ছে। হৈমন্তী তবুও থামলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে তুষারের সাথে কথা বলবে না। তুষারের সামনেই যাবে না আর।
ডাকতে ডাকতে একসময় চুপ হয়ে গেল তুষার। কিন্তু তার পায়ের শব্দ তীব্র ভাবে শুনতে পাচ্ছে হৈমন্তী। তার সঙ্গে সঙ্গে তুষারও সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছে। তিন তলায় আসতেই তুষারকে নিজের কাছাকাছি অনুভব করলো সে। আরও দ্রুত পা চালানোর আগেই, পেছন থেকে তার হাত খপ করে ধরে ফেললো তুষার। শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে নিলো। হৈমন্তী ভীষণ চমকালো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
— “এগুলো কি ধরণের অসভ্যতা তুষার? হাত ছাড়ুন।”
— “আপনাকে এতগুলো ডাক দিয়েছি আমি, শুনেন নি?”
হৈমন্তী মুখ শক্ত করে জবাব দিলো,
— “না।”
— “কালকে আসেন নি কেন হৈমন্তীকা?”

তুষারের কণ্ঠে কোনো রাগ নেই। কণ্ঠস্বর একদম শীতল, ঠান্ডা। তবে অভিমানে ভরপুর। হৈমন্তী অন্যদিকে চেয়ে উত্তর দিলো,
— “ইচ্ছে হয় নি তাই। এবার ছাড়ুন।”

বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। তুষার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ-ই হৈমন্তীকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো নিচে। হৈমন্তীর পরনে ঘরের এক আধপুরোনো সবুজ রঙা কামিজ। মেচিং ছাড়া নীল ওড়না এবং সাদা পায়জামা। এই অবস্থায় তুষার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিরক্তিতে মুখ পাংশুটে হয়ে গেল হৈমন্তীর। ইতিমধ্যে বিল্ডিংয়ের বাহিরে এসে গেছে তারা। দারোয়ান চাচার সামনে দিয়ে যখন তুষার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দারোয়ান চাচা কিভাবে হাসছিলেন তখন। ভাবতেই লজ্জা লাগছে হৈমন্তীর। সে আবারও হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস করতে লাগলো। রাগী গলায় ধমক দিলো,
— “আপনার সমস্যা কি তুষার? আমার হাত ছাড়ুন! নইলে আবার চড় খাবেন আমার হাতে। বেয়াদব কোথাকার!”

তুষার জবাব দিলো না। রাস্তার ওপাশে নিয়ে গেল। বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত রাস্তায়। তাদেরকে এভাবে হাত ধরা অবস্থায় দেখে ওরা কি ভাববে? তুষার কি নির্বোধ হয়ে গেছে? হৈমন্তী আরও বেশ কয়েকবার হাত ছাড়তে বললো। তুষার আগের মতোই নিশ্চুপ, নির্বিকার, নির্লিপ্ত। হৈমন্তী নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না। মুক্ত হাতটি দিয়ে জোড়ে চড় মারলো তুষারের ডান গালে। ভাবলো, তুষার হয়তো এবার হাত ছাড়বে। কিন্তু আশানুরূপ তেমন কিছুই ঘটলো না। তুষারকে আগের চেয়েও বেশি নির্লিপ্ত দেখালো এবার। হৈমন্তীর দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। তবে চোয়াল খানিক শক্ত হয়ে এলো তার।

তুষার একটা রিকশা ডাকলো। অগোছালো হৈমন্তীকে নিয়ে যেতে লাগলো কোনো এক জায়গায়। ততক্ষণে হৈমন্তীও প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত। হাল ছেড়ে চুপচাপ বসে আছে তুষারের অল্প দূরত্বে। তুষার তখনো তার হাত ছাড়ে নি। আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।

_____

কোনো এক নদীর তীর। ছোটখাটো কিছু নৌকা, স্টিমার নদীর বুক চিঁড়ে ছুটে চলছে। পানিতে পানিতে তান্ডব ঘটছে। তীব্র ভাবে ঢেউ বহমান। বাতাসের আনাগোনা প্রচন্ড। কোনোমতে করা খোপা ঢিলে হয়ে কাঁধে এসে ঠেকেছে হৈমন্তীর। ছোট চুলগুলো উন্মুক্ত কাঁধে বিঁধে গিয়ে কি ভীষণ চুলকাচ্ছে! হৈমন্তী আবারো হাত খোপা করতে লাগল। তার পাশে দাঁড়ানো তুষার মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল প্রেয়সীর চুল বাঁধা। একমনে চেয়েই রইলো, পলক ফেলছে না একদমই। হৈমন্তীর খেয়ালে এলো তা। হাত নামিয়ে, ক্রুদ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলো,
— “বারবার মানা করা সত্ত্বেও আমাকে এখানে এনেছেন কেন?”
হৈমন্তী থেকে চোখ সরালো সে। নদীর দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,
— “ধরুন, আপনি একটা পিকনিকের আয়োজন করলেন। সবাই জানলো, পিকনিকটা আপনি করেছেন আপনার কাজিনদের জন্য। অথচ আপনার মনে অন্য কিছু। প্রতিদিনের চেয়ে আরেকটু বেশি সময়ের জন্য একজনকে দেখার তাড়নায় পিকনিকটি আয়োজন করেছেন আপনি। ওই একজনকে বারবার ডেকে পাঠিয়েছেন পিকনিকে আসার জন্যে। তবুও সে আসলো না। এবং আপনি তবুও অপেক্ষা করে গেলেন ওই একজনের জন্য। একসময় পিকনিক শেষ হয়ে গেল। তখনো তার আসার নাম নেই। তাকে একটা বার দেখার ব্যাকুল ইচ্ছায় আপনি তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় ভোর অব্দি। কিন্তু ফলাফল শূণ্যই রয়ে গেল। তখন আপনার কেমন অনুভূতি হবে? কষ্ট হবে না? দহন সৃষ্টি হবে না মনে?”

একটু থামলো তুষার। হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে বললো,
— “আমি অপেক্ষা করেছিলাম, হৈমন্তীকা। আপনি আসেন নি।”

মুহুর্তেই হৈমন্তীর বক্ষস্থলে বয়ে গেল এক নিদারুণ যন্ত্রণাময় অনুভূতি। কেমন দোটানায় পরে গেল সে। কেন যেন মনে হতে লাগল, তুষারের জন্য তার মনে অন্য এক অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর আমি নামক ব্যক্তিটি গোপনে চিৎকার করে উঠল, ‘এ পাপ হৈমন্তী। এ অসম্ভব।’

হৈমন্তী দমে গেল। অতি সন্তপর্ণে ক্ষীণ অনুভূতিগুলো আড়াল করে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
— “আমি এখনই বাসায় যাবো।”
বুক চিঁড়ে এক সুগভীর, পীড়াদায়ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তুষারের। কিছু সময় নির্নিমেষ চেয়ে দেখল হৈমন্তীকে। এরপর বললো, “চলুন, হৈমন্তীকা।”

_____

রিকশা এসে থামলো বিল্ডিংয়ের সামনে। গেটের মাঝে বড় বড় করে লেখা ‘তৈমুর ভবন’
তুষার তৈমুর। তুষারের পুরো নাম। তুষারের নামেই এই বিল্ডিংটি তৈরি। আফতাব সাহেব ভীষণ ভালোবাসেন তার ছেলেকে। তেমনি শাসনও করেন। তিনি নিশ্চয়ই তার ছেলের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ভেবে রেখেছেন। সেখানে তার ছেলে তো তার কথা শুনছেই না। বিপথে হাঁটছে। নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে ভালোবাসা তো কোনো সঠিক কাজ নয়। সমাজ কি বলবে, আত্মীয় কি বলবে, তারচেয়ে বড় কথা ভবিষ্যতের কি হবে? ছোট ছেলের সঙ্গে কি চিন্তাধারার মিল হবে? তাছাড়া হৈমন্তীর বাবারও হৈমন্তীকে নিয়ে অনেক আশা। সে আশা কিভাবে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করবে সে?

হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষার তার পাশেই হাঁটছে। একেবারে দু’তলা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো সে। দরজার কাছাকাছি এসে হৈমন্তী যেতে নিলেই তুষার সুপ্ত আবদার করে উঠলো,
— “আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি হৈমন্তীকা?”

বলে উত্তরের আর অপেক্ষা করলো না সে। হুট করে জড়িয়ে ধরলো হৈমন্তীকে। নিজের বুকের সঙ্গে গভীর ভাবে ঠেকিয়ে রাখলো ওর মাথা। হৈমন্তী শক্ত হয়ে গেল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। তুষারের বুকে ধাক্কা দিয়ে কাঁপা গলায় তেজ ঢেলে আদেশ দিলো,
— “স-রু-ন, তুষা-র…”

তুষার একটু নিবিড় হতেই হৈমন্তীর কণ্ঠ থেমে গেল।

____________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here