#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২০
.
সোনা দিয়া বান্ধায়াছি ঘর
ও মন রে ঘুণে করল জর ও জর
হায় মন রে সোনা দিয়া বান্ধায়াছি ঘর
ও মন রে ঘুণে করল জর জর
আমি কি করে বাস করিব এই ঘরে রে
হায় রে তুই সে আমার মন ।
মন তোরে পারলাম না বুঝাইতে রে
হায় রে তুই সে আমার মন ….
জীপগাড়িতে বসে আনন্দে মেতে উঠেছি সবাই। আর এই আনন্দটাকে আরো আনন্দময় করার জন্য ইয়াসিন ভাইয়া গান গেয়ে চলছেন। ভাগ্যক্রমে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবে আমি আর রেয়ান পাশাপাশি বসেছি।
কিন্তু এতসব আনন্দে এক বিন্দু পরিমাণও খেয়াল নেই তার। সে চুপচাপ হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো তাকে জ্বালাতে। সবার শেষে বসায় কেউ তাকাচ্ছে না আমাদের দিকে। ইয়াসিন ভাইয়ার দিকেই সবার পুরোদমে মনোযোগ। সুযোগটা কাজে লাগালাম আমি। কনুই দিয়ে উনার পেটে গুঁতো দিলাম। তবে উনার কোনো হেলদোল নেই। আগের নেয়ই চোখ বন্ধ করে সে। ঘুমিয়ে গিয়েছেন নাকি? ভাবতেই ভ্রু কুঁচকে গেল। মৃদু স্বরে উনাকে বললাম,
— “শুনছেন?”
চোখ বন্ধ থেকেই তার জবাব,
— “শুনছি!”
তার মানে উনি জেগে! একটু কেঁশে বললাম,
— “আপনার কি ঘুম আসছে? চোখ বন্ধ করে আছেন কেন?”
— “মাথা ব্যথা করছে।”
— “আমার কাছে মাথা ব্যথার ঔষধ আছে। খাবেন?”
এবার চোখ খুললেন সে। আমার দিকে সামান্য ফিরে হেলান দেওয়া অবস্থায়ই তাকালেন উনি। শান্ত তার চাহনী। ঢোক গিলে আরো কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। আমিও অবুঝের মতো তাকিয়ে। ধীর গলায় বললেন,
— “এত যত্ন কেন?”
থমথমিয়ে গেলাম আমি। বুঝতে পারছি না ঠিক কি বলা উচিত। চঞ্চল চোখ জোড়া এদিক ওদিক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেমন অস্বস্তি লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি আবারো বললেন,
— “কোথায় মেডিসিন? দাও। পানি আছে তো সাথে?”
— “হুঃ!”
দ্রুত উত্তর দিয়ে ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগ থেকে ঔষধ আর পানির বোতল বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি। উনি তখনো তাকিয়ে। কিন্তু পরপরই চোখটা বন্ধ করে ফেললেন। আবারো বারকয়েক বার ঢোক গিললেন যা চোখ এড়ালো না আমার। বুঝতে পারছি না এত ঢোক গিলছেন কেন উনি? উনার কি বেশি খারাপ লাগছে? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম না আর। ঔষধ খোঁজায় মন দিলাম।
ঔষধ খোঁজা শেষে তাকে দিতেই সে খেয়ে নিলেন ঔষধ। পানি পান করার সময় চোখ গেল হিমানীর দিকে। সে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে রেয়ানের দিকে। তার দেখা অনুসরণ করে উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম হিমানী রেয়ানের গলার দিকে তাকিয়ে আছে। পানির বোতল উপরে উঠিয়ে পানি মুখে ঢেলে ঢোক-ঢোক করে পানি পান করছেন উনি। ফলে গলা একবার উপরে উঠছে তো একবার নিচে নামছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে হিমানী। কোনো এক অদ্ভুদ কারণে রাগ হলো প্রচুর। মৃদু ধমক দিয়ে রেয়ান ভাইকে বললাম,
— “সমস্যা কি আপনার? পানি পান করতে এত সময় লাগে? আর এটা পানি পান করার কি ধরণের স্টাইল? ঠিক করে খেতে পারেন না?”
উনি ভ্রু কুঁচকালেন। বোতলের ঢাকনা লাগাতে লাগাতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “পাগল হয়ে গেছো? পাবনা যাবে?”
রাগ যেন বেড়ে গেল আমার। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “আপনার ইচ্ছে হলে আপনি যান।”
— “আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে। পাবনা মেন্টাল হসপিটালে রেখে একেবারে আসবো।”
আমার কাঠকাঠ জবাব,
— “আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।”
— “রেগে আছো কেন?”
শান্ত কণ্ঠে উনার এমন কথা শুনে চুপসে গেলাম আমি। আসলেই তো! রেগে আছি কেন আমি? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে লাগলো আমার। তবে উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। একবার চোখ তুলে রেয়ান ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি চোখ বন্ধ অবস্থায় মুচকি হাসছেন। প্রাণবন্ত সেই হাসি!
০৫.
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। ক্লান্তিতে জীপগাড়িতেই সবাই ঘুমিয়ে। আমি ঘুমিয়ে আছি রেয়ান ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে আর সে আমার মাথার সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে। অথচ জেগে থাকলে দু’জন দু’জনের সাথে ঝগড়া করতে লেগে যেতাম। আর এখন! সবার মাঝেই এক ধরণের শান্তি, নিস্তব্ধতা। সবার এমন নিস্তব্ধতা দেখে দীঘি বড্ড খুশি মনে আবদ্ধের বাহু জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা রেখে মৃদু কণ্ঠে আবদ্ধকে বলল,
— “আচ্ছা, আমরা আর কতদিন থাকবো এখানে?”
আবদ্ধ তখন ঘুমে ঢোলে পড়বে প্রায়। দীঘির কথা শুনে ঘুম ঘুম ভাবটা একটু হলেও কমে গেল। বিরক্তও হলো প্রচুর। তবে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “কালকে চলে যাচ্ছি।”
দীঘি মন খারাপ করে বলল,
— “কালকেই চলে যাবো? আর কয়েকটা দিন থাকলে কি হতো?”
জবাবের অপেক্ষায় নেই দীঘি। সে আবারো বলল,
— “এখান থেকে কি আমরা ওই আংকেলটার বাসায় যাবো?”
— “উহু! দাদা বাড়ি!”
দীঘি কিছু বলল না। তার মন খারাপ হচ্ছে প্রচুর। আর মাত্র একরাত থাকতে পারবে এখানে। ভাবতেই আর ভালো লাগছে না দীঘির। তবে মন খারাপটা এত পাত্তা দিলো না দীঘি। ভবিষ্যৎ টাকে বিবেচনা না করে বর্তমানটাকে আনন্দময় করার চেষ্টা করল। আবদ্ধের সাথে আরেকটু গা ঘেষে বসে বলল,
— “শুনুন! আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিন তো।”
আবদ্ধ তখনো চুপ। দীঘির দিকে তাকালো না পর্যন্ত। দীঘি আবদ্ধের হাতে চিমটি দিতেই সে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। পরক্ষণেই দীঘির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
— “সমস্যা কি তোমার?”
দীঘি দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলল,
— “আপনার সমস্যা কি? চুলে হাত বুলিয়ে দিতে বলিনি?”
আবদ্ধ ঝাড়ি দিয়ে বলল,
— “এখানে যে মানুষ আছে চোখে দেখছো না?”
— “ওরা তো ঘুমিয়ে আছে।”
— “যদি জেগে যায়?”
দীঘির ভীষণ রাগ হলো আবদ্ধের ওপর। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে হাসি-মুখে বলল,
— “আচ্ছা, সমস্যা নেই। রাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিবেন আপনি। এখন আপাতত গান গেয়ে শোনান, আমি শুনবো।”
আবদ্ধ বিরক্তি নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই দীঘির ঝাঁঝালো কণ্ঠ,
— “আপনি যদি না শোনান তাহলে কিন্তু আমি খারাপ কিছু করে ফেলবো।”
আবদ্ধ চুপ হয়ে গেলো। এ মেয়ে দ্বারা বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসে! সবার সামনে উল্টাপাল্টা কিছু করলে তো তারই মানসম্মান যাবে। অগত্যা আবদ্ধ মৃদু স্বরে গেয়ে উঠল,
— “খোলা জানালা, দক্ষিণের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে…
কখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আমি, আছি পাশে…”
এতটুকু বলেই আবদ্ধ চুপ হয়ে গেল। দীঘি বিরক্ত হলো। বলল,
— “চুপ হয়ে গেলেন কেন? আরো গেয়ে শোনান।”
আবদ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “আর একটা কথা তো গাড়ি থেকে ফেলে দেবো। চুপচাপ ঘুমাও!”
দীঘি মনে হলো আবদ্ধ তাকে ধমক দিয়েছে। সেই শোকে আর একটা কথাও বলল না সে। আবদ্ধের শরীরের সাথে সেঁটে রইল। অতঃপর ঘুমানোর চেষ্টায় লেগে গেল। আবদ্ধও চোখ বন্ধ করে আছে।
_________________
রিসোর্টে পৌঁছে গেছি কিছু সময় হলো। আমরা এখন সরু রাস্তাটা দিয়ে যার যার রুমের দিকে এগোচ্ছি। আমার পাশেই হাঁটছেন ইয়াসিন ভাইয়া। সে সচেতন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছেন মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়ার দিকে। যেন জন্মজন্মান্তরের শত্রুতা তাদের সাথে ইয়াসিন ভাইয়ার। মনে মনে আফসোস হলেও বাহির থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে আমাকে বলে উঠলেন,
— “দেখেছিস কেমন নির্লজ্জ? সামনে তাদের আব্বু-আম্মু আছে আর এরা পেছনে পেছনে প্রেমের সাগরে ডুবে মরে যাচ্ছে। এত ন্যাকামি পায় কোথায় এরা? আমার তো…”
আরো কিছু বলতেন ইয়াসিন ভাইয়া। এর আগেই ফোন বেজে উঠল তার। ফোনের স্ক্রিনে ‘সুপ্তি’ নামটা ভেসে উঠতেই চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। আমার উদ্দেশ্যে ‘এক মিনিট’ বলেই ফোনটা রিসিভ করলেন তিনি। আদুরে ভাব এনে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
— “সুপ্তি বেব? হাউ আর ইউ? অনেক দিন পর ফোন দিলে যে?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই গগন বিহারি হাসি দিলেন ইয়াসিন ভাইয়া। চরম উত্তেজনার সাথে বলে উঠলেন,
— “তুমি তো আমাকে ভুলেই গিয়েছ। ইউ নো? আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি।”
প্রতিবার কথা বলতে বলতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠছেন ভাইয়া। আশেপাশে অনেকেই বিরক্ত তাতে। তবে আমার হাসি আসছে প্রচুর। কোনোমতে হাসি আটকাচ্ছি এমন সময় ইয়াসিন ভাইয়া আবারো বললেন,
— “জানো বেব? আমি এখন রাঙামাটিতে আছি। কাপ্তাই লেক সহ আরো অনেক জায়গায় ঘুরছি। তুমি আসবে আমার কাছে?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই মুখ মলিন হয়ে গেল ইয়াসিন ভাইয়ার। ভাইয়া নরম এবং হতাশা কণ্ঠে বললেন,
— “এটা কোনো কথা বলছো তুমি? আমি বলছি ঘোরার কথা আর তুমি বসে আছো ঘোরা-ফেরায় যত টাকা যাবে তত টাকা তোমাকে দিতে। এটার কি কোনো মানে হয় তুমিই বলো..?”
ইয়াসিন ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ফোনটা মনে হয় কেটে গেল। সেই কখন থেকে ইয়াসিন ভাইয়া ফোনে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেই যাচ্ছেন। তার এমন মরান্তিক অবস্থা দেখে হাসি পেল বড্ড। হেসে দিলাম খিলখিল করে। ইয়াসিন ভাইয়া মুখ তেঁতো করে দূর্লব কণ্ঠে বললেন,
— “এভাবেই তো মজা নিবি! ভাইটার এমন দূর অবস্থা দেখেও একটা মেয়ে খুঁজে দেস না। বেয়াদ্দপ! তোরা সবটি একই! ফাজিল! খোদা সইবো না দেখিস।”
আমার হাসি বন্ধ হলো না এতেও। কথাগুলো থেকেও ইয়াসিন ভাইয়ার করুণ মুখ দেখে হাসি পাচ্ছে প্রচুর। সে এবার রেগে বললেন,
— “এত হাসছিস কেন হ্যাঁ?”
হাসতে হাসতে আমার জবাব,
— “খুশির ঠেলায়!”
মুখে অন্ধকার নেমে এলো ইয়াসিন ভাইয়ার। মনে একাকিত্ব নিয়ে হেঁটে চললেন আমাদের সাথে। এবার আর হাসছি না আমি। সত্যিই খারাপ লাগছে এখন। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমার এমন তাকানো দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “বেয়াদ্দপ এভাবে তাকাস কেন? বোনদের সাথে প্রেম করি না আমি।”
এতটুকু যথেষ্ট ছিল আবারো হাসার জন্য। তবে আমি একা না! ইয়াসিন ভাইয়াও হেসে উঠলেন আমার সাথে।
__________________
চলবে…