#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২২
.
সময় বহমান। তার সঙ্গে বহমান মানুষের প্রতিদিনকার জীবন ধারা। সেদিন সকালে রেয়ান ভাই চলে গিয়েছিলেন সবুজ ভাইয়ার বাসায়। সেখানে একদিন থেকে পরেরদিনই চলে যান ঢাকা। এতে অবশ্যক মেজো চাচ্চু অত অবাক হননি। কারণ তিনি জানতেন এমনটিই হবে। রেয়ান ভাই যাওয়ার এক কি দু’দিন পর ঢাকা থেকে খবর আসে মেজো চাচ্চুর একটা জরুরি মিটিং পরে গেছে। ফলে তাকে ঢাকা যেতে হবে কালই। এ সুযোগে আমরাও চলে যাবো যে যার গন্তব্যে। যাওয়ার আগে সোফায় বসে কেঁদে দিয়েছিলেন মেজো চাচ্চু। তার সব আফসোস আবদ্ধকে নিয়ে। পরিকল্পনা মতে কিছুই হয় নি। পরিকল্পনা করা যত সহজ তা পূরণ করা ততই কঠিন। ঢাকায় মেজো চাচ্চুর বিজনেস, আব্বুর অফিস, আমার ভার্সিটি, আবদ্ধের ভার্সিটি আর ফুফিরা তো চট্টগ্রামে সেটেল। তারা তো এখানে থাকতে পারবেন না। তাছাড়া দীঘি এখনো ইন্টার পরীক্ষাই দেয় নি। তাকেও তো নতুন করে কলেজে ভর্তি করাতে হবে। এতকিছু এখানে থেকে কিভাবে হবে? সবাইকে একসঙ্গে করার উত্তেজনায় মেজো চাচ্চু প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন এসব। ভেবেছিলেন কোনোভাবে মেনেজ করে ফেলবেন। কিন্তু এখন ভাবছেন- ‘কিভাবে?’ এসবের মাঝে আবদ্ধের সাথে অন্যায় করে ফেলেছেন মেজো চাচ্চু। আফসোস হচ্ছে তার। নিজের মুর্খতার কারণে এত কম বয়সে আবদ্ধের বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে দীঘিও মেয়ে হিসেবে খারাপ না। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী! তবে বয়সটা অনেক কম। আবদ্ধের পাশাপাশি দীঘির সাথেও যে অন্যায় হয়েছে। এসব ভেবে বুকে যেন একটা বড় পাথর চড়ে বসেছে মেজো চাচ্চুর। হতাশা নিয়ে কোনোমতে গাড়িতে গিয়ে বসলেন তিনি। একটু কথাও বলেন নি কারো সাথে।
০৭.
ট্রেনের জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছি আমি। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি শীতল হাওয়া। কেন যেন মনটা বেশ বিষণ্ণ আমার। রাঙামাটিতে যখন ছিলাম তখন ঢাকায় আসার জন্য পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অথচ এখন! ঢাকায় যেতেই ইচ্ছে করছে না। ঠিক এই কারণে কখনো রাঙামাটিতে আসতে চাইতাম না। পুরোনো সব স্মৃতি এবং তার সঙ্গে একবার গেলে আবার না আসতে চাওয়ার মনোভাব পোষণ করা আমার মন, সব মিলিয়ে ইচ্ছে করেই যেতাম না আমি। অজানা কারণে বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আমার। চোখ মৃদুভাবে খুলে মেজো চাচ্চুর দিকে তাকালাম। উনার মুখে কেমন থমথমে ভাব। চোখটা আবারো বন্ধ করে ফেললাম। এসব দেখতে ভালো লাগছে না আর। মাথা ব্যথা করছে প্রচুর!
আমরা সবাই এক কেবিনে এবং আবদ্ধ আর দীঘির জন্য আলাদা এক কেবিন নেওয়া হয়েছে। একটু আগেই আবদ্ধের সাথে রেয়ানের কথা হয়েছে। মেজো চাচ্চু যেন আরো কয়েকদিন রাঙামাটি থাকতে পারেন সেজন্যই এত তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে গিয়েছিলেন রেয়ান। কিন্তু একসাথে তিনটি বিজনেস মিটিং পরে যাওয়ায় ঝামেলা হয়ে গেছে প্রচুর। বাধ্য হয়ে মেজো চাচ্চুকে ঢাকাতে আনতে হয়েছে তাদের। এ বিষয়েই টুকটাক কথা শেষ করে ফোন রেখে কেবিনে চলে আসে আবদ্ধ। এখন চোখ বন্ধ করে সীটের সাথে হেলান দিয়ে আছে সে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। নিজের বাবাকে কাঁদতে দেখলে কারই-বা ভালো লাগবে? দীঘি তার পাশেই বসে আছে। আবদ্ধের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না তার। দ্বিধান্বিত হাতে আবদ্ধের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দীঘি বলল,
— “আপনার কি খারাপ লাগছে? মাথা টিপে দেবো?”
আবদ্ধ চোখ খুলে তাকায়। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কোনো কথা ছাড়াই দীঘির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সে। হঠাৎ এমন করায় দীঘি মৃদুভাবে কেঁপে উঠে। কিছু বলা বা করার সাহস যেন মিইয়ে গেছে তার। চুপ করে বসে রইলে সে। কিছুক্ষণ পর আবদ্ধ নিজে নিজেই দীঘির হাত নিজের মাথার ওপর রাখে। যার অর্থ তার চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া। বুঝতে পেরে দীঘিও করল তাই। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “একটা কথা বলি?”
জবাব দেয় না আবদ্ধ। দীঘি আবারো বলে,
— “বলি, প্লীজ?”
— “উহুঃ!”
ক্লান্ত কণ্ঠে বলে উঠে আবদ্ধ। কেমন কেঁপে কেঁপে উঠে দীঘি। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বলে,
— “আপনার কি মন খারাপ?”
সাথে সাথে উত্তর দেয় না আবদ্ধ। অনেকটা সময় লাগিয়ে বলে,
— “না। মাথা ব্যথা করছে শুধু।”
একটু থেমে আবারো বলে,
— “তুমি বসে আছো কেন? খুব তো বলেছিলে মাথা টিপে দেবে। এই তোমার মাথা টিপে দেওয়ার নমুনা? আলসে মেয়ে!”
চটে গেলো দীঘি। ভ্রু কুঁচকে তেজি গলায় বলল,
— “বাজে কথা বলবেন না। আলসে আমি নই আপনি।”
আবদ্ধ হেসে দেয়। এ মেয়েটা একটুতেই কেমন রেগে যায়। আবদ্ধের ভালো লাগে সেটা। মুখে সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করে গম্ভীর কণ্ঠে আবদ্ধ বলল,
— “কি বললে তুমি? আবার বলো।”
— “শুনেন নি? আপনাকে আলসে বলেছি আমি। অতি শুদ্ধ ভাষায় ‘কুইড়া’ ”
আবদ্ধ এবার ভ্রু উঁচু করে তাকায় দীঘির দিকে। ভেবেছিল একটু রাগি ভাবে কথা বললে দীঘি চুপসে যাবে। কিন্তু তার বদলে হলো উল্টো টা। হকচকিয়ে গেলেও আবদ্ধ নিজেকে স্বাভাবিক করল। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল,
— “তুমি এত বকবক করো কেন দীঘি? বিরক্ত হচ্ছি আমি। চুপচাপ মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”
দীঘির রাগ হলো। সে বিরক্তি হওয়ার মতো কি এমন করেছে? অভিমানে আটখানা হয়ে গেল দীঘি। আবদ্ধের চুল জোড়ে জোড়ে টানতে টানতে বিড়বিড় করে উঠল,
— “হু! তার সাথে বকবক করতে আমার বয়েই গেছে। বাজে লোক একটা। তার এই সুন্দর চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে দেবো আমি। তখন বুঝবে মজা।”
আবদ্ধ মজা পেলো দীঘির কথায়। দীঘিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে উঠল,
— “উফফ! দীঘি তোমার হাতে জাদু আছে। আহ! কি আরাম!”
দীঘি আরো জোড়ে জোড়ে টানতে লাগলো চুল। সে খুব ভালো করেই জানে আবদ্ধ তাকে জ্বালাতে এমন করছে। এদিকে আবদ্ধ এখন সত্যিই সত্যিই ব্যথা পাচ্ছে চুলে। দীঘিকে চুল ছাঁড়তে বললেও সে ছাঁড়ছে না। এবার চেঁচিয়ে উঠল আবদ্ধ,
— “দীঘি ব্যথা পাচ্ছি তো।”
দীঘির ভাবগতি পরিবর্তন হলো না। সে নিজের কাজেই ব্যস্ত। আজকে আবদ্ধের সব কাজের হিসেব রফাদফা করেই ছাঁড়বে সে।
__________________
দুপুরের দিকে আমরা এসে পৌঁছালাম ঢাকায়। রেলওয়ে স্টেশন থেকেই মেজো চাচ্চুরা বিদায় নিয়ে চলে যান নিজ গন্তব্যে। আমরা চলে আসি আমাদের বাসায়। ছয় তলার একটি বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকি আমরা। তিন তলার মাঝের ফ্লেটটা আমাদের। ক্লান্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে সেই ফ্লেটটায়ই ঢুকলাম আমরা। ঢুকতেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো। বাসাটা ভালো লাগছে না আর। গুছানো হলেও বড্ড অগোছালো আর অস্বস্থি লাগছে আশপাশটা দেখে। মন চাইছে ছুটে চলে যাই রাঙামাটি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে ঢুকেই প্রথমে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম আমি। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। চোখ দু’টা বড্ড জ্বালা করছে। তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। একেবারেই নয়! ঘুমের প্রয়োজন। চোখ দু’টো বন্ধ করতেই ঘুম যেন হাজির হয়ে যায় দু’চোখের পাতায়।
এত ঘুমে কাতর হয়েও ঠিক করে ১ঘন্টা ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ। ফোনের ‘টুং,টাং’ শব্দে ঘুমটা নিমিষেই চলে যায় আমার। উঠে বসে ফোন চালু করতেই দেখলাম ‘২২২’ নম্বর থেকে কল এসেছে। রাগে, দুঃখে ফোনটা ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করছে আমার। আমার সখের ঘুমটা নষ্ট করে দিলো এরা। এখন তো আর ঘুমও আসবে না আমার। বিরক্তি নিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে ছাদে চলে এলাম। আপাতত একটু শান্তি প্রয়োজন আমার। আর সেটা ছাদেই পাবো আমি। ছাদে আসতেই দেখলাম পাশের ছাদে আগে থেকেই শুভ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের বিল্ডিংটা শুভ ভাইয়ার বাবার। শুভ ভাইয়া পেশায় একজন লেখক। প্রচুর বই, উপন্যাস পড়া আর লেখা তার একমাত্র ও প্রিয় কাজ। কথাও সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বলতেন পারেন উনি। আমার সাথে মাঝে মাঝে বিকেল বেলা ছাদে দেখা হয় উনার। দেখা হলেই বিভিন্ন কবিতা বা বইয়ের কিছু লেখা পড়ে শোনান আমাকে। সবই তার লেখা! আজও আমাকে দেখে মুচকি হেসে উনি বলে উঠলেন,
— “চারুলতা, কোথা ছিলে তুমি?
জানো কি? তোমায় খুঁজে পাগল প্রায় আমি।”
উনার কথা শুনে হেসে দিলাম। রেলিং ঘেঁষে উনার দিকে ফিঁড়ে দাঁড়ালাম। বললাম,
— “বাহঃ! লেখক সাহেব। সুন্দর বলেছেন।”
শুভ ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
— “কোথায় ছিলে এতদিন?”
— “দাদা বাড়ি।”
— “ভালোই তো।”
একটু থেমে আনমেই আবার বলে উঠলেন,
— “আচ্ছা, চলে যাওয়ার আগে একবার বলে যাবে না? আমি তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতাম ছাদে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। এমন তো না যে আমি প্রতিদিন ছাদে এসে গল্প করি উনার সাথে। মাসে দুই কি তিনবার ছাদে আসলে টুকটাক কথা হয় এই যা। এখানে অপেক্ষা করার কথা আসলো কোথা থেকে? আমার ভ্রু কুঁচকে তাকানো দেখে উনি হকচকিয়ে গেলেন। অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন,
— “মানে, দাদা বাড়ির কোথায় কোথায় বেড়ালে?”
স্বাভাবিক হলাম। বুঝতে পারছি উনি কথা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই আমিও তেমন কিছু ভাবলাম না এ বিষয়ে৷ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম। এর মধ্যে শুভ ভাইয়ার ডাক পড়ল। সে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ছাদ থেকে। আমি তখনো দাঁড়িয়ে। মনের মাঝে শুধু ফেলে আসা দিনগুলো খঁচখঁচ করছে।
রেয়ান ভাই সবুজ ভাইয়ার বাসায় যাওয়ার আগের দিন রাত্রি বেলা আমরা সবাই খাবার খেয়ে যার যার রুমে যাচ্ছিলাম। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ধাক্কা লেগে যায় রেয়ান ভাইয়ের বুকের সাথে। সাথে সাথে উনি বলে উঠলেন,
— “চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটো মিস?”
আমি কটমট করে তাকালাম উনার দিকে। একটু আগেও যে ‘সরি’ বলার ইচ্ছেটা ছিল সেটা এখন শেষ। বরং ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “আপনার মাথায় নিয়ে হাঁটি।”
উনি উনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে করুণ কণ্ঠে বললেন,
— “কোথায়? আমি তো পাচ্ছি না।”
উনার এমন নাটকীয় ভাব দেখে গা-টা জ্বলে উঠল আমার। অযথা কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বিড়বিড় করে উঠলাম,
— “অসভ্য, অভদ্র লোক!”
উনার হাসির আওয়াজ এলো কানে। তবুও পেছনে ফিরে তাকালাম না। চার, পাঁচ কদম এগোতেই পেছন থেকে উনি চেচিঁয়ে উঠলেন,
— “ওই!”
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম এবার। উনি প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে ‘কি’ জিজ্ঞেস করতেই মুচকি হেসে বললেন,
— “কিছু না। যাও!”
উনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয় থেকে আমিও চলে এলাম রুমে। এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। খুনসুটির ছোটাংশ!
__________________
রাত ১২ টা ৩২মিনিট। বিছানায় বসে, বালিশের সাথে হেলান দিয়ে উপন্যাসের বই পড়ছিলাম আমি। তখনই ফোনের ‘টুং,টাং’ রিংটোন বেজে উঠে। আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে। ধরব কি ধরব ভাবতে ভাবতে ধরেই ফেললাম। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বললাম,
— “হ্যালো? কে বলছেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। আমি আরো কয়েকবার ‘হ্যালো’ বললেও নিরুত্তর সে। আস্তে আস্তে বিরক্তটা রাগে পরিণত হলো আমার। মারাত্তক রেগে বললাম,
— “সমস্যা কি? কে আপনি? কথা বলছেন না কেন? রাত-বিরাতে মেয়েদের বিরক্ত করতে ভালো লাগে তাই না? আর ফোন..!”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে দিলো সে। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফোনের দিকে। কে ফোন দিলো আমায়? আবার কেটে দিলোই-বা কেন?
_______________
চলবে…
(আমি আমার গ্রুপে ‘বাতাসা’ নামের আরেকটা গল্প দেই। যারা পড়তে আগ্রহী তারা এ পোস্টের কমেন্ট চেক করুন।)