#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৮
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
একহাতের সাহায্য অতি সুপরিচিত মানুষীটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে ফোন তুলে কল দিল তানজীব। অধীর ওপ্রান্ত থেকে অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলো
বন্ধু তুই গাড়িটা নিয়ে ছুটেছিস সেটাতে রাহা,,, মানে নোরার বোন…
হ্যা। আনফরচুনেটলি উনি সেন্স হারিয়ে ফেলেছেন। রাহানকে নিয়ে দ্রুত আয়।
কি বলিস? সেন্স হারিয়েছে মানে? কেন?
মানে? মানে আবার কি? কি বলতে চাস তুই?
আরেহ রাগ করিস কেন? আচ্ছা তুই ওকে দেখে রাখ। আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি। ।
আশরাফ ভাই তাড়াতাড়ি আসুন। রাহা নাকি সেন্সলেস।
আল্লাহ কি করে হলো ?
বলতে পারছিনা। ওখানে আমার বন্ধু আছে। গিয়ে দেখি। আসুন। আঙ্কেল গাড়ি ছাড়েন।
ড্রাইভার আঙ্কেল মাথা নেড়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। আশরাফ ড্রাইভারের পাশে বসে পড়লো। রাহান অধীরকে বিড়বিড় করে বলল,
তোর বিয়ে এত অল্প ঝামেলায় মিটছেনা। ক্লাবে না জানি কি হচ্ছে?
অধীরের কপালে ভাঁজ।
এত রহস্য করছিস কেন?
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রাহান। অধীর হাতে চাপ দিয়ে বলল
বল।
রাহান চোখের ইশারায় আশরাফকে দেখিয়ে দিল। অধীর এবার শান্ত হয়ে বসলো। শক্ত চোয়াল বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে তার। একটার পর একটা চিন্তা।
****
রাস্তার পাশেই কাঁকুড়ে কালো পাথরের স্তূপ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাথে শুকিয়ে যাওয়া মরা পাতা বিছিয়ে আছে সবুজাভ-হলদে ঘাসের উপর। দূরের বড় রাস্তাটিতে শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটছে। গাড়িটা থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো মানবের চোখ গাড়িটার পেছন সিটে হেলানো মানবীর অচৈতন্য মুখবিবরে। কি এক অবিদিত জড়িমায় পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো ও যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আঁড়চোখই একমাত্র অবলম্বন।
তারাবিহীন খোলা আকাশের নিচে যেখানে সাক্ষী ছিল একটা নীল চিরকুট আর একজন জবর আর্মি অফিসারের ঠোঁট পুঁড়ে বেরিয়ে আসা নৈরাশ্য সেখানে আজ চিঠির বদলে চিঠির মানুষ একদম রক্তে মাংসে । ভীষণ আশ্চর্যের, অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারটি এক লহমায় ঘটে গেল। এতটা বিস্ময় কভু হয়েছে আর্মি অফিসার?
রমণীর গৌণ লোমকূপে নিবদ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট এঁটে তানজীব ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। পুনরুক্তি করলেন একটি বাক্য
চোখ খোলা দরকার, তোমার সাথে অনেক হিসেবনিকেশ আছে প্রাণো।
ধপাস করে ঢলে পড়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। তড়িৎগতিতে ছুটে গিয়ে ধরলেন তিনি । উপয়ান্তর না দেখে কোমলাঙ্গ নারীদেহ কাঁধ ও উরুর নীচে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখলেন গাড়িটি দাঁড়ানো হরিতাভ ঘাস-আচ্ছাদিত জায়গায়। চট করে মাথায় বুদ্ধি এল মেজরের। হাত গলে পড়া মানবীকে বসিয়ে দিলেন ষৎ সবুজবীথির উপর। মাথাটা হেলিয়ে দিলেন গাড়ির সাথে।
উপস্থিত বুদ্ধিদীপ্ত মাথায় চট করে মনে পড়লো সঙ্কীর্ণ পাহাড় থেকে পড়ে অচৈতন্য বরণ করা এক সৈনিকের জ্ঞান ফেরানো সেই কৌশলী প্রথা। দুচোখ ও সরু নাকের বাঁশির মিলন স্থলে দু আঙুলের চাপ দিল প্রবলভাবে।
শক্তসমর্থ কড়াপড়া আঙুলের প্রবল চাপে ভয়ে প্রস্তরীভূত ধী শক্তি হারানো মানবী সজ্ঞানে ফিরে হকচকিয়ে ভেঁক করে কেঁদে উঠলো আচমকা।
মেজরের কঠিন বুকে হালকা কম্পন ধরলো। ইশশ আঘাতটা কি বেশি জোরালো হয়েছে? মিস কবিরের ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদার অভ্যাস এখনো আছে ।
রাহা দু হাতের ভর দিল নিজ আসনে। দেখলো ঘাসের উপর সে বসে। গাড়িতে হেলান দেওয়া। সামনে সুকুমার একটি মুখাবয়ব। চড়া কপাল। কুঁচকে রাখা ডহর দুটো চোখ। পোড়া কালচে ঠোঁটে কুচুটিয়া হাসি। যেন মজা পাচ্ছে রাহার এই অস্বচ্ছন্দ অবস্থা দেখে।
ভয়ে হাঁটু কুড়িয়ে বসলো সে। চোখ নামিয়ে ফেলে আবার ও তুললো সে । মিহি গলায় বলল
আপনি খারাপ লোক আমি আগেই বুঝেছি।
তাই?
আবার ও কুটিল হাসলো লোকটি।
রাহা শাড়ি ওড়না জড়িয়ে ভালো করে সুশ্রী ভঙ্গিতে বসে বলল
দেখুন আমার আব্বা, জেঠুরা জানতে পারলে আপনার আস্ত রাখবে না।
কি করবে?
রাহা এবার ঘনঘন নাক টানলো।
আপনার নাকে সর্দি। ইয়াক। চোখের পানি নাকের পানি মিলে একাকার। সুন্দরীদের এসব থাকতে নেই। বেমানান লাগে।
রাহা আবার ও ডুকরে উঠলো।
আপনি আমাকে ছেড়ে দিন।
ধরলাম কখন?
বলেই লোকটা নিষ্পাপ ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টালো।
রাহা কাঁদোকাঁদো চেহারায় তাকালো আবার।
আপনার মা বোন নেই? একটা মেয়েকে একা পেয়ে মজা করছেন। খুব খারাপ হবে এর পরিণতি।
পরিণতির কথা আপাতত ভাবছি না ম্যাডাম।
আমি এখানে কি করে?
ঢুঁসে ঢুঁসে ঘুমাচ্ছিলেন।
বাজে কথা।
বলেই রাহা জড়োসড়ো হয়ে আরেকটু দূরে গড়ালো। লোকটা এমন রহস্য করে হাসছে কেন? কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। রাহা নিজেকে সামলে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল শাড়ি আর ওড়না তুলে।
সুকুমার লোকটা এবার আগের চাইতেও আওয়াজ করে হাসলেন। স্কন্ধ চুলকে মাথার চুলে হাত ব্রাশ করে ঘাসের উপর থেকে কুড়িয়ে নিলেন মেয়েটার মাথার বেণী থেকে খসে পড়া একটা সাদা পাথুরে ক্লিপ।
সেটি পকেটে পুড়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে পড়লেন ড্রাইভিং সিটে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলো পড়া মিররে দেখা যাচ্ছে পায়ের জুতো খুলে গোড়ালির উপর শাড়ি তুলে দৌড়ে যাওয়া মেয়েটিকে। বক্র হাসির চোটে কেঁপে উঠলো ওনার বক্ষঃপঞ্জর। গুনে গুনে দেখলেন এভাবে অনেকদিন পর হেসেছেন উনি। যান্ত্রিক জীবনে এমন বোকাসোকা ভীতু মানুষ পেলেই কেমন যেন মজা নিতে ইচ্ছে করে।
রাহা যখন দেখলো লোকটা তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে না। আরামসে গাড়ির সিটে বসে আছে। সে দৌড়া থামিয়ে দিল। কেঁদে উঠে বিড়বিড় করলো
লোকটা কি ভালো?
আবার সেদিকে ছুটলো সে। ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালার কাচ বরাবর গিয়ে বলল
শুনুন।
বলুন।
ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে লোকটা তার কথার জবাব দিল।
আমার আপার বিয়ে আজকে। আমাকে ওখানে পৌঁছে দিন।
এতে আমার কি লাভ ম্যাডাম?
লাভ মানে?
মানে আমি কি পাব?
আপনি যেটা চান সেটাই দেব।
সুকুমারকৃত লোকটা এবার আরও নিগূঢ় চোখে চাইলো। জানালার কাচ বরাবর এসে ছোট করে বলল
আপনার ভাই আসছে। ফোন দিয়েছিলাম। আমি আগন্তুক নই। ভয় পাওয়ার দরকার নেই।
রাহা এবার কি বলবে খুঁজে পেল না। তবে লোকটা সেকথা বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল রাহার কৃতজ্ঞ চাহনি উপেক্ষা করে।
বেয়াড়া লোকটার পেছনে একটা ভালো মানুষী রূপ আছে সেটা ভাবতেই সহস্র শত কৃতজ্ঞতা খরস্রোতা লহরে ভাসালো সে। কাঁধের পাশ গলা ওড়নার কোণা পেটের কাছে মুচলেকা করতে করতে বলল
থ্যাংকস।
আমি থ্যাংকস নিইনা।
কি নেন?
জেনে লাভ নেই।
তারপর আরেকটা গাড়ি এসে থামলো বেশ শব্দ করে তীব্র আলোর ঝলকানি থামিয়ে। রাহার চোখেমুখে ফুটে উঠলো তীব্র উচ্ছ্বাস। আবারও সুকুমার লোকটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো সে চোখের অবলোকনে। তারপর গাড়িটার কাছে ছুটে গিয়ে ভাইকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল,
তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
ঠাস করে একটা দিয়ে বসিয়ে রাখব বেয়াদব মেয়ে। ডাকাত দেখার শখ মিটেছে তোর? ছাড়। গাড়িতে উঠ।
মুখ তুলে গাল মুছে রাহান আর অধীরকে দেখে ঢোক গিললো রাহা।
জিজু!
হুমম। তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছ। যাইহোক গাড়িতে গিয়ে বসো।
ওখানে তো….
বলতে বলতে রাহা খেয়াল করলো সুকুমার লোকটা গাড়ি থেকে ততক্ষণে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
আশরাফ তার হাত ধরে টেনে এনে গাড়িতে বসিয়ে বলল
বিয়ের ঝামেলা মিটুক। তোকে হাত পা বেঁধে পিটাবো। এমনিতে ঝামেলার শেষ নেই। তারউপর তুই…
আমার কি দোষ? আমি তো গাড়িতে বসেছিলাম।
চুপ। কোনো কথা বলবি না।
ধমকে গালফুলিয়ে চুপ করে রইলো রাহা। আঙুলের নখ কাটা। নইলে একটা আঁচড় দিত জোরে।
আশরাফ গাড়ি ছেড়ে অধীরকে বলল
চলে এসো দ্রুত।
অধীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তারা যেতেই রাহানের পিঠ চাপড়ে বলল
আজকের দিনে এত ঝামেলা হতে হলো? উফফ জ্বালা। শালা আর্মি গেল কই?
রাহান বলল
ওখানে। তুলে নিস।
আঙ্কেল গাড়ি ছাড়েন।
***
গাল ফুলিয়ে জানালার উপর হাতে রেখে তার ভাঁজে মুখ রেখে বাইরে তাকিয়ে থাকা রাহার চোখ পড়লো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সুকুমার লোকটার দিকে। লোকটা সরু চোখে তার দিকে চাইলো। একদম চোখাচোখি হয়ে পড়ায় কুন্ঠায় গলিয়ে পড়া রাহা ইতস্ততভাবে চোখ সরিয়ে নিল। গাড়িটি সীমানা পেরিয়ে গেল ততক্ষণে। লোকটাকে আর দেখা গেল না।
—————
সামনের কাঁচভাঙা ফুলেল পরিশোভিত গাড়িটি এসে থামলো ক্লাবের বেজমেন্টে। অসংখ্য অল্পবয়সী তরুণী দাঁড়িয়েছে বরকে বরণের জন্য। ব্যাপারগুলো খুবই তাড়াতাড়ি ঘুচে গেল। কারণ বরের মায়ের কাছে যাওয়াটা খুবই জরুরি।
আনতারা বেগম নোরার পাশেই বসেছিলেন জ্ঞান ফেরার পর। ছেলের অপেক্ষায় ছিলেন।
যখন এল তখন ছেলেকে দেখতে পেয়ে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন
দেখলি তোকে আজকের দিনে ও ছাড়লো না ওরা। তুই এবার একটু কানে তোল আমার কথা। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে আব্বা?
এসব আর হবে না আম্মা। ভয় পেয়োনা। হাসিখুশি থাকো।
পরেই সে চোখ তুলে তাকালো মায়ের পাশেই লাল শাড়িতে মোড়ানো অনিন্দিত সাজে আবৃত শ্রীমতী বধূটির দিকে।
তার সুললিত কণ্ঠ আবৃত করে বুক অবধি ঝুলে আছে উচ্চমার্গীয় হিরকসম্বিলিত ভারী গহনা। কালো কেশগুচ্ছের সিঁথিতে কপাল অবধি প্রলম্বিত টিকলি। নাকে রিং-এর মতোন মস্ত নোলক। কানে টাঙানো সোনালী ঝুমকো কানের দুল। চোখের কোণায় চিন্তন রাজ্যের বেড়ী। রাঙানো ঠোঁটজোড়া নেড়ে বধূটি শুধালো,
আপনি ঠিক আছেন?
চোখ নিভালো অধীর। ভরসা দিয়ে বলল,
হুমম।
দ্যাখো দ্যাখো ভাবি তোমার ছেলের জন্য চিন্তা করার আরেকটা মানুষ চলে এসেছে। অধীর এবার বউয়ের কথা তো শুনতেই হবে বাছা।
অধীরের বড় ফুপুর কথা শুনে ছোটবড় সবাই হাসলো।
অধীর ও হাসলো। নোরাহ লজ্জা পেয়ে অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে নিল।
রাহা আসায় সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। নোরা বলল
ছোট তুই ঠিক আছিস?
হুম। আমার অনেক কাজ। ডাকিস না। পরে কথা বলব।
বলেই ফুলভর্তি সোনালী চকচকে কাগজের ঢালা নিয়ে ছুটলো সে।
পাশ থেকে কেউ একজন টিপ্পনী কাটলো।
আরেহ বউ আর বউয়ের বোন তো পুরো একই দেখতে। একই সাজে কেউ চিনতেই পারবেনা। বৌমা ও তোমার কত ছোট?
দু বছরের কাছাকাছি ।
আচ্ছা আচ্ছা। বেশ ভালো। দেখে মনেই হয় না।
অধীরকে টেনে নিয়ে গেল তার বড়ছোট মামাতো খালাতো ভাইগুলো। সে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো তানজীব আর রাহানকে। হাঁদারাম দুটো গেল কোথায়?
—————-
দোতলায় খাওয়াদাওয়া চলছে। তিনতলায় বরপক্ষের লোকজন। চতুর্থ তলায় কনেপক্ষের লোকজন। দূর থেকে রাতের আঁধারে নানারকম যান্ত্রিক কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে প্রকান্ড ক্লাবটিকে মনে হচ্ছে স্বর্ণখচিত কোনো প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সিঁড়িগুলো ঘুরানো প্যাঁচানো বাহারি ডিজাইনের।
দোতলার একটা কোণা বন্দী করা শেখওয়াত পরিবার। এদিকওদিক পায়চারি করছেন সেলিম শেখওয়াত ও সাজ্জাদ শেখওয়াত। রাহান আর তানজীব দাঁড়িয়ে ওনাদের পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সেই তখন থেকে। মিনি, সানজু আর রোহিনী শঙ্কিত বদনে একে ওকে দেখে যাচ্ছে।
এতগুলো বছর পর এসে ওই নিমকহারাম খুনী বর্বরগুলোকে দেখতে হবে জানলে জীবনে ও এখানে আসতো না তারা। বিশেষ করে মিনা আর তানজীব এদের মোটেও আসতে দিত না।
তানজীবের মনে হচ্ছে সবটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কেন আজকের দিনে ওসব কথা তুলতে হচ্ছে? ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ দেখানোর জিনিস না, প্রকাশের বিষয়বস্তু না। কে কাকে বুঝাবে?
আমি আসছি।
খবরদার তানজীব!
সেলিম সাহেবের গর্জনে থেমে গেল তানজীব। রাহান বলল
আব্বা তুমি আর চাচ্চু চলে যাও খেয়েদেয়ে। আজ কোনো অশান্তি চাই না। এমনিতে অনেক অশান্তি হয়েছে।
তানজীব আর মিনিকে রেখে যাব না। মিনি আমাদের সাথে চল।
মিনা বোকাসোকা চেহারায় একবার তানজীব আরেকবার রাহানের দিকে তাকালো। ভেতরকার উত্তেজনা সে কাউকে দেখাতে পারছেনা। অন্য কিছু তার মাথায় নেই। সে একপলক নোরাহ, প্রাণো আর আরাফ ভাইকে দেখতে পেলেই হলো। কতগুলো সকাল-বিকাল বন্ধুহীন পেরিয়ে গেছে তাদের। অথচ তাদের সাথে একবার ও দেখা হয়নি। তাদের বন্ধুত্বের মাঝে তো কভু কোনো দেয়াল ছিল না। তাহলে জেব্বা আর চাচ্চু কেন এমন করছে? কেন অতীত টানছে? কেন মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই বিষাক্ত অতীত? সে যাবে না। কিছুতেই না।
ছুটে গিয়ে তানজীবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। তানজীব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
আমি আছি।
আমার কথা কানে যায় না তোদের? মিনি চল। রাহান তোর বউকে বল। তানজীব তুই ও।
খানসা বেগম আর মনোয়ারা বেগম চুপচাপ।
তানজীব ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল
ভীতুরা পালায় জেব্বা । আমি আমরা ভীতু নই। ওই পরিবারকে ঘৃণা করে চলে যাব কিন্তু তার সাথে অধীরের পরিবারকে ও ঘৃণা করা হবে। আমার বন্ধু, তোমাদের বন্ধু, সাথে রোহীর শ্বশুরবাড়ি। ওরা আমাদের অনেক ঘনিষ্ঠ। এভাবে তাদের সাথে এসব করা মানায় না।
তুই একদম জ্ঞান দিবি না। কত বড় হয়েছিস যে আমাদের জ্ঞান দিচ্ছিস? আর্মি অফিসার হয়েছিস বলে এখন আমাদের কথার কোনো পাত্তা নেই?
তানজীব চোয়াল,চোখমুখ শক্ত করে তাকালো। রাহান রেগে চলে গেল সেখান থেকে। তানজীব বলল
কোনো কথা শুনতে চাই না আমি আর। মিনি যাবে না। আমি ও না। তোমরা খেয়েদেয়ে চলে যাও। অশান্তি যদি করো তাহলে তোমাদের দু’জনের খবর আছে। মণি বড়মা এদের কিছু তো বলো।
খানসা বেগম আর মনোয়ারা বেগম একে অপরের দিকে তাকালেন। মানুষগুলোর মুখের উপর কখন কথা বলেছে তারা?
দেখেছ দেখেছ আমাদের শাঁসাচ্ছে এ ছেলে? আজীমকে গিয়ে বলব যে খুনীর ঘরের মেয়ে নিয়ে যাচ্ছিস তোর ছেলের জন্য। দেখব বিয়েটা কি করে হয়। ওই জানোয়ারদের চরম শিক্ষা দেব।
তানজীব চমকে তাকালো।
নাহহ। খোদার কছম এসব কাজ ভুলেও করবে না।
মিনি, সানজু তোরা চল। এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। চল চল।
খুশিতে দুজনই হাত ধরাধরি করে ছুটলো।
যাওয়ার আগে তানজীব আবার ঘাড় ঘুরালো অদ্ভুত ভঙ্গিতে। বলল
কছম বলেছি আমি। যদি উল্টাপাল্টা কিছু করো দুটোকেই আমি দেখে নেব।
দেখেছ কিভাবে ধমকাচ্ছে?
তানজীব আর দাঁড়ালো না।
তবে মিনা আর সানজু বিরাট এক ভুল করে বসলো দোতলা থেকে তিনতলায় যাওয়ার সময়। তাদের খুশির ঠেলায় ছোটাছুটির চোটে গায়ের ধাক্কায় ফুলের ঢালা সহ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল একটা যুবতী মেয়ে। তানজীব ও তাদের পেছনে যেতে যেতে থেমে গেল মেয়েটিকে পড়ে যেতে দেখে। চোখ সরু করে চাইলো। মেয়েটিকে তুলতে গেল মিনা আর সানজু।
ছলছলে চোখে মেয়েটি তাকালো তাদের দিকে। মিনা বলল
আপনি ঠিক আছেন?
মেয়েটি চোখমুখ কুঁচকে বলল
নেচে নেচে হাঁটলে তো যে কেউ পড়ে যাবে। হাঁটুতে লেগেছে। উফফ।
সরি আমরা। আসলে দেখতে পাইনি। উঠুন। বউ কোথায় জানেন?
মেয়েটি উত্তর দিতে যাবে তক্ষুণি পেছনের সুকুমার লোকটিকে দেখে তড়িৎ গতিতে চোখদুটো ঈগল পাখির গালের মতো বড় হয়ে গেল। হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। বারকয়েক ঢোক গিলে ঢালাটি ফেলে, পা থেকে খুলে পড়া একপায়ের জুতো ফেলে আরেক পায়ের জুতো নিয়ে ছুটলো সে। মাগোমা সুকুমার লোকটি তার পিছু পড়েছে কেন? যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই এই লোক। সে আর কোথাও যাবে না।
মিনা,সানজু হা করে রাহার দৌড়ে যাওয়া দেখলো। পেছনে দাঁড়ানো তানজীবের দিকে ফিরতেই তারা দেখতে পেল মেজরের ঠোঁটে বক্র হাসি।
মেয়েটা পাগল বোধহয়। এনিওয়ে, বউ নিশ্চয়ই উপরতলায়। গো।
মিনা আর সানজু ভাইয়ের কথায় হেসে মাথা দুলালো।
চলবে,