#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৭.( শেষাংশ )
.
কারোর চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল আমার। টিপটিপ করে চোখ দুটো খুলতে লাগলাম। হঠাৎ চোখ খুলে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি আমি, শুধু কারোর চেচামেচির আওয়াজ কানে আসছে। আম্মু ও বড়মার গলার আওয়াজ পেতেই ধরফর করে উঠতে লাগলাম। হাতে বাঁধা পেতেই তাকিয়ে দেখলাম তাসফি ভাইয়া গম্ভীর মুখে আমার এক হাত খুব শক্ত করে ধরে আছেন। উনার পাশেই চুপচাপ সিরিয়াস মুডে দাঁড়িয়ে থাকা রিফাপুর চেহারা দেখতে পেলাম। মাথা ঘুড়িয়ে চারদিকে আত্মীয়দের দেখে বুঝতে পারলাম নিজের রুমেই আছি। চেচামেচির আওয়াজ দরজার কাছ থেকেই তীব্র ভাবে ভেসে আসছে।
শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছিলো। রুমে আসার জন্য আম্মুকে ডাকতে গিয়েও পারছিলাম না, তখনই হঠাৎ চারদিকে ঝাপসা হয়ে পড়ে যাই নিচে, তখন তাসফি ভাই এসে হয়তো ধরেছিলেন আমাকে। তারপর? তারপর আর তেমন কিছুই ঠিক মনে নেই। এভাবে হঠাৎ আমার অসুস্থ হওয়ার জন্য তো আম্মু ও বড়মার এতো চেচামেচির প্রয়োজন নেই। তাহলে…. তাহলে এভাবে কে চিৎকার করে কিছু বলছে? বড়মার কথা তেমন না শোনা গেলেও ছোট দাদী ও তার বড় মেয়ে রোজি ফুপুর আওয়াজ খুব জোরেই শোনা যাচ্ছে। মাথার হালকা চিনচিন ব্যাথা নিয়েই আস্তে করে উঠে বসলাম। রুমে থাকা কারোরই আমার দিকে বিন্দু মাত্র নজর নেই।
“আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে কি বেহায়া হয় এদের না দেখলে বোঝায় পারতাম না বাপু। মানসম্মানের টিকিটিও রাখলো না গো আল্লাহ। বাড়ি ভর্তি মানুষজন তাও এদের লাজলজ্জার বালাই নাই।”
কথাগুলোর মানে বুঝতে চেয়েও কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কে কি করলো যে এই মহিলাটা বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমন তামাশা শুরু করেছে? ফালতু একটা মহিলা।
“জোয়ান একটা ছেলের সাথে সারাদিন লাগালাগি তো কইরাই থাকে। কত কইসি এই মেয়ে সুবিধার না, এই মুরুব্বির কথা শুনেই না কেডা। আমারে তো এরা মা কইয়া মানেই করে না। এখন মানসম্মান হারাতে হইলো তো? আমারে কেউ দাম না দিলে কি হইবে, আমি তো ছেলেমেয়ের মতোই দেখি এদের।”
“দেখুন আপনি কিন্তু অযথা উল্টোপাল্টা ক….”
কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বড়মার কথা আটকে দিয়ে উনি আবারও বলতে লাগলেন,
“তুমি চুপ করো। খুব তো বড় বড় কথা বের হয় মুখ থেকে। শ্বাশুড়িকে তো সম্মান পর্যন্ত দেও না, তোমাদের থেকে এরা আর কি শিখবে? কি নির্লজ্জ মেয়ে রে বাবা, লজ্জা-সরমের বালাই নেই এদের? ঘরের মধ্যে দরজা আটকে কি নোংরামো শুরু করছে বাবা? ছিঃ ছিঃ!”
কথাগুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকে পড়লো উনি। উনার সাথে ফুপু ও চাচী আসলেন। আমার দিকে তাকিয়েই ফুপু বলতে লাগলো,
“কেমন বেহায়া ছেলেমেয়ে দেখো? এতক্ষণ দরজা আঁটকে নষ্টামি করে এখনও শখ মিটে নি, কোমন হাত ধরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে? কি নির্লজ্জ মেয়ে গো, একজন শ্বশুরবাড়ি না যেতেই ভাইয়ের সাথে কীর্তি-কারখানা শুরু করলো নতুন আত্মীয়দের সামনে আর মুখ রাখলো না আমাদের।”
“কি আর কইতাম গো বুবু। গ্রামে গেলেও তো লুকাই লুকাই হাত ধরাধরি করতো, কিছু কইতেও পারতাম না। মনে করতাম ভাই বোন হয়, তাই হয়তো। আজ বুঝতে পারছি ক্যান করতো। লাজলজ্জা নাই বলেই ঘর ভর্তি মানুষের সামনের হাত ধরাধরি করে আছে গো বুবু।”
চমকে উঠলাম আমি। কথাগুলো যে আমাকে ত্যাগ করে বলা সেটা বুঝতে আর কিছুই বাকি রইলো না। জোরে ঝাঁকি দিয়ে তাসফি ভাইয়ার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। কাঁপতে লাগলো আমার হাত দু’টো, কেঁপে উঠলো আমার দূর্বল শরীরটা। এখানে কি হচ্ছে সবকিছুই যেন মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভাই বোনের সম্পর্ক নিয়ে এত নোংরা চিন্তা-ভাবনা এরা কিভাবে মাথায় আনতে পারে? চোখের কোণায় পানি জমতে লাগলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিচু মনের মানুষগুলোর দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“ক্..কি বলছেন কি আ..আপনারা এএগুলো? কি করেছি আ..আমি?”
আমার কথার উত্তরে খেঁকিয়ে উঠলো ছোট দাদী।
“ঘরের দরজা আঁটকে এতক্ষণ নষ্টামি করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে না? আরে দেখ দেখ সবাই, মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না। নাটক কইরা যাচ্ছে দেখ সবাই। ক্যান যে পা রাখছি এই বাড়িতে? এগুলা আর দেখতে হতো না আল্লাহ!”
“চুপপ… আর একটাও বলবেন না আপনি। অনেকক্ষণ থেকে আপনাদের এই ফালতু কথাবার্তা গুলো শুনে যাচ্ছি। আমি চুপ করে আছি জন্য এই না কিছু বলবো না। কোন ভুল করি নি আমরা।”
তাসফি ভাইয়ার চিৎকারে আরও কেঁপে উঠলাম আমি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে এদের এমন নোংরা কথায়।
“ওও আল্লাহ্ গো, সত্যি কথার দাম নাই দেখি। সকলের সামনে এদের নষ্টটামি ধরা পরছে আর কয় কি এরা? এত রাইতে ভাই বোনে একলা ঘরে দরজা লাগাই থাকে আর আমি কইলে দোষ?”
আর সহ্য করতে পারলাম না এদের কথাগুলো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না দেখে ফুপি ও রিফাপু জড়িয়ে ধরলো আমায়। ওদের কাছে পেয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠলাম। কতটা নিচু মন মানষিকতার হলে এসব কথা বলতে পারে তারা। আমরা তো কোন অন্যায় করি নি, তাহলে এসব কথার মানে কি? আমাকে এভাবে কান্না করতে দেখে বড় চাচা, আব্বু, ফুপা, বড়মা, আম্মু সহ বাকি সবাইও রুমে আসলো।
“আপনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন? নানু বলে তো আপনাকে মানিই না যেটুকু সম্মান দিতাম সেটাও কিন্তু ভুলে যাবো এখন।”
“ছেলেটাকে কেমন করে মানুষ করেছো রেহানা? বোনের সাথে একা একঘরে থাকতে কিছু না, আমি কইছি তাতেই ফোসকা পরলো ছেলেটার? আর ছেলেটাকে কি-ই বা দোষ দেওয়া যায়, এই মেয়ে যে ওকে ফাঁসায় ঘরে আনছে সেটা কি বুঝি না?”
“আপনাকে তো আমি…..”
“আহ্ তাসফি শান্ত হও। এখন এভাবে রাগারাগি করার সময় নয়। মাথা ঠান্ডা করো।”
“আব্বু উনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। এত নোংরা চিন্তা ভাবনা কিভাবে আনতে পারে উনি। খুব সম্মান দেখিয়েছি এতক্ষণ, আর না।”
“তাসফি! মাথা ঠান্ডা করো বাবা। আমি তোমার আব্বু, তোমার ছোট মামাকে ভাবতে দাও ব্যাপারটা।”
বড় চাচার কথায় শান্ত হলেন তাসফি ভাইয়া। চুপ করে গেলেন উনি। কিন্তু আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারলাম না। বড় চাচার প্রতি অগাধ আস্হা থাকলেও কিছুতেই সামলাতে পারছি না এসব কথাগুলোর ভীড়ে। কখনোই এমন পরিস্থিতির স্বীকার হইনি, নিজেকে কিভাবে সামলাবো কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আজকে বাসায় থেকে যাওয়া আত্মীয়দের মাঝে সবাই গ্রামের। তারাও তাসফি ভাইয়াকে জড়িয়ে আমাকে নানা বাজে কথা বলে যাচ্ছে, কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। ফুপিকে জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছি।
“আমার কথা তো কেউ শুনাই শুনে না। যা কই খারাপ ভাইবা বসে থাকে সব। বলি এই মেয়েকে আর কেডাই বিয়ে করবে? বংশের মানসম্মান যা আছিলো সব তো শেষ হইয়া গেল। তাসফি তো আমাদের বংশের না, তাও ছেলে মানুষ ওর আর কি হইবো? সব চুনকালি তো আমারে বংশেই লাগলো, কে বিয়া করবি এইডারে?”
“ভাই আমি বলি বলি কি, আমাদের রাজিব আছে না? ওর সাথেই রূপার বিয়ে দিয়ে দেন। পরিবারের সম্মানটা তাও কিছুটা বাঁচানো যাবে। রেজীর ছেলে কিন্তু আসলেই অনেক ভালো।”
চমকে উঠলাম আমি, সাথে কান্নাটাও থেমে গেল আমার। কি বলে এনারা? অমন একটা লম্পট ছেলের সাথে আমাকে? ছি, স্বার্থের জন্য এরা এতটা নিচে নামতে পারে? এতদিন বড় চাচা ও আব্বুকে প্রস্তাব দিয়েও ব্যার্থ হতে হয়েছে জন্য এমন একটা পরিস্থিতিকে বেছে নিলো?
“হ্ আব্বা ঠিক কইছিস। আমার নাতনিটা কিন্তু অনেক ভালো। আমরা ওরে বিয়ার কথা কইলে না করবো না। আমিই রাজিবের সাথে কথা কমু, তোমরা আর কেউ কিছু কইয়ো না। বংশের সম্মান বাঁচাতে এডায় শেষ উপায়। তুই রাজিবের সাথেই এর বিয়ার ব্যাবস্থা কর আব্বা।”
উনার কথায় আত্মীয়দের সবাই সায় দিতে লাগলো। গ্রামের মানুষ, গ্রামের নামকরা উচ্চ বংশের সম্মান বাঁচাতে সবাই রাজী হয়ে গেলেন। ফুপা, বড় চাচা আব্বু, বড়মা, আম্মু নিরাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কোন কথা বলছে না। এই মুহুর্তে তাদের চুপ করে থাকাটা যেন ভীষণ রকম যন্ত্রণা দিচ্ছে আমাকে। সহ্য করতে পারছি না আর কিছুতেই। হুহু করে কেঁদে উঠলাম আবারও। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও ম*রে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
“তবে সেটাই হোক। করো তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা কিন্তু সেটা রাজিবের সাথে নয় আমার সাথে। আমাকে আর রূপাকে নিয়ে যখন এসব কথা জড়িয়েছে তাহলে আমিই ওকে বিয়ে করবো। আর সেটা আজকেই।”
.
.
(চলবে…..)
রুমে আঁটকে যাওয়ার ব্যাপারটা আগামী পর্বে অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে আশা করি। আপনাদের নেক্সট নেক্সট কমেন্ট দেখে আমি অনে অনেক আশাহত।☹️ গল্প দেখার মানষিকতা একেবারেই হাড়িয়ে যায়। সবাই পাঠন মূলক কিছু বললে আরও উৎসাহ পাবো। গল্পটা কেমন হচ্ছে সবাই জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।