#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৫.
.
হাজারো লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে বসে আছি বিছানার এক কোণায়। বাসায় এসে পৌঁছেছি মিনিট বিশেকের মতো হবে। রুমে এসেই তাসফি ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছিলেন ফ্রেশ হবার জন্য। কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে এসে, আমাকে কয়েকবার ফ্রেশ হবার জন্যও বলেছেন। কিন্তু আমি, আমি আসার পর থেকে ঠিক একই ভাবে বসে আছি বিছানার কোণে। মনোযোগ দিয়ে ভেবে চলেছি রিকশায় করা আমার কর্মকাণ্ড গুলো। ইস্! কিভাবে পারলাম আমি ওনাকে তখন জড়িয়ে ধরে ওসব কথাগুলো বলতে? নির্লজ্জের মতো কেমন করে জড়িয়ে ছিলাম, আর উনিও কিছু বলে নি। ভেবেই অবাক লাগছে আমার, সাথে লজ্জার বাসা বাঁধছে।
অনেকটা পথ চলে আসার পর হুট করে রিকশা থামিয়ে যখন আমায় বললেন,
‘একটু বসে থাক আমি এক্ষুনি আসছি।’
তখনই আমার ঘোর কেটে যায়। চট করে সরে আসি ওনার থেকে। উনি সময় ব্যায় না করে নেমে গেলেন রিকশা থেকে। কোথাও থেকে অনেকগুলো চকলেট কিনে এনে আমার হাতে দিয়ে বলে উঠলেন,
‘আতিফার দেওয়া চকলেট গুলো দিলাম। এবার বাসায় গিয়ে আদর গুলোও দিয়ে দিবো।’
ওনার সেই কথাটা শোনার পর থেকে আমি একেবারেই চুপ করে গেছি। তারপর থেকে ওনার সাথে না বলেছি কথা, আর না তাকিয়েছি ওনার দিকে।
“মাথার সাথে কানটাও কি গেল তোর? কখন থেকে একটা কথা বলে যাচ্ছি শুনতে পারছিস না? বেয়াদব! যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
জোরে এক ধমক দিয়ে বললেন উনি। এবার কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। তাসফির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার দিকেই রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও এক ধমক দিয়ে বললেন,
“গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা তাড়াতাড়ি, বৃষ্টির পানি যে গায়ে পড়ছে সেই খেয়াল আছে তোর?”
আমার আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহসটা হলো না। জামা কাপড় হাতে নিয়ে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। কেন জানি খারাপ লাগলো না ওনার ধমকে, বরং অনেক বেশিই ভালো লাগলো ওনার রাগের মাঝে করা কেয়ার গুলো।
.
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই চমকে গেলাম আমি, চলন্ত পা দু’টো সেখানেই আটকে গেল। মুখ থেকে অজান্তেই বেশ জোরে ‘ওও শিট’ শব্দটা বেরিয়ে আসলো। এবার আমার কি হবে? এত বড় ভুল আমি কি করে করতে পারলাম? উনি তো জেনে গেলেন আমি ওনার পারসোনাল ডায়েরি পড়ে ফেলেছি, তাও ওনাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওনার প্রেম কাহিনি গুলো। এবার তো আমায় ধুয়ে দিবেন। শুধু ধুয়ে না, তারপর লাথি দিয়ে ছাদে শুকাতেও দিবেন। ইস্! ডায়েরিটা পড়ার পর সেভাবেই বিছানার উপর ফেলে রেখেছি, একদম মনে ছিলো না উঠিয়ে রাখার কথা।
তাসফি ভাইয়া খাটের পাশে ডায়েরি টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার ডায়েরিটা বিছানার উপর ফেলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ভয়ে আমার গলাটা মুহুর্তেই শুকিয়ে গেল।
ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলাম,
“আ..আসলে আমি, আমি তো ভুল করে পড়ে ফেলছি। জানতাম না… তো ওটা আ..আপনার। আ..আমি…. ”
উনি কাছে চলে আসতেই শুকনো একটা ঢোক গিললাম। আবারও বলতে লাগলাম,
“আ..আমি, আমি তো পুরোটা পড়ি নি, বিশ্বাস করেন। এ..একটু পড়ে ফেলেছি, আ.. আমাদের বিয়ের কথাগুলো পর্যন্ত। আ..আমি ইচ্ছে ক….”
আমার কথা শেষ না হতেই একদম কাছে চলে আসলেন উনি। ভয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলাম, সাথে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরও যখন ওনার কোন সাড়া পেলাম না, তখন মিটমিট করে চোখ খুললাম ওনাকে দেখার জন্য। একই ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি আরও যেন আঁটকে গেলাম ওয়াশরুমের দরজার পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের সাথে। মনে হাজারো ভয় নিয়ে আবারও কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, উনি জোরে নিশ্বাস টেনে বলতে লাগলেন,
“আসলে, মানে এসব বলে তো আর কাজ নাই। যেটুকু পড়ার নয় ততটুকু তো পড়েই ফেলেছিস, এখন আবার ভয়ে কাঁপা-কাঁপি শুরু করছিস কেন?’
আমার ভয়টা কিছুটা কমে আসলেও পুরোপুরি কমে গেল না। উনি একটু চুপ থেকে, ওনার শক্তপোক্ত হাতটা দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে এগিয়ে নিলেন ওনার কাছে। নড়েচড়ে ওনাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারলাম না। বরং আমাকে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে নিলেন উনি। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“এত ভয় পাওয়ার কি আছে? আমার সবকিছুতেই তো তোর অধিকার আছে। তাহলে ডায়েরি টা আবার কি দোষ করলো। যেটা কিছুদিন পর জানতে পারতি, সেটা আজকে জেনে গেছিস, এই তো। তাহলে ভয় পাবার কি হলো?”
“তাহলে ক..কি আ..আপনি সত্যিই আমাকে ভাল্…ভালোবাসে….”
কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটা বলতেই উনি ঝুকে এলেন আমার কাছে, কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“নিজের থেকেও বেশি… আকাশের মতো সীমাহীন ভালোবাসি আমার বউকে।”
আগের কথা চেয়েও দ্বিগুণ কেঁপে উঠলাম আমি। হাত দুটো চলে গেল ওনার ঘাড়ের ওপর। খাঁমচে ধরলাম ওনার গায়ে থাকা টি-শার্ট। ওনার ফেলা নিশ্বাস আমার ঘাড় বেয়ে পিঠে পড়তেই শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর। পা দু’টো ভেঙে আসতে লাগলো, দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। কোন কিছু না ভেবেই জড়িয়ে নিলাম ওনাকে। লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি, ভালোলাগা সবকিছু মিলে মিশ্র অনুভূতিতে মিশে গেছি আমি।
“ভালোবাসি বলতেই এ অবস্থা? ভালোবাসা গুলো দেখাতে নিলে না জানি কি অবস্থা হবে?”
সেভাবেই কিছু সময় থাকার পর তাসফি ভাইয়া আবারও বললেন। আমি কিছু না বলে একই ভাবে ওনাকে জরিয়ে রাখলাম। ওনার দিকে তাকানোর সাহসটাও যেন পাচ্ছি না। হুট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আমি আবারও খামচে ধরলাম ওনাকে। আমি ‘কি করছেন’? বলতেই উনি বললেন,
“বাহ্ রে, আতিফার দেওয়া আদর গুলো ফেরত দিতে হবে না? আমি কিন্তু এত এত আদরের ঋণ নিয়ে থাকতে পারবো না।”
ওনার কথায় কিছুটা চমকে গেলাম আমি। সেই কথাটা এখনো ধরে নিয়ে আছেন উনি? এমন করলে তো লজ্জাতে মরেই যাবো আমি, অসভ্য বজ্জাত লোকটা কি বুঝতে পারছে না। ছটফট করে নামার চেষ্টা করলে উনি আবারও বলে উঠলেন,
“লাফালাফি করে কাজ নেই। আদরগুলো আমায় ফেরত দিতেই হবে, তা না হলে এতগুলো ঋণের বোঝায় আমার ঘুম আসবে না।”
“খুদা লাগছে আমার।”
ওনার সাথে না পেরে আস্তে করে বলে উঠলাম। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেঁসে উঠলেন। তারপর আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিতে দিতে আস্তে করে আফসোসের সুরে বলে উঠলেন,
“আমার ভবিষ্যৎ পুরাই অন্ধকার।”
.
.
প্রায় আধা ঘন্টা সময় নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেও চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও আনতে পারলাম না। এর কারণটা হলো পাশেই তাসফির কোলে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা ল্যাপটপের আলো। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে কিছু সময় পরপর তাকাচ্ছি, আবার হাতে মোবাইল নিয়ে অনলাইন থেকে টু মেরে আসছি। উনি আমার দিকে তাকালে মোবাইল রেখে অন্যদিকে তাকাচ্ছি। কেন জানি খুব অসভ্য চিন্তা ভাবনা গুলো উঁকি দিচ্ছে মাথায়। আজকে ওনাকে জড়িয়ে ওনার বুকে মাথা গুঁজে ঘুমানোর বাসনা জাগছে মনে। এ-সব অসভ্য চিন্তা ভাবনার জন্য নিজেই নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। এবার তাসফি বেশ বিরক্ত হলেন হয়তো। বললেন,
“কি সমস্যা? ঘুমাচ্ছিস না কেন?”
“ঘুম লাগছে না তো।”
“চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো বড়বড় করে রাখলে ঘুম লাগবে কিভাবে? চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
মনটা কিছুটা ভার হয়ে গেল আমার। এই নাকি আমাকে ভালোবাসেন? এতটুকু সময়ের মধ্যেই উড়ে গেল ওনার ভালোবাসা। হু্! বজ্জাত লোক একটা।
“এই নাকি ভালোবাসে আমায়? এটুকু সময়েই সব শেষ। ঘুম লাগছে না, কই একটু গল্প করে ঘুমাতে সাহায্য করবে, তা না। ধুর!”
বিরবির করে কথাটা বলেই উল্টো পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। দরকার নেই ওনাকে, আর না ওনার সাথে গল্প করার। আমি একাই ঘুমাতে পারবো।
মিনিট পাঁচেক পর কোমরে ভারী হাতের অস্তিত্ব পেতেই চমকে উঠলাম। বুঝতে বাকি রইলো না হাতটা ঠিক কার হতে পারে। ওনার হাতটা সড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে বললাম,
“কি… করছেন? ঘুমাবো তো, ছাড়েন না।”
“বউটা আমার অভিমান করেছে। তার অভিমান ভেঙে আদর ভালোবাসা দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিতে হবে তো, নাকি?”
গভীর রাতে ওনার ভারী কণ্ঠে বলা কথাগুলো তে আমি যেন একদম নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। আরও গভীরভাবে ডুবে যাচ্ছি ওনার ভালোবাসার অতলে। চুপ করে থেকে শুরু অনুভব করতে লাগলাম ওনার অনুভূতি গুলো।
.
.
(চলবে….)
আজকের পর্ব অনেকটা ছোট হয়ে গেছে। আগামীকাল বড় করে দিবো ইনশাআল্লাহ। কেমন হয়েছে জানাবেন অবশ্যই। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤