#পুতুল_খেলা
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা মনি
রিপ্তি অবাক হয়ে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকায়। যেই লোকটাকে চেনে না, আগে কখনো দেখে নি, সে হঠাৎ এসে রিপ্তিকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করছে!
রিপ্তি বা উপস্থিত কেউই কিছু বুঝতে উঠতে পারছিল না। মনির যুবকটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। যুবকটি রিপ্তির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,
‘আমি তোমার আসল স্বামী রিপ্তি। আমি বেচে থাকতে তুমি কিভাবে আরেকটা বিয়ে করছ?’
রিপ্তির অবাক হওয়ার সীমা পেরিয়ে যায়৷ এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কোনদিনও ভাবতে পারে নি। এলাকার লোকজন কানাঘুষা শুরু করে। ছকিনা এই সুযোগকে কাজে লাগায়।
‘এই মেয়েটার চরিত্র কেমন সবাই দেখছেন তো? নিজের স্বামীকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে। নাউজুবিল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ।’
যুবকটি রেগে গিয়ে মনিরকে কিছু ইশারা করে। মনির ছকিনাকে বলে,
‘আম্মু তুমি চুপ করো। অনেক নাটক করেছ। তোমার এসব নাটক করে আর কোন লাভ নাই।’
‘তুই আমার নিজের পেটের ছেলে হয়ে এমন কিভাবে করতে পাচ্ছিস? এই দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য তুই আমার মুখের উপর কথা বলছিস।’
‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
যুবকটির ধমকে ছকিনা কিছুটা দমে যায়। মনির সবাইকে সব সত্য বলতে থাকে,
‘এইসব যা হয়েছিল সব আমার আম্মুর চক্রান্ত। আম্মু রিপ্তির সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য আমার সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিল।’
‘তুমি যে তাহলে তখন বললে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। সেসব কি তাহলে মিথ্যা?’
‘আমি যা বলেছিলাম সব মিথ্যা৷ একজনকে সামনে আনার জন্য এসব বলেছিলাম।’
যুবকটিকে চোখ মে’রে কথাটি বলে মনির। যুবকটি মনিরের কাধে হাত দিয়ে বলে,
‘আজকাল খুব বুদ্ধিমান হয়ে গেছিস দেখছি৷ যাইহোক এখানে কোন বিয়ে হবে না। আপনারা সবাই যান এখান থেকে।’
মহল্লার মানুষরা যেতে না চাইলে যুবকটি গার্ড ডেকে সকলকে বের করে দেয়।
৯.
সবাই চলে যাওয়ার পর রিপ্তি যুবকটির সামনে গিয়ে দাড়ায়। যুবকটি হাত দুটো বুকে ভাজ করে দাড়িয়ে ছিল। রিপ্তিকে দেখে মৃদু হেসে বলে,
‘আমার সাথে নিজের শ্বশুরবাড়িতে ফিরে চলো রিপ্তি।’
‘কে আপনি? আমাকে নিজের স্ত্রী বলছেন কেন? আমি কিভাবে আপনার স্ত্রী হই?’
‘যেটা সত্যি আমি সেটাই বলেছি। তুমি আমার স্ত্রী।’
‘আমার সাথে সিরাজের বিয়ে হয়েছিল। আপনাকে আমি কখনো দেখিনি। তাহলে আমি কিভাবে আপনার স্ত্রী হই?’
‘সিরাজ না। তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল।’
যুবকটির কথা শুনে রিপ্তি দু পা পিছিয়ে যায়। সবকিছু তার কাছে কিরকম লাগছে। তার মাথা ঘুরছে।
‘নিজেকে সামলে নাও রিপ্তি। তোমাকে এখনো অনেক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে।’
রিপ্তি যথেষ্ট ঘোরের মধ্যে ছিল। যুবকটি তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এই নাও এই পানি খেয়ে নাও।’
‘আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’
‘আমি কোন মজা করছি না রিপ্তি। আচ্ছা তুমি একবার মনে করে দেখো তো তোমার বিয়ের দিন কি হয়েছিল।’
রিপ্তি ভাবে তার বিয়ের সময়কার কথা। নিজের বাবা-মায়ের মৃত্যুতে সেইসময় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল রিপ্তি। ছকিনা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাইছিল। রিপ্তির বাবার অঢেল সম্পত্তি ছিল তার নামে। এই সুযোগে যদি রিপ্তিকে বিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সব সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। এরকম সময় সিতারা বেগম তার ছেলের জন্য সম্মন্ধ নিয়ে আসে। ছকিনা এই সুযোগটা লুটে নেয়।
একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই বিয়েটা দিয়ে দেয়। রিপ্তি বিয়ে করবে না জন্য অনেক কান্নাকাটি করে। তাকে একপ্রকার জোর করে বিয়ের আসরে এনে বসানো হয়। কাজি যখন বিয়ে পড়াচ্ছিল তখনও সে চিৎকার করে কাদছিল, যার কারণে সে কোন কথাই শুনতে পায়নি। শোনার মতো অবস্থাতেও ছিল না।
কাজি কবুল বলতে বললেও রিপ্তি চুপ ছিল। অন্যদিকে পাত্র রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে ছিল বিধায় কেউ তার মুখ দেখে নি। রিপ্তি একবারও ছেলেটির দিকে তাকায় না। যার কারণে ছেলেটির মনে অভিমান জমা হয়।
ছকিনা বেগম রিপ্তিকে কুমন্ত্রণা দেয়। বলে,
‘যদি তুই কবুল না বলিস তাহলে তোর চাচাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।’
সেইসময় ছকিনা আর মঞ্জুরুল মিলে এমন নাটক সাজিয়েছিল রিপ্তির সামনে যে ছকিনা খুব খারাপ হলেও মঞ্জুরুল ভালো। মঞ্জুরুলও নাটক করে এই বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করে। রিপ্তি সেসময় খুব ছোট আর অপরিপক্ক ছিল তাই এসব নাটক ধরতে পারে নি। তাই নিজের চাচার জন্য কবুল বলে দিয়েছিল।
রিপ্তি এতক্ষণ ধরে এসব কথাই ভাবছিল। তখন যুবকটি বলে,
‘সেদিন যদি তুমি কাজির কথা শুনতে তাহলেই শুনতে পেতে তোমার বরের নাম সিরাজুল রহমান সিরাজ নয় তোমার বরের নাম আমানুল রহমান আমান।’
‘তার মানে আপনার নাম আমান আর আপনিই আমার স্বামী! তাহলে এতদিন ধরে আমি যে জানতাম সিরাজ আমার স্বামী!’
আমান মাথা নিচু করে।
‘সব দোষ আমার। সেদিন তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল তুমি এই বিয়েতে রাজি নও। তাই আমি অভিমান করে বিয়ের পরপরই বিদেশে চলে যাই। সেদিন আমার ফ্লাইট ছিল ভেবেছিলাম বিয়ের পর বউকে নিয়ে একেবারে কানাডা চলে যাব। কিন্তু তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমি রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। এদিকে আমার পরিবারের সবাই পড়ে গিয়েছিল মহা ঝামেলায়। আসলে বিয়েটা সেরকম আনুষ্ঠানিক ভাবে হয়নি৷ পরিবারের বাইরে কেউ বিয়ের ব্যাপারে জানত না। কিন্তু আমার আম্মু বিয়ের পরেরদিন বড় করে অনুষ্ঠান করে পাড়া প্রতিবেশি,আত্মীয় স্বজন সবাইকে ডাকে। আমার চলে যাওয়ার কথা শুনে তাদের মাথায় হাত চলে গিয়েছিল৷ নিজেদের সম্মান বাচাতে তাই সেইসময় আমার বদলে ভাইয়াকে তোমার বর বলে চালিয়ে দেয়।’
১০.
রিপ্তির হাত পা সব কাপছিল। তার সাথে এরকম কিছু হয়েছে সেটা কখনো বুঝতেই পারে নি। এইজন্য বোধহয় সিরাজ সবসময় তার থেকে দূরে থেকেছে। আসলে সিরাজ তো তার স্বামী নয়। অথচ এতদিন ধরে সিরাজকেই নিজের স্বামী ভেবে এসেছে রিপ্তি। তাকে তো এটাই বোঝানো হয়েছিল।
রিপ্তির খুব রাগ হয় আমানের উপর। আমানের শার্টের কলার চেপে বলে,
‘কেন করলেন আমার সাথে এমন? আমাকে নিয়ে এ কি খেলা খেললেন? আমাকে কি আপনাদের পুতুল মনে হয়? যখন যেরকম ইচ্ছা নাচাবেন আর আমি নাচব? পুতুল খেলা হচ্ছে আমার সাথে পুতুল খেলা?’
আমান রিপ্তির সামনে হাটু গেড়ে বসে।
‘আমায় ক্ষমা করে দাও রিপ্তি। আমি তোমার সাথে যা করেছি সেটা সত্যি অন্যায় মানছি আমি। সব কিছু আমারই ভুল ছিল। এখন তো আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি৷ এখন কি আমাকে আপন করে নেওয়া যায়না?’
‘কি করে ভাবছেন এতকিছুর পরেও আমি আপনাকে আপন করে নেব? আমি আপনাকে ঘৃণা করি, প্রচুর ঘৃণা করি। আপনার মুখও দেখতে চাই না। চলে যান আমার সামনে থেকে। নাহলে আমি এবার সত্যিই আপনাকে খু’ন করে ফেলব।’
‘আমাকে মে’রে ফেলে যদি তুমি শান্তি পাও তাহলে তাই করো মে’রে ফেলো আমায়।’
রিপ্তি কোন কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমান বাইরে থেকে বলছিল,
‘তুমি যতক্ষণ না আমাকে ক্ষমা করে দেবে, আমার সাথে যেতে রাজি হবে আমি এখানেই বসে থাকব। তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে রিপ্তি। আমি এতদিন পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছি যখন তখন তোমাকে যে করেই হোক আমায় ক্ষমা করতে হবে।’
রিপ্তি দরজা লাগিয়ে পাগলের মতো কাদছিল। তার সাথে ভাগ্য কেন এত নিষ্ঠুর খেলা খেলল? আল্লাহর কাছে নিজের জমানো সব অভিযোগ দাখিল করল রিপ্তি।
‘আল্লাহ আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো কোনদিনও কারো ক্ষতি করিনি। কখনো সজ্ঞানে কোন অন্যায় কাজও করিনি। তবুও কেন হলো আমার সাথে এমন?’
✨
সিরাজ তার লকারে কিছু একটা খুজছিল। মুনিয়া বিছানায় শুয়ে ছিল৷ গতকাল দুপুরের ঘটনাটা এখনো ভুলতে পারছে না। ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারে নি।
সিরাজ লকারে ডিভোর্স পেপারস খুজে না পেয়ে মুনিয়ার উপর চেচামেচি করতে শুরু করে।
‘তোমাকে না বলেছিলাম সবকিছু নজরে নজরে রাখতে। কোথায় ছিলে তুমি? লকারে তো ডিভোর্স পেপারস রেখেছিলাম সেগুলো এভাবে হাওয়া হয়ে গেল কিভাবে?’
মুনিয়া আমতাআমতা করে বলে,
‘আসলে কাল দুপুরে,,,,’
‘কি হয়েছিল কাল দুপুরে?’
‘কাল দুপুরে যখন আমি রান্না করছিলাম কেউ আমার মুখে রুমাল ধরে আমাকে অজ্ঞান করে দেয়। তুমি তো জানো লকারের চাবি আমার আচলেই বেধে রেখেছিলাম। তখনই হয়তো কেউ,,,’
‘এই কথা আগে বলো নি কেন? কত কষ্ট করে কোম্পানির কাগজের কথা বলে সেই সুদূর কানাডা থেকে আমানের সই এনেছিলাম। ঐ রিপ্তিকে দিয়েও সই করিয়ে নিয়েছিলাম। তোমার এই বোকামির জন্য আমার সব পরিশ্রম মাটি হয়ে গেল।’
বাইরে দাড়িয়ে হাসছিলেন সিতারা বেগম আর মোর্শেদ। মোর্শেদ বলে,
‘আম্মু তুমি তো খুব ভালো চাল দিলে। এক চালেই বাজিমাত।’
‘সিরাজ ভুলে গেছিল আমি ওর আম্মুম ও যদি চলে ডালে ডালে তাহলে আমি চলি পাতায় পাতায়। ভেবেছিল আমান আর রিপ্তিকে আলাদা করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করবে। আমার আমান আবার ফিরে এসেছে। এখন আর সিরাজের কোন উদ্দ্যেশ্য সফল হবে না।’
‘ঠিক বলেছ আম্মু। আমান ভাইয়ার জন্য আমি প্রয়োজনে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত। এবার লড়াই আরো জমজমাট হবে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨