#পুতুল_খেলা
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা মনি
রিপ্তি সারারাত দুই চোখের পাতা এক করে নি। তার জীবন নিয়ে যে সবাই এরকম ভাবে খেলেছে সেটা কখনো স্বপ্নেও ভাবে নি রিপ্তি। অবশেষে নিজের মনকে নিজেই বুঝ দেয় সে।
‘না যা হবার হয়ে গেছে। আমি আর কাউকে আমার জীবন নিয়ে খেলা করতে দেব না। আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছে সবকিছুর জবাব আমাকে দিতে হবে।’
রিপ্তি অবশেষে দরজাটা খুলে বাইরে আসে। দরজা খুলেও হতবাক হয়ে যায় রিপ্তি। আমান দরজার কাছে বসে ছিল। রিপ্তিকে দেখে উঠে দাড়ায়। আমানের চোখগুলো ফুলে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ। দেখে মনে হচ্ছে সারারাত সে এভাবেই ছিল। ঠান্ডায় কাপছিল বেচারা। দেখে মনে হচ্ছে এভাবেই সারারাত ঠান্ডায় বসে ছিল। শরীরে কোন ভারী পোশাক নেই।
রিপ্তি জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কি সারারাত এভাবেই ছিলেন?’
‘হ্যা মানে,,,’
‘আপনাকে কে এখানে থাকতে বলেছিল? আপনি কি ভেবেছিলেন, আপনি এরকম করবেন আর আমি সব ভুলে আপনাকে আপন করে নেব। যদি এমনটা ভেবে থাকেন তাহলে আপনি সম্পূর্ণ ভুল। আমাকে এতদিন ধরে ঠকিয়েছেন আপনারা সবাই। আমি কক্ষনো আপনাদের ক্ষমা করবো না।’
আমান আবার রিপ্তিকে অনুরোধ করতে থাকে,
‘প্লিজ রিপ্তি তুমি আমাকে শুধু একবার সুযোগ দাও। আমাকে বিশ্বাস করে দেখো আমি তোমাকে আর কোন কষ্ট পেতে দেবো না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোমাকে সুখী করার চেষ্টা করব।’
‘আমি আপনাকে কেন ভবিষ্যতে আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারবো না।’
রিপ্তি ও আমানের কথার মাঝে মনির সেখানে চলে আসে। মনিরকে দেখে রিপ্তি ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনির প্যান্টের পকেটে হাত গুজে মৃদু হেসে বলে,
‘তুমি আমায় ভুল বুঝতে পারো রিপ্তি। ভুল বোঝাটাই হয়তো স্বাভাবিক। বাট বিশ্বাস করো আমি যা করেছি সব তোমার ভালোর জন্যই করেছি। এই যে ছেলেটাকে দেখছ ও আমার বন্ধু আমান। ছেলেটা প্রথম দেখাতেই তোমাকে পছন্দ করেছিল, তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। তাই তো তোমার বিপদের কথা শুনে তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ দিতে চেয়েছিল। বাট বিয়ের দিন তোমার ঐরকম অবস্থা দেখে ওর ভেতরে ভেতরে অনুশোচনা হতে থাকে যে হয়তো তোমাকে সুখী করতে গিয়ে ও তোমার দুঃখ আরো বাড়িয়ে দিল। এই কারণেই বিয়ের পর অভিমান করে ও বিদেশে চলে গেল। বিদেশে গিয়েও ও তোমায় ভুলে যায়নি। রোজ নিয়ম করে আমার কাছে, মোর্শেদের কাছে তোমার খোজ খবর নিয়েছে। ও কখনো তোমার খারাপ চায়নি। হ্যা কিছু ভুল করেছে কিন্তু ওর ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ ছিল।’
‘এরকম নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আমার দরকার নেই। আমার কারো ভালোবাসার দরকার নেই। আমি,,,,’
আচমকা রিপ্তির ফোনে ম্যাসেজের টুংটাং আওয়াজ আসে। ম্যাসেজটা খুব ভালো ভাবে পড়ে রিপ্তি কোন ভাবনায় মশগুল হয়ে যায়।
‘ঠিক আছে আমি যাবো আপনার সাথে মিস্টার আমানুল রহমান আমান।’
১১.
পরিবারের সকল সদস্য একসাথে খেতে বসেছে। সবাই প্রথমদিকে চুপচাপ থাকলেও মাঝখানে সিরাজ বলে ওঠে,
‘আম্মু তুমি কাজটা একদম ঠিক করো নি। তুমি তো জানো আমি কত কষ্ট করে ডিভোর্স পেপারে দুইজনের সাক্ষর করে নিয়েছিলাম। কাল যখন তুমি মোর্শেদকে বাড়ি থেকে জোর করে ভার্সিটি পাঠিয়ে দিলে, তখন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, মোর্শেদ যাতে কিছু করতে না পারে সেই কারণেই তুমি ওকে বাইরে পাঠিয়েছ। ছেলেটা আমানের যা ভক্ত, ওর সব কথা শোনে। বাট তুমি এটা কি করলে? আমি নিশ্চিত হয়ে বাইরে চলে যেতেই তুমি পিছন থেকে ছু’রি বসিয়ে দিলে? মুনিয়াকে অজ্ঞান করে ডিভোর্স পেপারটা সরিয়ে দিলে?’
সিতারা বেগম ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে ছিল। লোকমাটা গিলে বলে,
‘তুই কি ভেবেছিলি সিরাজ? আমি আমানের বিরুদ্ধে কাজ করব। সব তো শুধু একটা নাটক ছিল৷ আমি ইচ্ছা করেই মোর্শেদকে বাইরে পাঠিয়েছিলাম। সব করেছি তোকে বোকা বানানোর জন্য। আর দেখ তুই বোকা বনেও গেলি। ভুলে যাসনা আমি তোর মা। তোর এক কাঠি উপরে চলি আমি।’
‘কাজটা তুমি একদম ঠিক করোনি আম্মু। এর মাশুল কিন্তু তোমাকে দিতে হবে।’
‘আমার কথা না ভেবে তুই তোর নিজের কথাটা আগে ভাব। আমান আজ ফিরে আসছে। ও এসে কিন্তু তোকে ছেড়ে কথা বলবে না। সবকিছুর হিসাব নেবে।’
আমানের কথা শুনে সিরাজ ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করে না। এমন ভাব করে যে মনে হচ্ছিল আমানকে সে দুই পয়সার কেয়ার করে না।
সিতারা বেগম মোর্শেদকে প্রশ্ন করে,
‘তুইও কম যাস না মোর্শেদ। তুই যেভাবে রিপ্তিকে আগলে রেখেছিলি, যেভাবে সেদিন ওকে আটকে রাখলি আমার তো মনে হয়েছিল তুই বোধহয় ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস।’
মোর্শেদ হালকা হেসে বলে,
‘কি যে বলো না আম্মু। আমি রিপ্তি ভাবিকে কখনো সেই নজরে দেখিনি৷ তুমি তো জানো আমি আমান ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসি, কতটা সম্মান করি। সে আমার জন্য যা করেছে তাতে আমি আজীবন আমান ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমান ভাইয়া যে রিপ্তি ভাবিকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে সেটা আর কেউ না জানলেও আমি খুব ভালো করে জানি৷ তাই তো তার অবর্তমানে ভাবির খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি। ভাবিকে আটকেও রেখেছিলাম যাতে ভাইয়া বাড়িতে ফিরে তাকে দেখতে না পেয়ে কষ্ট পায় সেই কারণে। আমি ভাইয়ার কষ্ট কিছুতেই সহ্য করতে পারব না।’
মোর্শেদের কথা শুনে সিরাজের গা জ্ব’লে যাচ্ছিল। সিরাজ মনে মনে বলে,
‘এদের নাটক যে আর কতদিন দেখতে হবে। এই আমানটা না জানি কোন রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল মোর্শেদকে। তারপর থেকে আমাদের বাড়িতে থেকে আমাদের সমান সুযোগ সুবিধা পেয়ে বড় হতে লাগল। আমাদের ভাইয়ের মতো। আম্মুও এমনভাবে আপন করে নিল যেন নিজের সন্তান। আব্বুই একমাত্র ছিল আমার মতো যে ওকে মেনে নেয়নি। শেষপর্যন্ত আব্বুকেও তো,,,,,,’
সবকিছুর মাঝে মুনিয়ার মাথা ঘোল হয়ে যাচ্ছিল। সে তো জানতো সিরাজের প্রথম স্ত্রী রিপ্তি। মুনিয়ারও এর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সাথে ঝগড়া ঝামেলার কারণে ডিভোর্স হয়ে গেছিল। তাই সিরাজকে বিয়ে করতে তার কোন আপত্তি ছিল না। এখন যখন জানতে পারল যে রিপ্তি আসলে সিরাজের স্ত্রী নয় তখন তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছিল।
১২.
আমান রিপ্তিকে নিয়ে তার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সিতারা বেগম মৃদু হেসে তাদের উষ্ণ অর্ভ্যত্থনা জানায়। রিপ্তি মনে মনে বলে,
‘তোমরা জানো না তোমরা কাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছো। তোমাদের সবাইকে তোমাদের কাজের জন্য শাস্তি পেতে হবে। আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ তোমরা। এবার সবকিছু ফিরে পাওয়ার পালা। আমার প্রতি করা প্রত্যেক অন্যায়ের গুনে গুনে হিসাব নেব। আমাকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলেছ তাইনা? এবার তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি খেলব।’
সিতারা বেগম বলেন,
‘তোমরা আর বাইরে দাড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসো।’
আমান রিপ্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। রিপ্তি হাতটা না ধরেই বাড়িতে প্রবেশ করে। সিতারা বেগনের সামনে গিয়ে বলে,
‘আপনি জানেনও না কাকে বাড়িতে আনলেন। আমি কতোটা ভয়ানক হতে পারি আপনাদেরকেও জন্য এবার সেটা আপনারা হারে হারে টের পাবেন। নিজেদের ধ্বংসের কাউন্ট ডাউন শুরু করুন। আজ থেকে আমি দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের জীবনকে নরকে পরিণত করার দায়িত্ব নিলাম। আমার মা-বাবার প্রতি করা অন্যায়ের বদলা তো আমাকে নিতেই হবে।’
রিপ্তির শেষের কথাটা শুনে সিতারা বেগম ঘাবড়ে যান। যার কারণে এই শীতের দিনেও তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨