গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 22

0
556

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বাইশ
–তুই কোনোদিন মা হতে পারবে না।
কথা’টা শুনতে’ই ফাইজা আঁতকে উঠলো। চোখ থেকে মুহূর্তেই অশ্রুধারা নামতে শুরু করলো। তনুজা ফাইজা’র মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মেয়ের মতো বুকে আগলে নিলো ফাইজা’কে। ফাইজা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তনুজা ফাইজা’র খালামনি হয়। পেশায় একজন গাইনী ডাক্তার। ছোট বেলায় ফাইজা একটা এক্সিডেন্টে ওর গর্ভধারন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এটা ফাইজা জানত না। তাই আজ নিজের প্রশ্ন গুলোর উওর খুঁজতে’ই ফাইজা সকাল সকাল কলেজে আসার নাম করে এখানে চলে আসে। আর এসেই এত বড় একটা সত্যির মুখোমুখি হতে হবে ভাবতে পারছেনা ও। বুকেদ ভেতর ঝড় বইছে। তনুজা স্বান্তনা স্বরে বলে উঠলো…
–মা হতে হলে যে গর্ভ ধারন করতে হবে। নিজের দেহ থেকেই সন্তান জন্ম দিতে হবে এমন’টা নয়। তোর জন্য আমি ফুটফুটে বাচ্চা এনে দিব। দেখবি যা’কে পেয়ে তুই তোর এই যন্ত্রনা নিমিশেই ভুলে যাবি।
বলেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ফাইজা কান্না মাখা স্বরে বললো….
–যে মানুষ’টা আমাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে তাকে আমি ঠকাচ্ছি মনি’মা……
ফাইজার কথায় অনুজা ওর মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে একটু রাগী স্বরে বললো….
–তুই কি করে ভাবলি যে তুই ফারদিন’কে ঠকাচ্ছিস। ফারদিন সমস্ত সত্যি’টা যেনে’ই তোকে ভালোবাসে……..
তনুজার কথায় ফাইজার কান্না থেমে গেলো। ছলছল চোখে তনুজার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তা দেখে তনুজা একটু হেসে ওর চোখের পানি টুকু মুছিয়ে দিতে দিতে বললো….
—বাচ্চা’দের মতো কাঁদছিস কেনো? আমাদের ফারদিন জামাই বাবা জীবন যদি জানে তার এক মাত্র প্রেয়সী কেঁদে কে’টে একাকার হয়ে আছে। তাহলে কি করবে বল তো?
ফাইজা উচ্ছুক স্বরে প্রশ্ন করে বসলো…..
–উনি সব’টা কি করে জানে মনি’মা?
তনুজা ফাইজার সামনে থেকে উঠে টেবিলে গিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে বলে উঠলো…..
–ফারদিন যেদিন তোকে বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে উঠলো। সেদিন তোর বাবা এই একটা ভয়ে ছেলে’টাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। তাতে ছেলে’টার চোখে আমি তীব্র যন্ত্রনা দেখেছিলাম। ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম ছেলে’টা তোকে কত’টা ভালোবাসে। ভদ্রতার খাতিরে ছেলে’টা সেদিন তোর বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারে’নি। হাতে পায়ে ধরে রিকুয়েষ্ট করছিলো কিন্তু তোর বাবা রাজি হচ্ছিলোনা। সেদিন ও বাসা থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আমিও ওর পেছন পেছন ওর গাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। তোর জীবনের বড় সত্যি’টা খুলে বলেছিলাম ও’কে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে যাই এত বড় একটা সত্যি জেনেও ছেলে’টা এক মুহূর্তের জন্য ভেঙে পড়ে’নি৷ বরং এই বিষয়’টা এক প্রকার পাত্তা না দিয়ে আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে ছিলো….
“আমি ও’কে ছেড়ে বাঁচতে পারব না বিশ্বাস করুন। নিজের জীবনের সব তিক্ততা ভুলে ও’কে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছি। ওর মা না হওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই বিশ্বাস করুন। আমার শুধু ও’কেই চাই। আমি কোনোদিন ওর শরীরে এক ফোটা আঁচড় লাগতে দিব না। বাইরের কেউ কোনোদিন এই বিষয় ও’কে কথা শুনাতে পারবে না। একটু বুঝিয়ে বলুন আন্টি আংকেল’কে আমি ও’কে ছাড়া বাঁঁচব না”
বলেই কান্না করে দিয়েছিলো বাচ্চাদের মতো। আমি অবাক নয়নে তাঁকিয়ে ছিলাম৷ একটা ছেলে এতটা ভালোবাসতে পারে কি করে? সেদিন ও’কে কথা দিয়েছিলাম যে করে হোক আমি তোর বাবা-মাকে রাজি করিয়ে তোকে ওর হাতে তুলে দিব। আমি আমার কথা রেখেছি। এত সব কিছুর মাঝে তোর বাবা-মাকে আমি জানাতে পারিনি যে ফারদিন সত্যি’টা জেনেই তোকে মেনে নিয়েছে। ছেলে’টা তোকে খুব ভালোবাসে ফাইজু। তুই খুব ভাগ্যবতী যে এমন কাউকে পেয়েছিস। আর তুই ভাবছিস তুই ও’কে ঠকাচ্ছিস। ব’লদ মেয়ে……
বলেই পানির গ্লাস’টা ওর দিকে এগিয়ে দিলো। ফাইজা কথা না বলে এক দমে পানি টুকু খেয়ে নিলো। ওর এখন নিজেকের সত্যি’ই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। যেই ছেলে’টা ও’কে এত বেশি ভালোবাসে আর ও কিনা তাকে’ই ছেড়ে যেতে চাইছিলো। এটা ভেবে নিজের উপর রাগ ও উঠছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে তনুজা’কে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো…..
–জানো এক বছর আগে আমি তাকে আমাদের স্কুলের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তখন তো সামনে আমার এস এস সি এক্সাম ছিলো। সেদিন আমার স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে ছিলো। আরজার সাথে কথা বলতে বলতে গেট দিয়ে বের হতে’ই দেখি সে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে ছিলো। ব্লু কালার শার্ট আর ব্লাক জিন্স’এর সাথে ব্লু আর সাদার কম্বিনেশনে সুজ। চোখে ব্লাক সানগ্লাস। মাথায় ব্লাক ক্যাপ ছিলো। একটা মনোমুগ্ধকর লাগছিলো যে আমি হা করে তাঁকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করো সেদিন নিজের অজান্তে’ই অনেক ক্ষন দূর থেকে তাঁকিয়ে ছিলাম। তার চোখে সান গ্লাস থাকায় বুঝতে পারিনি সে কোন দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। কিন্তু তাও কেনো যেনো আমার মনে হচ্ছিলো ওই মানুষ’টা আমার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। ছোট খাটো ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে দেখতাম সে আমাদের স্কুল গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকতো আবার কখনো দেখতাম গাড়ির ভেতর বসে আছে। তাকে প্রতিদিন দেখার নেশা জন্মেছিলো খুব করে। তাকে যেখানে দেখতাম হা করে তাঁকিয়ে থাকতাম। এভাবে কখন যে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিজেও জানিনা। দিন গুলো কা’ট’তে লাগলো। আমার পরিক্ষা শুরু হয়ে গেলো তখন আর তাকে দেখতে পেতাম না। খুব মন খারাপ হতো জানো। কত দিন কান্না করেছিলাম শুধু তাকে দেখতে পাবোনা ভেবে। তারপর শেষ পরিক্ষার দিন আরজা’কে সাথে করেই স্কুলের সামনে গিয়েছিলাম ভেবেছিলাম তাকে একবার শুধু দেখতে পাবো। কিন্তু, আমাকে তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়েই ফিরে আসতে হয়েছিলো সেদিন তাকে দেখতে পাই’নি। আস্তে আস্তে ওই মানুষ’টা আমার মাথায় আঠার মতো লেগে গিয়েছিলো। চাইলেও ভুলতে পারি’নি তাকে একদিনের জন্য। দিন গড়িয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহ পর যখন তাকে নিজের কলেজের নিউ টিচার হিসেবে দেখতে পেলাম। সেদিন আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হয়’নি। মানুষ’টা প্রায় কয়েক মাস পরে দেখে ভেতরের জমানো কষ্ট গুলো চোখের অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়েছিলো সবার আড়ালে। তার এক সপ্তাহ পর ফ্রেন্ড’দের সাথে ইচ্ছেকৃত ভাবে ডেয়ার নিয়ে তাকে রাস্তার মাঝেই নির্ল’জ্জের মতো ভালোবাসি বলেছিলাম। তার বদলে দুইটা থা’প্প’ড় খেতে হয়েছিলো ভরা রাস্তায়। তাও আমার কষ্ট লাগে’নি জানো। শুধু নিজের ফিলিংশ’টাকে ডেয়ার বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তার যেই রাগ বাবা…..
বলেই আনমনে হেসে উঠলো ফাইজা। অনুজা মন দিয়ে শুনছিলো ওর কথা গুলো। তাহলে মেয়ে’টাও ছেলে’টাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতো। ভাবতেই তার ভালো লাগছে৷ সে হেসে ফাইজার দুই গাল টেনে বলে উঠলো….
–বাবা আমার এই বাচ্চা মেয়ে’টা দেখি অনেক আগেই পেঁকে গিয়েছিলো। এদিকে তার বাবা মেয়ে’ ছোট বলে শুধু শুধু ছেলে’টাকে দূরে থাকতে বলেছিলো…….
কথা’টা শুনতেই ফাইজা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসতে অনুজা পূর্নরায় বললো…..
–তোরা দুজন সারাজীবন খুব ভালো থাক। কখনো ছেড়ে যাস না ছেলে’টাকে। ভালোবাসা’কে আকড়ে ধরতে হয় ছেড়ে দিতে নেই। ছেড়ে দিলে ভালোবাসা সস্তা হয়ে যায়। অভিমানে ফাটল ধরে সম্পর্কে। তখন না চাইতেও সেই মানুষ’টাকে হারিয়ে ফেলতে হয়….
বলেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। এই কষ্ট’টা তো তার থেকে ভালো কেউ বুঝতে পারবেনা।
ফাইজা অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলো….
—এতদিন কেনো সে আমার সাথে মিস বিহেভিয়ার করতো তার কারন’টা বোধহয় আমি বুঝতে পারছি……
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here