‘ডিভোর্স হয়ে গেলে একটা মেয়ের তখন কেমন অবস্থা হয় প্রাপ্তি? এসব ছাড়ো, তোমার অনুভূতি কেমন হবে বলো?’
রেস্টুরেন্টে কাপল, ফ্রেন্ড সার্কেলের সমাগম রয়েছে। তবে কোথাও কোনো সোরগোল নেই। কেমন যেন পিনপতন নিরবতা। সফ্ট মিউজিক বাজছে। গানের মৃদু শব্দ ব্যতীত অন্যান্য কোনো শব্দ নেই।
প্রাপ্তি ক্ষীণস্বরে জানতে চাইল,’এসব কথা কেন বলছ?’
‘বলছি এই কারণেই যে, আমি তোমাকে একটু স্পর্শ করলেই তোমার বিরক্ত লাগে, রাগ ওঠে; যখন আদনান তোমাকে স্পর্শ করে তখন তো তুমি কিছু বলো না। তুমি আমার চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি কি সবসময় আদনানকেই দাও না? তোমায় বিয়ে করলে তো দু’দিনের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যাবে।’
গমগমে কণ্ঠস্বরে কথাগুলো উচ্চারিত হতেই ধরণীর সমস্ত রাগ চেপে বসে প্রাপ্তির মাথায়। সে রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকায় সামনের মানুষটির দিকে। তবুও সে নির্বাক রয়। রেস্টুরেন্টে আরও অনেক মানুষ রয়েছে। এখানে সে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে চাইছে না।
এবার পুরুষালী কণ্ঠটি আরও একবার বলল,’কী হলো? এখন কেন কিছু বলছ না?’
প্রাপ্তি নখ খুঁটতে খুঁটতে যতটা সম্ভব কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,’রায়হান আস্তে কথা বলো। এখানে আরও মানুষজন রয়েছে।’
রায়হান এবার নড়চড়ে বসে। অট্টহাসি দিয়ে বলে,’ওয়াও! গ্রেট। আদনান সবার সামনে তোমায় জড়িয়ে ধরলে সেটা কিছু না, আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা বললেই সেটা দোষ হয়ে যায়?’
‘তখন সিচুয়েশনটাই ওরকম ছিল। আদনান ইচ্ছে করে আমায় জড়িয়ে ধরেনি।’
‘তাই নাকি? ওর বেলায় সিচুয়েশনের দোহাই আর আমার বেলাতে বিরক্ত? আসলে তোমার সমস্যাটা কি বলো তো? তুমি রিলেশন করবে আমার সাথে আর জড়াজড়ি করবে ঐ আদনানের সাথে? মানে গাছেরও খাবে আবার তলারও কুড়াবে।’
‘একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলতেছ না? দয়া করে, মুখটা সামলে কথা বলো।’
‘কেন মুখ সামলে কথা বলব? আমি তো ভুল কিছু বলিনি।’
‘তুমি সত্যিও কিছু বলোনি।’
‘তাই নাকি? তাহলে বলো তো সত্যিটা কী? ওর স্পর্শ খুব ভালো লাগে? শান্তি পাও?’
রায়হানের এহেন কুরুচিপূর্ণ আকার-ইঙ্গিতের কথা শুনে গা ঘিনঘিন করে ওঠে প্রাপ্তির। রাগে,অপমানে চোখের কোণে জমা হয় একটুখানি নোনাজল।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,’একদম নিজের লিমিট ক্রস করবে না রায়হান।’
‘আমি আমার লিমিটের মধ্যেই আছি। তোমাকে আজ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।’
প্রাপ্তি আর রাগ কন্ট্রোল করে রাখতে পারে না। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে,’উত্তর চাই তোমার? তাহলে শোনো, তোমার স্পর্শে খারাপ উদ্দেশ্য থাকে যেটা আদনানের জড়িয়ে ধরাতে ছিল না। সে শুধুমাত্র আমায় সেইফ করেছে। বুঝতে পেরেছ তুমি?’
প্রশ্নটা করলেও আর উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে পার্স নিয়ে সে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে রায়হান। উপস্থিত সবাইও প্রাপ্তির কথায় এবং রিয়াকশনে বেশ হকচকিয়ে যায়।
________
রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা বাড়িতে ফিরে প্রাপ্তি। রাগে, অপমানে এখনও তার মুখটা থমথমে হয়ে আছে। রায়হান কখনো তাকে এভাবে কথা শোনাবে, এটা সে কল্পনাও করেনি। রিলেশনের পূর্বেই তার এসব ভাবা উচিত ছিল। আগে ভাবেনি আর এখন সে আফসোস করছে। রিলেশনটা যে কীভাবে হয়ে গেল এটাও সে বুঝতে পারে না। রায়হানের কাছে রিলেশন মানেই চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা, একটু কোয়ালিটি টাইম কাটানো, ক্লোজ হওয়া। অথচ প্রাপ্তির কাছে ভালোবাসা মানে এসব নয়। সে এগুলো একদমই পছন্দ করে না। গতকাল তার মামাতো বোন সেতুর মেহেদী অনুষ্ঠান ছিল। মূলত রায়হানের সাথে তার পরিচয়টা সেতুর মাধ্যমেই হয়েছিল। সেতুর বন্ধু হওয়াতে বাকি সব বন্ধুদের সাথে রায়হানও এসেছিল অনুষ্ঠানে। সেতুর মেহেদী অনুষ্ঠানে বসার ডেকোরেশন করা হয়েছিল অনেকগুলো প্রদীপের মাঝখানে। গোল বৃত্তের চারপাশে ছিল সারি সারি প্রদীপ আর মাঝখানে সেতু এবং তার কিছু বান্ধবী। সে সময়ে প্রাপ্তি ছিল গোল সার্কেলের বাইরে তবে প্রদীপের কাছাকাছি। বাচ্চাদের সাথে ছবি তুলতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার লেহেঙ্গার ওড়না একটা প্রদীপের ওপর পড়ে একটু একটু করে আগুন আগাচ্ছিল। যে যার মতো নাচ-গান, ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকায় দৃশ্যটি কারোরই চোখে পড়েনি। সেতুর মেহেদীর ফটোগ্রাফি করছিল আদনান। তখন তার দৃষ্টি পড়ে প্রাপ্তির দিকে এবং পরবর্তীতে ওড়নার দিকে। তখনো আগুন বেশি একটা আগাতে পারেনি। সে দ্রুত উঠে গিয়ে পা দিয়ে ওড়নার আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। হতবুদ্ধির ন্যায় তাকাতেই প্রাপ্তি যখন দেখতে পায় তার ওড়নাতে আগুন তখন সে ঘাবড়ে যায়। কান্না করে ফেলে।
সেই মুহূর্তে আদনান ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলেছিল,’কাঁদিস না। আগুন নিভে গেছে। এত্ত কেয়ারলেস তুই!’
এই দৃশ্যটা সেখানে বাকি সবার সাথে রায়হানও দেখেছিল। এখান থেকেই মূল ঝামেলার শুরু।
.
প্রাপ্তি বাড়িতে ফিরে দেখে আদনান ওর বন্ধুদের নিয়ে গায়ে হলুদের ডেকোরেশনের তদারকি করছে। প্রাপ্তি পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে আদনান পেছন থেকে বলে,
‘ছিছিছি, তোর কি কোনো কালেই আক্কেল-জ্ঞান হবে না? আজ সেতুর গায়ে হলুদ। কোথায় হাতে হাতে একটু কাজকর্ম করবি! তা না করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিস।’
প্রাপ্তি নিরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। পিছু ফিরে বলে,’আমার জন্য কোনো কাজ আটকে নেই।’
‘তা না থাকুক। তবুও তোর একটা দায়িত্ব আছে না? কাণ্ডজ্ঞানহীন যেন কোথাকার!’
‘তোকে এতকিছু ভাবতে হবে না।’
‘আলবৎ ভাবতে হবে। ওয়েট! এই তুই আমাকে কী বললি? তুই করে বললি কেন? তোকে কতবার বলেছি, আমাকে তুই করে বলবি না।’
প্রাপ্তি আর কিছুই না বলে নিজের ঘরে চলে যায়। অযথা ঝগড়া করার মুড এখন তার নেই। সে রুমে গিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। ভাবতে থাকে নিজের বোকামির কথা। কেন যে সে রিলেশনে জড়াতে গেল! আগেই তো ভালো ছিল। কোনো রিলেশন ছিল না, প্যারা ছিল না। আসলে সব দোষ হচ্ছে ঐ ব’জ্জা’ত আদনানের! তার জন্যই তো প্রাপ্তিকে ফা’ল’তু রিলেশনে জড়াতে হলো।
‘এই প্রাপ্তি শোন, তোর কি মন খারাপ?’
শান্তিতে বেশিক্ষণ শুয়েও থাকতে পারল না প্রাপ্তি। আদনান এসে হাজির। এর সাথে ছোটোবেলায় বন্ধুত্ব হওয়া ছিল জীবনের আরও একটা ভুল!
প্রাপ্তি শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,’না, আমি ঠিক আছি।’
‘না, তুই ঠিক নেই। তুই ঠিক থাকলে আমাকে তুই করে বলতি না।’
‘আজব! আমরা তো ফ্রেন্ড।’
‘চুপ কর। তোকে এর আগেও আমি সবটা ক্লিয়ার করেছি। বারবার এক কথা বলা আমার পছন্দ নয়। এখন শোন,আমি এসেছি তোর মন ভালো করতে।’
‘আমার মন ভালোই আছে।’
‘তুই বেশি কথা বলিস না। আমি তোর থেকে বয়সে বড়ো।’
‘কী আশ্চর্য! এজন্য কি তুমি আমার চেয়ে বেশি জানো আমার মনের খবর?’
‘হ্যাঁ, জানি তো!’
‘কেন? তুমি কি মন বিশেষজ্ঞ?’
‘তুই এত ঝগড়ুটে কেন বল তো? কিছু বললেই শুধু ক্যাটক্যাট করে উঠিস।’
‘আদনান, তুমি ঠিকই ধরেছ। আমার এখন মন ভালো নেই। এই মুহূর্তে আমার কথা বলতেও ভালো লাগছে না। তুমি প্লিজ চলে যাও।’
‘আমি জানি তো, তোর মন খারাপ। এর জন্যই তো এলাম। তোকে এখন আমার হুরপরীর গল্প শোনাব। তাহলেই দেখবি তোর মন ভালো হয়ে যাবে।’
‘আমি তোমার হুরের গল্প শুনতে চাই না। খুব হিংসে হয় আমার তাকে।’
‘কেন?’
‘কারণ তুমি ও’কে অনেক ভালোবাসো। একটা ছেলে কেন একটা মেয়েকে এত বেশি ভালোবাসবে?’
‘তোর গোবরভরা মাথায় সেসব ঢুকবে না। আমার হুর কত বুদ্ধিমতী তুই জানিস?’
‘না। জানতেও চাই না। তুমি এখন যাও প্লিজ!’ প্রাপ্তি গায়ে কাঁথা টেনে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
আদনান মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,’শুনলি না তো? না শুনলে নাই। থাক তুই মন খারাপ করে। আমার কী তাতে? আমার এত সময়ও নেই বুঝলি।’
আদনানও উঠে যায়। ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় রায়হানের সঙ্গে। অজান্তেই রায়হানের মনের ভেতর ক্রোধ সৃষ্টি হয় আদনানকে প্রাপ্তির রুম থেকে বের হতে দেখে। আদনান অবশ্য কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। বাতাসের তোড়ে সেও একটু আকটু শুনেছে প্রাপ্তি এবং রায়হানের সম্পর্কের ব্যাপারে। তবে বিষয়টা এখনো ক্লিয়ার নয়। প্রাপ্তিকেও সে এসব ব্যাপারে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। যদি তার শোনা কথা ভুল হয়ে থাকে, তাহলে প্রাপ্তি বাড়িতে তুলকালাম একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। শেষমেশ দুই বাড়িতেই শুরু হবে অশান্তি। রায়হানকে এই সময়ে এই বাড়িতে দেখে মনে মনে একটু সন্দেহ হলেও বুঝত দিলো না আদনান। সহাস্যে জিজ্ঞেস করল,
‘কী খবর? কখন এলে?’
রায়হানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অজান্তেই সে আদনানকে সহ্য করতে পারে না। প্রাপ্তির সাথে সম্পর্ক হওয়ার থেকে তো আরো বেশি সহ্য করতে পারে না। সে একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলের অনুভূতি, চোখের ভাষা এসব বুঝতে পারে। তার অবচেতন মন কেন জানি বলে, প্রাপ্তির প্রতি আদনানের অন্য কোনো অনুভূতি রয়েছে। সে আদনানের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে প্রাপ্তির রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। সেই মুহূর্তে সামনে হাত রেখে বাঁধা দেয় আদনান।
চলবে…
#আমার_একলা_আকাশ
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া