#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১৭

0
416

#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১৭
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম

তিন্নি ছাদে এসে রওনকের পাশে দাঁড়ালো। রওনক তিন্নির দিকে একবার তাকিয়ে আবারো সামনের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
— কি কাজ জলদি বল?
— কোনো কাজ তো নেই।
রওনক অবাক হলো না। ও ধারণা করেছিলো তিন্নি কিছু একটা আন্দাজ করেছে। এখন কি তিন্নি ওকে জেরা করবে। নাকি ওরই কিছু বলা উচিত। এ ভাবনা আসতেই তিন্নি কিছু বলার আগে রওনক বলল,
— আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি তিন্নি।
তিন্নি করুন চোখে তাকালো রওনকের দিকে। তারপর বলল,
— তুমি কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবা রওনক ভাই।
রওনক মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো। তিন্নি রওনক কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। রওনকের চোখ ও শুকনো নেই। রওনক কে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই তিন্নি আবিদ কে দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে। ও রওনক কে বলল,
— তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে রওনক ভাই?
তিন্নি দেখালো আবিদ কথাটা শুনেই সেখান থেকে চলে গেছে। রওনক তিন্নিকে ছেড়ে দিলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমাকে করুনা করছিস তিন্নি?
তিন্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর রওনক কে নিয়ে বসলো এবং বলল,
— আব্বা মারা যাওয়ার পর প্রতিটা সময় তোমাকে পাশে পাওয়ার কথা। সেই তুমি পাঁচ মাস পর থেকে হঠাৎ আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলে। বিষয়টা অদ্ভুত না। সবাই অনেক কিছুই মনে মনে ধারণা করে। কিন্তু আসল ঘটনা তো কেউ ধারণায় ও আনতে পারেনি। কি করে একা একা এসব সহ্য করেছো। সারাজীবন এ অনুভূতি লুকিয়ে রাখা সম্ভব?
— তুই কবে থেকে জানিস?
— আপার জন্মদিনের দিন আপার প্রিয় রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে তুমি আপার কলেজের গেট দিয়ে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মাথায় বেরিয়ে এলে। আর বেরিয়ে এসে আবর্জনার স্তূপে সেই স্টিক গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল, ফেলে দেওয়ার সময় তোমার চোখে মুখে রাগ নয় না পাওয়ার কষ্ট ছিল রওনক ভাই।
— তুইও সেদিন ওখানে ছিলি?
— আনলাকিলি। আপার কলেজের রোডেই আমার এক ছাত্রের বাসা ছিল। সেদিন আপার জন্মদিন ছিলো তাই ভেবেছিলাম আপার সাথে দেখা করে যাই।
— ঐ দিন আফিফ ও তিথি কে রজনীগন্ধার স্টিক দিয়ে প্রপোজ করেছিলো। তিথির হাতে রজনীগন্ধার স্টিক আর মুখে আনন্দের হাসি এখনো আমি ভুলতে পারি না জানিস। কষ্ট শুধু এখানেই সে আনন্দ আমার জন্য ছিল না।
— আমি সেদিন আপাকে আটকাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আফিফ ভাইয়ের মধ্যে কোনো কমতি ছিলো না। আর বোনের খুশির জন্য আমাকে স্বার্থপর হতে হয়েছে। এখন যদি তুমি চলে যাও সারাজীবন আত্মনুশোচনায় ভুগতে হবে আমাকে। তোমার জীবনটা সাজানোর একটা সুযোগ আমাকে দেবে না? কথা দিচ্ছি অসুখি হবে না।
— আমি হয়তো হবো না কিন্তু তুই?
— আমি ও হবো না।
— বোকার মতো কথা বলিস না তিন্নি। ভালোবাসার কষ্টটা কতটা ভয়ানক আমার থেকে ভালো কেউ জানেনা। তোর একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আবিদ এবং তুই দুজনেই কষ্ট পাবি। জানিস কতবার মরে যেতে ইচ্ছা করেছে আমার। আজ আপনজন ছেড়ে বাইরে পর্যন্ত চলে যাচ্ছি তা কি এমনি এমনি।
— কেন যাচ্ছ দেশে থেকে কি নিজের জীবন গুছিয়ে নেয়া যায়না?
— না এখানে থাকলে কারনে অকারণে তিথির সাথে দেখা হবে। আর তখন তিথি একাও থাকবে না। আফিফ থাকবে ওর সাথে। আমি চাইনা ইর্ষায় ওর জন্য কোনো বদদোয়া আসুক আমার মন থেকে। আর ভয় পাস না। নিজের জীবনটাকে যাতে গুছিয়ে নিতে পারি এজন্যই যাচ্ছি। এরপর যেদিন ফিরে আসবো তিথিকে মামাতো বোন ছাড়া অন্য কিছু মনে করবো না ইনশাআল্লাহ।
তিন্নি কিছু বলতে পারলো না। রওনক কে সে প্রচুর শ্রদ্ধা করে। ভালোও বাসে। তার জন্য কিছু করার ইচ্ছা তিন্নির অনেক দিনের। এজন্যই কখনো বিয়ে করতে না চাইলে ও রওনকে ও কথাটা বলেছে। রওনক হ্যা বললে ও সত্যিই তাকে বিয়ে করত। তিন্নি কে কথা বলতে না দেখে রওনক ই আবার বলল,
— আমি একটু পরেই চলে যাবো। যাওয়ার আগে তোর সাথে দেখা হতেও পারে নাও পারে। তবে কথা বলার সুযোগ কম। আজ কিছু কথা আমি তোকে বলে যাই। মামা যেদিন মারা যায় সেদিন তুই কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে মামা বার বার একটা কথাই বলেছিলেন। বলতে গেলে তার শেষ কথাই এটা ছিলো যে, ” তোর সবথেকে বড় দায়িত্ব হচ্ছে নিজের ইচ্ছার প্রতি অবহেলা না করা। বেঁচে থাকতে তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমি মরে যাওয়ার পর আমার হয়ে নিজের জন্য কিছু করিস।”
মামা কথা গুলো কেন বলেছিলেন আমি এখন বুঝতে পারছি। আরো আগেই আমার কথাগুলো তোকে বলা উচিত ছিলো। এখনো দেরি হয়ে যায়নি। আবিদ কে এইকয়দিন দেখে বুঝেছি সে তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। শুধু সে না তুইও। আর মামির মুখে আবিদের পরিবার সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে বিয়ের পর তুই যদি সানভি এবং মামির দায়িত্ব নিতে চাস তারা আপত্তি করবে না।
— আমার ভয় করে রওনক ভাই। ভালোবাসা মানুষকে স্বার্থপর বানিয়ে দেয়।
— তোর কি আমাকে স্বার্থপর মনে হয় তিন্নি? ভালোবাসা কখনোই কাউকে স্বার্থপর বানায় না। আর যদি কেউ স্বার্থপর হয়ে যায় তাহলে বুঝবি সে ভালোবাসতেই জানেনা। তোর ভয়ের কারণটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কখনো কি মামির দিকটি ভেবে দেখেছিস। তুই বলিস মানুষের পরনির্ভরশীল হওয়া উচিৎ না। কিন্তু তুই কি তাকে তুই নির্ভরশীল বানিয়ে ফেলিস নি?
— তাতে ক্ষতি কি? আমি তো তাদের ছেড়ে যাবো না।
— আর এটা ভেবে তারা খুশি তাইতো? মামিকে কোনোদিন প্রশ্ন করেছিস সে তোর ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে কি অনুভব করে। তোর সিদ্ধান্ত কে তারা সম্মান করে, তোর ওপর দায়িত্ব দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত। কিন্তু তার মানে এই না যে তোকে এভাবে দেখে তারা খুশি। স্যাক্রিফাইস করতে পারাটা আসলেই মহৎ গুণ। তবে সবসময় সবজায়গায় সেটা করার দরকার হয় না। আজকে তুই আমার জন্য একটা স্যাক্রিফাইস করতে চাইলি। ভেবে দেখতো সেটা কি আদৌ আমার প্রয়োজন কিনা? তুই ভাবিস তোর এই ত্যাগ মানুষকে খুশি করে,ভালো রাখে। কিন্তু তোকে যারা ভালোবাসে তারা কখনোই চায় না তাদের জন্য তুই নিজের খুশি জলাঞ্জলি দিস। আমরা মানুষ। এই পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়,প্রয়োজন ও নেই।
— তাহলে তুমি কেনো একা বাঁচতে চাচ্ছ?
রওনক মুচকি হাসলো এবং বলল,
— আমি একা বাঁচতে চাচ্ছি না। নিজেকে একটু সময় দিতে চাচ্ছি। এতদিন এই একতরফা ভালোবাসা আমাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে এসেছিলো। এখন সেই আমিকেই আমার কাছে আনতে চাইছি। আর মনে একজনের জন্য অনুভূতি নিয়ে অন্য আরেকজন কে আপন করা যায় না। তাহলে সেই মানুষটির সাথে সাথে নিজেকেও ঠকানো হয়ে যায়।
— তুমি কি আজকে আমাকে কিছু কথা দেবে রওনক ভাই?
— কি কথা?
— অস্ট্রলিয়া গিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবে না। আপাকে পুরোপুরি ভুলতে পেরেছো কিনা সেটাও আমাকে সবার আগে জানাবে। এবং আপাকে ভোলার সাথে সাথেই তুমি নিজের জীবন নতুন করে গোছানো শুরু করবে।
— আচ্ছা দেবো তবে তোকেও আমাকে একটা কথা দিতে হবে।
— কি?
— তুইও আর শুধু অন্যের জন্য বাঁচবি না। নিজেকে নিয়েই ভাববি। বিশেষ করে আবিদকে নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করবি। আমি চাই না ওর জীবনটা আমার মতো যন্ত্রণাদায়ক হোক।
তিন্নি কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেল। রওনক তাকে আটকালো না। তিন্নির সাথে কথা বলে ওকে বুঝিয়ে তার নিজের কষ্টটা অনেক অংশে কমে গেছে। এখন তিথিকে ভোলা বোধহয় এতটাও কঠিন হবে না।

তিন্নিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুরো রাস্তা কারো সাথে একটা কথাও বলে নি আবিদ। বাড়িতে ফিরে ও কাউকে কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সে। সবাই তখন নতুন বিবাহিত দম্পতি নিয়েই ব্যস্ত। আবিদের দিকে কারোরি খেয়াল হলো না। পরেরদিন অনেক সকাল হয়ে গেলেও আবিদের দেখা পাওয়া গেল না। তিথিদের বাড়িতে কি কি হয়েছে এসব নিয়ে সবাই যখন গল্পে ব্যস্ত ঠিক তখনই শিরিনের আবিদের কথা মনে হলো। এসব নিয়ে সবথেকে বেশি হৈচৈ তার করার কথা কিন্তু এসেছে পর থেকে একবারের জন্যও তো আবিদকে দেখেননি তিনি। বিষয়টা তিথিরও খেয়াল হলো। গল্পের আসর থেকে সেই প্রথমে উঠে দাঁড়ালো। তারপর শাশুড়ির কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
— আবিদকে দেখেছেন মা?
— আমিও তো ওর কথাই ভাবছি। বিয়ে বাড়ির ক্লান্তি বোধহয় এখনো কাটাতে পারেনি এখনো ঘুমাচ্ছে।
কথাটা বলে শিরিন নিজেই বোধহয় আশস্ত হতে চাইলেন। কিন্তু তিথি বলল,
— কাল রাতে ও তো ওকে দেখিনি মা। সবাই ক্লান্ত ছিলো কিন্তু তাও আমাদের নিয়ে কত হৈচৈ করলো। ওকি ঠিক আছে অসুস্থ হয়ে পড়েনিতো আবার?
শিরীন আর অপেক্ষা করলেন না। আবিদের রুমের দিকে রওনা হলেন। তিথিও শাশুড়ির পিছনে চলতে লাগলো। তারা দুজনেই যখন আবিদের রুমে পৌঁছালো তখন আবিদের রুমের শোচনীয় অবস্থা। পুরো রুম লন্ডভন্ড। তার মাঝে বিছানায় হেলান দিয়ে ফ্লোরের মধ্যে বসে আছে আবিদ। শিরীন সাথে সাথে ওর সামনে গিয়ে বসলো। আবিদের চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। মাকে সামনে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো ও। তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না। হুট করে কি হলো আবিদের?

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here