#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_19+20+21+22
দিনের আলোর সমাপ্তি ঘটে আফীফের জন্য শুরু হয়েছে আরেকটি বিষন্নতার সন্ধ্যা।সামী,মৌ সবাই আমানের রুমে আড্ডার আসর জমাতে ব্যস্ত তখনি রুমে প্রবেশ করে আফীফ।তাকে দেখে বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আমান।
– আরে ভাইয়া তুমি আমার রুমে?
– দেখতে এলাম তোরা কি করিস।
আফীফ কথা শেষ করেই সামীর পাশে বসে পড়ে।সামীর দিকে তাকিয়ে মিহি হাসে আফীফ।তার প্রত্যুত্তরে সামীও হাসলো।
– এখানে দিন কাল কেমন কাটছে সামী?
– খুব ভালো ভাইয়া।চলে যাওয়ার পর আমি তোমাদের সবাইকে মিস করবো।
– আমরাও তোমায় মিস করবো।তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি আই মিন আমার তোমার পরিবার সম্পর্কে জানার ইচ্ছে।তুমি কি আমায় প্রশ্ন গুলোর উওর দিয়ে সাহায্য করবে?
– অবশ্যই ভাইয়া বলো কি জানতে চাও।
– না তেমন কিছু না পরিবারের মাঝে তোমার প্রিয় ব্যক্তি কে?
– বাবা-মা,ফুফি, আপুনি সবাই আমার প্রিয় তাদের ছাড়া আমার আর কে বা আছে।
– তোমাদের পরিবারে সবচেয়ে রাগী সদস্য কে?
– আমার পাপা!
– কেন তোমার আপুনি না?
– সেহেরিশ আপু তো রাগারাগি করে না।সারাদিন প্রফুল্ল থাকে।মাঝে মাঝে রাগে তবে আবার ঠিক হয়ে যায়।তবে যানো সেদিন…
সামী থেমে যায় তার মুখটা কেমন চুপসে গেছে।আফীফ তার চুপসে যাওয়া ভাবটা ধরতে পেরে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
– সেদিন কি হয়েছিল সামী?
– পাপা যখন বিডিতে আসার কথা বললো তখন আপুনি হঠাৎ রেগে যায়।পাপার সাথে মিস বিহেভ করে। কিন্তু আপুনি এর আগে কখনো এমন করে নি।সেদিনের কান্ডে আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম।সে কিছুতেই গ্রামে আসবে না।যদিও ফুফির কথায় রাজি হয়ে আসলো তখন অনন্তপুর থেকে কিছুতেই এই গ্রামে আসবে না।
সামীর কথায় আফীফ বেশ ভালো করেই সেহেরিশের সম্পর্কে উপলব্ধি করেছে।
‘প্রসঙ্গ যখন বারুদ আফীফ দেওয়ান,সেহেরিশ তখন আগুন হয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে।’
এই আগুন আর বারুদ এক সঙ্গে থাকলে নির্ঘাত
বিষ্ফোরণ হবে।একদিকে সেহেরিশের বিরোধ ভাব অনুভূতি অন্যদিকে আফীফের হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসা কি করে প্রকাশ করবে সে!
যদি বিষ্ফোরণ থেকে আফীফের হৃদজমিনে ভালোবাসা নেমে আসে তবে বিষ্ফোরণি হোক!
___
আজ দুপুরের পর মেয়েকে দু-চোখে না দেখে মনটা খচখচ করছে খুরশীদ আনওয়ারের।ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে মেয়ে রুমেই আছে।তাই তিনি সেহেরিশকে দেখার উদ্দেশ্য তার রুমে পা বাড়ায়।
লালাটুকটুকে শাড়িটি এখনো সেহেরিশের গায়ে।গায়ে কম্বোল জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সে।তার পাশে তুন্দ্র এবং কেইন অপরাধী মুখ করে বসে আছে।
– আ’ম সরি সেহেরিশ।শাড়ি পড়া নিয়ে তোর উপর জোরাজোরি করা আমার মোটেও উচিত হয়নি।
– আহ্ তুন্দ্র এবার আমার ভীষণ রাগ লাগছে কতবার বলেছি নিজেকে অপরাধী বলবি না।আমি তো রেডি হয়ে ছিলাম মাঝ থেকে কি হয়ে গেলো নিজেও জানি না।।
– কিন্তু সবটা তো আমার কারনেই হয়ছে।
তুন্দ্রের কথায় পাত্তা দিলো না কেইন বরং সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
– তুন্দ্র তুই চুপ থাক।সেহেরিশ তুই তখন হাতে এই ভাবে বারি দিলি কেন?তুই জানিস আঙ্কেল আন্টি জানলে আজ রক্ষে থাকবে না।
সেহেরিশ থতমত মুখ করে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।এই মূহুর্তে কি বলবে সে?মিথ্যা প্রশ্ন সাজিয়ে সোজাসাপটা বলতে থাকে,
– আসলে এত চুড়ি ধীরে ধীরে খুলতে অসহ্য লাগছে তাই আছাড় মেরে ভেঙ্গে দিয়েছি।
– বোকার মতো কথা বলবি না।হাতে যে এতটা কেটেছে কষ্টটা এবার সহ্য কর।
– কার হাত কেটেছে?
দরজার পাশ থেকে খুরশীদ আনওয়ারের কথায় লাফিয়ে উঠে তুন্দ্র এবং কেইন।সেহেরিশ চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে।
– কি রে তোরা এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
– আ..আঙ্কেল ভেতরে আসুন।আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম।
খুরশীদ রুমে প্রবেশ করেই সেহেরিশের দিকে চোখ বুলায়।মেয়েটির কান্নারত ফোলা নাক মুখ চোখ দেখে তিনি বুঝেই যান কিছু একটা চলছে এই তিনজনের মাঝে।
– কি রে আম্মু তুই এইভাবে বসে আছিস কেন?
– কিছু না পাপা।হঠাৎ আমার খোঁজে কোন জরুরি কথা আছে নাকি?
– না তোকে দেখতে এলাম।
মুরশীদ মেয়ের পাশে বসেন।হাত বাড়িয়ে সেহেরিশের কপালে হাত রাখতেই ভ্রু যুগল কুচকে নেয়।
– তোর গায়ে তো জ্বর।আমাদের বলিসনি কেন?
– আমি মেডিসিন নিয়েছি পাপা।সমস্যা নেই।বলছিলাম কি আর কয়দিন থাকবো এখানে চলো না ফিরে যাই আমরা।
সেহেরিশের কথায় তাল মেলালো কেইন।
– ইয়েস আঙ্কেল সেহেরিশ ঠিক বলছে।ডিসেম্বর শেষ হয়ে এলো আমার ক্রিসমাস আছে।আমাকে তো মাস্ট ফিরতে হবে।
– শুনেছি রমিজ মিয়া দুই সাপ্তাহ পর আসছে।মানে কি বুঝতে পারছো বাবা, কাটায় কাটায় ৩ তারিখে তিনি আসছেন তখনি আমাদের আলাপ-আলোচনা শুরু হবে।তোমার অনুষ্ঠান পচিঁশ তারিখ।কিছু না মনে করলে একটা কথা বলি।তুমি থেকে যাও বাবা।সেদিন বরং তোমরা ঢাকায় চলে যাবে ঘুরবে ফিরবে দিনটি উর্যাপন করবে দিনটি।
মুরশীদের কথায় সহমত জানালো কেইন।মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে নিজের রুমে ফিরে যান খুরশীদ আনওয়ার।তার বাবা হাতের ব্যান্ডিজ না দেখায় সেহেরিশ যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো।
রাতের খাওয়ারে সেহেরিশ আর নিচে নামলো না।ক্লান্ত শরীর নিয়েই ঘুমিয়ে গেলো।কেইন যাওয়ার আগে সেহেরিশের দরজা ভিড়িয়ে চলে যায় আর সেহেরিশ মগ্ন গভীর ঘুমে।দরজা খোলা পেয়ে সেহেরিশের রুমে ঢুকে যায় অজ্ঞাত কোন ব্যাক্তি।পিলপিল পায়ে এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায় বিছানার সামনে নিয়ন বাতির আলোয় সেহেরিশের মায়াবী মুখ মন্ডল তাকে অন্যরকম ঘোরে টানছে।
– ইসস কি যে মায়া এই মুখে সহযে আকৃষ্ট করে।আই নিউ ইউ সেহেরিশ।তবে সম্মুখে তোমায় চাইবার বহিঃপ্রকাশ আমি করতে পারবো না।যা করবো সব আড়ালে।আমি অপেক্ষায়!
অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রাত তিনটার কাছাকাছি।আফীফ আজ দু-চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারেনি।আহনাফ দেওয়ান তাকে খুব অল্প সময় দিয়েছে সেহেরিশকে মানাতে কিন্তু কি করে করবে সে।গায়ের চাদরটা জড়িয়ে আফীফ নিঃশব্দে সেহেরিশের রুমে প্রবেশ করে।ড্রিম লাইটের আলো চারিদিকে স্তব্ধ নিরিবিলি পরিবেশে কোথাও যেন ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ।আফীফ সর্তক হয় চারিদিকে আবারো চোখ বুলায় ফিফফিসে আওয়াজের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।
রাতে হঠাৎ ঘুম কেটে যাওয়ায় ঘুমন্ত জুহিকে ফোন করে বসে সেহেরিশ।শুরু হয়ে যায় দুজনের ফুসুরফাসুর।কম্বোলের নিচে গুটিসুটি মেরে কথা বলছিল সেহেরিশ।হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো তপ্ত শ্বাসে নড়ে সে।তড়াক করে পেছনে ঘুরে তাকাতেই কম্বোলের নিচে আফীফকে দেখে লাফিয়ে উঠে।তাকে বসতে দেখে আফীফ দ্রুত সেহেরিশের ফোন হাতে নিয়ে নেয়।মোবাইল চেক করতেই আফীফ বুঝতে পারে এটি ফাহমিদার ফোন।সেহেরিশের ফোন তখন আফীফ নিজেই ভেঙ্গেছিল।
– এই আমার ফোন দিন অসভ্যতার লিমিট ক্রস করছেন আপনি।
ভিডিও কলে জুহি অন্ধকারের মাঝে কিছুই বুঝতে পারছে না।আফীফ তড়িৎ গতিতে রুমের লাইট অন করতেই সেহেরিশকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়।সেহেরিশ নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত কম্বোল গায়ে জড়িয়ে নেয়।আফীফ চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে শ্বাস ছাড়ে।
“আরে হচ্ছে টা কি?এই যে আপনি কে”
ভিডিও কলে জুহির প্রশ্নে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে আফীফ।
– হেই মাই শালিকা।
– শালিকা?
– ইয়েস তোমার জিজু হই।সেহেরিশ তোমার ফ্রেন্ড আমার হবু বউ খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।
আফীফের বেল্লিক কথায় রেগে যায় সেহেরিশ।
– কি হচ্ছে কি আপনি এইসব কি বলছেন।একদম উলটা পালটা কথা বলবেন না।
আফীফ সেহেরিশের কথায় পাত্তা দিলো না বরং জুহির সাথে কথা চালিয়ে গেলো।
– তুমি জানো না শালিকা।সেহেরিশ হয়তো লজ্জায় বলেনি।
– কি বলেন এইসব আমি কিছুই জানলাম না।কেইন তুন্দ্র আমাকে কিছু বলেনি।
– আরে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি।তাদের বলার দরকার নেই।তোমার ফ্রেন্ড আমার সাথে রেগে আছে বুঝলে এখন বলছে বিয়ে করবে না।একটু বুঝিয়ে বলো আমার মতো সুদর্শন ছেলেকে বিয়ে না করে থাকা যায়?
– হেই সেহেরিশ তুই বিয়ে করিস না।ছেলেটাকে আমার দিকে ছুড়ে মার।
জুহির কথায় ফোন কেটে দিলো আফীফ।সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বলে,
– দেখলে তোমার ফ্রেন্ড আমায় দেখে ফিদা আর তুমি আমায় পাত্তা দাও না। হাউ ফানি।
– এইসব পাগল ছাগলকে দেখলে কোন ভালো মেয়ে ফিদা হয় না যত্তসব।এত রাতে আমার রুমে কি?
– দেখতে এলাম তুমি কি করছো।
– দেখা হয়েছে এবার যান।
আফীফ গেলো না বরং সেহেরিশের সামনে এগিয়ে আসলো।
– বলেছিলাম শাড়িটা চেঞ্জ করতে তবে এখনো পরে আছো কেন?একটু আগে তো আমার হাট এট্রাক করিয়ে ছাড়তে।
– ইচ্ছে হয়নি তাই করিনি।
– তখন হাতে এইভাবে চুড়ি গুলো আছাড় দেওয়ার কারন কি বুঝাতে চাইছো তুমি রাগী তোমার রাগ বেশি?
সেহেরিশ উওর দিলো না বরং আফীফের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
– আপনার দাদাকে আমি বিচার দেবো।কেমন নাতি তার রাত দুপুরে অন্য মেয়ের রুমে না বলে চলে আসে।
– আমার দাদাজান কি বলেছে জানো?বলেছে তোমায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করে যেন বাড়িতে আনি।আর যদি তোমার বাবা রাজি না হয় তবে তোমাকে আর তোমার বাবাকে তুলে আনবে বিয়ের আসরে।
সেহেরিশ উওর দিলো না।রাগ দেখিয়ে কম্বোল টেনে বিছানায় শুয়ে যায়।হঠাৎ করেই মাথাটা ধরেছে ভীষণ তাই এই মূহুর্তে সেহেরিশের তর্ক করার মুড নেই।আফীফ সেহেরিশের পাশে সটান হয়ে শুয়ে যায়।
– এসব কি এখানে শুয়ে আছেন কেন?
– তোমার হাতটা দাও।
সেহেরিশ ভ্রু কুচকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।তৎক্ষনাৎ আফীফ তার পাচঁ আঙুল সেহেরিশের আঙুলে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
– আর একটা সাউন্ড করলে তোমার আম্মুর মোবাইলটাও ভেঙ্গে দেবো চুপচাপ ঘুমাও!
– ইডিয়ট।
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২০
এক রাশ রাগ ক্ষোভ নিয়ে মারুফার অভিমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরিশ।মনে মাঝে সুপ্ত রাগটা ক্রমশ দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে।নিজের রাগ নিবারণ করতে এক হাতের সাথে অন্যহাত সমান তালে কচলে যাচ্ছে।মারুফা তার দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে।মারুফা কি তাকে নিয়ে লুডু খেলা শুরু করেছে নাকি,নাকি তার আবেগ অনুভূতি নিয়ে।নিজের কাছে আজ নিজেই প্রশ্নবাণ সেহেরিশ।
আফীফের সাথে সেদিনের কথা গুলো সব মারুফাকে জানিয়ে দেয় সেহেরিশ।আফীফ যে তাকে চিনতে পেরেও নাটক করছে এবং স্ত্রী হিসেবে তাকে চাইছে সবটা জানতে পেরে মারুফার মুখের রঙ পালটে যায়।তারপর থেকেই শুরু হয় আফীফের সম্পর্কের গুনগান।
– এমন হাত কচলাচ্ছিস কেন?
– না কিছু না ফুফি।তোমার কথাটা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– আমি খারাপ কিছু বলি নি সেহেরিশ,আফীফ পাত্র হিসেবে সু-পাত্র।তোর সাথেও বেশ মানানসই।
– তুমি তো বলেছিলে আফীফ থেকে আমি যেন একশ হাত দূরে থাকি। আমিও তাকে দূরে দূরেই রাখছি তবে এখন এসব কথা কেন?
– হ্যা আমি তখন ঠিক বলেছিলাম।দেখ যে ছেলেটা তোকে না পেয়েও এত বছর মনের মাঝে লালান করেছে তার মত যোগ্য জীবনসঙ্গী তুই আর পাবি কি না আমার সন্দেহ।
সেহেরিশ ‘ফস’ করে শ্বাস ছাড়লো।সব কিছু গোলমাল লাগছে তার।এতদিন আফীফকে নিয়ে মনের মাঝে তিলার্ধেল অনুভূতি হলেও মারুফার কথায় তা সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে গেছে।বর্তমানে আফীফকে দেখলেও তার সারা অঙ্গে আগুন লেগে যায়।সেদিন রাতে আফীফকে মনের রাগ মেটাতে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে সেহেরিশ।তারপর থেকে আফীফ চুপচাপ হয়ে গেছে সেহেরিশকে দেখলেও না দেখার ভান করে দূরে দূরে থাকে।রাগের মাথায় বলা কথা গুলো বর্তমানে সেহেরিশকে পীড়াদায়ক যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে।
সেহেরিশকে চুপ থাকতে দেখে চোখ ছোট করে তাকায় মারুফা।নিঃশব্দে শ্বাস ছেড়ে সেহেরিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
– যদি তুই আফীফকে পেতে দাবি করিস তবে তুই পরিবার এবং আফীফ দুটোকেই পাবি।তবে তোর মা-বাবা আমি তখন অনেক দূরে থাকবো চাইলেও দেখার তৃষ্ণা মেটাতে পারবি না।তোর পাপা মামনিকে চাইলেও জড়িয়ে ধরতে পারবিনা।আর আফীফকে ছাড়লে স্বাধীন জীবন পাবি।সেখানে তোর বিয়ে দেবো চাইলে সহজেই আমাদের কাছে আসতে পারবি। যাই হোক আমার মনে হয়না আফীফ তোকে অর্জন করা ছাড়া এই বাড়ি থেকে মুক্তি দেবে।বাকিটা তোর ইচ্ছা।
মারুফা চলে যায় কিন্তু সেহেরিশের মাথায় দিয়ে যায় চিন্তার বোঝা।
সকাল ভোর ভোর তুন্দ্র এবং কেইন ক্রিসমাসের উদ্দেশ্য ঢাকায় রওনা হয়।সেহেরিশ যেতে চাইলো খুরশীদ আনওয়ার অপরিচিত শহরে মেয়েকে একা ছাড়েন নি।তাই মারুফা যাওয়ার পর সেহেরিশ রুমেই চুপচাপ বসে ছিল।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো আফীফের কাছে ক্ষমা চাইবে যত যাই হোক বাজে ভাবে রিয়েক্ট করা তার মোটেও উচিত হয় নি।বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে সেহেরিশ ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।
ছাদে কফি মগ হাতে জিউসের সঙ্গে কথা বলছে আফীফ।সেদিনের পর আফীফের মন ভালো নেই।সেহেরিশের অবহেলা তাকে বার বার মুষড়ে দিচ্ছে।
– তুমি তাকিয়াকে সব বলে দিয়েছো অথচ আমায় জানালে না।
– সরি জিউ আসলে সেদিন এমন একটা অবস্থায় ছিলাম হুট করেই সত্যটা প্রকাশ পায়।তবে যা বুঝেছি তাকিয়ার মনে অতীতের কান্ডে আমার প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া কিছুই নেই।আমার প্রতি তার সম্মানটুকু নেই।আর ভালোবাসা তা তো দূরের কথা।যানো সেদিন আমার সাথে কতটা বাজে বিহেভ করেছে।এই আফীফ দেওয়ানের সাথে কেউ গলা উচু করে কথা বলে না তার তাকিয়া…
– আহ চিল ব্রো।তাকিয়া সহজে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা হয়তো রাগ সামলাতে না পেরে এমনটা করেছে।তুমি দেখবে তাকিয়া ক্ষমা চাইবে।
– দে…
আফীফ থামলো সেহেরিশকে তার সামনে দেখে দ্রুত ফোন কেটে পকেটে পুরে নিলো।কফির মগটা হাতে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।সেরিশকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– কিছু বলবেন আপনি?
– আমি দুঃখিত।আপনার সাথে সেদিন বড্ড বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলাম।
– ইট’স ওকে।
আফীফ সেহেরিশ দুজনেই চুপচাপ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো।আফীফ সেহেরিশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কফি মগে চুমুক দিয়ে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
– আপনি কী আমায় ক্ষমা করতে পারেন নি মি.আফীফ?
– আমি আপনার কথায় বিন্দু পরিমানেও কষ্ট পাই নি ক্ষমা কেন করবো?
– তবে আমায় ‘আপনি’ বলে সম্মোধন করছেন কেন?
আফীফ ঘুরে তাকায়।সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার মুখে ফু দেয়।তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের মাঝে অনামিক অনুভূতির ঢেউ খেলে যায়।আফীফের শুভ্র উজ্জ্বল মুখের ঘোরে সেহেরিশকে যেন বার বার কাছে টানছে।
– আমি ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করলে যদি আপনি খুশি হন তবে তুমি বলেই ডাকবো।
সেহেরিশের ঘোর ভাঙ্গে। মাথা নাড়িয়ে আফীফকে ‘তুমি’ বলার অনুমতি দেয়।আফীফ কফির মগে আরেকটি চুমুক দিয়ে মগটি সেহেরিশের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
– নিন চুমুক দিন।
– আ..আমি?
– তো এখানে কেউ আছে নাকি আর?
– আপনার মুখের কফি।
– তো? আমি কি থুথু ছিটিয়ে দিলাম নাকি?
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক বসায়।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে।ছাদের রেলিংয়ের পাশে রাখা টবে গাঁদা ফুলের গাছে থেকে একটি ফুল ছিড়ে সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।সেহেরিশ চমকে তাকালে আফীফ তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।
– তোমার নাম ফুলপরী রেখে আমি ভুল করিনি।ইচ্ছে করছে হাজার রকমের ফুলের মাঝে তোমাকে বসিয়ে রাখি।তোমার চুল গুলো এত ছোট কেন?চুল বড় করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যায়?
– এটা ফ্যাশন আপনি বুঝবেন না।
সেহেরিশের কথায় রুষ্ট হয় আফীফ।চোখ ছোট করে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,
– যে ফ্যাশনে তোমার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খামতি রাখে তবে সে ফ্যাশন তোমার দরকার নেই।
সেহেরিশ অবাক হয়।কফির মগে আরেকটি চুমুক দিয়ে আড় চোখে তাকায় আফীফের দিকে।
– আজ থেকে ফুফু আম্মার কাছে নিয়মিত তেল লাগাবে।তোমার থেকেও আমাদের মৌ’য়ের চুল অনেক বড় আর তোমাকে দেখলে আমার রাগ লাগে।
সেহেরিশ মাথা ঘুরিয়ে নেয়।বিড়বিড় করে আফীফকে হাজারটা গালি দিয়ে নিজেকে স্থির করে।
– আমাকে ভালোবাসলে কি তোমার জাত চলে যাবে সেহেরিশ?
হঠাৎ আফীফের অনাড়ম্বর কথায় চমকে যায় সেহেরিশ।এই কথার প্রত্যুত্তর কি দিতে হবে তা সেহেরিশ জানে না।তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে দ্রুত নিচে নেমে যায়। আফীফ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুরু দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
_____
আড়ালে যত্ন ভালোবাসায় কেটে গেলো আরো কয়েকটি দিন।আফীফ আর সেহেরিশের সম্পর্ক এখন মোটামুটি আগের মতো স্থির।আফীফের খুনশুটি,হুট-হাট রেগে যাওয়া সেহেরিশের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।তুন্দ্র এবং কেইন তার উৎসব শেষে আবারো গ্রামে ফিরে এসেছে।তবে খুরশীদ আনওয়ারের সাথে আবারো বদানুবাদে লেগে গেছে সেহেরিশ,তুন্দ্র এবং কেইন।থার্টি-ফাস্ট নাইট উপলক্ষ্য গ্রামে কোন অনুষ্ঠান না হওয়ায় শহরে যাওয়ার জন্য আবদার করে তারা।কিন্তু খুরশীদ এবং ফাহমিদা কিছুতেই রাজি হয় নি।কেইন এবং তুন্দ্রের রিকুয়েষ্টে আফীফ অবশেষে রাজি হয় বাড়িতে থার্টি-ফাস্ট নাইট উৎযাপন করতে।
দেওয়ান মঞ্জিলে আজ আলোক সজ্জায় সজ্জিত।ছাদের উপর নিয়ন বাতি দিয়ে সম্পূর্ণ ছাদ সাজানো।কেইন টুংটাং গিটারের শব্দ তুলছে।সেহেরিশ লং গাউন পরে তৈরি হয়ে এসে কেইনের পাশে বসে যায়।তুন্দ্র,আফীফ,মুনিফ বারবিকিউ করবে বলে সব কিছু রেডি করছে।মৌ,সামী, আমান তারা বাজি ফাটাতে ব্যস্ত।
বারবিকিউ রেডি করে তুন্দ্র, মুনিফ,আফীফ সবাই সবার জায়গায় বসে যায়।আফীফ নিজের স্থান ছেড়ে সুযোগ বুঝে চেয়ার টেনে সেহেরিশের মুখোমুখি বসে।
হিমেল হাওয়া চারিদিক,আলোতে জ্বলমলে পরিবেশ, গিটারের টুংটাং শব্দে মূখরিত পরিবেশ।সেহেরিশ গায়ের চাদরটা কিঞ্চিৎ টেনে আড় চোখে আফীফের দিকে তাকায়।গায়ের আসমানী রঙের শাট,হাতা ফোল্ড করে তুন্দ্রের সাথে হাত নাড়িয়ে কথা বলছে আফীফ তার সাথে ঠোঁটে লেগে আছে মুচকি হাসি।সেহেরিশ এক পলক দেখেই যেন তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়।দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– সত্যিত! এই ছেলের হাসি দেখা মানা।একবার দেখেই আমার দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়েছে।আমার নিষ্পাপ মনটাকে অন্যদিকে টানছে।দূর,নিজেকে শক্ত কর সেহেরিশ নিজেকে শক্ত কর।
সেহেরিশ না চাইতেও আফীফের দিকে আরেকবার তাকালো।তখনি দুজনের চোখাচোখি হতেই সেহেরিশ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ ঠোঁট কামড়ে হেসে ভ্রু কুচকে সেহেরিশের দিকে তাকায়।
– অমৃত ভাই অমৃত।আজকের বারবিকিউটা যা হবে না।বলে বুঝাতে পারবো না।
তুন্দ্রের কথায় সবাই তার দিকে দৃষ্টি রাখে।মুনিফ আফীফের পিঠে চাপড় মেরে বলে,
– হতেই হবে আমাদের আফীফ রাজা হাত লাগিয়েছে বলে কথা।
– আজকের খাওয়ার শেষে তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– সারপ্রাইজ?
সেহেরিশ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো তুন্দ্রের দিকে।কিন্তু তার কথায় প্রত্যুত্তর করলো না তুন্দ্র।বরং কেইনের দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাসে।হঠাৎ একটি বাজি ফাটার শব্দে সেহেরিশ চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কেইনের হাত জড়িয়ে ধরে তার কান্ডে বাকিরা থতমত খেয়ে গেলেও আফীফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের হাতের দিকে।তার বুকের ভেতরটায় হঠাৎ মুষড়ে উঠে।হিংসায় বিষিত হয় মন।
– আফীফ ব্রো গান ধরো।
কেইনের কথায় সৎবিৎ ফিরে আফীফের৷
– সরি আমি গান পারি না কেইন।
– মিথ্যা বলছো কেন আফীফ ব্রো।গ্র্যান্ডফাদার বলেছে তুমি ছোট বেলায় গান শিখতে।
– সেটা ছোট বেলায় সমাপ্ত এখন আমি গান তেমন গাইনা।সুর ধরতে পারবো কি না নিশ্চিত নই।
– তাতে কি?আমি আর তুন্দ্র ইংলিশ,হিন্দি গান গাইতে পারি।বাংলাটা আমাদের গাওয়া হয় না তেমন।তুমি বরং আমাদের আজ বাংলা গান শোনাও।
– ওকে চেষ্টা করবো।আগে চলো তুমি গানটা শুনে নাও তবে গিটারের সুর তুলতে সহজ হবে।
কেইন এবং আফীফ কিছুটা দূরে গিয়ে আলাপচারিতা শেষে আগের জায়গায় বসে।তুন্দ্র উঠে গিয়ে সোডিয়ামের লাইট গুলো আফ করে দেয়।পুরো ছাদ জুড়ে এখন শুধু নিয়ন বাতির আবছা আলো।কেইন গিটারের তাল তুলতেই আফীফ সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।তার দৃষ্টির অবস্থান বুঝতে পেরে সেহেরিশ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।
♪♪♪ আজ মনে হলো হঠাৎ,তোকে চাইছে মন বারবার-
তোকে ছাড়া বসে না মন এ ঘরে।
কেন থাকো দূরে দূরে কাছে এসে দেখো না।
কত থাকবো একা একা এ মন তো মানে না।
আমার বন্ধুয়া বিহনে গো সহেনা পরানে গো একেলা ঘরে রইতে পারিনা।
আমি হয়ে যাবো তোমার যদি থাকো শুধু আমার
যদি আগলে রাখো আমায় আদরে,
কেন থাকো দূরে দূরে কাছে এসে দেখো না।
কত থাকবো একা একা এ মন তো মানে না।
আমার বন্ধুয়া বিহনে গো সহেনা পরানে গো একেলা ঘরে রইতে পারিনা।…
আফীফের একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।সেহেরিশকে ইশারা করে গান গাওয়া প্রতিটা কান্ডে লজ্জা মিশ্রিত রাগ উঠে যায় সেহেরিশের।যার দরুনে কেইনের মাথায় থাকা ক্যাপটা আফীফের দিকে ছুড়ে মেরে সেহেরিশ ধমকের সুরে বলে,
– একলা ঘরে না থাকতে পারলে আমানকে নিয়ে থাকুন,মুনিফ ভাইকে নিয়ে থাকুন তবুও এইসব ভুলভাল,অর্থহীন গান গাইবেন না, স্টুপিড!
সেহেরিশের ধমকে সবাই আহাম্মক বনে যায়।
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২১
অন্ধকার একটি কক্ষে দীর্ঘ কয়েক বছর বন্দি সে।দূর থেকে গানের আওয়াজে চাতক পাখির মতো চারিদিকে চোখ বুলায়।কান খাড়া করে বেশ কয়েকটি মেয়ে ছেলের জোরে জোরে কথা বলার শব্দে আবারো বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসে।তখনি দরজা খোলার শব্দে আবারো উঠে দাঁড়ায় সে।
তার সামনে মধ্যে বয়স্ক একজন ব্যাক্তি খাওয়ারের থালা এগিয়ে দিয়ে বলে,
– খাইয়া লও রাত বহুত হইছে।খাওন দিতে ভুইলা গেসিলাম।মেলা কাম দেওয়ান বাইত।
লোকটির কথায় ব্যাক্তিটির ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া যায়।মনের সংশয় মেটাতে দ্রুত প্রশ্ন করে সে,
– আফীফের কি বিয়ে নাকি আজ?
– খুশি হইয়া লাভ নাই আজ আফীফ ভাইজানের বিয়া না।
– তবে! তবে এত গান বাজনা হই হুল্লোড় কিসের?
– বছরের শেষ বিদায় দেওয়ার লাইগা এত আয়োজন৷আমি যাই গা কাম আছে বহুত।
লোকটি আবারো নিজ গন্তব্য ফিরে যায়।অবরুদ্ধ ব্যাক্তিটি খাওয়ারের থালাটা হাতে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে থাকে।
____
গত কয়েক বছরে এই দেওয়ান মঞ্জিলে এত জোরে গান বাজনা হই হুল্লোড় দেখা যায় নি।সবাই আফীফের ভয়ে তটস্থ থাকতো।নিয়ম করে চলাফেরা ছিল তাদের সকলের অভ্যাস। কিন্তু আজ সবটা পালটে গেছে দেওয়ান মঞ্জিলে।সেহেরিশ, তুন্দ্র, কেইন পালটেছে আজ সেই নিয়ম।গানের তালে তালে ছাদে সবাই মিলে নেচে গেয়ে মাতিয়ে তুলছে।আফীফ দূরে চেয়ারে বসে সেহেরিশের কান্ড দেখছে।নাচের তালে তালে হুট হাট আছাড় খেয়ে তুন্দ্র কিংবা কেইনের সাথে ধাক্কা লাগছে।আবার সামী, আমান, মৌয়ের হাত ধরে নেচে যাচ্ছে।কে বলবে এই ছেলে মেয়েগুলো এতটা চলোর্মি। সব সময় তো আফীফের সামনে ভদ্র চুপচাপ থাকে।
খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়।ক্লান্ত শরীরটা আফীফ বিছানায় এলিয়ে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।আজ সেহেরিশকে ভালোভাবে গানের মাধ্যেমে শায়েস্তা করেছে তাতে বেশ খুশি আফীফ।
রাত প্রায় শেষ হতে চললো আড্ডা মাস্তি শেষে সেহেরিশ রুমের দরজা খুলতেই হাতে টান পড়ায় সহসা ঘুরে তাকায়।কেইনকে দেখে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ধমকের সুরে বলে,
– সমস্যা কি?এইভাবে টান দিলি কেন?
– বলেছিনা সারপ্রাইজ আছে।
– কি সারপ্রাইজ?
– আয় আমাদের রুমে।
সেহেরিশ বিরক্ত মুখ নিয়ে কেইনের পিছু পিছু তাদের রুমে যায়।দরজা খুলতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।এক দৌড়ে রুমে ঢুকে ঝাপিয়ে বসে যায় বিছানার উপর।টেবিলের সামনে সাজিয়ে রাখা ওয়াইন,হুইস্কির বোতলের দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ আবারো লাফিয়ে উঠে।
– তোরা কোথায় পেলি এইসব?
– সারপ্রাইজ টা কেমন ছিল?
– পুরাই জোশ। আগে বল কোথায় পেলি?পাপা দেখলে কিন্তু মেরেই ফেলবে আমায়।
– ঢাকায় গেলাম যে আসার সময় নিয়ে এসেছি।চাপ নিস না।দুই প্যাগ নিয়ে রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবি।হুট হাট এক দুইবার মাতাল না হলে চলে না।
তুন্দ্রের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো সেহেরিশ।তিনজনে তিনটে গ্লাস তুলে নিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলে আরো একবার আড্ডায় মেতে উঠলো।
ঘুমের ঘোরে চোখটা লেগে আসছিল আফীফের তৎক্ষনাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে দরজা খোলার উদ্দেশ্য বিছানা থেকে নেমে যায়।কে এসেছে এই মূহুর্তে? দাদাজান নয়তো নাকি বাবা?
ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে সামনে সেহেরিশকে দেখেই চমকে যায়।
– কী সমস্যা?এত রাতে আমার রুমে কী?
– উহহহহ একটু আদর করে কথা বললে কি হয়?
সেহেরিশের ঠোঁট উলটে কথায় আফীফের মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে যায়।ভ্রু কুচকে সেহেরিশের দিকে এগিয়ে আসতেই উটকো গন্ধ নাকে লাগে।
– তুমি ড্রিংস করেছো?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠে সেহেরিশ।নিরিবিলি পরিবেশে সেহেরিশের ফ্যাচফ্যাচে কান্নার আওয়াজ সবার কানে যাবে বলে আফীফ দ্রুত সেহেরিসের মুখ চেপে ধরে।
– চুপ, বাড়ির সবাই জেগে যাবে।তোমার রুমে চলো।
আফীফ নিজের রুমের দরজাটা ভিড়ে সেহেরিশকে নিয়ে দ্রুত তার রুমে চলে যায়।সেহেরিশের রুমের দরজাটা বন্ধ করে আফীফ তাকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয়।
– এই বাড়িতে মদ আনার সাহস কার হলো?
আফীফের ধমকে কেঁপে উঠে সেহেরিশ।আমতা আমতা করে বলে,
– ত-তুন্দ্র,কেইন।
– তোমাদের আমি এই বাড়িতে হইহুল্লোড় করতে দিয়েছি মানে এই না যে যা ইচ্ছা তাই করবে।মদ আনার মতো সাহস করে তোমরা মোটেও ভালো করো নি।
সেহেরিশ প্রত্যুত্ত করলো না।ঠোঁট উলটে তাকিয়ে রইলো আফীফের দিকে।
– চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও আমি আমার রুমে গেলাম।
আফীফ যেতে নিলেই সেহেরিশ আবারো তাকে টেনে ধরে।
– না না না আমি একা থাকবো না আমাকে নিয়ে যাও। আমি একা থাকবো না।
– আরে আজব এমন নাটক করার মানে কি?
আফীফ রাগের মাথায় আবারো সেহেরিশকে ধমক দেয়।যার দরুনে দু পা পিছিয়ে যায় সেহেরিশ।তার চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনা জল।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়।সেহেরিশ যে এখন সজ্ঞানে নেই তা বুঝতে পেরে তার মাঝে অনুতপ্তের আভাস দেখা যায়।
– সেহেরিশ তুমি ঘুমিয়ে যাও আমি বরং যাই।
– না আমায় ছেড়ে যেওনা।
আফীফ ঘুরে তাকায়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে হতাশার দৃষ্টিতে তাকায় সেহেরিশের দিকে।সহসা সেহেরিশ আফীফের পায়ের উপর নিজের পা রাখে।দু পা উচু করে আফীফের গলা জড়িয়ে ধরে কিঞ্চিৎ হাসে।
– করছো কি তুমি?
– কই কি করলাম?
– আমার পায়ের উপর কি তোমার?
– আমায় ভালোবাসো না?
আফীফ থেমে যায়।সেহেরিশের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার মুখমন্ডলে ফু দিয়ে বলে,
– তুমি কি জানো মাতাল অবস্থায় মানুষের পেট থেকে সত্যি কথা বেরিয়ে যায়।
– উহু, আমি কি বলছি ভালোবাসো আমায়?
– অনেকটা!কিন্তু তুমি না আমায় ভালোবাসো আর না আমায় তোমায় ভালোবাসতে দাও।কি করি আমি বলতো?
– জানি না।
– তবে জানবে কে?আমায় ভালোবাসো তাকিয়া?
সেহেরিশ উত্তর দিলো না।বরং আফীফের গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তার কান্ডে বাকরুদ্ধ আফীফ।
– কি করছো তুমি?যখন সজ্ঞানে ফিরবে তখন কিন্তু আফসোস হবে তোমার কাজের জন্য।
– তাতে কি? চলোনা আমরা বিয়ে করি।
এমন কথায় আফীফ চমকে যায়।এক গাল হাসি দিয়ে বলে,
– আরে বাহ, প্রেম করতে চায় না যে জন।সে জন এসেছে আমাকে বিয়ে করতে।সূর্য আজ কোন দিকে উঠলো।
– এমন করছো কেন?বলনো না ভালোবাসি।
– ভালোবাসি, ভালোবাসি,ভালোবাসি।আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে তুমি?
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।হেলেদুলে হেটে নিজের ফোন নিয়ে গান চালিয়ে দিলো।তার কান্ডে আফীফের মাথায় হাত।
– সমস্যা কি তোমার।এখন আবার গান চালালে কেন?
– একটু নাচবো তোমার সাথে।
– উফফ কি সব বায়না তোমার। আমি নাচতে পারিনা।
– আমি নাচবো মানে নাচবো।
সেহেরিশ আফীফের হাত টেনে নাচতে শুরু করে।বেচারা আফীফ উপায় না পেয়ে সেহেরিশের সাথে হেলে দুলে নাচতে থাকে।হুট করেই সেহেরিশ সবচেয়ে অবাক কান্ড করে বসে।আবারো আফীফের পায়ে পা রেখে তার ডান গালে জোরে কামড় বসায়।কামড়টা এতটাই জোরে লাগে যে আফীফ সহ্য না করতে পেরে চিৎকার দিয়ে উঠে।
– পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?
– তুই হাসবি না তোকে হাসতে দেখলে আমার রাগ লাগে।
– তাই বলে তুমি এইভাবে কামড় বসাবে।দেখো রক্ত!
সেহেরিশ হুট করেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে।আফীফ সেহেরিশের কান্ডে হাসবে নাকি কাদবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।ভোরের পাখি ডাকার কিচিরমিচির শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে।বাড়ির সবাই জেগে যাবে সেই চিন্তা এক মূহুর্তেই আফীফের মাথায় ভর করেছে।দ্রুত সেহেরিশকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
– প্লিজ ঘুমিয়ে যাও।যদি বাড়ির সকলে তোমার কান্ড দেখে তবে আজ আর রক্ষে থাকবেনা।
– না আমি একা ঘুমাবো না তোমার সাথে ঘুমাবো।
– উফফ কি যন্ত্রণায় পড়লাম আমি।তুমি ঘুমাবে নাকি আবার আমি সেই গান গাইবো?
– তোমার গান আমি শুনতে চাইনা বিশ্রি লোক।
– তাহলে ঘুমিয়ে যাও।
সেহেরিশ হেলেদুলে আবারো সটান হয়ে শুয়ে যায়।আফীফ তার দিকে এগিয়ে এসে ভালোভাবে গায়ে কম্বোল জড়িয়ে দেয়।
– হেই গুডনাইট কিসি দাও আমাকে।
– এখন কি গুড নাইট নাকি গুড মর্নিং?আমি নিজেও কনফিউজড।
সেহেরিশ ঠোঁট বাকিয়ে শুয়ে পড়ে।আফীফ তার চুল গুলো কানের গুজে দিয়ে কপালে গাঢ় করে চুমু খায়।
– কেন বার বার মায়ায় জড়াও?এতটা মায়ায় জড়িয়ো না যতটা মায়ায় জড়ালে তোমাকে ছাড়া আমি অপূর্ণ থেকে যাবো।
সকালে নাস্তার টেবিলে বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকলেও উপস্থিত নেই কেইন, তুন্দ্রএবং সেহেরিশ।আফীফের ডান গালে ব্যান্ডেজ দেখে বাড়ির সবাই উদ্বেগ।
– কিরে আফীফ তোর গালে কি হয়েছে?
– তেমন কিছু না দাদাজান।
– তেমন কিছু না মানে?গালে কি হয়েছে সেটা বল।
– উফফ এত প্রশ্ন কিসের।
আফীফের হঠাৎ রাগে আহনাফ দেওয়ান ভড়কে যান।আফীফের গালের দিকে সবার আড় চোখে তাকানো দেখে আফীফ দ্রুত খাওয়ার শেষ করে উঠে যায়।দোতালায় নিজের রুমের দিকে যেতে নিলেই আচমকা সেহেরিশসের সাথে ধাক্কা খায়।
– আহ
– এই মেয়ে চোখ কি বেগে রেখে হাটো?
– আরে আজব আপনি আচমকা এসে ধাক্কা দিয়ে আপনি নিজেই বাজে ব্যবহার করছেন।
আফীফ থেমে যায়।ভালোভাবে সেহেরিশের দিকে চোখ বুলিয়ে গমগম সুরে বলে,
– মাথা কি ভার লাগছে?
– তা লাগছে।আপনি জানলেন কি করে?
– কিছু না।
– এই আপনার গালে কি হয়েছে?
– কেন তোমার মনে নেই?
– কী মনে থাকবে?
– কাল রাতের কথা।
– কাল রাতে কি হয়েছে?
– আমাকে লাভ বাইট দিয়েছো তার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।
– আল্লাহ!কি বলছেন এইসব?
– আরে সব ভুলে গেলে।কত কিছু হয়েছে তুমি সব ভুলে গেছো যাক ভালোই হলো।তুন্দ্র আর কেইনের সাথে ড্রিংস করে আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করেছো।
– কি করেছি আমি?
– ওই যে… থাক বলবো না।
– আরে বলুন প্লিজ। আরে কোথায় যাচ্ছেন?
আফীফ দ্রুত নিজের রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।এদিকে সেহেরিশ তার রুমের দরজায় করাঘাত করে যাচ্ছে।
– এই যে বলুন প্লিজ কি হয়েছিল কাল।
আফীফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল ছুঁয়ে হাসতে থাকে।
– নিলাম প্রতিশোধ।এবার কাল রাতে আর কি কি হয়েছে উলটা পালটা সব ভাবতে থাকো।আমি বরং বিনোদন উপভোগ করি।
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২২
জানুয়ারির শুরুতে হিমেল হাওয়া দিন দিন যেন বাড়ছে।সকাল শেষে মিহি রোদ জানলা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করলেও হিমেল হাওয়ায় আবারো সারা শরীর শিউরে উঠছে।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে নেয় আফীফ।আজ বাড়িতে বৈঠক বসবে।গ্রামের প্রত্যাক সদস্যদের সুবিধা-সুবিধা,চাওয়া-পাওয়া ,অন্যায়-অবিচার,আবদার নিয়ে আলোচনায় বসা হবে।প্রতি সাপ্তাহের মঙ্গলবার দিনটিতে আফীফ বৈঠকে বসেন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দশটা পঞ্চাশ মিনিট বাজতে দেখে দ্রুত আয়নার সামনে দাঁড়ায়।গালে কামড়ের দাগটা একদম সেঁটে গেছে।এই দাগের কারনে আজ তিনদিন রুম বন্দি সে। বাইরে কাজের প্রয়োজন হলে মাক্স পরে বের হয় কিন্তু পরিবারের সকলের সামনে মাক্স দিয়ে মুখ ঢাকা বেমানান।বরং তখন সন্দেহ সবার বাড়বে।আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আফীফ নিজের গালে হাত ছোঁয়ায়।উপরে নিচের তিন দাঁতের দাগ একদম স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।বিষটি নিয়ে আফীফের মাঝে মোটেও খারাপ লাগা কাজ করছে না বরং ভালোলাগা এবং ভালোবাসার সংমিশ্রণে অনুভূতি তৈরি হয়েছে।সেহেরিশের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এর মাঝে।আচ্ছা মেয়েটা যে না চাইতেও আফীফকে তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিচ্ছে সেটা কি সে যানে?
আফীফের ভাবনার ছেদ ঘটে মুনিফের কলে। পকেট থেকে ফোন বের করে গম্ভীর সুরে বলে,
– হ্যা মুনিফ বল।
– ভাই অনেকেই চলে এসেছে তুমি দ্রুত আসো।
– হুম অপেক্ষা কর আমি আসছি।
আফীফ চাবি এবং মোবাইল হাতে রুম থেকে বের হতেই সেহেরিশের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।সেহেরিশ নিজেও এই মাত্র তার রুম থেকে বের হচ্ছে।আফীফকে দেখেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে দ্রুত আবার রুমে ঢুকে যায়।আফীফ তার কান্ডে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে।চাবির গোছাটা উপরের দিকে ছুড়ে আবার ক্যাচ নিয়ে বলে,
– ইসস আমার লজ্জাবতী বউটারে!
.
দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সেহেরিশ।আফীফকে দেখলেই লজ্জায় লালভাব ছড়িয়ে যায় তার মুখে।সেদিনের কান্ডে আজও ইতস্তত বোধ করে সে।আফীফ মুখের ব্যান্ডেজ খুলে একবারের জন্য সেহেরিশকে কামড়ের দাগটা দেখাতেই সাত আসমান থেমে ধম করে যেন নিচে পড়ে সে।নিজের কান্ডে নিয়েই লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে।কিন্তু চতুর আফীফ সেহেরিশকে লজ্জায় ফেলতে তাকে দেখলেই “সেদিন রাত” শব্দটি মুখ বিড়বিড় করে বলতে থাকে।কিন্তু সেই রাতে কি হয়েছিল তা আফীফ তাকে বলে নি কিংবা তার তিলার্ধেক পরিমানেও মনে পড়ছেনা তার।সেহেরিশ দরজা খুলে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে আফীফ আছে কি না তা দেখার জন্য।কাউকে না দেখে সে বাইরে বের হতে নিলেই আচমকা আফীফ হুড়মুড় করে তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।আফীফের কান্ডে সেহেরিশ নিজেও হতবাক।
সেহেরিশকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আফীফ এক গাল হাসি দেয়।মুখের মাক্সটা খুলে হাসিটা স্থির করে।
– দেখো তুমি গালের দাগটা।আজ আমার বাড়িতে বিশেষ বৈঠক কিন্তু এই দাগ নিয়ে সবার সম্মুখে আমি হই কি করে বলতো?
– আপনি মাক্স খুললেন কেন?মাক্স পড়ে বৈঠকে যান।
– তা যাবো কিন্তু গালের দাগটা দেখো দিন দিন কেমন কালচে হয়ে উঠছে।
সেহেরিশ একপলক তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নেয়।আফীফ যে তাকে লজ্জায় মারতে এইসব ছল কৌশল করছে তা খুব ভালো করেই যানে সে।
– সরি বললাম তো।তবুও কেন এমন করছেন?
– উহহ সরি বললে হবে না ফুলপরী আমি রিভঞ্জ চাই!রিভেঞ্চ মানে রিভেঞ্জ।
শেষ কথাটা আফীফ বেশ দৃঢ় সুরেই বললো।সেহেরিশ তৎক্ষনাৎ তার দু-গালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে বলে,
– ছিহহ এইসব করে আমার গায়ে কলঙ্ক মাখবেন না।আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি এবারের মতো মাফ করে দিন।সেদিন রাতে কি হয়েছিল তা ভেবে আমি মরছি আপনি আবার এইসব করে আমাকে জানে মেরে দেবেন না প্লিজ।
– আরে চাপ নিচ্ছো কেন?সেদিন রাতে যা হয়েছে বেশ ভালোই হয়েছে।
– মানে?
– না কিছু না।বাই দা ওয়ে তোমার মতো নাকি আমি।একা একটা মেয়েকে পেয়ে এইসব করবো?আমি আমার বৈধতা নিয়ে করবো।তখন তোমার গায়ে কলঙ্ক লাগুক আর কালি লাগুক তুমি আমারি থাকবে।রিভেঞ্জ তোলা রইলো।আল্লাহ হাফেজ ফুলপরী।
আফীফ দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এদিকে সেহেরিশ রাগের মাথায় শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে বিড়বিড় করতে থাকে,
– বৈধতা মাই ফুট।
সহসা সেহেরিশের নাম্বারে একটি কল আসে।নতুন ফোন নতুন সিম হওয়ায় কারো নাম্বার সেভ নেই তার কাছে তাই নাম্বারটি কার ঠিক ঠাহর করতে পারছে না সে।ফোন রিসিভ করতেই কানে আসে সেই চিরচেনা কন্ঠ।
– অন্তত রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য হলেও তোমায় বিয়ে করবো ফুলপরী।আমার ভালোবাসা বড্ড তেতো।
সেহেরিশ থমকে যায় এই লোকটা যে তাকে লজ্জায় মারার জন্য তার পিছু নিয়েছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।
__
শক্ত মুখ করে বেশ রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে আছে আফীফ।গ্রামে বাল্যবিবাহ,যৌতুক প্রথা সে দূর করলেও কিছু কিছু মানুষের মন থেকে তা দূর করতে পারেনি।আফীফ গ্রামের প্রত্যাকটা মেয়ের জন্য মেট্রিক পরিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করেছে।এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনার খরচ তার নিজের।তবুও কিছু কিছু লোক তার অজান্তে আঠারো বছরের আগেই আড়ালে বিয়ে দেওয়ার সিধান্তে নেয়।ফল স্বরূপ আফীফের কানে ঠিকি পৌছে যায় বিয়ের সংবাদ।
– এত লুকোছাপা করে লাভ কি হয় চাচা।যে গ্রামটার মানুষগুলো আমার ইশারায় চলে আর আপনি সেই গ্রামের মানুষ গুলোকে আমার নিষিদ্ধ নিয়মে রাজি করাতে উতলা হয়ে উঠেছেন?
– ভুল হইয়া গেসে বাবা মাফ কইরা দাও।মাইয়াডার মা অসুস্থ তাই চাইছি বিয়া দিয়া চিন্তা দূর করতে।
– কোন ক্লাসে পড়ে সে?
– এইটে পড়ে।
– বাহ ক্লাস এইটের মেয়েকে বিয়ে দিতে এত উতলা হয়ে উঠলেন।আজকেই আপনাকে ফাস্ট এবং লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম আর যেন এমন ভুল করতে না দেখি।
– শুকরিয়া বাজান শুকরিয়া।
লোকটি দ্রুত তার হাত গুটিয়ে পালায়।মুনিফ ইশারা করলে একটি ছেলে এসে আফীফের সামনে দাঁড়ায়।তৎক্ষনাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আফীফ ছেলেটাকে ঠাস ঠাস করে চার থাপ্পড়ে মাটিতে বসিয়ে দেয়।শ্যামলা মুখমন্ডল ছেলেটির লালচে হয়ে গেছে।আফীফ দ্রুত ছেলেটির কলার টেনে আবার দাঁড় করায়।
– তোর সাহস কি করে হলো আমার নির্দেশ অমান্য করার?নিজের বউকে যৌতুকের জন্য নিয়মিত মারধোর করিস।কিন্তু কাল সহসা গরম পানি ছুড়েছিস।মেয়েটাকে যেমন কষ্ট দিয়েছিস তোর শাস্তিও তেমন হবে।মুনিফ জানোয়ার টাকে নিয়ে যা।ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে গোসল করাবি।
– ভাইজান মাফ কইরা দেন এমন দুঃসাহস আমি আর দেহামু না।ভাইজান মাফ কইরা দেন আমারে।
– চুপ!তোকে মাফ করলে আরো দশজন একই অন্যয় করতে সাহস পাবে।কি হলো মুনিফ নিয়ে যাচ্ছিস না কেন?
মুনিফ দ্রুত ছেলেটাকে নিয়ে যায়।এদিকে এতক্ষণ যাবৎ আফীফের কান্ড দেখছিল সেহেরিশ,মৌ এবং আমান।আফীফের ধমকে,চাহনী, সব কিছুতে সেহেরিশ ভীতিগ্রস্ত।এটা তো সেই আফীফ না যে আফীফ তাকে বারংবার লজ্জায় ফেলে।হুটহাট ধমক দেয় আবার আদুরে সুরে কাছে টেনে নেয়।এটা তো রাগান্বিত, ক্রুদ্ধ, তেজি আফীফ।এই আফীফের মুখমন্ডল সেহেরিশ সেই আট বছর আগে শুরুতে দেখেছিল আর সেদিন বন্দি রুমে।এই একটা লোক কতটা রূপ নিয়ে চলে ভাবা যায়।
– ইসস জামাল চাচা আপনার কথাটা দ্রুত বলুন প্লিজ!আমি আর অপেক্ষায় থাকতে পারছি না।
আমানের বিড়বিড় কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে সেহেরিশের।
– কি হয়েছে এমন বিড়বিড় করছো কেন আমান?
– আপু জামাল চাচার মেয়ের বিয়ে।
– তো?আর জামাল চাচা কে?
– ওই যে পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই আঙ্কেল টা।তার মেয়ের বিয়ে শুক্রবার।আমাদের সবাইকে দাওয়াত করতে এসেছে।কিন্তু দেখবে আফীফ ভাইয়া সবার দাওয়াত ক্যান্সেল করে শুধু মাত্র নানাজান,তার এবং মুনিফ ভাইয়ার দাওয়াত গ্রহন করবে।আফীফ ভাইয়া সবসময় আমাদের দাওয়াতের কিসমত মেরে দেয়।
আমানের রুষ্ট কন্ঠ।সেহেরিশ ভ্রু কুচকে আমানের হাতটা আলতো ভাবে ধরে বলে,
– একটা বিয়ে মিস করলে কি হয় আমান?
– তুমি জানো গ্রামের বিয়েতে কতটা মজা হয়।গায়ে হলুদের দিন রঙ ছোড়াছুড়ি।সবাই কাঁদা পানিতে গড়াগড়ি করে কত আনন্দো করে।বিয়ের দিন বরের জুতা চুরি,গেট আটকে টাকা নেওয়া,গান বাজনা,ভোজন, উফফ এইসব মজা তুমি কখনো ফিল করোনি সেহেরিশ আপু।
– এহহ বিয়েতে এইসব করে?আজ শুনলাম আমি।গ্রাম্য বিয়ের আনন্দ আমি এর আগে ফিল করিনি।
– তুমি পারবে আপু ভাইয়া দাওয়াত ক্যান্সেল করলে তুমি বলবে তুমি সবাইকে নিয়ে বিয়েতে যেতে চাও।প্লিজ আপু প্লিজ।
– আরে না তোমার ভাইয়ার সাথে আমি রাগ করেছি আমি কথা বলবো না।
সেহেরিশের কথায় মৌ এবং আমান দুজনে রুষ্ট হয়।কিছুক্ষণ পর জামাল আফীফের দিকে এগিয়ে আসে।
– আফীফ বাবা তোমার কাছে আবদার নিয়ে এসেছি।
– কী আবদার চাচা?
– আমার মেয়েটার পড়াশোনা যথেষ্ট পরিমান শেষ।এখন ভালো ঘর এবং বর দেখে বিয়ে দেওয়ার সিধান্ত নিয়েছি।বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছি বাবা।
– আলহামদুলিল্লাহ! শুনে খুশী হলাম চাচা।
– এবার আমাকে যে খুশি করতে হবে তোমার।দেওয়ান মঞ্জিলের সকলের দাওয়াত আমার মেয়ের বিয়েতে।বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে দেখেছি তাদের সহ দাওয়াত রইলো।আমাকে ফিরিয়ে দিও না বাবা।
– চাচা আপনার দাওয়াতে আমি খুশি হলাম এবং গ্রহণ করলাম।কিন্তু উপস্থিত আমি মুনিফ আর দাদাজান থাকবো।
– সে কি কথা আমি তো সবাইকে দাওয়াত করেছি।তোমাদের সবাইকে যেতে হবে।
– চাচা দেখা যাক কে যায় আর কে না যায়।তবে আমরা তিনজন অবশ্যই যাবো।আর বিয়েতে কোন প্রয়োজনে অবশ্যই আমাদের জানাবেন
– শুকরিয়া বাবা।আমি তবে আসি।তোমার নানাজানকে সালাম জানাবে।
– অবশ্যই।
আফীফের কথায় আবারো রেগে যায় আমান এবং মৌ।
– দেখলে সেহেরিশ আপু।কি পরিমান বেয়াদবি করছে ভাইয়া।আমাদের হক’টা মেরে দিচ্ছে।
– তাই তো দেখছি আমান।তবে আমি বিয়েতে যেতে চাই যে করেই হোক তুমি ব্যবস্থা কর।
– আমার কথার চাইতেও ভাইয়া তোমার কথার দাম বেশি দেবে।তাই বলছি কি একবার তুমি বলে দেখো।
– শুনো তুমি গিয়ে বলবে জামাল চাচার বিয়েতে সেহেরিশ আপু যেতে চায়।দেখবে তোমার ভাইয়া রাজি হবে।একবার চেষ্টা করে দেখো।
– ওকে।
আফীফের বৈঠক শেষে মুনিফের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে করতে বাগানের দিকে হাটা শুরু করে।তখনি তার সামনে দাঁড়ায় আমান।
– ভাইয়া।
– কি রে কিছু বলবি?
– হ্যা সেহেরিশ ভাবী পাঠিয়েছে একটি আবদার নিয়ে।
– কোথায় তোর ভাবী?
– ওই যে তালগাছটার পেছনে।
এতক্ষন আমান আর আফীফ ফিসফিসিয়ে কথা বললেও বর্তমানে আফীফ বেশ জোরেই উওর দেয়।
– কি বলবি বল।
– আসলে সেহেরিশ আপু চাইছে জামাল চাচার মেয়ের বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে।আপু সবাইকে নিয়ে বিয়েতে যেতে চায়।
– তোর আপুকে বল সেকি বিয়ে করতে চাইছে নাকি খেতে চাইছে?
আফীফ কথাটি বলেই সহসা হাঁটা শুরু করলো।এদিকে সেহেরিশ স্তম্ভিত হয়ে তার পানে তাকিয়ে আছে।আমান ঘুরে তাকিয়ে সেহেরিশের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
– সেহেরিশ আপু তুমি কি বিয়ে করতে চাও নাকি খেতে চাও?
আমানের প্রশ্নে অপ্রতিভ অবস্থায় পড়লো সেহেরিশ।রাগ নিয়ে উলটো দিকে হাটা শুরু করে বিড়বিড় করে বলে,
– যেমন বর তেমন দেওর।দুইটাই বাদর!ইসস কি সব বলছি আমি।কে আমার বর কে আমার দেওর?এদের মাঝে থেকে সেহেরিশ তুই পাগল হয়ে গেছিস।
#চলবে….