#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা ওয়াহিদ
| সূচনা পর্ব |
মায়ের সেলাই করা শাড়িটির কুচি ঠিক করতে করতে অনেকটা লুকিয়েই বান্ধুবির ভাইয়ের বিয়েতে চলাফেরা করছি। কিন্তু আমার এতো সাবধানতা অবলম্বন করার পরেও কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলাম। নাকে হালকা ব্যথা পাওয়ায় বাম হাতে নাক কচলাতে কচলাতে সামনের লম্বা করে মানুষটির দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কী সুদর্শন এই যুবক! কিন্তু সে আমার দিকে কীভাবে যেন তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে আমার খেয়াল হলো আঁচলের ফাঁড়া অংশেও একটি কাতান কাপড় দিয়ে সেলাই করা আর উনি সেইই অংশেই চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। আমি এবার ওনার ড্রেসআপ দেখলাম। ওনার ড্রেসআপ দেখে আমি এক মুহূর্তও তার সামনে না দাঁড়িয়ে ছুটে অন্যদিকে চলে আসলাম। কী লজ্জা, কী লজ্জা। বান্ধুবির ভাইয়ের এতো বড় বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার এই পোশাক কিরকম মানানসই? আর গরিবের কী বড়লোকী খাবার গলা দিয়ে নামে? সে যে গলা অবধি গিয়েই গুরুতর ভাবে আটকে থাকে। এসব ভাবতে ভাবতেই জনমানব শূন্য স্থানে একটি চেয়ার টেনে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বসে থাকার মাঝেই সেই যুবকটার কথা মনে পরলো। তার দামী লাল শেরওয়ানি দেখে মনে হচ্ছিলো সে জামাই আর চেহারাটাও কেমন নাফিসার সাথে মিল আছে। তাহলে আমি যার সাথে ধাক্কা খেলাম সেই নাফিসার ভাই? হয়তো। ইশ! কী সুন্দর সে, নাফিসার হবু ভাবী কতটা লাকি তাই না? দোয়া করি আল্লাহ যেন এমন একজন সুপুরুষ আমার জীবনে পাঠায়।
★
নাশিদ অনেকটা অবাক হয়েই রথির যাওয়া দেখলো। সে অনেকক্ষণ ধরেই রথিকে ফলো করছিলো। এমন সাদামাটা জামা পরে এতো সিকিউরিটি থাকতেও কি করে প্রবেশ করলো সেটা নাশিদের মগজে ঢুকছে না।
তবে সে সন্দেহ করছে মেয়েটি কোন ক্রাইমের সাথে জড়িত এবং সে এখানে ভয়ংকর কিছু ঘটাতেই এসেছে। তাও সে নিশ্চিত হবার জন্যে রথির পথ আটকে দাঁড়ায় যার ফলে অসাবধান বশত রথি নাশিদের সাথে ধাক্কা খায়। কিন্তু রথির ঘন ঘন পাঁপড়ী নাড়ানো এবং রথির মায়াবী মুখটা দেখে মনে হলো না সে কোনো ক্রাইমের সঙ্গে সংযুক্ত। নাশিদ সেসব ভুলে রথির পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগে। পুরো শাড়িতেই কিছু কাতান কাপড় দিয়ে সেলাই করা। মুখশ্রীতে কোনরকম কৃত্রিম সাঁজ নেই কিন্তু পরমুহূর্তে মেয়েটির ভয়ার্ত চেহারা লক্ষ করলো সে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগমুহূর্তেই মেয়েটি তাকে দেখে পাশ কেটে চলে গেলো যা নাশিদকে কিছুটা হতভম্ব করেছে। নাশিদ পাহাড় সমান ভাবনা-চিন্তার থেকে বেরিয়ে আসলো কয়েকজন গেস্টের ডাকে। সে ঠোঁটে হাসি ঝুলানোর চেষ্টা করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গেস্টদের দিকে চলে গেলো।
এদিকে নাফিসা তার ভারী লেহেঙ্গা উঁচু করে রথিকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দার শেষ অংশে চলে এসে দেখলো রথি হাতদুটো একসাথে করে গোল গোল চোখে চারপাশের ডেকোরেশন দেখছে। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট। নাফিসা কপালে চাপড় মেরে রথির সামনে গিয়ে বললো,
-‘বাহ! আমি এদিকে তাকে পুরো বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি আর উনি এখানে ডেকোরেশন বিলাস করছে!’
নাফিসার কথায় আমি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালাম!
-‘ডেকোরেশন বিলাস আবার কী রে?’
-‘যেহেতু বুঝিসই না তাহলে আমায় ফেলে এখানে বসে আছিস কেন একা একা? আমার বুঝি চিন্তা হয় না? জানিস আন্টি কিছুক্ষণ বাদেই ফোন করে জিজ্ঞেস করছে তুই আমার পাশে পাশে আছিস কি না! যখন থাকিস না তখন আমার মিথ্যে বলতে কেমন লাগে?’
আমি মুখটা বেজার করে বলি,
-‘তো আমি কী করবো? তুই তো তোর কাজিনদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলি। আর আমি চাইনি আমার ড্রেসআপ দেখে কেউ জানুক আমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে তোর বেস্টফ্রেন্ড। কেন আমায় এই ঝামেলায় আনলি বল তো? আমার অনেক আনইজি ফিল হচ্ছে!’ শেষোক্ত কথাটি নিজের হাত আরও কিছুটা গুটিয়ে বললাম।
নাফিসা লম্বা শ্বাস ফেলে একটি চেয়ার টেনে আমারই সামনে বসে বললো,
-‘একসময় তো এরকম ছিলি না তুই, তাহলে তুই ভাবলি কী করে এই কয়েক বছরে আমিও স্বার্থপরের মতো তোকে ছেড়ে যাবো? আমাকে এখনো চিনতে ভুল করলি রে রথি। আমার বাবা-মা, ভাইদের শিক্ষা অতটাও নিচু নয়।’
-‘ছিঃ, ছিঃ এ কী বলছিস নাফু, আমি সেরকম কিছু মিন করিনি। আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি…’
আমার কথার মাঝপথেই নাফিসা আমায় থামিয়ে বললো,
-‘থাক, থাক। আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না। এখন চল, এখানে তোর আর থাকা লাগবে না!’
-‘কিন্তু সত্যি বলছি রে বোন, এই পোশাকে লোকজনের সামনে যেতে বড়ই লজ্জা লাগছে। সবাই কতো বড় বড় মানুষ, তাদের স্ট্যাটাসও কতো উঁচু। সেখানে আমি মোটেই হেনস্তা হতে চাই না!’
-‘তাহলে যখন বললাম আমি একটা লেহেঙ্গা কিনে দেই তখন কেন নিলি না তুই? নিলে কী এ-সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হতি?’
আমি জবাবে কোন উত্তর দিলাম না। হাতে থাকা মাঝারো সাইজের একটা মগের গিফট বক্স দিয়ে বললাম,
-‘আজ তেমন সামর্থ্য নেই, এটা খুব কমদামী মগ। তোর ভাইকে দিস। যদি ভালো লাগে রাখবে নয়তো ফেলে দিতে বলিস। তবে একটা ছোট্ট অনুরোধ, আমি যেন তা জানতে না পারি।’
নাফিসা করুণ চোখে রথির দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি কতো ঝামেলাই না সহ্য করছে প্রতিনিয়ত। যেই বয়সে তার পড়াশোনা করার কথা সে তার সংসার টানছে৷ কী অদ্ভুত এই দুনিয়ার নিয়ম। যাদের সামর্থ্য আছে তো তাদের নিয়তি ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে আর যাদের সামর্থ্য নেই তাদের দিক থেকে যেন নিয়তি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে নাফিসার বিশ্বাস “আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।” সে ইনশাল্লাহ অনেক কিছুই ভেবে রেখেছেন। এই কথাটি মাথায় আসতেই নাফিসা মুচকি হেসে গিফট বক্সটি নিয়ে বলে,
-‘উপহারকে উপহার বুঝতে শিখ রথি। উপহার কতো টাকার সেটা যাচাই করা বোকামী বুঝলি? কেউ ৫ টাকার বাদাম উপহার করলেও ওটা উপহারই। যাইহোক, এসব কথা ছাড় এবং আমার সাথে চল। এবার যদি আমার কথার দ্বিমত করিস আমি সত্যি তোকে থাপ্পড় দিবো! চল’
বলেই আমায় একপ্রকার জোর করে আবারও কোলাহলের মাঝে নিয়ে গেলো। সেখানে এক জায়গায় বসে রইলাম দুই বান্ধুবি। এদিকে আমি হাতদুটো কুঁকড়িয়ে অস্বস্তিতে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছি। ভিষণ খারাপ লাগছে আমার। নাফিসা আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে কয়েকজন কালো স্যুট পরিহিত লোককে আমাদের ঘিরে দাঁড়াতে বললো। তারা নাফিসার কথায় আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো। নাহ এবার আর কারো আমার দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। ভাবতেই আমি এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর আবারও তাকে মানে নাফিসার ভাইকে দেখলাম যে অদূরে হেসে হেসে কথা বলছে। আমি নাফিসাকে তার দিকে ইশারা করে বললাম,
-“ওটাই নেওয়াজ ভাই তাই না? ইশ! তোর হবু ভাবীর তো দেখছি কপাল ভালো। কি সুন্দর জামাই পাবে। চান্স পেলে আমি-ই তোর ভাইকে বিয়ে করে তোর ভাবী হয়ে যেতাম!” আফসোসের সুরে বললাম। নাফিসা একবার তার দিকে তো একবার আমার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট।
নাফিসা এবার মুখ চেপে হেসে বললো,
-“ওটা নেওয়াজ ভাই নয়, নাশিদ ভাই।”
আমি বিস্ফোরিত চোখে নাফিসার দিকে তাকালাম! অতঃপর অবাক হয়ে বললাম,
-“তোর ভাই না সিলেটে শিফট ছিলো?”
-“হু। তবে নেওয়াজ ভাইয়ের বিয়ের আগেই ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। ভাইয়া আর বাবা-মা তো সেই খুশি। সাথে আমিও। তবে তুই যাই বলিস, তোর জন্য সুবিধা হলো ভাইয়ের সাথে ধুমিয়ে প্রেম করতে পারবি!” মজা করে বললো নাফিসা। আমি নাফিসাকে এক চাপড় মেরে আবারও বললাম,
-“ধ্যাত! কী ভুল করে বসলাম! তাহলে উনি জামাইদের মতো লাল শেরওয়ানি পরে ঘুরছে কেন? আমি কই ভাবলাম এটাই নেওয়াজ ভাই!”
নাফিসা এবার হু হা করে হেসে উঠলো। আমি ঠোঁট উল্টে ওনার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো।
~চলবে।