#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (৮)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
আজ প্রাহির মন অনেক ভালো।আজ সে স্কুলে যাবে।নতুন স্কুল,নতুন পরিবেসশ সবকিছুই নতুন।তবে একটু মন খারাপও করছে ওর আগের ফ্রেন্ডদের জন্যে।তবে সেটা ও প্রকাশ করতে চাইছে না।আরো আগেই যেতো।প্রাহির জ্বর ছিলো তিনদিন পর্যন্ত।আজ শরীর ভালো লাগায় আজ ও স্কুলে যাবে।বেডের উপর বসে পা দোলাচ্ছে প্রাহি।পায়ের প্রসস্ত নুপূরজোড়া ঝংকার তুলে মধুর ধ্বনি সৃষ্টি করছে।প্রাহিকে নূপুরজোড়া দিয়েছে রায়হানা বেগম।প্রাহি তো বেজায় খুশি হয়েছে।অবশ্য এই নুপূরজোড়া নাকি ওর আম্মুর।প্রাহির আম্মু নাকি সবসময় এই নুপূরজোড়া পায়ে দিয়ে সারা বাড়ি ঝংকার তুলে হেটে বেড়াতো। নিচ থেকে ডাক আসছে নাস্তা করার জন্যে।প্রাহি বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো আয়নায় নিজেকে স্কুল পরিহিত ড্রেসে দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো।বেনি দুটো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখে নিয়ে নতুন স্কুল ব্যাগ কাধে নিয়ে নিচে নেমে যাওয়া ধরলো।
——–
চামচ দিয়ে ওট্স খাচ্ছে আর ফোন চাপছিলো অর্থ।হঠাৎ ঝংকার তোলা মিষ্টি নুপূরের শব্দ কানে এসে বারি খেতেই ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।খাওয়া থামিয়ে সিড়ির দিকে তাকিয়ে প্রাহিকে দেখতেই চোখজোড়া শীতল হয়ে এলো।স্নিগ্ধতায় ঘেরা মানবীর মুখশ্রীটা দেখে সারা শরীর জুড়ে শীতলতা বয়ে গেলো।মানবীর ললাটে ওর ওষ্ঠজোড়ার ছোঁয়া দিতে ইচ্ছে করছে অর্থ’র।সাদা স্কুল ড্রেসে আর দুই বেনীতে একেবারে পিচ্চি পুতুল লাগছে প্রাহিকে অর্থ’র কাছে।এই ছোট্ট মেয়েটাকে কিভাবে যে নিজের অনুভূতিগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে অর্থ।মেয়েটা কি ওর ভালোবাসা বুজতে পারবে কোনদিন। অর্থ আর কিছু ভাবতে চায় না।যা হবার হবে সে শুধু এখন আর স্নিগ্ধময়ীকে দেখতে চায় প্রানভরে।এদিকে হিয়া মুখ টিপে হাসছে। ভাইকে এইভাবে প্রাহির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিয়ার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপলো।হিয়া অর্থ’র কানের কাছে গিয়ে জোড়ে চিৎকার করে উঠলো।অর্থ থতমত খেয়ে যায় এতে।ব্যাপারটা বুজতে পেরেই রাগি চোখে হিয়ার দিকে তাকায়।হিয়া ভাইয়ের মুখটা দেখে মনে মনে হাসলেও।তা বাহিরে প্রকাশ করলো না।এদিকে আকস্মিক চিৎকারে প্রাহিও অনেক ভয় পেয়েছে।প্রাহি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে হিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
-” আপু! এমন করলে কেন?আমি ভয় পেয়েছে।”
হিয়া উঠে গিয়ে প্রাহি নিজের আর অর্থ’র মাজে বসিয়ে দিলো।প্রাহি চোখ বড়বড় করে তাকালো।এই ভয়ংকর লোকটার পাশে ওকে কেন বসালো প্রাহি?উঠতে হবে ওকে এখনই।নাহলে বজ্জাত রাক্ষসটা দেখা যাবে ওকে ধাক্কা দিয়ে চেয়ার থেকেই ফেলে দিবে।প্রাহি উঠার জন্যে উদ্যত হতেই একজোড়া শীতল হাত ওর ডানহাত শক্ত করে ধরলো।প্রাহি ভয়ে ভয়ে অর্থ’র দিকে তাকিয়ে দেখলো।সে ইনোসেন্ট মুখ করে একধ্যানে খাবারের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে।ভাবটা এমন মানে সে কিছুই করেনি। প্রাহি অর্থ’র কানের কাছে মুখটা নিয়ে কাঁপা গলায় বলে,
-” ছা..ছাড়ুন না হাতটা উঠবো।”
অর্থ খেতে খেতেই বললো,
-” চুপচাপ এখানে বসে খাবে।উঠতে চেষ্টা করলেই থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো।”
প্রাহি ভয়ে কেঁপে উঠলো।কাঁদো কন্ঠে বলে,
-” হাত না ছাড়লে খাবো কিভাবে?ডান হাতটাই তো ধরে রেখেছেন।”
অর্থ প্রাহির হাতটা ছেড়ে দিলো।তারপর রাগি চোখে তাকালো প্রাহির দিকে।প্রাহি সাথে সাথে মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।অর্থ পাশে থাকায় বেচারি ভালোভাবে খেতেও পারছে না।কোনরকম অর্ধেক পরোটা একটা ডিম দিয়ে খেয়ে মুচকি হেসে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
-” আমার হয়ে গেছে।”
সবাই হতাশ হয়ে তাকালো প্রাহির দিকে।এতুটুকু নাস্তা করে বলে কিনা হয়ে গেছে।প্রাহি উঠতে নিলেই অর্থ প্রাহি বেনী টেনে ধরলো।প্রাহি ব্যাথা পেয়ে ককিয়ে উঠলো। অর্থ রাগি কন্ঠে বলে,
-” প্লেটে যা যা দিয়েছি তা জলদি শেষ করো।নাহলে আজ এই চেয়ারের সাথেই সারাদিন হাত পা বেধে বসিয়ে রাখবো আর টেবিলে যতো খাবার আছে সব খেতে হবে।”
কথাগুলো শুনতেই প্রাহি চোখ বড়বড় করে তাকালো।ভয়ে পেয়ে চেয়ারে বসে জলদি বলে,
-” খাচ্ছি তো।এখনি সব খাচ্ছি।”
প্রাহি তাড়াহুরো করে খেতে নিতেই ওর গলায় খাবার আটকে গেলো।কাশতে লাগলো প্রাহি। অর্থ জলদি করে প্রাহিকে পানি খাইয়ে দিলো।তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই একটু স্থির হলো প্রাহি।অর্থ এইবার দাঁতে দাঁত বললো,
-” ডাফার একটা।খেতেও পারে না ঠিকভাবে।”
প্রাহি কাঁদো মুখ করে বসে রইলো।আর খেলো না।অর্থও আর জোড় করলো না।অর্থ’র খাওয়া শেষ হতেই বাহিরে যেতে যেতে প্রাহির উদ্দেশ্যে বলে,
-” কা’ম ফাস্ট আ’ম ওয়েটিং।”
বলেই চলে গেলো।প্রাহিও সবাইকে বলে বাহিরে চলে গেলো।দেরি হলে দেখা যাবে ওকে গাড়িতে করে নিয়ে কোন নদীতে ফেলে দিয়েছে লোকটা।
এত্তোক্ষন বাড়ির একটা লোকও কোন কথা বলেনি।সবটা চুপচাপ দেখেছে।হিয়া এইবার সবার উদ্দেশ্যে বলে,
-” দেখলে তো আমি যা বলেছি সেটাই ঠিক হলো।ভাইয়া প্রাহিকে ভালোবাসে।আর আরাফ আমাকে সঠিকই বলেছে।”
সেদিনের আরাফের সাথে ঘুরেফিরে বাড়ি আসার পরেই হিয়া সবাইকে সবটা বলে দেয়। সব শুনে সবাই বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যমুখো হয়ে গিয়েছিলো।কেউ বিশ্বাসই করতে চাইনি।তাই হিয়া গত তিনদিন ধরে অর্থ’র ব্যবহার প্রাহির প্রতি কি রকম সবটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখিয়েছে।তারা কাজে থাকলে জোড় করে টেনে এনে দেখিয়েছে।আজ একেবারে সবার কাছে সবটা ক্লিয়ার।হেনা থমথমে মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।রায়হানা বেগম এইবার হেনার হাতদুটো ধরে করুন স্বরে বলে,
-” প্রাহির অভিভাবক তো এখন তুই ছোট।তাই তোর কাছে তোর মেয়েকে আমি চাইছি আমার ছেলের জন্যে।প্লিজ তুই না করবি না।আমার ছেলেটা এই কয়দিনে অনেক্ষানি পরিবর্তন হয়েছে।এই বোনটার কথা রাখ ছোট।”
হিয়াজ সিকদার স্ত্রীর কথায় অবাক তিনি অবাক হয়ে বলেন,
-” কি বলছো কি রায়হানা?প্রাহির মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে কিনা তোমার ছেলে ভালোবাসে।আবার তুমি তা প্রসয় দিচ্ছো।”
রায়হানা বেগম ছলছল চোখে স্বামির দিকে তাকালেন।বললেন,
-” ভালোবাসা তো অপরাধ না হিয়াজ।আর ভালোবাসায় বয়স কোন ম্যাটার করে না।তুমিও তো আমার থেকে ১৬ বছরের বড়।আমরা কি সংসার করছি না বলো?আমরা কি সুখী না?”
হিয়াজ স্ত্রীর চোখের পানি মুছে দিলেন।রায়হানা বেগমের চোখের পানি তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না।এরেঞ্জ ম্যারেজ হলেও তিনি তার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন।তিনি বলেন,
-” কান্না থামাও।আর আমাদের ব্যাপারটা আলাদা রায়হানা।এখনকার ছেলে মেয়েরা এতোটা গ্যাপে বিয়ে করতে চায়না।আর তারা নিজেরাই নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেয়।প্রাহির বয়স অনেক কম।কোনটা আবেগ আর কোন ভালোবাসা এটা বুজার ক্ষমতা এখন তার হয়নি।আর অর্থকে যে প্রাহি মেনে নিবে এমনটা নাও হতে পারে।আজ আমরা ওদের মেনে নিলাম ঠিক আছে।প্রাহিও আমাদের কথা রাখতে সম্মতি জানালও।কিন্তু একসময় প্রাহি বুজদার হবে।তখন যদি ওর অর্থ’কে রেখে অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলে?মেনে নিতে পারবে তো অর্থ?”
-” নেগেটিভ না ভেবে পজিটিভ ও তো ভাবতে পারো।এমনটা তো নাও পতে পারে?”
হিয়াজ আর রায়হানা বেগম যখন তর্কে ব্যস্ত তখন হেনার একটা কথায় সবাই থেমে গেলেন,
-” আমি রাজি। অর্থ আর প্রাহির সম্পর্ক আমি মেনে নিয়েছে।”
রায়হানা বেগম খুশি হয়ে হেনাকে জড়িয়ে ধরেন।বললেন,
-” সত্যি?”
-” হ্যা! কিন্তু আমার একটা কথা আছে।প্রাহিকে আগে অর্থ’কে ভালোবাসতে হবে।আমি যদি প্রাহির চোখে অর্থ’র জন্যে ভালোবাসা দেখতে পাই।তাহলে আমি মেনে নিবো সব।কিন্তু ওর বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ওকে জোড় করতে পারবো না।মেয়েটা ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে।ওকে আর আমি কষ্ট দিতে পারবো না। অর্থকে প্রাহির মনে অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে।আর এর জন্যে আমি ওকে দুবছর সময় দিলাম।এর মাজে যদি প্রাহি অর্থকে ভালোবেসে ফেলে।তাহলে প্রাহির আঠারো বছর বয়স হলে আমি অর্থ’র সাথে প্রাহির সাথে বিয়ে দিবো।”
নুরুল আমিন উঠে ছোট ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তিনি আর কিছুই বললেন না।কারন যার যার ছেলে মেয়ে তাদেরই ব্যাপার।তিনি এখন বুড়ো হয়েছে।সে এসবে আর কি বলবেন।হেনার কথায় রায়হানা বেগম অনেক খুশি হলেন আর এটাও বলেন তিনি ওর শর্তে রাজি।হিয়া আর হেমন্ত তো পারেনা নেচেকুদে বাড়ি ঘর মাথায় উঠিয়ে ফেলতে।হিয়া খুশি মনে হেমন্ত’র সাথে চলে গেলো ভার্সিটিতে।
#চলবে______