#খেলাঘর_৪
আয়না বাদশাকে নিয়ে প্রথমে চুল দাড়ি কাটালো এতক্ষন জংলী দেখাচ্ছিলো পুরো, তারপর ওদের পছন্দের একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুজনেই লাচ্চি খেলো,এখন আবার রিক্সায় উঠেছে রিক্সার হুড খোলা মাথার উপর দপদপ করা রোদ।বাদশার মেজাজ ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে কড়া রোদে ঘোরার কোনো মানেই ও দেখছে না কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না, এই মেয়েটার কাছে সে অপরাধী।
—তোমার কি এখন আমাকে খুব খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছে বাদশা?
বাদশা কিছুই বললো না ও দৃষ্টি এলোমেলো করে দূরে কোথাও তাকিয়ে রইলো এত কথা ও ভাবতে পারে না ওর দম বন্ধ হয়ে আসে।আয়না বিষন্ন হয়ে বলে,।
—একটা মেয়ে যার বিয়ে হয়ে গেছে,যার স্বামী মাত্রাতিরিক্ত ভালো, প্রতিষ্ঠিত সে এখনো পুরোনো প্রেমিককে মনে গেথে স্বামীর সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি পড়ে থাকে এই আশায় যে শুধুমাত্র এক নজর প্রেমিক কে চোখের দেখা দেখবে এমন মেয়েকে কেউই ভালো বলে না।আমারো নিজেকে ভালো লাগে না, বিশ্বাস করো মাঝে মাঝে খুব ঘেন্না ঘেন্না লাগে তখন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শুদ্ধ হতে চাই।
—তোমার কি জ্বর আয়না?
আয়না বাদশার কথা অগ্রাহ্য করে বললো,
—আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি জানো? সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন করে শুরু করবো ওই শান্ত মানুষটার সাথে সুন্দর একটা সংসার করব মানুষটার তো কোনো দোষ নেই, কিন্তু আমি পারি না ওই মানুষ টা আমার সবটা কথা শোনে কিন্তু আমার তাকে চাই না, আমার তোমাকে চাই যে আমার কথার পিঠে কথা বলে আমি একটা চড় মারলে যে আরেকটা ফিরিয়ে দেয় যে আমার উপর বিরক্ত হয়, বিরক্ত হয়ে কপাল কুচকে ফেলে,যার সাথে আমার ছোটবেলা থেকে ভাব যার সাথে আমার ভালোবাসা বিনিময় হয়েছে, যার সাথে কথা বলে আমি শয়ে শয়ে রাত পাড় করে ফেলেছি ক্লান্তহীন পায়ে খুব হেটেছি পাশাপাশি এক রিক্সায় বসেছি।এত স্মৃতি আমি কি করে ভুলি বলো তো?আচ্ছা আমরা কি খুব কথা বলে ফেলেছি? একসাথে অনেকটা হেটেছি? আমাদের বলতে সময়টুকু কি আমরা ফুরিয়ে ফেলেছি বাদশা?
বাদশা চুপ করে রইলো কিছু বলতে পারলো না,
—আমার বাবা বরাবরের ভালো ব্যাবসায়ী, সে খুব ভালো করেই তোমাকে আর ডাক্তার সাহেব কে তার কথায় কাবু করে ফেলেছে, আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি আমি কিন্তু সসর্বোচ্চ দিয়ে তোমায় পেতে চেয়েছি কিন্তু তুমি আমাকে চাওনি। আমি ডাক্তার সাহেবকেও বলেছিলাম আমি তোমাকে চাই তিনিও স্বার্থপর তিনি বাবাকে প্রতিদান দিতে চাইলেন ছোট থেকে মানুষ করার প্রতিদান,তুমি ভাবলে আমি ভালো থাকবো হয়তো অথচ কেউ আমার দিকটা দেখলো না, আমার বাবা শুধু নিজের দিক ভাবলেন তিনি দায়মুক্ত হতে আমার পা জড়িয়ে বললেন মরার আগে এটাই আমার তোর কাছে শেষ চাওয়া! অদ্ভুত! কি অদ্ভুত দুনিয়া।
—তোমার মনে হয় শরীর খারাপ করছে আয়না আমি কি একবার আবরার কে খবর দেব?
আয়না কঠিন চোখে চাইলো বাদশার দিকে, বাদশা দেখলো আয়নার চোখ লাল হয়ে আছে একজন অসুস্থ মানুষ যন্ত্রণায় অনেকদিন না ঘুমুতে পারলে যেরকম লাল হয় সেরকম অস্বাভাবিক লাল,আশ্চর্য ওর বাড়ির লোকজন কি তা খেয়াল করে নি!বাদশা এবার কপাল কুচকে হুড তুলে দিলো, আয়না কড়া গলায় বললো
—হুড তুললে কেন এক্ষুনি হুড নামাও তোমার সাথে আর এভাবে আমা হুড তোলা রিক্সায় চড়া মানায় না
—এত বেশি বুঝবা না আমার উপর দিয়ে, এখন কথা বললে কানের নিচে একটা থাপ্পড় খাবা, এই রোদে ঘুরলে তুমি জ্বর হয়ে মরবা। এখন বাসায় যাবা, কিছু খাবা তারপর ওষুধ খাবা, ঘুম দিবা এর মধ্যে একটা কথাও যদি এলোমেলো হয় তাহলে তুমি তো জানোই আমি কত খারাপ।
আয়না তাকিয়ে রইলো ওর সেই চিরপরিচিত রগচটা মানুষ টার দিকে ঠিক পাশেই মানুষ টা অথচ চাইলেই ছুয়ে দিতে পারছে না!
প্রহর আর কায়নাত আগের দিনের রেস্টুরেন্ট টা তেই এসেছে বসেছে, এইটা কায়নাতের ভার্সিটির পাশেই,দুজনেই চুপচাপ, নিরবতা ভেঙে প্রহর বললো,
—আপনি কি সন্ন্যাসিনী হতে চাচ্ছেন?
কায়নাত হাসলো কাচভাঙা শব্দে প্রহর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, কায়নাতের চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর পাতলা ঠোঁট মানানসই নাক সব মিমিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সুন্দর, কায়নাত হাসি চেপে বলল,
—চাই না তবে মনে হয় সেরকমই কিছু হবে,
—কেন?
—আপার জন্যে,
—আপনার আপার জন্যে কেন?
—আপা আমার ৩ বছরের বড়, আমার যখন এগারো বছর বয়স তখন মা মারা যান, আপা ছিলেন খুব আদুরে, অলস, অকর্মা অদ্ভুত ভাবে মা মারা যাবার পর আপা কর্মঠ হয়ে উঠলেন কেমন করে যেন সমান তালে সংসার পড়া লেখা বাবা আমাকে সব সামলে নিলেন। তখন ভাবতাম আপা এমন মনের জোর কোত্থেকে পায়! বুঝতাম না আড়াল থেকে তাকে সাহস যোগাতো একজন, পৃথিবী খুব নির্মম জানেন আমার আপার জন্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, যখন তার মায়ের আদরে বড় হওয়ার কথা ছিলো তখনই আমার জন্যে তাকে মা হয়ে উঠতে হয়েছে, তার একজন ভালোবাসার মানুষ ছিলো,
—ছিলো?
—শুনুন না,৯ মাস আগে বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে
—মাই গড!
— আহ! পাড়া প্রতিবেশীদের মত সিম্প্যেথী দেখাবেন না তো!
প্রহর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো এই মেয়েটার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে অথচ এর চোখে মুখে তার বিন্দু মাত্র শোক নেই!কায়নাত বলে চলল,
—বাবা একটা চাল চাললেন, বাদশা ভাই মানে যাকে আপা ভালোবাসেন সে রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত, যা বাবার খুবই অপছন্দ আপার সম্পর্ক টা জানার সাথে সাথেই বাবা আপাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করলেন, আমার দুলাভাই আবরার, কোনো সারনেম নেই, একজন ডাক্তার, চমৎকার মানুষ সে এতিম মানুষ বাবা তাকে পড়ালেখার খরচ দিয়ে বড় করেছেন,দুলাভাই এর কাছে প্রতিদান হিসেবে চাইলেন তার বড় মেয়ে কে বিয়ে করতে,আপা খুব লড়েছিলেন জানেন?বাদশা ভাইকে অনেক রিকুয়েস্ট করেছিলেন পালিয়ে যেতে, কিন্তু শেষ মুহুর্তে বাবা আপার পা জড়িয়ে ধরলেন কি সাংঘাতিক ভাবুন!ব্যাস কি থেকে কি হলো আপার বিয়ে হয়ে গেলো।আমার আপা সাংঘাতিক কঠিন মেয়ে বিয়ের পর একদিন ও তিনি দুলাভাই এর সাথে সংসার করেন নি, বিয়ে পড়ানো হলেই দুলাভাই এর সামনে গিয়ে বললেন, আপনি জানে আমি আপনাকে ভালোবাসি না আপনার সাথে সংসার করার প্রশ্নই ওঠে না আপনি আমার বাবার মেয়ে জামাই হয়েই থাকুন।বাবাকে বললেন বিয়ে করতে বলেছ বিয়ে করেছি এর বাইরে কোনো কথা বললে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবো, বাবা কখনো ভাবেন নি আপা এমন কিছু করবেন।আমি জানি আপা এমন কিছুই করবে না বাবাকে ভয় দেখানো আরকি,আপা এর পর খুব কঠিন হয়ে গেলো,হাসে না ঠিক মতো খায় না কাদেও না রোবটের মত জীবন যাপন করে।
প্রহর কায়নাতের দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা ছেলেমানুষের মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গল্প করার মতো করে বলে যাচ্ছে
—এই হচ্ছে কাহিনী আমার আপা যতদিন না স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন আমি ওই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না।
—তোমার আপা স্বাভাবিক হলে আসবে?
—কোথায় আসবো?
—আমাদের বাড়ি
কায়নাত মাথা নিচু করে ফেললো।
—হ্যালো সাহেব বলছেন?
—আপনি কে?
—আমি লিলি
—কে লিলি?
—আপনি খুব ভালো করেই জানেন কে লিলি, আমার মা মিলি কে না পেয়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমরা সবাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি আপনি কি দয়া করে মিলি কে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিতে পারেন? আমি কথা দিচ্ছি আমার বাবা আপনাদের বাড়িতে যাবেন।সংবাদ সম্মেলনও করবেন
—আপনার মা কোন হাসপাতালে আছেন?
—আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?শুনুন মিথ্যে কথা আমি কখনো বলি না আমার দেওয়া কথার ও কখনো খেলাফ হয় না আমি তো বললাম বাবা যাবেন
—আমি সে কথা বলি নি আমি মিলি কে নিয়ে আসছি সেখানে,
হাসপাতালের নাম বলে লিলি ফোন কেটে দিলো, সাহেব নিজের মনে একটু অনুশোচনা বোধ করে তারেক আর মিলি কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে লিলির ফোনে ফোন দিলো, ফোন রিসিভ হওয়ার আগেই ছোট্ট মিলি গিয়ে হালকা আলাশী রঙের জামা পড়া ছিপছিপে গড়নের উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙের একটা মেয়ে জড়িয়ে ধরলো,লিলি মিলি কে নিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেলো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেড়িয়ে এসে সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—আমি জানি রাজনীতি কোনো নিয়ম নিতী মেনে চলে না, তারপরও বলবো এতটা নিষ্ঠুর হবেন না যাতে মানুষ হিসেবে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের দিকেই না তাকাতে পারেন। আমার কথা রাখার জন্যে ধন্যবাদ।
সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—আপনার বাবা আমার ভাইয়ের নামে
লিলি হাতের ইশারায় সাহেব কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
—ওই যে দেখুন আমার বাবা শরিফুল ইসলাম এক নামে তাকে শহরে সবাই চেনেন অসহায় হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন, তার নীতিহীনতার জন্যে আমরা পরিবারের কেউ তার সাথে কথা বলি না, আশা করছি আপনার পরিবারের সামনে আপনি মাথা উচু করে দাড়াতে পারবেন।
সাহেব এবার ভালো করে মেয়েটিকে খেয়াল করলো খুব সাধারণ ধাচের মেয়েটি লম্বা চুল একটা বেনী করে সামনে একপাশে করে রেখেছে মেয়েটির চোখ দুটি অসম্ভব সুন্দর যেন পুরো পদ্মবিল! মায়ের এমন কঠিন অবস্থায় ও মেয়েটি কেমন শক্ত!সাহেব মেয়েদের ঠিক বুঝে ওঠে না তারা এত বিচিত্র কেন!
—আমি দুঃখিত মিস লিলি
—যদি মন থেকে অনুশোচনা করে থাকেন তাহলে ক্ষমা আপনি পেয়ে গেছেন আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে আমি নিজে বাবাকে নিয়ে আপনাদের বাসায় যাবো।
—আপনাদের আসতে হবে না
—অবশ্যই হবে লিলি কথা দিয়ে কথা রাখে,আজকের মতো আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না
বলেই লিলি আবার কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলো, সাহেব হাসপাতালের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো তারেক বলল,
—বাড়ি যাবি না?
—তুই চলে যা
—আর তুই?
সাহেব আর কোনো কথা বলল না তারেক জানে আর কোনো কথা সে বলবেও না।সাহেব গেলো না সে হাসপাতালে বসে রইলো সন্ধ্যা পর্যন্ত, যখন পর্যন্ত লিলির মা পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত না হলো।
চলবে…
সামিয়া খান মায়া