খেলাঘর১৩

0
345

#খেলাঘর১৩

—আমি আপনাকে অনেক টেনশনে ফেলে দিয়েছি তাই না সাহেব?
সাহেব কিছু বললো না ও সরু দৃষ্টিতে আশে পাশে দেখছে,
—আপনি চাইলে একটা সিগারেট জ্বালাতে পারেন আমার কোনো অসুবিধা নেই।
সাহেব লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,
—তুমি অনেক বুদ্ধিমতি লিলি
লিলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—মেয়েদের বেশি বুদ্ধিমতী হতে নেই,বুদ্ধিমতি মেয়েদের সংসার হয় না।বোকা মেয়েরা ভালো থাকে, তাদের এত ভাবনা নেই।
—আমার কিন্ত তা মনে হয় না,আমার মনে হয় মানুষ বুদ্ধিমতি মানুষের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করে এই যে দেখো আমার বাবা সে ঘন্টার পর ঘন্টা তোমার সাথে আলাপ করে এমন অনেক রাজনৈতিক কথা আছে যা সে তোমার থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আজকাল আমাদের জানান।আমার মা একজন বোকা ধরণের মহিলা তার ওতো চিন্তা নেই, কিন্তু আমি বুঝি বাবার দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে মানুষ কাউকে চায় যার সাথে সমস্ত কিছু আলোচনা করা যায়,
—আপনার মায়ের অনেক সুন্দর একটা সংসার আছে।
সাহেব দক্ষ হাতে সিগারেট জ্বালালো, লম্বা করে একটা টান দিয়ে বলল,
—আমার মায়ের সুন্দর সংসার সাজিয়ে ঠিক পাশের বালিশে বাবা দুশ্চিন্তায় রাত জাগে,মা ঠিকই ৯ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে আব্বা হাসফাস করে,মা বুঝতেই পারে না।
লিলি একবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
—আজকে দুটো বাইক বেশি মনে হচ্ছে, রোজ আমি ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে যে বাইকগুলো আমায় পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় তাদের মধ্যে তো এরা থাকে না, আর তারা মাথায় হেলমেট ও পড়েন না।
সাহেব সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে,ঠোঁটে একটা বাকা হাসি ঝুলিয়ে মনে মনে বললো,তুমি আসলেই খুব বুদ্ধিমতী লিলি।
—আপনাকে আর আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করতে হবে না আমি কাল থেকে আপনার সাথেই গাড়িতে আসব
—তুমি কি ভয় পাচ্ছো লিলি?
লিলি একটু অসহায় ভাবে সাহেবের দিকে তাকালো,সাহেব লিলির দিকে না তাকিয়েই বললো,
—ভয় পেলে তোমাকে একদম ছোটমানুষের মত লাগে।বুদ্ধিমতীরা তো ভয় পেলে বুঝতে দেয় না

সাহেব দ্রুত রিক্সার হুড তুলে দিয়ে, পকেট থেকে ফোন বের করে বললো,
—গাড়ি নিয়ে আয় রিক্সার কাছে ফাস্ট।
সঙ্গে সঙ্গেই বাইক দুটো ওদের রিক্সা ঘিরে দাড়ালো আর তার সাথে সাথেই একটা প্রাইভেট কার এসে পাশে থামলো।সাথে আরো সাত আট টা বাইক।হেলমেট পড়া লোক দুটো সঙ্গে সঙ্গে দুটো আলাদা রাস্তায় বাইক নিয়ে চলে গেলো।রিক্সাওয়ালা খানিক ভড়কে গেছে দরদর করে ঘামছে, সাহেব রিক্সা থেলে নেমে হেসে,তার দিকে পাচশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো
—এইটা রাখুন।ভয় নেই চাচা, লিলি এসো।
লিলির অল্প সময় লাগলো নিজেকে সামলে নিতে।ও রিক্সা থেকে নেমে গাড়িতে উঠলো।তারপর থেকে মাথা নিচু করে রইলো আর কথা বললো না।
তারেক ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে পেছনে সাহেব লিলি,তারেক লিলিকে স্বাভাবিক করতে বলল,
—লিলি! ভয় পেয়েছো নাকি! আমি তো জানতাম লিলি খুব সাহসী!
লিলি জানালার কাচে চোখ রাখলো, ও আসলেই ভয় পেয়েছে, ওর জেদের জন্যেই সাহেব ওর সাথে রিক্সায় এসেছে আজ যদি ওর জন্যে সাহেবের কোনো ক্ষতি হতো ও সাহেবের বাবা মায়ের কাছে কি বলতো!তারেক জবাব না পেয়ে আয়নায় সাহেবের দিকে তাকালো,
—লিলি তুমি শুধু শুধু ভাবছো,ওরা আমাদের ভয় দেখাতেই এসেছিলো,ক্ষতি করার হলে সাথে আরো কেউ থাকতো,
লিলি কিছুই বলল না বাইরে তাকিয়ে রইলো।

বাদশা একটা কাজে নিউমার্কেটের দিকে এসেছিলো, কিছু লোকের সাথে দেখা করার ছিলো এখন ক্ষমতা হাতে দলে দলে লোক আসছে দেখা সাক্ষাৎ করতে বাদশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, সব দুধের মাছি।নিউ মার্কেটের পাশেই লেক বাদশা বাইক থামিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ দাড়ালো,একসময় প্রায় প্রতিদিন এখানে আসা হতো আয়নার সাথে, এই খানেই দাড়িয়ে আয়না বাদশা কে বলেছিলো তুমি আমার ম্যাজিশিয়ান। বাদশা কিছুক্ষণ বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে অতীত আওড়ালো, ওর কষ্ট হয় না এমন না কিন্তু ও একটুও দুর্বল হলে আয়নাকে সামলানো যাবে না ওকে কঠিন হতে হবে আরো অনেক কঠিন আয়না একটা চমৎকার মেয়ে ওর লাইফে কোনো ম্যাজিশিয়ানের দরকার নেই ও নিজেই একটা ম্যাজিক।বাদশা ফিরেই আসছিলো কি মনে করে আবার ঘাটের দিকে নামলো ও অবাক হয়ে গেলো সেখানে আয়না বসে কাদছে!ওর এক মুহুর্তের জন্যে মনে হলো ও ভুল দেখছে রাস্তায় বসে কাদার মেয়ে আয়না নয় কিন্তু ওর ভুল ভাঙলো কাছে গিয়ে বুঝলো ওটা আয়নাই।বাদশা ধমকের সুরে ডেকে উঠলো
—আয়না!এখানে কি করো অফিস নেই তোমার!
আয়না কিছুক্ষণ বাদশার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার আগের মতোই কাদতে লাগলো।বাদশা অবাক হয়ে পাশে বসলো।নরম সুরে বললো
—হেই ম্যাজিক মিরর কাদছ কেন!
বাদশা নিজেই কিছুটা লজ্জা পেলো এখন কি আর এই নামে আয়নাকে ওর ডাকা চলে?তবে আয়না হয়তো খেয়াল করে নি বাদশা তাকে ম্যাজিক মিরর ডেকেছে, আয়না কান্না মাখা কণ্ঠে অস্পষ্ট করে বলল,
—সে চলে গেছে, আমি কোথাও তাকে খুজে পাচ্ছি না, হসপিটালে তার বাসায় কোথাও না
বাদশা ভ্রু কুচকে বলল,
—কে চলে গেছে আয়না?
—ডাক্তার সাহেব… সে চলে গেছে। আমি হেরে যাই বারবার আমিই হারিয়ে ফেলি কাউকে ধরে রাখতে পারি না, তোমাকে পারি নি, বাবাকে পারি নি তাকেও না…
বাদশা একটু সময় চুপ রইলো,সে ভেবেছিলো আয়না তার জন্যে কাদছিলো, যদিও সে চায় আয়না আবরারের সাথে ভালো থাকুক তবুও আয়নার এই চোখের পানি যে আবরারের জন্যে এটা শোনার পর তার বুকের ভেতর কোথাও একটা ব্যাথা করে উঠলো, আমরা মানুষ খুব অদ্ভুত আমরা চাই কিছু মানুষ শুধু আমাদের জন্যেইই অপেক্ষা করুক।বাদশা মৃদু হেসে বলল,
—তুমি তাকে খুজছো কেন আয়না?
আয়না এবার বাদশার দিকে তাকালো,বাদশার মনে হলো আয়নার তাকানোর ভঙ্গি অস্বাভাবিক, মেয়েটা কি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে! তারা সবাই আয়নাকে ভালো রাখতে গিয়ে কি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে!সে আয়নার মাথায় হাত রেখে বললো,
—আমি আবরার কে খুজে দেব তোমার জন্যে
আয়না ভরসা পেলো সে জানে বাদশা যখন বলেছে তার মানে সে ঠিক খুজে দেবে,
—তুমি আবার আমার ম্যাজিশিয়ান হবে!?
—হ্যা আরেকবার শেষবার।
আয়না খুশি হলো…তার মনে হলো তার আর কোনো চিন্তা নেই।
লিলিরা গাড়ি থেকে নামতেই কায়নাতের সাথে দেখা মুহুর্তেই সে স্বাভাবিক হয়ে কায়নাতের সাথে কথা বলতে লাগলো তারেক আর সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,সাহেব একটু দূরে গিয়ে সিগারেট জ্বালালো। কায়নাত আজকাল অনেক শান্ত হয়ে গেছে আগের চঞ্চলতা নেই,তারেক টিটকারি মেরে বলল,
—বিয়ের পর তুই মোটা হয়ে গেছস
—হ্যা আর তোর বন্ধু চিকন, এইই সাহেব ওইদিকে দাড়াইলি ক্যান তুই, তোরে কি লিলি খাইতে দেয় না ঘরের কাজ করায়? তুই শুকায় গেছস ক্যান!
তারেক আর সাহেব একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো তারেক বিড়বিড় করে বলল,
—খালি ওরে না আমারে সহ করায়।
লিলি মিটিমিটি হেসে বলল,
—আরে না আপু পড়ালেখা করছে তো আজকাল দেখবে এবার উনারা দুজন কিন্তু তোমাকে টপকে যাবে,
কায়নাত খিলখিল করে হাসলো হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি চলে এলো ওর হাসি থামিয়ে মনে হলো কতদিন পর ও প্রাণ খুলে হাসলো! তারেক আর সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,আর লিলিও, লিলির মনে হলো অনেক কষ্ট লুকিয়ে হাসলে মানুষ এভাবে হাসে।
—সরি, সরি না মানে অহংকার করছি না কিন্তু এই দুইটা তো পাশ নিয়েই টানাটানি লাগায় আর তো
কায়নাত কথা শেষ করতে না পেরে আবার হাসলো, তারপর বললো,
—তবে লিলি তোমার ক্ষমতা আছে, তুমি পলেটিশিয়ান সাহেব চৌধুরী কে স্টুডেন্ট এর আওতায় আনতে পেরেছো,কিন্তু লিলি এরা বরং নিজের যোগ্যতায় পাশ করলেই তুমি খুশি হয়ে যেও এর বেশি আশা করলে কিন্তু কষ্ট পাইবা।
নিতান্তই মজার ছলে কায়নাত কথাগুলো বলল, তারেকও অন্য কথায় কায়নাতকে কথা শোনালো কিন্তু লিলির মনটাই খারাপ হয়ে গেলো,সে মৃদু হেসে বলল,
—আমি আসি আপু আমার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে
তারেক বলল,
—সাহেব আমি আর কায়নাত ক্লাসে যাই তুই ওরে আগায় দিয়ে আয়
—আমি পারব তারেক ভাই,
সাহেব সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল,
—আমি যাচ্ছি
লিলি শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
—আমি ঠিক পারবো,আপনাদেরও ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে প্লিজ আপনারাও ক্লাসে যান।
বলেই লিলি চলে গেলো,সাহেব লিলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো,কায়নাত হাসি থামিয়ে বলল,
—সাহেব আজকে ক্লাসের পর কি তুই ফ্রি থাকবি? তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে তোর তো দেখাই পাওয়া যায় না।
তারেক আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—তুই দেখতে চেয়েছিলি নাকি? আর ভাই এখন ওর বিয়ে শাদী হয়ে গেছে আমিই তো ওর দেখা পাই না, শালা বেদম পড়ালেখা করে,
—তাই নাকিরে সাহেব! তুই কি পড়ালেখা নিয়ে সত্যি সিরিয়াস হয়ে গেলি?
সাহেব কায়নাতের চুল টেনে দৌড় মেরে বলল,
—বি কেয়ারফুল সাহেব চৌধুরী কোনো কিছুতে সিরিয়াস মানে সেখানে তার চেয়ে সেরা আর কেউ নেই।
কায়নাত সাহেব কে তাড়া করে বলল,
—তুই আবার আমার চুল আউলায় দিছস কুত্তা

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here