#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১১।।
মাথায় রীতিমতো আগুন জ্বলছে আফসানার। শুরু থেকেই উদয়ের দিকে সন্দেহ ছিল তার, যখন ফোন আর ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা ওকে দেয়নি সে।
কিন্তু তাই বলে এত বড় প্রতারণা! এ তো পুরো দস্তুর চিটিং।
লাঞ্চের সময় ইমিডিয়েট বস ইমতিয়াজ ভাইকে জরুরি কাজের কথা বলে হাফ বেলা ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, বলেছিল আজ আর ফিরবে না অফিসে।
সাড়ে চারটার দিকে আফসানাকে হন হন করে অফিসে ঢুকতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন ইমতিয়াজ ভাই।
“তুমি? বলছিলে যে আজ আর ফিরবা না!”
“না, ইমতিয়াজ ভাই, কেমন গিল্টি ফিলিং হচ্ছিল আমার! পরশু দিন ভিজিট করতে আসবে, এই সময় আমার থাকাটা জরুরি! তাছাড়া কাজটাও হয়ে গেল আমার!”
কপালে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বলল আফসানা।
“বাহ, বাহ, খুব ভালো। তোমাদের মতো সিনসিয়ার ইয়াং ব্লাডই তো দরকার আমাদের!”
খুশি হলেন ইমতিয়াজ ভাই।
“তবে, খুব বেশি কষ্ট বোধ হয় করতে হবে না তোমাকে। উদয় বোধ হয় অনেকখানিই করে রেখে গেছে। কাল এসে দেখবে।“
উদয়ের নাম শুনেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠল আফসানার। আর একই সাথে মাথায় খেলে গেল একটা ভয়ানক কুবুদ্ধি।
“ঠিক আছে, ইমতিয়াজ ভাই, আমি ডেস্কে যাচ্ছি তাহলে।“
পাঁচটার পর যখন একে একে খালি হতে শুরু করল অফিস, আফসানা তখন কিচেনে গেল চা বানাতে। কড়া লিকারের এক কাপ চা নিয়ে যখন আয়েশ করে নিজের ডেস্কে বসে চুমুক দিচ্ছিল আফসানা তখন এসে উঁকি দিলো পিয়া, ওদের আরেক কলিগ।
“কী রে যাবি না? সোয়া পাঁচটা বাজে!”
“তুই যা, আমার একটু পেণ্ডিং কাজ আছে!”
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল পিয়া। আরো মিনিট দশেক অপেক্ষা করল আফসানা।
তারপর লাফিয়ে উঠে গিয়ে বসল উদয়ের ডেস্কে। একই রুমে কাছাকাছি কিউবিকলে বসে ওরা।
ফোন আর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড না জানলেও উদয়ের ডেস্কটপের পাসওয়ার্ড ওর জানা, দেখে রেখেছিল। পরশু দিনের প্রেজেন্টেশন কোথায় রেখেছে সবই জানে আফসানা।
একই টিমের হওয়াতে ওকে দেখিয়ে দেখিয়েই সেভ করেছিল উদয়। সবগুলো একে একে ডিলিট করল আফসানা।
সব শেষে সেন্ট মেইলে গিয়ে সেখান থেকেও প্রেজেন্টেশনটা ডিলিট করে দিলো সে। ব্যাক আপ রাখার জন্য সব জিনিস নিজের একটা ব্যাক আপ মেইলে যেটার পাসওয়ার্ড ভুলে গেছে পাঠিয়ে রাখে উদয়।
মেইলে সাইন ইন করাই ছিল। ব্যস, এবার নিশ্চিন্ত।
কিছু ক্ষণ রিভলভিং চেয়ারে দুলে দুলে হাসলো ও। এবার মজা টের পাবে বাছা ধন।
কালকে এক দিনের মধ্যে এত কিছু কীভাবে রেডি করবে দেখা যাবে। একদম উচিত শিক্ষা হয়ে যাবে ওর।
“ম্যাডাম, যাইবেন না?’
লাফিয়ে উঠল আফসানা। ঝাড়ু দিতে দিতে প্রশ্নটা করেছে পিয়ন আক্কাস আলী।
“হ্যাঁ যাচ্ছি।“ এ কথা বলেও সাথে সাথে উঠল না আফসানা।
অপেক্ষা করল কিছু ক্ষণ। আক্কাস আলী সরে গেলে উদয়ের ডেস্কটপ শাট ডাউন করে সুন্দর করে আবার সব গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখল, যাতে দেখে কিছু বোঝা না যায়।
তারপর ব্যাগ তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল গট গট করে।
আশিকের মেইলে একটা মেসেজ এসেছে। সিগমা এড ফার্মের হিউম্যান রিসোর্স থেকে তাকে জানানো হচ্ছে যে প্রোগ্রামার পোস্টের জন্য তাকে নির্বাচন করা হয়েছে।
ছয় মাসের ট্রেনিং পিরিয়ডে বেতন উনত্রিশ হাজার টাকা। ছয় মাস পর চাকরি স্থায়ী হলে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা সাথে বছরে দুটো ফেস্টিভাল বোনাস।
রাজি থাকলে তাকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ নিম্নলিখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এক মাসের নোটিশে যে কোনো পক্ষ তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে।
এটা যে একটা এপয়েন্টমেন্ট লেটার সেটা বুঝতে বেশ কয়েক বার পড়তে হলো আশিকের। চতুর্থ বার পড়ার সময় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মামি।
“কানে কি তুলা দিছ নাকি? ডাকছি কখন থেকে শুনতে পাচ্ছ না?”
ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলল আশিক। ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
আচ্ছা এটা কোনো ট্র্যাপ নয় তো? দেখা গেল সে চাকরিতে যোগ দান করতে যাবে আর তাকে বলা হবে জামানত হিসাবে দুই লাখ টাকা জমা দেন।
“ক্যান্টিন থেকে দুই লিটার পানির বোতল নিয়ে আসো একটা। তাড়াতাড়ি আসবা, আবার বিড়ি খেতে দাঁড়াইয়া পড়বা না কোথাও! আর ভাঙতি টাকা গুনে আনবা।“
আশিকের একবার ইচ্ছে হলো বলে, “আমি যে বিড়ি খাই না এটা আপনি ভালো করেই জানেন মামি!” কিন্তু সে বলল না কিছু।
লিফটের সামনে ভিড় অনেক, লাইনে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল আশিক। নামতে নামতে কল করল সুজনকে।
আশিকের সাথে কারো খুব ভালো বন্ধুত্ব না হলেও সুজন কীভাবে কীভাবে যেন টিকে গেছে। আশিকের ভরসার মানুষ সুজন।
“হ্যাঁ দোস্ত বল।“
“আচ্ছা সিগমা এড ফার্ম থেকে একটা মেইল আসছে আমার কাছে, একটু আগে দেখলাম। তুই কি জানিস এটা কী?”
“আরে গত মাসে এটার ইন্টারভিউ দিতে গেলাম না আমরা? গাধা নাকি তুই? অবশ্য গাধা না হলে কি আর এই অবস্থা হয়?”
খোঁচাটা গায়ে মাখল না আশিক, “কী করব এখন?”
“কী আর করবি, জয়েন করবি! আর ওই বাসা থেকে বের হয়ে আসবি! আর আসার আগে অবশ্যই অবশ্যই ওই বাসার গেটের সামনে হেগে দিয়ে আসবি। পারবি না?”
আশিক হেসে ফেলল। রেগে গেল সুজন।
“হাসতেছিস কেন গাধার বাচ্চা? বল হাসতেছিস কেন? সারা জীবন তোর মামাতো বোনের টানে ওই বাসায় থাকবি তুই?”
হাসতে হাসতেই বলল আশিক, “এমনিই! আচ্ছা ফোন রাখি আমি।“
“ট্রিট দিবি কবে?”
“আগে জয়েন তো করি!”
“আচ্ছা জানাইস!”
ফোন রেখে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল আশিক। সুজনকে বলা হয়নি, জিনিয়া বিয়ে করে ফেলেছে।
বর নাকি তার ছোট বেলার বন্ধু। এটাই ভালো হলো হয়ত।
আশিক যখন ফিরল জেসমিন তখন বাইরে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসা। তার সামনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া।
উদয়কে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
আশিককে দেখা মাত্র ঝাঁঝিয়ে উঠলেন জেসমিন, “এক বোতল পানি আনতে এতক্ষণ লাগল? মনে তো হচ্ছে দুনিয়ার বাজার করতে দিছি! এই সময়ে মাছের বাজারে গিয়ে মাছ কিনে নিয়ে আসা যায়! ভাদাইম্যা একটা! চেহারা দেখতে ইচ্ছা করে না!”
আশিকের কী হলো কী জানে, শান্ত গলায় বলল, “আগামী মাস থেকে আমার চেহারা আর দেখতে হবে না মামি!”
কথাটার গুরুত্ব না দিয়ে বললেন জেসমিন, “কেন, তোমার কোন বাপের তালুক পাওয়া যাবে আগামী মাসে?”
জিনিয়া প্রতিবাদ করে বলল, “আহ আম্মু, কাকে কী বলতেছ? আমার সাথে রাগ তুমি আশিক ভাইয়ের সাথে ঝাড়তেছ কেন?”
“আর একটা কথাও বলবি না তুই! বিদায় হ আমার চোখের সামনে থেকে! আশিক এরে নিয়ে বাসায় যাও!”
জিনিয়া যেন তৈরিই ছিল। বলার সাথে সাথেই রওনা হলো লিফটের দিকে।
আশিক মৃদু স্বরে বলল, “বাসা থেকে কিছু আনতে হবে আপনার জন্য?”
“না এখন কিছু লাগবে না আমার। পরে মনে পড়লে ফোন করব।“
নিচে নেমে জিনিয়ার পাশে হাঁটতে হাঁটতে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল আশিক, “তারপর? জামাই কী করে?”
জিনিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, “আপনিও বিশ্বাস করছেন এইটা?”
“মানে?”
জিনিয়া হাত নেড়ে বলল, “আরে জামাই টামাই কিছু না! ও তো আমার ফ্রেণ্ড! আমরা এক সাথে খেলতাম ছোট বেলায়!”
“ও আচ্ছা তাই নাকি?” আশিকের বুকের ওপর থেকে একটা চাপ সরে গেল যেন।
“হ্যাঁ তাই!”
“কোথায় ছিলা কাল রাতে?”
“ছিলাম তো ওদের বাসাতেই! কিন্তু এত্ত এত্ত এডভেঞ্চার হইছে কাল রাতে! আপনি যদি কাউকে না বলেন তাহলে বলব আপনাকে! কিন্তু আগে প্রমিস করেন বলবেন না কাউকে? এই সব কিন্তু টপ সিক্রেট!”
“ঠিক আছে, তুমি আগে বল তারপর আমিও তোমাকে বলব আমার একটা সিক্রেট!”
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)