#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি
#পর্ব_৪
অফিসে বলে পূর্ণাকে নিয়ে বাসায় আসে আশিক। অফিসে ভালোই একটা তামাশা হলো। স্যারের কাছে যখন জরুরি প্রয়োজনে বাসায় যেতে হচ্ছে বলতে যায় আশিক, তখন এইচআর অফিসার নিয়াজ আহমেদ আশিককে বলেন,
“আশিক, বাসায় যেতে চাইছো যাও। তবে ঘরের সমস্যা ঘরেই সমাধানের চেষ্টা করো। বাসাবাড়ির সমস্যা অফিসে টেনে আনলে তো হলো না।”
“স্যার, আই এম রিয়েলি স্যরি স্যার। আর কখনোই এমন হবে না। পূর্ণা একটু অসুস্থ স্যার।”
“তোমার ওয়াইফ অসুস্থ, না তুমি পরকীয়া আসক্ত। এগুলো তোমার পার্সোনাল বিষয়। অফিসের কাজে তোমার পার্সোনাল বিষয় কোন ব্যাঘাত ঘটালে অফিসও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিবে। আর তাছাড়া এসব কোন ভালো উদাহরণ নয়। তোমাকে সবাই একজন দক্ষ, স্মার্ট ছেলে হিসেবে জানে। বৌ থাকার পরও এসব বান্ধবী রাখা তোমার সাথে মানায় না। ভালোও না।”
“স্যার বিশ্বাস করেন, এসব ভুল বোঝাবুঝি। লারা আমার শুধুই বন্ধু।”
“বন্ধু হলেই ভালো। বান্ধবী হলেও তোমার ব্যাপার। কিন্তু এই যে তোমার বৌ আর বান্ধবী মিলে অফিসে সিনক্রিয়েট করলো, সেটা কিন্তু ভালো ব্যাপার না। এমনিতেই তোমার ওয়াইফ নাকি রিসেপশনে যখন তখন ফোন করে তুমি কোথায় আছ জানতে চায়। হুটহাট অফিস চলে আসে। এগুলো কিন্তু কাজের পরিবেশ নষ্ট করে। সবসময় ওয়াইফ অসুস্থ বলে পাশ কাটানো যায় না। আগুন না লাগলে ধোঁয়াও ছড়ায় না। যা রটে কিছুটাতো বটেই। তোমার বান্ধবী নাকি স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছে। তুমিও নাকি তোমার স্ত্রীকে ছাড়ছো! বিয়ে হলো কয়দিন। এখনই এসব!”
এত ছোটো আশিক জীবনেও হয়নি। বুঝতেই পারছে অফিসে ওর চরিত্র নিয়ে কানাঘুঁষা হচ্ছে।
গাড়িতে বসে একটা কথাও বলেনি পূর্ণার সাথে। না রাগরাগি না অভিমানের কথা। গত কয়েকমাসে অভিমান, বিরক্তিতে টুকটাক তর্কে জড়ালেও আজ যেন সমস্ত কথা শেষ হয়ে গিয়েছে। বাবা মা না থাকার জন্য একাকিত্বের কষ্টটাও মনে হয় এই তীব্র অপমানের জ্বালার মতো ছিল না। এখন কষ্টের সাথে সাথে মনটাও কেমন তিতা হয়ে আছে। বিতৃষ্ণা লাগছে পাশে বসে থাকা রমণীকে। পূর্ণার ভালোবাসার নাগপাশে হাসফাঁস লাগছে।
“আশিক, অফিসে সমস্যা হয়েছে? তোমাকে খারাপ কিছু বললে চুপ করে শুনবা না। চাকরি করতে তো তুমি বাধ্য না। চাকরি ছেড়ে দাও। আশিক?”
“পূর্ণা, আমাকে মাফ করা যায় না? প্লিজ। আমাকে একটু চুপ করে বসে থাকতে দাও।”
“তুমি আমার উপর রেগে আছ? আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে? আমি যদি আমার পুরানো প্রেমিকের সাথে এভাবে ধরা পড়তাম? অথচ আমি এখনো আমাদের ঘর বাঁচাতে চাইছি।”
“ফর গড সেক পূর্ণা! লারা আমার পুরানো, নতুন কোন প্রেমিকা না। তুমি যে একটা মানসিক সমস্যায় ভুগছো এটা বুঝতে পারছো না! আমি চাকরি ছেড়ে দেব? কেন ছেড়ে দেব? যেন তুমি আমাকে বাসায় বন্দী করে ফেলতে পারো! আমি একজন সুস্থ সবল শিক্ষিত পুরুষ পূর্ণা। আমাকে এভাবে অপদস্ত করে, গৃহবন্দী করে ফেলে তোমার কি লাভ হবে? আমাকে একক ভাবে পাবে এমনটা ভাবছো? ভুল।
বরং তখন আমি নিজেও তোমার মতো মানসিক রোগী হয়ে যাব। কাউকে ভালোবাসার মানে তাকে এভাবে নজরবন্দী করে ফেলা না। কিন্তু এসব কিছুই তোমার মাথায় ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে না। তুমি নিজের একটা ইলিউশনের জগতে বাস করছো।”
“আশিক, আই অ্যাম স্যরি। আমি আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি তাই না। আর করবো না এমন। তুমি এমন কঠিন কঠিন কথা বলো না প্লিজ।”
আশিক কিছু না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণা কাঁদতে থাকে। পূর্ণার কান্না দেখে আশিকের কেন জানি আরও বেশি বিরক্ত লাগে। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এখন না বাসায় গিয়ে শাশুড়ির সামনে গিয়ে বলবে ঠিক করে।
ড্রয়িং রুমে শাশুড়ি আর শ্যালিকা বসে আছে। পূর্ণা থেকে থেকে কেঁদেই চলেছে। আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে তা এখন বুঝতে পারছে। কিন্তু আশিক এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে এটা সে কোনদিন ভাবেনি। আশিক কাপড় গুছিয়ে ব্যাগটা এনে রাখতেই হাসনা হেনা বেগম হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসেন।
“বাবা তুমি আমার ছেলের মতো তাই বলছি, পূর্ণা ভুল করেছে, বাড়াবাড়ি করেছে তা ঠিক। কিন্তু তুমিও কেনো বিয়ের পর অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখবে?
পূর্ণা কোন দিকটা খেয়াল রাখে না তোমার। তাও বারবার মেয়েটাকে কষ্ট দাও।”
শাশুড়িকে মায়ের মতোই সম্মান করে আশিক। নিজের পঙ্গুত্ব আর স্বামীর মৃত্যু ওনাকে অনেক ভেঙে দিয়েছে বোঝে আশিক। এর আগে যেবার পূর্ণা ঘুমের ঔষধ খেয়েছিল, মেয়ের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আশিকের কাছে কথা আদায় করেছিলেন যে আশিক পূর্ণার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবে। আশিক চেষ্টাও করেছে। কিন্তু দিনদিন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
“আম্মু, আমার কারও সাথে কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই। আর কোনদিন এসব সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবতেও পারি না। এই বিশ্বাসটা কি আপনার আর পূর্ণার আমার উপর রাখা উচিত না? অফিসের কলিগ থেকে শুরু করে শ্যালিকা, চাচাচো বোন থেকে শুরু করে ঘরের কাজের সহকারী, সবাইকে নিয়ে পূর্ণা ইনসিকিউরড। এমনকি কোন ছেলেবন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়া, ফোনে কথা বলা পর্যন্ত পূর্ণা সহ্য করতে পারে না। বিয়ের পর আমার সমস্ত স্বাধীনসত্ত্বা কি আমি হারিয়ে ফেলেছি?”
হাসনা হেনা বেগম চুপ করে থাকেন। মেয়ের এই অতিরিক্ত পাগলামির কারণ তিনি জানেন, কিন্তু জামাইয়ের সামনে তা বলতে বাঁধে।
“আম্মু পূর্ণা আমার সর্বোচ্চ খেয়াল রাখে, ওকে নিয়ে আমার অন্য কোন অভিযোগ নেই। সত্যি বলছি আমার জীবনে ও ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। কিন্তু এই সন্দেহবাতিক মনোভাব, আর নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার মানসিকতা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে ফোনে কথা বলতে গেলেও পূর্ণা চেক করে। আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড নিয়ে অসংখ্য বন্ধু বান্ধবকে আনফ্রেন্ড করেছে। এসব কিছু আমি মেনে নিলেও আজকের বিষয়টার পর আমি আর নিতে পারছি না। ভাবতে পারছেন আমি অফিসে মুখ দেখাবো কী করে? আমি আসি। প্লিজ আম্মু আমাকে থাকার জন্য জোর করবেন না। একটা বিরতি প্রয়োজন আমার।”
পূর্ণাকে রেখেই আশিক বের হয়ে আসে। মনটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কী হতো পূর্ণা যদি একটু স্বাভাবিক হতো!
তার জীবনে ভালোবাসা এসেও কেনো হারিয়ে যায় বারবার। পূর্ণাকে পেয়ে তো সে সুখী ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন এই পাগলামিও তো মেনে নেওয়া যায় না। আপাততঃ হোটেলে ওঠে আশিক। বাসা খুঁজবে, না মেসে উঠবে ঠিক করতে পারেনি। অফিস থেকে তিনদিন ছুটি নিয়েছে। কলিগদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না।
(চলবে)