#সুখের_খোঁজে পর্ব ৪

0
205

#সুখের_খোঁজে৪

(বড় গল্প)

পর্ব ৪

ভীষণ রকম ঘাড় ও মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে আমার। ঘুম ভাঙে না বলে বোধহয় জ্ঞান ফেরে বলা উচিত। সাথে সাথেই মনে পরে সীমাহীন রাগে কি ভীষণ ক্ষিপ্রতায় আমার মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিয়েছিল শহীদ। অন্ধকার ঘরে দেয়াল হাতড়ে উঠে দাঁড়াতেই দরজা খোলার শব্দ। শহীদ ফিরে এসেছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখের ওপর ছুঁড়ে মারে কয়েক টুকরো কাগজ। তুলে দেখি দেশে ফেরার আমার নামে করা টিকিট, আগামী পরশু ফ্লাইট।

সারারাত শহীদের পা ধরে বসে থাকি। আমার মালয়েশিয়ান বন্ধু মাঝে মাঝে তার বাচ্চাদের রাখার জন্য আমাকে কিছু টাকা দেয়। আমি নিতে না চাইলে বোঝায় দেশে আমার বোনকে পাঠিয়ে দিতে। সেই টাকাই আমি পাঠিয়েছি সেটা যে কতবার বলি তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। এমনকি বাক্সে জমানো বাজারের উদ্বৃত্ত পয়সাগুলোও দেখাই। না মন গলেনি তাতেও শহীদের। কি জানি নিজের জেদ ওপরে রাখতে নাকি আমাকে এক জীবনের তরে পরাস্ত করতে তার এমন সিদ্ধান্ত ছিল তা আমার কাছে আজো পরিস্কার না।

দুদিন পরে আমাকে দুবাই এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে শহীদ চলে যায়। এই দুদিনে আমাদের কোন কথাবার্তাই হয়না বলতে গেলে। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে প্লেনের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আমার শুধু মনে হচ্ছিলো জীবন আমাকে নিয়ে আর কত খেলা বাদ রেখেছে? কি এক অনিশ্চিত জীবনের পথে হাঁটতে যাচ্ছি সামনে। এমনকি আমাকে কেউ এয়ারপোর্টে নিতে আসবে কি না তাও জানিনা। কত শত প্ল্যান যে করে ফেললাম, কত যে দিবাস্বপ্নও দেখে ফেললাম পুরোটা পথে। স্বপ্নগুলোর সিংহভাগই ছিল শহীদ ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে। আমি আবার দুবাই ফিরে গিয়েছি। প্লেনের চাকা বাংলাদেশ বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোঁয়ার সাথে সাথে অপমৃত্যু হয় আমার সব দিবাস্বপ্নের। যা ভেবেছিলাম তাই, কেউ আসেনি আমায় নিতে। অর্থাৎ শহীদ কাউকে কিছু বলেনি।

শহীদের ছেলেদুটো আমাকে বিয়ের প্রথম থেকেই মেনে নেয়নি। আর এখন একাকী ঐ বাসায় উপস্থিত হওয়ার ফলে কি অপমান সইতে হয় তা ভেবে মামার বাসাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমার নিজের জন্য কিছু সময় দরকার। সেই যে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে এক অনিশ্চিত জীবনের শুরু আর তা থেকে মুক্তি পেতে অন্যের দয়ায় বাঁচার চেষ্টা তার কোথাও শেষ হওয়া দরকার। মামার বাসার পথে যেতে যেতে একটাই সিদ্ধান্ত নেই আমি হেরে যাব না। আমার নিজের কোন যোগ্যতা নেই ভেবে পুরোটা সময় আমি পরগাছার মতো বাঁচতে চেয়েছি। কিন্তু আসলে আমার নিজের ভেতর মনোবল শব্দটা কোথাও দারুন গোপনীয়তায় লুকিয়ে ছিল বলেই বোধহয় ওভাবে ভেবেছি। দেখিনা একাকী কিছু করা যায় কি না? কত লোকেই তো একলা বেঁচে থাকে। এভাবে ভাবতে পেরে অনেকটাই স্বস্তি লাগছিল নিজের মনে।

মামার বাসায় আমাকে একাকী দেখে সবাই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেও আমাকে একাকী বিশ্রামের সুযোগটুকু করে দেয় মামীরা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ হয় ঘুরে দাঁড়ায় নয়তো জীবন থেকে পালিয়ে যায়। সেদিন বিশ্রামের সময় আমি দুচোখের পাতা এক মূহুর্তের জন্য বন্ধ করতে পারিনি কি করা উচিত আর কি করা উচিত না এই ভাবনায়। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে আমি ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কাজ থেকে ফিরলে রাতে মামাদের সাথে কথা বলার সুযোগ মেলে। শহীদের সব কথা শুনে মামারা খুব ক্ষেপে গেলেও আমি শান্তভাবে আমার অবস্থান বোঝাই তাদের; জোর করে কোন সম্পর্ক টেনে নেয়া যায়না বরং ও যদি কখনো ভুল বুঝে ফেরত আসে আমি হাসিমুখে তার সাথে ফিরে যাবো। নানীবাড়ির সম্পত্তিতে মায়েরও অধিকার আছে কাজেই আমাদের তার ভাগ দিতে হবে এভাবে বললে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে ভেবে অন্যভাবে মামাদের কাছে আবদার করি। অন্তত আমাকে কয়েকটা মাস তাদের নীচতলার দুটো রুমে থাকতে দেওয়ার অনুরোধ করি। আমার বাকি খরচ আমিই চালিয়ে নেব যেভাবেই পারি। আরো অনুরোধ করি বাবার সাথে পরিবারের সবাই মিলে বসার জন্য। বাবার সংসারে বাবা সুখে থাকুক কিন্তু আমাদের সম্পত্তির ভাগ আমরা চাই।

আমার এহেন আচরণগত পরিবর্তনে মামারা বেশ অবাক হলেও আমার অসহায় অবস্থাটুকু এবেলা ওনারা অনুভব করেন বোধ করি। বাবা প্রথমে বেশ হম্বিতম্বি করলেও মামারা আইনের আশ্রয় নেবেন জানালে উনি খানিক দমে যান। শর্ত দেন আমি চাইলে গ্রামের বাড়ি যেয়ে থাকতে পারি। কিন্তু আমি শক্ত মুখে জানাই আমি টাকা চাই সাথে মায়ের কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। শায়লা আর শর্মীও আমার সাথে এ ব্যাপারে একাত্মতা জানায়। মানুষ যখন নিতান্তই ঠেকে যায় সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তখন কাউকে না কাউকে সদয় করে পাঠান তার প্রতি। আমার বড় মামা পুরোটা ব্যাপার নিজের কাঁধে নিয়ে আমাকে ঢাকা শহরে একাকী থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন। সাথে পেলাম বাবার থেকে এককালীন কিছু টাকা, মায়ের একটা খুব ভালো ব্র্যান্ডের সেলাই মেশিন আর নানাবাড়ির নীচতলার দুটো কামরা।

আমি ঘর পেয়েছি, টাকা পেয়েছি এখন আমি সিনেমার নায়িকাদের মতো সেলাই মেশিন ঘুরিয়ে দুনিয়া জয় করে ফেলবো এসব শুধু সিনেমাতেই হয়। বাস্তব বড় রূঢ় কঠিন। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা এ যুগেও মেয়েলোককে একা তিষ্টোতে দেয়না আর আমি তো বলছি আজ থেকে আরো প্রায় তিন দশক আগের কাহিনী। শর্মীকে অনুরোধ করেছিলাম হোস্টেল ছেড়ে আমার সাথে এসে থাকতে। কিন্তু ও আমাকে বোঝায় এ বাসা থেকে এতোদূরে ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া করাটাই বরং তার জন্য অনিরাপদ। তবে ছুটিছাটায় বা সপ্তাহান্তে চলে আসবে বলে কথা দেয়।

শুরু হয় আমার জীবনের একলা পথচলা। প্রাইভেটে বিএ ভর্তির আবেদন করি কাছের এক ডিগ্রী কলেজে। সাথে মায়ের সেলাই মেশিন নিয়ে নাড়াচাড়া। মা নিজে যা যা কাজ জানতেন সবই শিখিয়েছিলেন কিন্তু চর্চার অভাবে সবই প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু ঐ যে জীবনের সেই কঠিন সময়ে মাথার ভেতর মনোবলের ঘুনপোকা নাড়া দিল দিন দিন করে তাই যেন আমার ভেতরের কর্মক্ষমতাটুকু জাগিয়ে তুলতে লাগলো। মামাদের ছত্রছায়ায় থাকাতে আশেপাশের লোকে খুব একটা বাজে কথা বলার সাহস না পেলেও চলার পথে দুষ্ট লোকের অভাব ছিল না মোটেও। চোখ কান বুজে শুধু নিজের লক্ষ্যে হেঁটে গেছি। প্রথমে খুব কম খরচে ঘরের লোকের কাপড় সেলাই করতে শুরু করি। আস্তে আস্তে তার পরিধি বাড়ে পাড়াপড়শীর ঘর পর্যন্ত। না অনেক টাকার স্বপ্ন আমি কখনোই দেখিনি। নিজে খেয়ে পরে ভালো থাকতে পারলেই আমি সুখী। সেলাইয়ের ব্যস্ততা বাড়লে আমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত হবে তাও আমি চাইনি। জীবনের স্বর্ণালী সময়ে পড়াশোনা না করে যে ভুল আমি করেছি নতুন করে আর সেই ভুলে নিজেকে জড়াতে চাইনি কোনভাবেই।

আমার একলা জীবনের প্রায় বছরখানেকের মাথায় একদিন মামার বাসায় দুবাই থেকে ফোন আসে। শহীদের ওপর আমার কোন রাগ ছিল না ছিল একরাশ অভিমান। আমি তার মত হতে চেষ্টা করেছি নিজের শতভাগ দিয়ে, চেয়েছি নিজেকে ওর আদলে বদলে সুখী হতে কিন্তু সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে আমাকে পথের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেয়ার সাহস সে করেছে শুধুমাত্র আমার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কেউ বা কিছু ছিলনা বলে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে কত কিছু ভেবে ফেলেছি কি বলবো কি বলবো না।

– হ্যালো?

হ্যালো লায়লা ভাবী? আমি রহমান, শহীদের বন্ধু। চিনতে পেরেছেন?

– জ্বি চিনতে পেরেছি। ভালো আছেন?

হুম ভালো। শহীদ সামনের সপ্তাহে বাংলাদেশে আসছে। আপনি কি তার সাথে দেখা করবেন? আমি সব ডিটেইলস আপনাকে সময়মত জানাবো। কেন এতোদিন যোগাযোগ করেনি সেসবও বলবো। কাল এসময় আমি ফোন দিবো আবার, আমার কার্ডে টাকা নেই আজ।

আমি কিছু বলার আগেই ওপাশের ফোনের লাইন কেটে যায়। ওপাশের ফোনের লাইন কেটে গেলেও রিসিভার হাতে দীর্ঘসময় আমি বসে রইলাম। কি করা উচিত আমার? নিজের লক্ষ্যে একাকী পথ চলার সিদ্ধান্তে অটল থাকা নাকি শহীদ ক্ষমা চাইলে তার হাত ধরে সংসার নামক অচেনা জীবনে আবার জড়িয়ে যাওয়া?

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

চলবে….

পর্ব ৩

https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/2444952265549952/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here