#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” ও খোদা, আমার কোমড় তো মনে হয় এবার গেলো। আর তো মনে হয় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবোনা৷ আ…..” মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে বললেন ফাতেমা বেগম। মায়ের আহাজারি শুনে তেজবীন দ্রুত তার পাশে বসলো।
” মা তোমার কি হয়েছে? কোথায় ব্য’থা করছে?”
” বাবু তুই এসেছিস। আমি মনে হয় আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না। আমার কোমড় মনে হয় ভে’ঙে গিয়েছে।”
” কিসব আজেবা’জে কথা বলছো বলো তুমি? কিছু হবেনা।”
” না না আমি জানি আমার কোমড় ভে’ঙে গিয়েছে। এতো বড় বালতি এতোগুলা সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে গেলে কোমড়ের কি আর আস্থ থাকে? তোর বউ আমাকে মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করছে বাবু। তুই ওই মেয়েকে এখনোই না তাড়ালে তুই তোর মাকে হারিয়ে ফেলবি। ওই মেয়ে তোর আড়ালে আমার উপর অনেক অত্যাচার করে। আমাকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাই। তুই আসার আগে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকে যেন তুই মনে করিস সেই সব কাজ করে, আমরা কোন কাজ করিনা। বাবুরে তুই ওই মেয়েকে এখুনি বিদেয় না করলে তোর মাকে তুই হারিয়ে ফেলবি। তুই কি চাস তোর মা কষ্ট পাক?”
” মা এসব কথা কেন বলছো? একটু চুপ করে শুয়ে থাকো। তৃধা, এই তৃধা।”
তেজবীনের চিৎকার শুনে চুলোটা ছোট করে একপ্রকার দৌড়ে এলো তৃধা। বিছানায় ফাতেমা বেগমকে শুয়ে থাকতে দেখে চিন্তায় পড়ে গেলো সে।
” কি হয়েছে? মায়ে এভাবে শুয়ে আছে কেন?”
” এটা তোমার জানার দরকার নেই। দ্রুত দু’টো হট ব্যাগে করে গরম পানি নিয়ে এসো।”
” হঠাৎ?”
” বলছে না যেতে, এতো প্রশ্ন করছো কেন? যা বলেছি তা চুপচাপ করো, পরবর্তীতে কোন প্রশ্ন করলে ঠাটিয়ে দু’টো থা’প্পড় মেরে কথা বলাই বন্ধ করে দেবো।” চিৎকার করে রেগে বললো তেজবীন। আচমকা তেজবীনের রাগী মুখশ্রী দেখে তৃধা ঘাবড়ে গেলো। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ হট ব্যাগে গরম পানি ভরে নিয়ে এলো।
তেজবীন একটা নন্দিনীর পাশে রেখে অন্যটি দিয়ে ফাতেমা বেগমের কোমড়ে ছ্যা’কঁ দিতে লাগলো। ব্যাগ দু’টো দিয়েই তৃধা চলে গিয়েছে।
” ওরে আমার ছেলে তো চলে গেলো। ওই ডা’ই’নি আমার ছেলেকে নিজের বশে করে নিয়েছে গো। আমার ছেলেকে আমি কষ্ট করে মানুষ করেছি, আজ আমি কে? আমার ছেলের কষ্টের টাকা এখন অন্যের মেয়ে ভোগ করছে। হে খোদা তুমি কোন পা’পের শাস্তি দিচ্ছো? আমার ছেলে তার মাকে ভুলে গিয়েছে৷ মায়ের কষ্ট দেখেও সে বিচলিত হচ্ছে না। বুঝতে পেরেছি আমার ছেলেকে ব’শ করেছে ওই ডা’ইনি।” আহাজারি করতে করতে বললেন ফাতেমা বেগম। চিৎকার চেচামেচি শুনে তৃধা এবং তিথি দৌড়ে এলো কি হয়েছে দেখার জন্য।
” ভাই মায়ের কি হয়েছে? চিৎকার করছে কেন?”
” কিছু হয়নি। তোরা দু’জন নিজেদের কাজে যা।”
” তেজবীন মায়ের কিছু হয়েছে? অসময়ে শুয়ে আছেন যে?”
” বলেছিনা এখান থেকে যেতে। আর একটা কথা বললে দু’টোকে থা’প্পড় মেরে গাল লাল করে দেবো।” চিৎকার করে বললো সে। ভাইয়ের চিৎকার শুনে তিথি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে গেলো। তৃধা রুমের মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে সেও চলে গেলো।
তেজবীন চুপচাপ ফাতেমা বেগমের কোমড়ে হট ব্যাগ দিয়ে ছ্যা’কঁ দিচ্ছে। ফাতেমা বেগম এবং নন্দিনী চোখের ইশারায় কিছুটা একটা বললো।
” ভাই তুই আসলেই বদলে যাচ্ছিস। মা বোনের কষ্ট তুই এখন আর দেখতে পাস না।”
” আপু প্লিজ চুপ করো। তোমরা সারাদিন ঘরে বসে থাকো, আমি তো আর ঘরে বসে থাকিনি। আমিও মানুষ, আমারো মানসিক শান্তি বলে কিছু আছে। তোমরা সবাই শুধু নিজেদের কথাই চিন্তা করো, আমার কথাও তো কখনো একটু ভাবতে পারো। সারাদিন অফিসের এতো ঝামেলার পর বাসায় এসে তোমাদের প্রতিদিনের এতো এতো অভিযোগ, ঝগড়া আর ভালো লাগছে না। কোনদিন দেখবে যে আমি আর বাড়িতেই ফিরে আসবোনা।” কথাগুলো বলে হট ব্যাগটা টেবিলে রেখে চলে গেলো তেজবীন। তেজবীনের কথা শুনে মা-মেয়ে দু’জনেই চমকে গেলো। সে বেরিয়ে যেতেই ফাতেমা বেগম দ্রুত উঠে বসলেন।
” নন্দু আমি কি ঠিক শুনেছি?”
” আমার সন্দেহই ঠিক ছিলো৷ দেখলে তো সে কি উওর দিলো? কোথায় ভেবেছি ওই ফকি’ন্নির পিঠে দু’টো তিনটে দেবে কিন্তু সে তো উল্টো আমাদেরকেই শুনিয়ে গেলো। এখন কি করবে?”
” অপেক্ষা কর, দেখ আমি কি করি।”
রাতে খাবার টেবিলে তেজবীনকে দেখতে না পেয়ে তৃধা এসে দেখলো সে শুয়ে আছে।
” খেতে এসো।”
” পরে খাবো, তোমরা খেয়ে নাও।”
তেজবীনের হাবভাব তৃধার সুবিধার লাগছেনা তাই সে জোর করলোনা। তৃধা বেরিয়ে যেতেই ফাতেমা বেগম কোমড়ে হাত দিয়ে তেজবীনের পাশে বসে তার মাথা হাত রাখলো।
” আমাকে ক্ষমা করে তে বাবু৷ আমি বুঝতে পারিনি এখন আমার কথা শোনার তোর সময় নেই। আমি এরপর থেকে তোমাকে আর কিছু বলবোনা। তোর বউয়ের নামে কোন নালিশ করবোনা। আমি তো মা, আমি কি আর চাইবো তোমাদের মধ্যে ঝা’মেলা হোক? আমি এখন থেকে চুপচাপ তোর বউয়ের সব কথা মেনে চলবো, না হলে এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাবো? তুই আর রাগ করে থাকিস না। এই বুড়িকে ক্ষমা করে দে, খেতে চল বাপ।”
” মা এরকম করে বলো না৷ তুমি যাও আমি আসছি।”
” আয় বাপ, তোর জন্য আমি বসে আছি। আ….. কোমড়টা মনে হয় আর ঠিক হবেনা।” কোমড়ে হাত দিয়ে বেরিয়ে গেলো ফাতেমা বেগম। তেজবীন কিছুসময় থম মেরে শুয়ে থেকে উঠে পড়লো।
তেজবীন বসতেই তৃধা দ্রুত তাকে খাবার পরিবেশন করে নিজেও খেতে বসে পড়লো। সবার আড়ালে ফাতেমা বেগম এবং নন্দিনী চোখের ইশারায় কথা বলে চলেছে।
দ্রুত খাবার শেষ করে তৃধা উঠে যাবে তখন গম্ভীর কণ্ঠে তেজবীন জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি আজ মাকে দিয়ে কাজ করিয়েছো?”
উঠতেও গিয়েও উঠলো না তৃধা। আধোঁয়া হাতটা নিয়ে মা-ছেলেকে একবার পরখ করে নিলো সে। এদিকে তেজবীনের কথা শুনে ফাতেমা বেগম এবং নন্দিনীর মনে যেন খুশির ঢেউ বয়ে গেলো। দু’জনেই নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলেন, ভাব এমন যেন কোন সিনেমা শুরু হতে যাচ্ছে।
” আমি ওনাদের শুধু কাপড়গুলো ছাদে মেলে দিয়ে আসতে বলেছিলাম।”
” কেন বলেছিলে? ঘরে বসে থেকে কি এমন করো যে সামান্য কাপড় গুলো ছাদে মেলে দিয়ে আসতে পারোনা? সামান্য কাপড় শুকনোর জন্য তোমার মাকে বলতে হ্যাঁ? তুমি জানো না মা অসুস্থ, তোমার তো আর স্বাস্থ্যসবল শরীর মায়ের নেই যে কাজ করবে। তোমার মধ্যে কি একটুও কমনসেন্স নেই?”
” আমার মধ্যে না হয় কমনসেন্স নেই কিন্তু তোমাদের মধ্যে কি খুব কমনসেন্স আছে? পুরো একমাসের কাপড় যে সবাই জমিয়ে রেখেছিলে, বিবেকে কি একটুও বাঁধেনি? একবার চিন্তা করা উচিত ছিলো আমি এই শরীরে এগুলো কিভাবে পরিষ্কার করবো। তাও আমি করেছি। কাপড় মেলে দেওয়া সামান্য কাজ হলে তোমার মা-বোন কেন এই সামান্য কাজটুকু করতে পারবে না?”
” মা অসুস্থ, মায়ের কিছু হয়ে গেলে কি করতে তুমি?”
” তোমার মা অসুস্থ হলে কই কোনদিন তো দেখলাম না ডাক্তারের কাছে যেতে বা কোন ওষুধ খেতে। এইসব ঝামেলা করার সময় তো উনি দিব্বি সুস্থ থাকে। তোমার মা নাহয় অসুস্থ কিন্তু তোমার বোনের তো কোন সমস্যা নেই। এমন তো না যে আমি ওনাকে ঘরের সকল কাজ দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকি। ওনাদের বোঝা উচিত এতো ছোট বাচ্চাকে রেখে ঘরের কাজ করা কতটা কঠিন। ওনারা যদি আমার মেয়েটাকে দেখে রাখতেন তাহলে এই কাজটাও আমি বিনাবাক্য করতাম।”
থালটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো তৃধা। ফাতেমা বেগম কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন তার আগেই তিথি বললো,
” ভাই কাপড়গুলো আমিই মেলে দিয়েছিলাম। মা শুধু আপুর একটা কাপড়ই মেলে দিয়েছিলো। গা ব্যথা, কোমড় ব্যথা হলে তো আমার হওয়ার কথা কিন্তু কই আমার তো একটা আঙ্গুলও ব্যথা করছে না।”
” তিথি তুই কিন্তু বেশি কথা বলছিস।”
” ও… সরি আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম সত্যি কথা বললে তো আবার কয়েকজনের গা জ্বলে যাই।” কথাটা বলেই খালি থালাটা নিয়ে উঠে গেলো তিথি। তেজবীন আনমনে ভাত নেড়েই চলেছে৷ তার এখন মস্তিষ্ক শূণ্য লাগছে৷ ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বহুদূরে চলে যেতে।
চলবে……