বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২) #পর্বঃ১০

0
288

#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

দ্রুত রান্না শেষ করে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ছুটলো তৃধা। পাঁচ মিনিটের মাথায় গোসল শেষ করে বেরিয়ে এলো সে। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আরেকটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। এসব দেখে তেজবীন জিজ্ঞেস করলো,

” এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো তুমি? ব্যাগে এসব কেন ঢুকাচ্ছো?”

ব্যাগগুলো একপাশে রেখে তন্বীকে ডাইপার পড়াতে পড়াতে বললো,

” অফিসে যাচ্ছি। সবার খাবার টেবিলে রাখা আছে, নিয়ে খেয়ে নিও।”

” অফিসে যাচ্ছো মানে! তুমি এখনো অফিসে যাবে নাকি? কই তুমি যে আবার অফিসে যাবে আমাকে তো বললে না?”

” এতো অবাক হচ্ছো কেন? আমি কি আজ নতুন চাকরি করতে যাচ্ছি নাকি? তোমাকে বলেই বা কি হবে? তুমি তো আর আমার কোন কাজে সাহায্য করবে না।”

নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্যাগগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো তৃধা।

ফাতেমা বেগম মাত্রই ঘুম থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়েছিলেন। তৃধাকে এই সাজে দেখে তিনিও একই প্রশ্ন করলেন।

” কি হলো এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো? সাথে এই বাচ্চাকেও তো নিয়ে যাচ্ছো দেখছি। আর এতো ব্যাগপত্র সাথে কেন?”

” অফিসে যাচ্ছি। সকালের নাস্তা আর দুপুরে খাবার রান্না করা আছে। আশা করছি নিজেদেরটা নিজেরা নিয়ে খেতে পারবেন৷ তেজবীন তোমার খাবার আমি ব্যাগে দিয়ে দিয়েছি, সাবধানে ব্যাগ নিও।”

” এই দাঁড়াও দাঁড়াও আগে আমার কথা শোন। অফিসে যাচ্ছো মানে? তুমি কি আবারো চাকরি করবে নাকি?”

” আশ্চর্য। আপনারা এমন ভাব করছেন যেন আমি বলেছিলাম আমি আর চাকরি করবো না। আমি শুধু কয়েক সপ্তাহের জন্য মাতৃকালীন ছুটি নিয়েছিলাম৷ ছুটি শেষ তাই পুনরায় অফিসে যাচ্ছি। আপনারা যদি ভেবে থাকেন আমি চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে থাকবো তাহলে দয়া করে এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। যতই বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন আমি চাকরি ছাড়বোনা। কারণ ভবিষ্যতে হয়তো এই চাকরিই আমার বি’পদের সঙ্গী হতে পারে।”

” এতো চেটাং চেটাং করে যে বলছো চাকরি করবে তা তুমি চাকরি করতে গেলে তোমার মেয়েকে দেখবে কে? আমি আগেই বলে দিচ্ছি এই অহেতুক ঝামেলাকে আমি দেখে রাখতে পারবোনা। এতোই যখন চাকরি করার শখ তখন এর ব্যস্ততাও তুমিই করবে। ভুলেও আমাকে দেখা শোনা করার জন্য বলবে না, না হলে আমি কিন্তু তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবো।”

ফাতেমা বেগমের কথা শুনে তৃধা তাচ্ছিল্য ভরা হাসলো। নিজের উপর হাসলো, নিজের ভাগ্যের উপর হাসলো৷

” হ্যাঁ তৃধা তুমি চাকরি করতে গেলে এই বাচ্চাকে দেখবে কে? তোমার এসব নিয়ে একবার ভাবা উচিত ছিলো।”

” তুমি এমনভাবে বলছো যেন মেয়েটা শুধু আমার, আমিই একা তাকে জন্ম দিয়েছি। যাক সবাই তো বলছো তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ে। মেয়েটা যেহেতু শুধু আমার একার তাহলে তাকে নিয়ে তোমাদের এতো চিন্তা করতে হবেনা। আমার মেয়েকে দেখে রাখার জন্য এই বাড়িতে মানুষের অভাব পড়লেও আমার বাবার বাড়িতে মানুষের অভাব নেই৷ তোমার মা তো আবার অসুস্থ কিন্তু আমার মা অনেক স্বাস্থ্যবান৷ আমার মেয়েকে কয়েকঘন্টা দেখার জন্য আমার মা’ই যথেষ্ট। অফিসের সময়টা তন্বী মায়ের কাছেই থাকবে, ফেরার সময় আমি নিয়ে আসবো। আশা করছি আর কোন প্রশ্ন করবে না।”

তৃধার কথা শুনে ফাতেমা বেগম বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিতে গেলে তৃধা পিছিয়ে যায়।

” কি করছেন কি আপনি?” অবাক প্রশ্ন করলো তৃধা।

” দাও, বাচ্চাটাকে এদিকে দাও। সাহস কত বড় এই মেয়ের। এই তুমি কোন সাহসে ওকে নিজের মায়ের কাছে রেখে অফিসে যাচ্ছো? আমাদের কাউকে জিজ্ঞেস করেছো তুমি?”

” আপনাদের কেন জিজ্ঞেস করবো? কারা আপনারা? আজ পর্যন্ত তো আমার মেয়ের বিষয়ে আপনাদের কোন মাথাব্যথা দেখিনি তাহলে এখন কেন এতো মাথাব্যথা? শুনুন আমি তন্বীর মা, আমার থেকে নিশ্চিয়ই অন্যকেউ বেশি জানবেনা। তাই আমি যা করছি ভেবেচিন্তেই করছি। তোমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে৷ এভাবে পিলারের মতো বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে তৈরি হতে যাও৷ আশা করোনা তোমার কথায় আমি সিদ্ধান্ত বদলাবো। আগে নিজে ঠিকভুল বিবেচনা করতে জানো, তারপর তোমার সিদ্ধান্তে সহমত হবো। আসছি।”

পরবর্তীতে কোনকথা না শুনে তৃধা মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ফাতেমা বেগম চিৎকার চেচামেচি করেই চলেন৷ তেজবীন বরাবরের মতোন চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো।

বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো তৃধা। একা দু’টো ব্যাগ এবং ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো তার।

” আপনার কোন সাহায্য লাগবে কি তৃধা সাহেবা?”

পেছন থেকে আচমকা পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো তৃধা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলো একদম তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। এক চিমটি পরিমাণ দূরত্ব তাদের মধ্যে। তৃধা দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে নিলো। যা দেখে রুদ্র বি’শ্রী ভাবে হাসলো।

” আরে আরে এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আমিই তো। তা এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছেন তৃধা সাহেবা? সাথে তো আবার আপনাদের একমাত্র অংশও আছে দেখছি।”

শেষোক্ত কথাটা রুদ্র কোন হিসেবে বলেছে বুঝতে পেরে ঘৃ’ণায় তৃধার গা ঘিনঘিন করে উঠলো।

” আপনারা সবাই কি এরকম? ছ্যাঁচড়া, গায়ে পড়া স্বভাবের? আপনার চরিত্র যে অনেক সাধু তা তো আমি জানি আর যাইহোক অন্তত শা’লার বউ হিসেবে এসব নোংরা কথা বন্ধ করুন।”

” আরে আরে শান্ত হন। এতো রে’গে যাচ্ছেন কেন? আমি তো মজা করছিলাম।”

” আপনার সাথে আমার ঠাট্টা মশকরার সম্পর্ক নয়৷ সম্মান দেবেন তাহলেই আমার থেকে সম্মান পাবেন। না হলে আপনাকে আবারো শিক্ষা দিতে আমার বেশি সময় লাগবেনা।”

এরমাঝেই রিকশা পেয়ে গেলে তৃধা তাকে উঠে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করলো, রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে আবারো বিশ্রিভাবে হাসলো। তার হাসি এবং মুখোভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মাথায় বা’জে কিছু চলছে।
.
.

ঘুমন্ত তন্বীকে বিছানায় শুয়ে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে তৃধা অফিসে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।

” মা তন্বীর সব জিনিস ব্যাগে আছে। ফিডার, দুধের টিন সব টেবিলে রাখা আছে। তুমি সব সামলে নিতে পারবে তো?”

” আমি কি বাচ্চা নতুন পালছি? দু’বাচ্চার মা আমি, তোর ভাইয়ের ছেলেও আমি দেখাশোনা করেছি। তুই চিন্তা করিস না, আমি ঠিক সব সামলে নেবো।”

” তাহলে আমি আসছি। কোন সমস্যা হলে ফোন করো।”

মায়ের ভরসায় তন্বীকে ওনার কাছে রেখে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো তৃধা।

মা হওয়ার পর এই প্রথম তৃধা চাকরিতে এসেছে। তাকে দেখে সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে, বাচ্চার খোঁজখবর নিচ্ছে। বাইরে সবার সাথে হালকা কুশলবিনিময় করে তৃধা তার বসের সাথে দেখা করতে এলো।

” গুড মর্নিং স্যার।”

” গুড মর্নিং তৃধা। কেমন আছো?”

” জ্বি স্যার ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?”

” এতোদিন ভালো ছিলাম, তুমি আসাতে আরো ভালো আছি। আগের থেকেও সুন্দর হয়ে গিয়েছো তুমি দেখছি। বাচ্চার হওয়ার পর সবাই কি এরকম সুন্দরী হয়ে যাই নাকি? না বাচ্চা হওয়ার খুশীতে হাসবেন্ড বেশি যত্ন করেছে?”

সাতচল্লিশ বছর বয়সী বসের মুখে এই ধরণের দ্বিমুখী অর্থের কথা শুনে তন্বীর গা ঘুলিয়ে উঠলো। হৃদয়ে চেয়ে গেলো বিতৃষ্ণা। অপারগ তৃধা কিছু বলতেও পারছেনা, না হলে পরবর্তীতে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে৷ তৃধা মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো,

” আচ্ছা পুরুষ জাতিটাই কি এমন? কেউ মেরুদন্ডহীন, কেউ চরিত্রহীন তো কেউ এরকম। তারা কি মেয়েদের উপর এধরণের ব্যবহার করে খুব আনন্দ পাই? তারা কি বোঝেনা তাদের এই সাময়িক আনন্দ একটা মেয়ের জীবনে কথাটা বেদনাদায়ক হতে পারে? তারা কি কখনোই বুঝবেনা একজন মেয়েকে। তারা বুঝি সবসময় নারীদের প্রতি এমন উদাসীন হয়েই থাকবে? নারীরা কি সবসময় সবজায়গায় এভাবে লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েই যাবে? কেন নারীরা নিজেদের জীবনের প্রতিটি স্তরে এভাবে লাঞ্ছিত হয় ? মেয়ে হওয়াটা বুঝি এই সমাজে অ’পরাধ?”

চলবে……..

( অনিয়মিত হওয়ার জন্য দুঃখিত। আমার প্রতিটা কোচিং এ পরীক্ষা চলছে, যার কারণে একদিন পর পর দিচ্ছি। আশা করছি বুঝতে পারবেন আপনারা। আমি চেষ্টা করবো কিছুদিনের মধ্যে আবারো নিয়মিত দেওয়ার। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here