#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
বেশ কিছুমাস পেরিয়ে গিয়েছে। নন্দিনী এ বাড়ি থেকে তো যাইনি বরং বর্তমানে রুদ্র নিজেই লাপাত্তা।
” ভাইয়া তুই ভাবিকে ফিরিয়ে আনবি না?”
” আমি কি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি নাকি? সেই তো চল গিয়েছে। তার আসতে ইচ্ছে হলে ফিরে আসতে পারে, কেউ তো তাকে বাঁধা দিচ্ছেনা।”
তেজবীনের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখলো তিথি।
” ভাইয়া তুই ঠিক আছিস? ইদানীং তুই আগের থেকেও বেশি অদ্ভুদ আচরণ করছিস। তোর শরীর ঠিক আছে?”
” আমি ঠিক আছি তিথি। তুই যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।”
তিথি বেরিয়ে যাওয়ার পর তেজবীন বাথরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে আয়নার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলো। চোখ দু’টো আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে, অত্যাধিক মাথাব্যথা সহ্য করতে না পেরে ব্যথার ওষুধ সাথে দু’টো ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। এতোটা পরিমাণে তার মাথা ব্যথা করছে মানে হচ্ছে এই বুঝি মাথাব্যথায় কেউ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করছে। বেশ খানিকক্ষণ ছটফট করার পর অনেক কষ্টে তেজবীন ঘুমতে স্বার্থক হলো।
.
.
আশেপাশের মানুষজন প্রথমকে খেয়াল না করলেও এখন খেয়াল করেছে যে তৃধা তার বাপের বাড়িতেই থাকতে। ফলে তথাকথিত সমাজের নিয়ম অনুযায়ী এটা দৃষ্টিকটু। তাদের দেখা পেলেই সবাই খুঁটি খুঁটি জানতে চাইছে আসল ব্যপারটা কি। এতে শায়লা খাতুন তৃধার উপর আরো চটে গেলেন। তিনি রেগে, বকাঝকা করেও তৃধাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে না পেরে এবার তাকে ইমোশনালি ব্যাকমেইল করবেন বলে মনোস্থির করলেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিনি তৃধাকে নিয়ে আলাদা একটা রুমে বসলেন।
” দেখ তৃধা, তুই হয়তো ভাবছিস তোর মা খুব খারাপ, তোর কষ্ট বুঝতে পারছেনা। কিন্তু তুই ভুল ভাবছিস, আমি জানি তোর কিরকম লাগছে। কিন্তু মারে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই নিজের বাড়ি। মেয়েরা লাল কাপড়ে স্বামীর বাড়িতে পা রাখে সাদা কাপড়ে বেরিয়ে আসে, এটাই রীতি। তুই তো দেখছিস সবাই আমাদের দেখলে কিরকম ফিসফিস করে, এখন আমরা হচ্ছি তাদের গল্পের বিষয়। তুই নিজের মেয়েটার কথা একবার ভাব। আমি কি কম কিছু সহ্য করে এই পর্যন্ত এসেছি? আমিও যদি তোর বাবাকে ছেড়ে চলে যেতাম তাহলে কি আজ তোরা এতো ভালো পরিবেশে বড় হতে পারতি? এই চাকরি-বাকরি করতে পারতি? আমি তোদের মুখে দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে গিয়েছি। মারে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস একটু তো সহ্য করতেই হবে অনন্ত মেয়ের জন্য হলেও তোকে মানিয়ে নিতে হবে রে।”
” মানিয়ে নিয়ে কি হবে? কখনোই আমি ওদের থেকে সম্মান পাবো না, সবসময় লাঞ্চনার স্বীকার হতে হবে।”
” কে বলেছে তোকে? দেখবি মেয়ে বড় হতে হতে সবাই সব ভুলে যাবে। তখন তোকে ছাড়া তাদের দিন যাবে না।”
ম্লান হেসে তৃধা বললো,
” তোমার মতো বুঝি? কই আমরা তো বড় হয়ে গিয়েছি কিন্তু বাবার মধ্যে আমি এখনো তোমার জন্য সেই সম্মানটা দেখতে পাইনি। বাবা এখনো নিজের প্রয়োজনে তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। আমাদের সামনে না হোক আড়ালে আজো তিনি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন সেটা আমি জানি মা।”
মেয়ের কথা শুনে মুখ কালো হয়ে গেলো শায়লা খাতুনের। তাও মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
” একজন স্বামী খারাপ হতে পারে কিন্তু একজন বাবা কোনদিনও খারাপ হতে পারেনা। তোর বাবা আমার সাথে যাই করুক না কেন কখনো তোদের অবহেলা করেনি, তিনি সবসময় চেষ্টা করে গিয়েছেন তোদের সবচেয়ে ভালোটা দেওয়ার জন্য। মেনে নে মা, এটাই জীবন। সমাজের নিয়মের বাইরে চলা সহজ নয়। সমাজের বাইরে চলতে গেলে তারা তোমাকে বাঁচতে দেবেনা। আমাদের আশেপাশে অনেক হায়নারা আছে যারা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। আমি কাল জামাইকে ফোন করবো, তুই সব গুছিয়ে রাখিস।”
শায়লা খাতুন দরজা কাছে পৌঁছোতেই তৃধা বলে উঠলো,
” আমাদের আশপাশটা অনেক বিষাক্ত তাই না? একজন মা হয়ে সমাজের কারণে মেয়েকে এমন এক পরিবেশ ঠেলে দিচ্ছে যেখানে সে যেকোন সময় মা’রা যেতে পারে৷ অবশ্য তোমারই বা কি দোষ? অন্যজন কি বলবে তা চিন্তা করতে করতেই আমাদের জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলো হারিয়ে যায়।”
মেয়ের কথা শুনে মুখে আঁচলগুজে কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেলেন শায়লা খাতুন। জানালা দিয়ে খালি আকাশ দেখে তৃধা নিজেও চোখের জল ফেলতে লাগলো।
.
.
বন্ধের দিন হওয়ায় বাড়িতে সবাই আছে। তবে মানুষগুলো একসাথে থাকলেও সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। প্রয়োজন ব্যতিত কারোর অন্যের কথা মনে পড়ে না।
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো তৃধা। দরজা খুলে অপ্রত্যাশিতভাবে তেজবীনকে দেখে ভড়কে গেলো সে। আগের থেকেও শুকিয়ে গিয়েছে তেজবীন, চোখ আগের তুলনায় আরো কোটোরে ঢুকে গিয়েছে। তবে তৃধা সেদিকে বেশি মায়া না দেখিয়ে শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
” এখানে কেন এসেছো তুমি? এতো মাস পর মনে পড়েছে আমাদের কথা?”
শরীর ভেঙে পড়লে কি হবে সবচেয়ের মতোন কথায় অহংকারী একটা রেশ রেখে সে জবাবে বললো,
” আমি নিজে আসিনি, তোমার মা’ই আমাকে ফোন করে অনুনয় করলো। প্রতিদিন ফোন করে এতোবার অনুরোধ করেছে তা দেখে কি না এসে পারা যাই?”
তাঁর কথা শুনে তৃধা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার সে বুঝতে পারছে কেন এই কয়েকদিন শায়লা খাতুন ফিরে যাওয়ার জন্য কিছু বলেননি। রাগে সে তেজবীনকে দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
অপরিচিত মানুষকে দেখে ছোট তন্বী পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ড্যাবড্যাব করে দেখছে। বয়স তার একবছর পেরিয়ে গেলেও বাবাকে সে খুব ভালো করে এখনো পর্যন্ত দেখেনি। তাই তেজবীন এখন তার কাছে অপরিচিত কোন অতিথি৷ শায়লা খাতুন নিচুস্বরে তন্বীকে বললো এটাই তার বাবা। এতোদিন পর বাবাকে দেখে ছোট তন্বী খুশি হাত তালি দিতে লাগলো৷ হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত তেজবীনের পায়ের কাছে এসে তার মনোযোগ আর্কষণ করার চেষ্টা করতে লাগলো।
তেজবীন তাকে দেখছে কিন্তু কোলে নিচ্ছেনা। কোলে না নেওয়াতে তন্বী তার পায়ে আলতোভাবে থাবা দিতে লাগলো। একসময় সব জড়তা কাটিয়ে মেয়েকে কোলে নিতেই তন্বী খিলখিল করে হেসে অস্পষ্টভাবে বাবা বাবা বলে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। তেজবীনকের কি হলো সে জানেনা তার মনে হচ্ছে কিছু একটা থাকে বলছে তন্বীকে নামিয়ে দিতে। তবে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে তন্বীকে জরিয়ে ধরতেই তার বুকে প্রশান্তির ছেঁয়ে গেলো।
” জানো বাবা মেয়েটা খালি তোমাকে খুঁজে। কত রাত সে বাবা বাবা বলে কান্না করেছে। দেখো ঝামেলা সব পরিবারেই তো হয় কিন্তু তাই বলে কি এতোবড় সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? তোমরা আলাদা হয়ে গেলে যে মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। অনন্ত মেয়েটার কথা চিন্তা করে সব মিটিয়ে নাও।”
” আমি তো আপনাদের মেয়েকে কি়ছু বলিনি। আপনাদের মেয়েই তো জিদ দেখিয়ে চলে এসেছে। এসব আমাকে না বুঝিয়ে মেয়েকে বোঝালেই পারতেন।”
” তুমি কিছু বলেনি এটাই তোমার সমস্যা। মুখ থাকতেও যে বোবার মতো থাকে তার সাথে আর কতদিন থাকা যাই?” বলেই তন্বীকে তেজবীনের কোল থেকে নিয়ে নিলো তৃধা।
” আপনি আপনার মেয়েকেই বোঝান। সে যেতে চাইলে আমার কোন আপত্তি নেই। তাকে জিজ্ঞেস করুন তার সিদ্ধান্ত কি, তারপর আমাকে মতামত জানান।”
শায়লা খাতুন তৃধা টেনে ভিতরে নিয়ে গেলেন। এটা ওটা বুঝাতে বুঝাতে তিনি জোড় করে সব জামা-কাপড় ব্যাগে ঢুকাতে লাগলেন।
” বাবা তুমি বস, ও তৈরি হয়ে আসছে।”
” আপনাদের বাথরুমটা কোথায়?”
শায়লা খাতুন বাথরুমে দেখিয়ে দিয়ে আবারো জামা-কাপড় ঘুছাতে চলে গেলেন। বাথরুম থেকে বের হতেই তৃধার সামনে পড়ে গেলো তেজবীন। তৃধা সূক্ষ্ণসৃষ্টিতে তেজবীনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” তোমার নাকে কি হয়েছে? লাল লাগছে কেন?”
তৃধার প্রশ্ন শুনে তেজবীন ভড়কে গেলো। সে উল্টো ঘুরে বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তার এধরণের অদ্ভুত ব্যবহারে তৃধার কপালে ভাঁজ পড়লো।
চলবে…….