বইছে আবার চৈতী হাওয়া
২৫.
-চোখে চোখে রাখব মানে?
-বুঝস না? সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডরে এত রাতে একজনের অফিসে রাইখা নিশ্চিন্তে ঘুমাস কেমনে?
-বুঝলাম না
-ঐদিন কয়টা পর্যন্ত মীরা আশিকের অফিসে ছিল জানোস?
– না, কয়টা?
– রাত দশটার সময় আমি যায়া দেখি দুজনে একসাথে দাঁড়ায়ে আছে
-ও
– দেখ, তোরে বন্ধু ভাইবা কথাটা বললাম। তুই আবার কিছু মনে করিস না। আমি জানি আশিক খুব ভালো ছেলে। তারপরেও আমার গার্লফ্রেন্ড হলে তো আমি দিতাম না।
রাসেল বিদায় নিয়ে চলে গেল। শুভ আর কিছু বললো না, তবে ওর মনটা খচখচ করতে লাগলো। আশিক আর মীরার মধ্যে একটা সহজ সাবলীল ব্যাপার আছে, এটা শুভ লক্ষ্য করেছে। কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না। শুভ ফোন বের করে মীরাকে ফোন করল। বন্ধ দেখাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মেসেজ করলো। কোন রিপ্লাই এলোনা।
লাইব্রেরিতেও মন বসাতে পারলো না শুভ। বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে সেকেন্ড ইয়ারের রুমে খুঁজে এলো। রুম ফাঁকা, কেউ নেই। করিডোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ছেলেমেয়ে গল্প করছে। শুভ একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজকে ওদের পরীক্ষা ছিল। ক্লাস আর নেই। মীরা পরীক্ষা শেষ করে চলে গেছে। শুভর মেজাজ খারাপ হলো। একবার একটু বলে যেতে পারলো না।
মীরার পরীক্ষা ভালো হয়নি; যদিও এটা নিয়ে ওর মন খারাপ নয়; কারণ দারুণ মন ভালো করার মতন দুটো ঘটনা ঘটেছে। ছোট খালা ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন; তারপর কি হয়েছে ও জানে না, তবে সুমনার কাছ থেকে শুনেছে বড় চাচা সৌরভের বিয়েতে মত দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হলো মীরা একটা বড় অর্ডার পেয়েছে। একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য তিরিশটা সেট তৈরি করে দিতে হবে। সবাই একই রকম হলুদ আর লাল পাড়ের শাড়ি পরবে। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সেট তৈরি করে দিতে হবে। ওরা কয়েকটা স্যাম্পল দেখতে চেয়েছে।
মিরা একটু বিপাকে পড়েছে। কয়েকটা ডিজাইন তৈরি করে দেখাতে হবে। এর মধ্যে যেটা সিলেক্ট হবে সেটাই তৈরি করতে হবে। মীরা ঘড়ি দেখল। আড়াইটা বাজে। এখনই বেরোতে পারলে নিউমার্কেট থেকে একটু কেনাকাটা করে তারপর টিউশনিতে যেতে পারত। কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। কারো সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো। সাধারণত হলের কারো সাথে ও এসব বিষয়ে কথা বলে না। সবাই ঠিক সহজ ভাবে নিতে পারে না ব্যাপারটা।
প্রথম দিকে যখন শখের বসে এই কাজগুলো করতো অনেকেই আগ্রহ দেখিয়েছে। ওকে বাণিজ্যিকভাবে কাজগুলো করার পরামর্শ কেউ দেয়নি, একমাত্র টুম্পাই একদিন চোটপাট শুরু করেছিল। ধমকা ধমকি করে বলেছিল আর কতদিন ফ্রি ফ্রি সবাইকে সার্ভিস দিবি? আজ টুম্পা থাকলে ভালো হতো। একমাত্র ওর সঙ্গেই এগুলো নিয়ে একটু কথা বলে মীরা ; কিন্তু ওর একটা দাওয়াত থাকায় তাড়াতাড়ি পরীক্ষা শেষ করে চলে গেছে।
মীরা দ্রুত তৈরি হয়ে নিউমার্কেটের রিক্সা নিয়ে নিল। কেনাকাটা করতে বেশি সময় লাগলো না, মোটামুটি মাথার মধ্যে ছিল কি কি লাগবে সেই মতই কিনে নিল। চারটা স্যাম্পল তৈরি করবে ঠিক করল। তারপর ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তিরিশটা সেট করতে বেশ অনেকগুলো টাকা লাগবে। জমানো টাকা যদিও আছে ওর কাছে, তবু কেমন একটু ভয় ভয় করছে। ঠিক কিভাবে কি করলে ভালো হয় বুঝতে পারছে না। কারো সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো। একবার আশিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলে কাজ হতো। উনি এখন কোথায় আছে কে জানে? কদিন ইউনিভার্সিটিতেও দেখেনি ওকে মীরা। আশিককে ফোন করার জন্য মোবাইল বের করে দেখল ফোনে চার্জ নেই। এই ফোনটা আর ব্যবহার করা যাবে না, অনেক পুরনো হয়ে গেছে। একেবারেই চার্জ থাকে না।
মীরার স্টুডেন্টের বাসা শংকর। ভেবেছিল ওখানে গিয়ে ফোনের চার্জ দেবে তারপর আশিককে একটা ফোন করবে। কিন্তু স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে জানতে পারল আজকে ওর একটা দাওয়াত আছে তাই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। মিরা দ্রুত পড়ানো শেষ করে দিল। তাড়াহুড়ায় আর মোবাইল চার্জ করা হলো না। একবার আশিকের অফিস থেকে ঘুরে আসা যায়, যদি তাকে পাওয়া যায়।
মীরা ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। যদি আশিক ভাই না থাকে ? যদি অফিস তালা বন্ধ থাকে? তাহলে আর কি করবে, ফিরা যাবে। সদর দরজা খোলাই ছিল। মীরা আস্তে করে ঢুকে পড়ল। সামনের ঘরটাতে কেউ নেই।ভেতরের ঘরটাতেও কাউকে দেখা গেল না। কি আশ্চর্য! অফিস খোলা রেখে কোথায় চলে গেল? মিরা একবার রান্না ঘরে উঁকি দিল। সেখানেও কেউ নেই। আর একটু এগিয়ে দেখল ছাদ বারান্দার দরজাটা খোলা। আশিককে দেখা যাচ্ছে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দূরে লেকের দিকে তাকিয়ে । মীরা কাছাকাছি এসে আস্তে করে ডাকলো
– আশিক ভাই
আশিক চমকে পেছন ফিরে তাকালো। মীরা হতভম্ব হয়ে গেল। আশিক ভাইয়ের চোখ ভেজা। ওর হাতে একটা কিছু ছিল। মিরাকে দেখে চট করে সেটা লুকিয়ে ফেলল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-মীরা , তুমি এখানে?
মীরা মাথা নিচু করে ফেললো। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছে, বোধহয় আশিক ভাইয়ের কোন কারনে মন খারাপ ছিল। এরকম অবস্থায় এখানে আসাটা উচিত হয়নি। মীরা মাথা নিচু করেই বলল
-আমি আজকে যাই। হুট করে এসে বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম।
মীরা আর দাঁড়ালো না। কথা শেষ করে উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা ধরল
– মীরা দাঁড়াও
মীরা দাঁড়ালো তবে পেছন ফিরে তাকালো না।
আশিক হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
-এক কাপ চা বানিয়ে দেবে। খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে।
মীরা পেছন ফিরে হেসে ফেলল। হাসছে আশিক ও। ওরা দুজনই জানে যে একে অপরকে সহজ করতে চাইছে। মীরা বলল
-এক্ষুনি দিচ্ছি
মীরা চলে যাবার পর আশিক ওর ওয়ালেটটা পকেটে পুরে ফেলল। ওটাতে ওর মায়ের একটা ছবি ছিল। সাধারণত নিচের দিকে খুব লুকিয়ে রাখে ও।
বছরের এই সময়টা এলে মায়ের কথা অসম্ভব মনে পড়ে। এরকমই পৌষের এক রাতে মা চলে গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ও। বেশ অনেকদিন অসুস্থ ছিল তারপর। এইরকম শীতের ঝকঝকে বিকেলে যখন সবার মন ভালো হয়ে যায় তখন ও চোখ মেলতে পারে না। মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা হয়।
মিরা চা নিয়ে চলে এসেছে। আশিকের সামনে রেলিং এর উপর কাপটা রাখল মীরা। আজকের বিকেলটা খুব ঝকঝকে। চারিদিকে আসরের আজান দিচ্ছে। মীরা ওড়নার আঁচল মাথায় তুলে দিয়েছে। আশিক আড়চোখে একবার তাকালো। কি অদ্ভুত মিষ্টি লাগছে ওকে। কেমন বউ বউ লাগছে। আচ্ছা, মিরাকে বউ সাজলে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগবে। আশিক বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। গত দুদিন ধরে ও কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করছে না, পড়াশোনা ভালো লাগছে না, প্রিয় বইগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে না, মাথায় কোন কবিতা ও আসছে না। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। ছোটবেলায় ও সব কিছু মায়ের সঙ্গে শেয়ার করত। এখন যদি মা বেঁচে থাকতো, জানলে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেতো। কেন ওর সঙ্গেই এমন হলো? এই পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে কেন মীরাকেই ওর ভালো লাগলো? কেন সব সময় ওর সঙ্গেই এমন হয়? ওর ভালবাসার মানুষগুলো ওর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। কেউ কি জানে কেন এমন হয়? বোধ হয় না। কেউ জানে না।
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
চলবে………
গত পর্বে অনেকেই অভিযোগ করেছেন গভীরতার অভাব হয়েছে। এই নিয়ে ভাবছিলাম কদিন। লেখায় মন বসছিল না। ঠিক কি ধরনের গভীরতা আশা করছেন জানতে পারলে ভালো লাগতো। যাহোক আজকের কবিতার নাম “যাতায়াত” লিখেছেন হেলাল হাফিজ। আমার অসম্ভব প্রিয় একটা কবিতা।