বইছে আবার চৈতী হাওয়া ৬৬

0
369

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৬

জানালার বাইরে একটা শালিক এসে বসেছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। একটু ভয় ও নেই মনে। গ্রিলের অন্নপাশে বটিতে নারকেল মুড়ি রাখা। পাশে চায়ের কাপ। জুরিয়ে গেছে বহু ক্ষণ। মুড়ি গুলো ও নেতিয়ে গেছে।
মীরা কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একমুঠো মুড়ি তুলে আস্তে করে ছড়িয়ে দিল জানালার বাইরে। পাখিটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো। একটু কাছে, আরো একটু, তারপর খেতে লাগলো। এবার ও দূরের রাস্তার দিকে তাকাল। সকাল থেকেই জানালার ধারে বসে আছে। সুমনা কয়েকবার খেতে ডেকেছে। যেতে ইচ্ছা করেনি । পরে চা আর মুড়ি দিয়ে গেছে, সেটাও মুখে দেয়নি।

পাখিটা কি আয়েশ করে খাচ্ছে। আরেক মুঠো তুলে ছড়িয়ে দিল ও। পাশের কার্নিশ থেকে কয়েকটা কাক আর চড়ুই পাখি তাকিয়ে আছে। বোধহয় আসবে কিনা ঠিক করতে পারছে না। মীরা আবার বাটিতে হাত দিল কিন্তু আর তুলতে পারল না, তার আগে কেউ একজন পাশ থেকে বলল
– এই যা। যা এখান থেকে। অলক্ষী পাখি। যা দুর হ।

মীরা চমকে তাকালো। বড় চাচী। চাচি কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখল তারপর বলল
– কিছুই তো খেলিনা। এমন করলে চলবে ? শরীর ঠিক রাখতে হবে তো।
আর ওই অলক্ষনে পাখিটাকে একটুও খাবার দিবি না। জানিস না তুই এক শালিকে দুঃখ হয়।

মিরা জবাব দিল না। আর কি দুঃখ হবে ওর? যা হবার তো হয়েই গেছে। গত দশ দিনে আশিকের সঙ্গে ওর কোনরকম যোগাযোগ হয়নি। এতবার ফোন করেছে, প্রতিবারেই ফোন বন্ধ দেখায়। সেদিন ভোরবেলা উঠে মীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আশিক ওকে বিদায় না দিয়ে এভাবে চলে যাবে। গাড়িতে ওঠার আগে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল ওর। একটা সময় আর পারেনি, সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করেছিল। ওর থেকে অবশ্য বেশি কাঁদছিল রোজিনা আর আফসিন। আরিফ সাহেবের গলা ভার হয়ে ছিল। উনি কাছে এসে মীরার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন

আরে পাগলি মেয়ে, বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে কেউ কাঁদে? সবাই তো শ্বশুরবাড়ি আসার আগে কাঁদে।
আফসিন মিরাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ভাবি তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি না থাকলে ভালো লাগেনা
মীরা বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। ভেবেছিল হয়তো আশিক আশেপাশেই কোথাও গেছে। ও বেরোনোর আগে ঠিক চলে আসবে। আরিফ সাহেব ও অপ্রস্তুত হচ্ছিলেন । শেষমেষ বললেন
তুমি রওনা দিয়ে দাও। ওই পাগল ছেলের কথা আর বলো না, কাউকে বিদায় দিতে পারেনা। ফোনে কথা বলে নিও।
মীরা ফোন করেছিল । একবার নয় অসংখ্যবার। আশিক ফোন ধরেনি। পরের দিকে ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছিল। বাড়ি ফেরার পর মাকে নিয়ে দুদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে। এর মধ্যেও ফোন করেছে কয়েকবার। প্রতিবারই ফোন বন্ধ ছিল।

দুদিন হাসপাতালে রেখে মাকে ছেড়ে দিল। তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি। তবে ডাক্তার বলেছে উনি অনেক অযত্ন করেন। প্রেসার অনেক লো, আলসারও ধরা পড়েছে । অনেক যত্নে রাখতে হবে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করাতে হবে। ফেরার পর থেকে মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় যখন যা মনে আসে তাই বলে। মীরা জবাব দেয় না। এমনিতেই মায়ের মন খারাপ। ওর বিয়ের পর থেকে ভীষণ রকম ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে। ব্যাপারটা যে কেউ বোঝে না তা নয়। বড় চাচা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। বলেছে তার সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে দেবে। সেটাতেও রাজি না আমার কথা শোনাতেও ছাড়ছে না। মীরা আজকাল একটু দূরে দূরেই থাকে। ওকে দেখলেই মা কেমন উত্তেজিত হয়ে যায়। অনেক কথা বলে। প্রথমদিকে আরিফ সাহেব প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিতেন। গত কদিন ধরে সেটাও করছেন না। এটা নিয়ে ও মায়ের অভিযোগের শেষ নেই। আজ সকালে খেতে ডাকার পর মীরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শুনেছিল মা বলছে

-দুদিন ফুর্তি করে মন ভরে গেছে। আর ভালো লাগবে কেন? যা ঘটানোর তা তো ঘুটিয়েই ফেলেছে। আর রেখে কি করবে? তাই ফেলে রেখে গেছে।
– আহ রেহানা চুপ কর। মেয়েটা শুনতে পাবে
-শুনলে শুনুক। ওর জন্যই তো হয়েছে এইসব। অফিসে গিয়েছিল না? এইসব করতেই তো গিয়েছিল। কেমন? এখন মজাটা বুঝুক। আমারই কপাল খারাপ। মা হয়ে ফেলে তো আর দিতে পারি না।
লজ্জায় মীরার ইচ্ছা করছিল মরে যেতে। আর নিচে যেতে পারে নি ও। উপরে উঠে জানালার ধারে বসে ছিল।

এখানে এসো কাউকে কিছু জানায়নি ও। কিন্তু বড়চাচী কি করে যেন ধরে ফেলল। মকে হাসপাতাল থেকে আনার একদিন পর দুপুড়ে ঘুমিয়ে ছিল মীরা। ঘুম ভেঙে দেখল বড়চাচী চা নিয়ে এসেছে। একটু লজ্জা পেয়েছিল । অবাক ও হয়েছিল। বড়চাচীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা সহজ নয়। বিশেষ করে যখন থেকে সৌরভ এর সাথে বিয়ের ধোয়াটা উঠেছিল। বরাবর অবশ্য এমন ছিল না। ছোটবেলায় ও চাচীর আশেপাশেই ঘুরঘুর করত। কত কি খেতে মন চাইত। চালতার আচাড়, কুমড়ার মোড়ব্বা, বাদামের সরবত। মা এসব করতেই পারত না। সব আবদার ছিল তার কাছে। চাচি মুখ ঝামটা দিত, কথা শোনাত কিন্তু দিন শেষে ঠিকই বানিয়ে দিত।

মীরা উঠে বসল। শরীর ভরা আলস্য। চাচী পাশে বসে বলল
– কিরে ক মাস?
মীরা একটু চমকাল। কথা এড়িয়ে গিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চাচী আবার ও জানতে চাইল।
-কিরে কিছু বলিস না যে। ভুলে যাস না তোরা তিন বোন কিন্তু আমার হাতেই বড় হয়েছিস। তিন বারই আমি তোর মা কে আগলে রেখেছি।

মীরা লুকায়নি, সবই বলেছিল। সঙ্গে এটা ও বলেছিল এখনি কাউকে কিছু না জানাতে। কিছু জটিলতা আছে ঢাকায় ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর সবাইকে জানাবে। চাচী কথা রেখেছিলেন, কাউকে জানাননি, তবে মীরা অবাক হয়ে লক্ষ করেছে এরপর থেকে চাচি ওর প্রতি বিশেষ যত্ন নিচ্ছে। তবে গতকাল শরীর এত খারাপ হয়ে গেল যে আর লুকিয়ে রাখা গেল না।

মীরা আর পারছিল না। এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে কোন ভাবেই আশিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না ও নিজে তো ফোন করছেই না মিরা ফোন করলে হয় ধরছে না অথবা ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাড়িতেও ফোন করেছিল সেখান থেকে জানতে পেরেছে আশিক কোথায় আছে কেউ জানে না। শেষ বার মীরার সঙ্গে কথা বলে আরিফ সাহেব খুব অপ্রস্তুত হয়েছেন। হয়তো এ কারণেই দুদিন ধরে ফোনও করছেন না। মিরার কিছু ভালো লাগে না খেতে ইচ্ছা করে না, কোন কিছুতে মন বসে না। বিকেলের দিকে ছাদে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। তারপরই চাচি আর সৌরভ মিলে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলল টেস্ট করতে হবে। টেস্টের রিপোর্টগুলো নিয়ে এসেছিল ও। ডাক্তারকে দেখানোর পর উনি বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন
আপনার হাসবেন্ড কোথায়?
মীরা জানাল সে ঢাকায়, কদিন পর মীরা ও সেখানে চলে যাবে। কিন্তু এরপর ডাক্তার যা বললেন তা শুনে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। মীরার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক রকমের কম এছাড়াও আরো কিছু জটিলতা আছে। ডাক্তার জানালেন ভেরি রিস্কি প্রেগনেন্সি। আরো কিছু টেস্ট করতে হবে। ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করতে পারলেই ভালো।
মীরা জানেনা ওর ঢাকা ফেরা হবে কিনা। আশিক কি সত্যি ওকে ভুলে গেছে? সত্যিই ওর মন ভরে গেছে? এতটাই নড়বড়ে ওদের সম্পর্ক? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। তবে কি হয়েছে? যে ভয়টা ওর মনের ভিতর অতলে কোথাও লুকিয়ে আছে, তবে কি সেরকম কিছু হয়েছে? শুভ কিছু জানিয়েছে ওকে? কিন্তু ওতো মীরার সঙ্গে কথা বলতে পারত। জিজ্ঞেস করতে পারত একবার। এভাবে পালিয়ে যাবার কি অর্থ? নাকি মা যা যা বলছে সেটাই ঠিক? মীরা জানেনা তবে ও প্রতিদিন অপেক্ষা করে। প্রতিদিন ওর মনে হয় এই হয়তো আজ আশিক আসবে।

এই জানালার ধারে বসলে দক্ষিণের রাস্তাটা দেখা যায় । শহর থেকে কেউ ওদের বাড়িতে এলে এদিক দিয়েই আসতে হয়। মীরা সারাক্ষণ প্রতীক্ষায় থাকে। মাঝে মাঝে দেখে দূরে বহু দূরে একটা অস্পষ্ট অবয়ব। তবে যখন সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন বুঝতে পারে, এ অন্য কেউ।

পাখিটা আবারো এসে বসেছে। চাচী , এবার হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল তারপর বলল
তোর খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। সুমনা কেও পাঠিয়ে দিচ্ছি। একদম ঠিক মতন বসে খাবি।
মিরা কিছু বলল না ম্লান একটু হাসল। চাচী চলে গেলে ও আবার জানালাটা খুলে দিল। এক ঝলক দমকা হাওয়া এসে ওর চুল গুলো এলমেলো করে দিয়ে গেল। মীরা চুল সামলে আবার দক্ষিণের রাস্তাটার দিকে তাকাল। দূরে একটা ছায়া পড়েছে। মীরা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল এটা যেন আশিক হয়। চোখ মুদেই অপেক্ষা করল দরজায় কড়া নাড়ার। তার ও অনেকক্ষণ পর চোখ মেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল

তুমি ফিরবে কোন একদিন
হয়তো নীলিমায় হারানো কোন এক নিষ্প্রভ
বেলায়। নতুবা কোন এক নবীন হেমন্তে,
এক নতুন দিনের নির্মল খোলা হাওয়ায়।
অথবা কোন এক শ্রাবণের দিনে
অহরহ ঝরা ঘন কাল মেঘ বৃষ্টির
মুহু মুহু নির্ঝর খেলায়।
তুমি ফিরবে কোন এক রাতে
পূর্ণিমার ভরা জোছনায়।
তুমি ফিরবে জানি বহুদিন পরে
হয়তো বা হাজার বছর পরে।
কোন এক নিঃস্ব হৃদয়ে,
লক্ষ্য প্রাণের ভিড়ে, তুমি ফিরবে।
বহুরুপে সেই প্রাণে, অনেক নবীনের ভিড়ে,
তোমার আমার গড়া ভালবাসার নীড়ে!

চলবে………

আজকের কবিতাটা নাম তুমি ফিরবে লিখেছেন___সমরেশ মজুমদার। এই কবিতাটা দেব অনেকদিন ধরেই ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু সেসময় তিনি আর থাকবেন না এটা কখনো ভাবিনি। যাহোক এটা আমার লেখা শেষ ধারাবাহিক। আর ধারাবাহিক লিখব না ঠিক করেছি। সময়মত লেখা দিতে পারি না। পাঠকদের হতাশ করি। নিজে হতাশা কাটাতে লেখি সেই লেখালেখিই যদি হতাশার কারন হয় তবে আর ও পথে না হাটাই ভাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here