বৃষ্টিস্নাত_ভোর #সূচনা_পর্ব

0
804

১.

‘ আপনের আব্বায় চুইসাইড করবার লাগছিল। ‘ এই কথাটা এখনো যেন বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে মেহুলের হৃদয়ে। হৃদয়জুড়ে চলছে তীব্র বিষাদের রক্তক্ষরণ।

নিস্তব্ধ প্রকৃতি, বেলা ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত। চিরচেনা প্রকৃতি যেন আজ অচেনা লাগছে মেহুলের কাছে। সবটাই যেন বিষাদময়। কিছুটা সময় পূর্বেই যে সে একটা দুঃসময়ের সাক্ষী হয়েছে। আকাশ লাল আভায় ছেয়ে গেছে। পাখিরা কলরব তুলে ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। মেহুল বারান্দায় বসে সবটা পর্যবেক্ষণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার জীবনের প্রতি কেবল বিতৃষ্ণা।

___________

টিউশন করানো শেষে বাড়ি ফিরছিল মেহুল। তখনই একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেহুলের কল আসে। সে খানিকটা বিরক্তির সাথেই কল রিসিভ করল। অপর পাশ থেকে একটা বাজখাই পুরুষ গলা ভেসে এলো।

‘ মেহুল তানজুম কইতাছেন? ‘

‘ জি বলছি। ‘

‘ আপনের আব্বায় চুইসাইড করবার লাগছিল। ‘

‘ কীহ্! আব্বু এখন কোথায়, কেমন আছে? আর আপনি কে বলছেন? ‘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল মেহুল।

‘ কমলাপুর রেলস্টেশনে আহেন। হেরে আমরা এইহানে লইয়া আইছি অহন। ‘

‘ আমি আসছি। ‘

হঠাৎ করে জিয়া সাহেব তথা মেহুলের বাবা কেন আত্মহনন করতে গেল? এই বিষয়টি মেহুলের নিকট কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। কী এমন ঘটে গেল যে তার বাবা এহেন ঘৃণীত জঘণ্য পাপাচারে লিপ্ত হতে যাচ্ছিল! নানাবিধ চিন্তা মেহুলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে সে তার বাবাকে এসব জিজ্ঞাসা করে বর্তমানে আর কোনো মানসিক চাপে রাখতে চাইছে না। মেহুল বারান্দা ছেড়ে নিজের রুমে গেল। বোনটার কোনো খবর নেই দুদিন যাবৎ। তার উপর আবার নিজের বাবার আত্মহত্যা চেষ্টা! মায়ের মলিন মুখখানা। সব কিছু তাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। অথচ মিসেস জিয়া এখনো তার স্বামী কর্তৃক গৃহীত মারাত্মক পদক্ষেপের কথা জানেন না। জানলে কী করে সামাল দিবে তাকে মেহুল? চিন্তায় চিন্তায় কপালের রগ দপ দপ করছে তার। পুলিশের নিকট অভিযোগ দায়ের করেও কোনো উপকার হয়নি। তাছাড়া প্রতিবেশীদের কটুক্তির জ্বালায় টিকে থাকা দায় হয়েছে। এমন সময় মিসেস জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে মেহুলের ধ্যান ভঙ্গ হলো।

‘ আম্মু শোন। মিহিরের কোনো খবর পেলি আম্মু। ‘
‘ আম্মু এখনো পাইনি। তবে পেয়ে যাব চিন্তা করো না। ‘ সান্ত্বনার স্বরে মেহুলের আশ্বাসের বাণী।
‘ কী করে চিন্তা না করে থাকি বল? দুইদিন ধরে আমার মেয়েটার খবর নেই, কোথায় আছে? কেমন আছে? কিছু জানি না। ‘ এতটুকু বলে কেঁদে ফেললেন মিসেস জিয়া।

কী করুণ সেই কান্নার সুর! কত বেদনায় মিশ্রিত সেই চোখের নোনাজল! এভাবে নিজের চোখের সামনে মায়ের অসহায়ত্ব কখনো প্রত্যক্ষ করেনি মেহুল। তাই যেন কথা বলার সব শব্দই তাকে ধোকা দিয়ে হারিয়ে গেছে। মেহুল নিশ্চুপ থেকে মাকে কাঁদতে দেখলো। বোনকে খুঁজে না পেয়ে যে তারও হৃদয়ে দহন হচ্ছে। সেই দহনে পোড়া ক্ষত কাকে দেখাবে মেহুল!

_________
আমি মেহুল তানজুম। মেহবুব জিয়া ও তানজিয়া যুথির বড় মেয়ে। আমার ছোট বোন মিহির তানজুম। আমি বর্তমানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বোন সামনের বছর এইচএসসি দেবে। কিন্তু গত পরশু থেকে ও নিখোঁজ। ওর সন্ধানে থানায় জিডি পর্যন্ত করেছি। কিন্তু ওর কোনো খবর নেই। কী করে মিহিরকে খুঁজে পাব, সেই চিন্তায় যখন অস্থির ঠিক তখনই খবর এলো বাবা নাকি সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন। বাবা গত দুইদিন ঢাকার বাইরে ছিলেন না। কোনো এক জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ফোনে অবধি তাকে পাওয়া যায়নি। অথচ ঢাকায় ফিরেই অঘটন ঘটাতে যাচ্ছিলেন! এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকায়িত রয়েছে।

রাতের খাবার খাওয়ার সময়,

‘ আব্বু, তুমি খাবে না? ‘ প্রশ্ন করলাম আমি।

‘ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা খেয়ে নাও। ‘ এই কথা বলে আব্বু টেবিল থেকে উঠে গেলেন।

‘ আম্মু তুমি খেয়ে নাও। আমি আব্বুর সাথে কথা বলে আসি। ‘ উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম।

‘ আমার খিদে নেই মা। তুই কথা বল আমি ঘুমুতে যাচ্ছি। ‘ এই বলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল আম্মু।

আমি খানিকটা সময় নিলাম পরিস্থিতি বুঝতে। অতঃপর হতভম্ভ হয়ে গেলাম। আজকে সকালের পর থেকে আম্মু কিছুই খায়নি। না ওষুধ খেয়েছে আর না কোনো খাবার। সবাই শুধু আমাকেই মেজাজ দেখাতে জানে। আমি চুপচাপ সবটাই হজম করছি। কী কপাল! বিপদ যখন হানা দেয় চারিদিক থেকেই হানা দেয়। আম্মুর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে আব্বুর খোঁজে ছুট লাগলাম। আব্বুর সাথে কথা বলতে হবে। অতঃপর ছাদে গেলাম। দেখলাম আব্বু একদৃষ্টে আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে। আমি নিঃশব্দে আব্বুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং আব্বুকে ডাকলাম,

‘ আব্বু একটু কথা ছিল। ‘

‘ বল। ‘ নিষ্প্রভ হয়ে বললেন আব্বু।

‘ আমরা কী তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? ‘ ধরা গলায় বললাম।

‘ নাহ্ মা। তোরা আমায় কষ্ট দিবি কেন? ‘

‘ তাহলে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলে কেন? ‘ একথাটা বলার সাথে সাথেই চোখ বেয়ে একফোঁটা তপ্ত অশ্রু টুপ করে মাটিতে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম যেকোন মুহূর্তে অশ্রুবর্ষণ শুরু হবে। তাও নিজেকে থামাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।

আব্বু অনেকটা সময় চুপ করে ছিলেন। চারপাশে পিনপতন নিরবতা। মাঝে মাঝেই পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। কেমন একটা গম্ভীর পরিস্থিতি। অতঃপর আব্বু কাশি দিয়ে গলা ঝেড়ে নিলেন। বলতে শুরু করলেন,

‘ তোদেরকে ছেড়ে না গেলে তোরা তো মারাত্মক বিপদে পরবি মা। ‘

‘ মম. মানে…? ‘ হকচকিত হয়ে বললাম আমি।

‘ তবে শোন। আমার চাকরির মেয়াদ তো আগামী মাস অবধি। তারপর আমি কী করব? তোর, মিহিরের লেখাপড়া, সংসারের খরচ, বাসা ভাড়া কী করে চলবে? আর তুই টিউশনি করিয়েই বা কতটুকু সামলাবি? এসব নানান চিন্তায় বিগত একমাস আমি ঘুমাতে পারি নাই। তারপর একদিন এলাকার এক ভাইয়ের মাধ্যমে একজনের খোঁজ পাই। যে কিনা মানুষকে চড়া সুদে ঋণ দেয়। ওইদিকে মিহিরের ভর্তির টাকা যোগাড় করতে পারছিলাম না আমি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই ঋণ নেব। ‘ এতটুকু বলে থামলেন আব্বু।

‘ তারপর কী হলো আব্বু? ‘ প্রশ্ন করে ফেললাম কৌতূহলী হয়ে।

‘ আমি লাখ খানেক টাকা লোন নিয়ে ফেললাম। তারপর সে আমাকে একটা প্রস্তাব করে। ‘ হতাশাভরা কণ্ঠে বললেন আব্বু।

‘ কী ছিল সেই প্রস্তাব? ‘ এতটুকু বলতেই আমার ফোন বেজে উঠলো বিকট শব্দে। মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল। আব্বু আমার রাগান্বিত চেহারা দেখে বললেন,

‘ ফোন রিসিভ কর। আমি তোকে পরে সবটা বলব। হতেই পারে কোনো দরকারি ফোন। ‘

অতঃপর তিনি ছাদ প্রস্থান করলেন। আমার ফোন আবারো বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো,

‘ আপনি কী মিহির তানজুমের বড় বোন বলছেন? ‘

‘ জি বলছি। আপনি কে? ‘

‘ আপনি জলদি স্টার হসপিটালে চলে আসুন। আপনার বোনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ‘

‘ কীহ্ কখন? আমি এক্ষুণি আসছি। ‘

__________

২.

ঘড়ির কাটা রাত দুটোর ঘর অতিক্রম করেছে। আমি, আম্মু হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার আব্বু রিসিপশনে কথা বলছেন। তারপর আমরা মিহিরের কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে আমার। সারা শরীরে অসহনীয় জ্বালাপোড়া করছে। আমার বোনকে যারা এভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদের কী কোনো বিচার হবে না! কিছুক্ষণ আগে যখন ফোন করা সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছ থেকে জানতে পারি আমার বোনের অ্যাক্সিডেন্টের কথা, ঠিক তখনই আব্বু আর আম্মুকে ছুটে আসি হাসপাতালে। তারপর ডক্টরের দেখা পাই। তার কথাগুলো ছিল এমন যে,

‘ আপনারা পেশেন্টের কী হন? ‘

‘ আমি ওর বড় বোন। উনি আমার বাবা আর উনি আমার মা। ‘ উদ্বিগ্ন গলায় বললাম কথাগুলো।

‘ আসলে আপনাদের মেয়ের একটা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিছু কিছু অ্যাক্সিডেন্ট এমন যে আপাত দৃষ্টিতে তার ক্ষত পরিলক্ষিত না হলেও এর রেশ, যন্ত্রণা রয়ে যায় আজীবন। ‘

‘ কী হয়েছে মিহিরের? ‘ কম্পিত গলায় প্রশ্ন করলাম ডক্টরের উদ্দেশ্যে। কেন যেন মনে হচ্ছিলো কোনো ভয়ঙ্কর এক দুঃসংবাদ শুনতে চলেছি। অতঃপর ডক্টর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বললেন,

‘ ইউর সিস্টার হ্যাজ বিন রেপড। ‘

কথাটা যেন বজ্রঘাতের মত ঠেকল আমাদের কাছে। মুহূর্তের মাঝে চোখ-মুখ জুড়ে বিষাদের কালো ছায়া ফুটে উঠল। আম্মু চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। আব্বু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ডক্টর আরো ভয়ানক তথ্য দিয়ে বললেন,

‘ আপনার বোনকে টানা দুদিন আটকে রেখে গনধ*ন করা হয়েছে। ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওকে সাংবাদিক নেহাল হাসনাত ও তার বন্ধু রায়হান কবির রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। উনারা মিহিরকে সময় মতো হসপিটালে এডমিট না করলে ওকে বাঁচানো যেত না। ‘

_________

কী রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি! কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমার বোনকে উদ্ধার করা ব্যক্তিদ্বয়কে যে সামান্য কৃতজ্ঞতা জানাবো সেই কথাও যেন আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। উনাদের মুখ দর্শন এখনো করা হয়ে উঠে নাই। কেবিনে শিফট করা হয়েছে মিহিরকে। ভোর হয়ে গেছে। পাখিদের কলকাকলীতে ভরে উঠেছে প্রকৃতি। হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আম্মু আর আব্বু বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ধীর কদমে বাইরে বের হলাম। হঠাৎ কারোর ভেজা শরীরে ধাক্কা খেলাম। পড়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার পূর্বেই কেউ আমায় ধরে ফেলল।

________

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর

#সূচনা_পর্ব

#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

[ আসসালামুয়ালাইকুম ডিয়ার রিডার্স,

সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি নতুন গল্প নিয়ে হাজির হলাম আপনাদের মাঝে। আশা করি আপনাদের সাড়া পাবো। অনুগ্রহপূর্বক গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকার অনুরোধ রইল। ভালো লাগলে অবশ্যই রিয়েক্ট করতে ভুলবেন না। সকলের ভালোবাসা প্রত্যাশী। ]

#চলবে_কি_?

#NUSRAT_TABASSUM_METHILA

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here