#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০৫
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
ফুলেল বিছানায় মনমরা হয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছে মেহুল। কিন্তু কিছুতেই দুয়ে দুয়ে চারের হিসেবটা মেলাতে পারছে নাহ্। হঠাৎ মেহুলের নেহালের কথা মনে হলো। এখনো কেন সে আসছে না! মনের অজান্তেই চিন্তা করে বসল মেহুল। অপেক্ষার পালার অবসান ঘটিয়ে কারো পদাচারণের শব্দে মনের ভেতরটায় অজানা শিহরণে শিহরিত হয়ে উঠলো তার। নেহাল ভেতরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দিল। মেহুলের কেমন যেন অদ্ভূত সুখানুভব হচ্ছে! আচ্ছা এমন অনুভূতি কি প্রেমে পড়ার পূর্ব লক্ষণ! নানান ভাবনা নেহালকে নিয়ে সাজিয়েও ফেলেছে। এমন অদ্ভূত ভাবনা কেন হচ্ছে তার? যেই বিয়ে নিয়ে খানিকটা পূর্বে সে দ্বিমত ছিল, সেই বিয়ে নিয়েই এখন যেন তার মনের অন্দরমহলে হাজারো সুখ পাখিরা ছুটে বেড়াচ্ছে। নেহাল বেশ অনেকটা সময় নিয়ে মেহুলকে পর্যবেক্ষণ করলো। মনে মনে সে প্রশ্ন করে উঠল,
” আচ্ছা এই মেয়েটার কাছে আসলেই কেন হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়? ”
চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে দিয়ে নেহাল গলা পরিষ্কার করে নিল শব্দ করেই। তারপর বলল,
‘ মেহুল আপনি পোশাক পাল্টে, শাওয়ার নিয়ে নিন। আপনার হয়তো অস্বস্তি হচ্ছে? আর কিছু প্রয়োজন হলে নিঃসংশয়ে বলে ফেলবেন। ‘
এই তিনটে বাক্যই যথেষ্ট ছিল মেহুলের অশান্ত মনকে শান্ত করতে। মেহুল নিজের কল্পনায় সবসময় এমন একজন জীবনসঙ্গীকে খুঁজেছে যে কিনা মেহুলের সুবিধা-অসুবিধাকে প্রাধান্য দেবে। তাই সে স্বানন্দে নিজের মাথা ডানে বামে কাত করিয়ে সম্মতি প্রদান করলো। এমনিতে মেহুলের বিয়েতে অমত থাকলেও নেহালের প্রতি ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। নেহাল মানুষটাকে তার বড্ড ভালো লাগে, কিন্তু দু-চার দিনের পরিচয়ে কারো প্রতি মায়া বাড়াতে সাহস হয়নি তার। বরাবরই নেহালকে দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা হতো মেহুলের সেই শ্রদ্ধা আরও বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে নেহালের এই সামান্য তিনটি বাক্য শ্রবণ করে। মেহুল লাগেজ থেকে নিজের কাপড়-চোপড় ঘেঁটে একটা সুতির শাড়ি বের করল। ওটা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই নেহালের পিছু ডাকে থমকে দাঁড়ায় মেহুল।
‘ আপনার জোরপূর্বক শাড়ি পড়তে হবে না। আপনি যে পোশাক পড়ে স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন সেটাই নিয়ে যান। ‘
‘ না সমস্যা নেই। আমি পারব। ‘ মেহুলের চোখে-মুখে খুশির ছাপ।
‘ প্লিজ মেহুল। নিজের ওপর বোঝা হিসেবে কিছু চাপিয়ে দেবেন না। ‘ অনুরোধ প্রকাশ পেল নেহালের কণ্ঠে।
‘ আচ্ছা। ‘ কিঞ্চিত হেসে মেহুলের সহজ শিকারোক্তি।
মেহুল শাড়ি লাগেজে রেখে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য একটা সেলোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নেহাল আনমনে হেসে উঠল নিজের বোকা বোকা কথা স্মরণ করে। কেন যেন মেহুলের সাথে কথা বলতে গেলেই তার সব কথা গুলিয়ে যায়। মেহুল সামনে থাকলেই তার হৃদপেশীর কার্যক্রম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। কত বিপজ্জনক কাজ অনায়াসে করে আসে যে, যার বুক সামান্য কাঁপে না সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে গিয়ে। অথচ সেই নেহাল কিনা একটা মেয়েকে দেখে হুঁশ হারিয়ে ফেলল! এই তো সেইদিনের কথা যেদিন নেহালের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মেহুল। সেই *বৃষ্টিস্নাত ভোর* যে নেহালের পরবর্তী দিনগুলোর সুখ কেড়ে নিয়েছিল। শয়নে, স্বপনে শুধুই মেহুল আর মেহুল। জীবনটা যে তার মেহুলময় হয়ে উঠেছিল। নেহাল শেরোয়ানী বদলে ফেলল। তার বড্ড আফসোস হচ্ছে-
” কেন যে মেহুল তাকে ভালো করে লক্ষ্য করল না! সে তো বেশ সুদর্শন হিসেবেই নিজেকে জানে অর্থাৎ লোকমুখে প্রচলিত। তবে মেহুল কী তাকে পছন্দ করছে না! তাই হবে হয়তো নতুবা ছোট্ট একটা কথা তো বলতেই পারত। ”
এরকম হাজারটা আজগুবি চিন্তায় নেহাল মত্ত হয়ে ছিল। হঠাৎ দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে চমকে শব্দের উৎসের দিকে দৃষ্টিপাত করল সে। মেহুল একটা ঘিয়ে রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। শরীরের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা না হলেও এই রে তাকে বেশ মানিয়েছে। বড্ড মোহনীয় লাগছে। কেশগুচ্ছ কোমর বরাবর ছড়িয়ে রয়েছে। যেখান থেকে টপ টপ করে পানি বিন্দু আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হচ্ছে। চেহারায় অন্যরকম শুভ্রতা ফুটে উঠেছে। স্নিগ্ধ মায়বী মুখাবয়ব যে কাউকেই তীব্র আকর্ষণ করতে সমর্থ। নেহালের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হলো না। ভাবটা তার এমন যেন চোখ দিয়েই মেহুলকে গিলে খাবে। মেহুল একবার নিজের দিকে আর একবার নেহালের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলো। কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। নেহালের এই চাহনীতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার।
“কী এমন দেখছে নেহাল কে জানে?” মনে মনে এই ভাবনা ভেবে নেহালের দৃষ্ট আকর্ষণ করে ধ্যান ভাঙানোর লক্ষ্য স্থির করে গলা ঝেড়ে কেশে উঠল মেহুল। তারপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নেহালের দিকে। নেহাল থতমত খেয়ে নিজের দুরাবস্থা চাপা দিতে হাসার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। মেহুল বলে উঠল,
‘ কী সমস্যা আপনার? কী দেখছিলেন ওভাবে? ‘
‘ আসলে আমি, মানে আমি, না মানে আমি…’ কথা বলতে গিয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বসল নেহাল। যা তার ক্যারিয়ার জীবনে মারাত্মক বিরলতম ঘটনা হিসেবে লেখা হতে চলেছে। ” বউয়ের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার কারণে হাতেনাতে ধরা পরল সাংবাদিক নেহাল হাসনাত। অতঃপর লজ্জা এড়াতে বউয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিতীয় দফা লজ্জায় পতিত হয়ে কথার খেই হারিয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে সে। ” কী মারাত্মক! এসব ভেবে সশব্দে আনমনে হেসে ওঠে নেহাল। মেহুল নেহালের এহেন আচরণ দেখে ভড়কে উঠে বলে বসল,
‘ এই আপনার সাথে কোনো বদজীন আছে নাকি? এমন পাগলের মতো হাসছেন কেন? আমি আম্মুর কাছে যাচ্ছি, আমার ভয় লাগছে। আম্মু, আম্মু মু মু উউ… আপনি…… ‘ আর কিছু বলার ফুসরত পেল না মেহুল। তার পূর্বেই কেউ বলিষ্ট হাতের বাঁধনে মেহুলের মুখ আবদ্ধ করে ফেলে পেছন দিক থেকে। মেহুলের বুঝতে বাকি রইল না কে এই হাতের মালিক। মেহুল তার শরীরের শক্তি প্রয়োগ করে নেহালের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ব্যর্থ হয়। নেহাল নিজের অপর হাতের দ্বারা মেহুলের কানের কাছে থাকা চুলগুলো সযত্নে সরিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে। ফলে নেহালের উত্তপ্ত শ্বাস এসে মেহুলের কানে, কাধে বাধাগ্রস্ত হয়। মেহুল ঘটনার আকস্মিকতায় কাঁপতে শুরু করে নেহালের দিকে ঘুরে যায়। নেহালের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। মেহুল নেহালের শার্ট খাঁমচে ধরে। দুজন দুজনার এতটাই কাছে যে একে অপরের নিঃশ্বাস অবধি গুনতে পারছে। মেহুল তার কম্পনরত নেত্রযুগল নেহালের দিকে তুলে ধরে। নেহাল সেই চোখের অতল গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তারপর ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,
‘ আপনি এভাবে চিৎকার করলে বাসার সবাই কী ভাববে বলুন তো। আর সত্যি বলতে কী জানেন? তখন আমি আপনাকে দেখছিলাম। আপনার চেহারায় লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু জলের প্রতি আমার চরম হিংসে হচ্ছিল। ওরা কত ভাগ্যবান আপনাকে ছুঁয়ে দিল। ওদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করছিলাম। আর হেসে উঠেছি কারণ আপনি সামনে এলে আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলি। নিজের করা পাগলামি গুলো স্মরণ করে হাসি আটকতে পারিনি বউ। ‘ এতটুকু বলে মেহুলের কাছ থেকে সরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল নেহাল। মেহুল ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তবে ” বউ ” শব্দটা মেহুলের দারুণ লেগেছে। আবারো শুনতে মন চাইছে তার। লজ্জায় তার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় নেহাল বলে উঠল,
‘ ডোজ বোধহয় কম হয়ে গেছে আবার আসব আমি নাকি নিজের চুল শুকিয়ে নেবেন। মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা লাগানোর পায়তারা করে স্বামীসেবা লাভের শখ জেগেছে? আমি কিন্তু প্রস্তুত আছি। আমি সহ্য করতে পারবেন তো? ‘ এ যেন বড়সড় রকমের হুমকি। মেহুল চুল ভালো করে মুছে উক্ত স্থান ত্যাগ করে বারান্দায় পদার্পণ করল। এখানে থাকলে এই নির্লজ্জ লোকের পাল্লায় পড়ে মাটির সাথে মিশে যেতে হবে তাকে। এরপর মেহুল হেয়ারড্রায়ারের সাহায্যে চুল শুকিয়ে শুয়ে পরল। তবে বিছানায় দুজনের মাঝে এতটা জায়গা রয়েছে যে আরো দু-চারজন মানুষ অনায়াসে তাদের মাঝে ঘুমাতে পারবে। মেহুল অবশ্য ঘুমের বাহানায় চোখ বন্ধ করে নেহালের বলা কথাগুলোই ভাবছে। মানুষটাকে তার বেশ লেগেছে। অল্প সময়ের মাঝেই মেহুলকে কতটা আপন করে নিয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে মেহুলের ‘ বাবা হয়তো তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছে। বিদায়বেলায় অমন আচরণ করে বোধহয় নিজের অজান্তেই বাবাকে সে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ‘ তীব্র অনুশোচনায় মনের ভেতরে হাহাকার বয়ে যায় মেহুলের। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
__________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…
#NUSRAT_TABASSUM_METHILA
[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]