১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি পর্ব #বৃষ্টিস্নাত_ভোর #পর্ব_১০ (অন্তিম পর্বের শেষ খন্ড)

0
513

১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি পর্ব
#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_১০ (অন্তিম পর্বের শেষ খন্ড)
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

নেহালের সাথে গত তিনদিনে একটা বারের জন্যেও সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়নি মেহুলের। কেমন আছে তার স্বামী! সেই চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে মেহুল। এদিকে বাড়িতে নতুন মেহমানের আগমনের সংবাদটাও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। মিসেস রহমান যদিও মেহুলের বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন। যত্নে কোনো ক্রটি রাখছেন না। বংশের প্রদীপের আগমন বলে কথা। কিন্তু সন্তান আগমনের সংবাদ যেন মেহুলের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। কারণ তার ভালোবাসার সঙ্গী যে অন্ধকার কুঠিরে আবদ্ধ। সে হয়তো এই সুখের সংবাদটি জানেও না। আর কবে নাগাদ জানবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মেহুল এখন দিনের অধিকাংশ সময় ডুকরে কেঁদে কাটিয়ে দেয়। নেহাল বিনা একটি দিন যেন তার কাছে বিনা অক্সিজেনে শ্বাস গ্রহণের ব্যর্থ চেষ্টার মতো। ভাবতে গিয়েও সে অবাক হয় কয়েকদিন আগেও ছিল না ভালোবাসার কোনো অস্তিত্ব। হুট করে কোনো এক স্নিগ্ধ *বৃষ্টিস্নাত ভোরে* দেখা পাওয়া মানুষটা যেন এখন মনের সর্বত্র জুড়ে অদৃশ্য বিচরণ চালিয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। ফোনের ব্যাপক শব্দে ধ্যান ভাঙল মেহুলের। খানিকটা সময় সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর তা রিসিভ করল,

‘ আপাই তুই ফোন তুলছিস না কেন? ‘ উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শ্রোতা শুনতে পেল।

…… দীর্ঘশ্বাসের ভারী শব্দ।

‘ কী হলো কথা বলবি না? ‘ অনুরোধের স্বরে মিহির।

‘ আমার কিছু বলার নেই। তুই কেন কল করেছিস? ‘ নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় মেহুল।

‘ রায়হান জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাস না? ‘

মেহুল স্তব্ধ হয়ে পড়ল। তার হাত-পা অনর্গল কাঁপছে। সে চাইলেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। অতি কষ্টে উচ্চারণ করল মেহুল,

‘ কখন আসবি মিহির? ‘

‘ এইতো তোর বাসার কাছে চলে এসেছি। ‘

‘ আচ্ছা আয়। ‘

কিছুক্ষণের মাঝেই মিহির আর রায়হানের আগমন ঘটল “শান্তি নিবাসে”। বাড়ির নাম খুব শখ করে রেখেছিলেন মিস্টার রহমান ও তার স্ত্রী। নেহালের জন্ম তাদের জীবনের শান্তি বয়ে এনেছিল বিধায় এই নামকরণ। কিন্তু “শান্তি নিবাসে” কী আজ শান্তি অবশিষ্ট আছে? অশান্তিতে পূর্ণ প্রতিটি মানুষের জীবন সেথায়। কোন যে এক পাপের ফল ভোগ করছে তারা, ভেবেই অস্থির। মিহির মেহুলের রুমে গিয়ে দৃষ্টিক্ষেপ করল। দেখল মেহুল তার পেটে হাত দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিরবির করে কী যেন বলছে। মিহির ধীরগতিতে পা ফেলে মেহুলের নিকট এগিয়ে গেল। তারপর অতি সতর্কতার সাথে মেহুলের কাধে হাত রেখে বলল,

‘ আপাই। ‘

‘ হুম। ‘ মুখ থেকে এই ক্ষুদ্র শব্দ নিঃসৃত করে মেহুল পিছন ফিরে তাকালো। মিহিরকে দেখতে পেয়ে তার হৃদয়ের জমে থাকা কষ্টগুলো যেন অশ্রু আকারে বেরিয়ে আসতে চাইল। অনেক চেষ্টা করেও নিজের অশ্রু সংবরণ করতে না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মেহুল। অপরদিকে মেহুলকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে মিহির আশ্চর্য হয়ে যায়। যেই মেয়েটি কিনা সর্বক্ষণ নিজে শক্ত থেকে অন্যকে নেতৃত্ব দিয়েছে ভেঙে না পড়তে, মনকে শক্ত রাখতে সেই মেয়েটি আজ কিনা স্বামীর শোকে কাতর! এই স্বল্প সময়ের মাঝেই এত ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল দুজনের মাঝে! মিহিরের কাছে একদিকে বিষয়টি যেমন অতি আশ্চর্যের আবার অন্যদিকে অতি প্রশান্তিরও বটে। প্রশান্তির কারণটি মেহুল আর নেহালের মধ্যকার তীব্র ভালোবাসা। মিহির বললো,

‘ আর কাঁদিস না। এবার চল। ‘

‘ মিহির আমি প্রেগন্যান্ট। ‘

‘ কী বলছিস আপাই? ভাইয়া জানত? ‘ উত্তেজিত হয়ে বলল মিহির।

‘ নাহ্। আমি তো গতকালকেই জানলাম। ‘ এতটুকু বলে পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ে মেহুল। এই আবেগঘন মুহূর্তে আগমন ঘটল রায়হান কবিরের। সে বলল,

‘ এবার তো আমাদের বেরোনো উচিত। ভাবী প্লিজ ভেঙে পড়বেন না। মিহির তুমি ভাবীকে নিয়ে এসো। ‘

‘ জি আপনি যান। আমি আপাইকে নিয়ে আসছি। ‘ মিহির রায়হানের কথার প্রেক্ষিতে বলল।

_________
গাড়ি থেকে প্রথমে রায়হান নামল। মেহুল আর মিহিরকে অপেক্ষা করতে বলে কারাগারের প্রবেশ পথের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। সেই যাওয়ার পানে চেয়েছিল মেহুল। অশ্রু যেন তার চোখের বাঁধ মানছেই না। কিছু সময় পর, রায়হানের আগমন ঘটল গাড়ির সামনে। সে বলল,

‘ মিহির তুমি ভাবীকে নিয়ে সাবধানে এসো। ‘

মিহির ইশারায় মাথা নাড়িয়ে ইতিবাচক উত্তর প্রদান করল। সে অতি সাবধানে মেহুলকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। মেহুলের নিকাবের আড়ালে থাকা মুখ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর না হলেও মিহির নিশ্চিতরূপে বলতে পারবে

“তার আপাই নিকাবের আড়ালে কাঁদছে।”

সে যাই হোক। এখন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নেহালের সাথে দেখা করা। মেহুল যে অন্তঃসত্ত্বা এই সুসংবাদ কী আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কারাবন্দী নেহালের উপর? সে কী খবরটা উপভোগ করায় অবস্থায় আছে? নাকি জালিমের জুলুমে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে? এমন অনেক প্রশ্ন মিহিরের মনে কিলবিল করছে। আচ্ছা! তার আপাই কী পারবে নেহাল ভাইয়ের দুরাবস্থা দেখে নিজেকে শক্ত রাখতে? পারবে তো নিজেকে সামলে নিতে? দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অন্ধকারে আবদ্ধ কারাকক্ষের সামনে এসে উপস্থিত হলো মেহুল, মিহির ও রায়হান। কারা প্রকোষ্ঠের ভেতরে নেহালের রক্তাক্ত মুখাবয়ব দৃষ্টিগোচর হলো মেহুলের। মেহুল ধীর কদমে এগিয়ে গেল লোহার বেড়িতে ঘেরা কারাকক্ষের সামনে যেখানে নেহাল বন্দী রয়েছে কতিপয় মিথ্যা অভিযোগে। রায়হান মিহিরকে নিয়ে সরে গেল। তার উদ্দেশ্য নেহাল ও মেহুলকে খানিকটা প্রাইভেসি দেয়া। নেহাল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মেহুলের হাত স্পর্শের উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে গেল। অতঃপর অতি কষ্টে উচ্চারণ করল,

‘ কেমন আছে আমার বউটা? ‘

‘ আমার কথা আপনার মনে পড়েনি বুঝি? কেন ওই রিপোর্ট করতে গেলেন? মিহিরের সাথে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এদেশে থাকতে হলে প্রভাবশালীর অপকর্ম মেনে নিয়েই থাকতে হবে। কোনো দরকার ছিল নিজের জীবনকে এভাবে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার? চুপ করে আছেন কেন? জবাব দিন। আপনার পুরো শরীরে এত ক্ষতচিহ্ন কেন? ‘ মেহুল উত্তেজিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে শ্বাস নেয়ার উদ্দেশ্যে থামল।

‘ একটু শান্ত হও মেহুল প্লিজ। ‘ হকচকিত হয়ে নিজের শরীরের ক্ষতচিহ্ন ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বলল নেহাল।

‘ আপনি জানেন? আমি মা হতে চলেছি? আর আপনি বাবা। কত স্বপ্ন ছিল আমার এই আগমনকে ঘিরে। কিন্তু আপনি সবটাই ধূলিসাৎ করে দিলেন। ‘ অভিমানী কণ্ঠে মেহুল।

‘ কী বললে তুমি? সত্যি আমরা বাবা-মা হব? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ‘ আবেগান্বিত হয়ে বলল নেহাল।

‘ হুম। ‘ বলে লোহার বেড়ির ফাক গলিয়ে মেহুল তার হাত বাড়িয়ে নেহালের হাত স্পর্শ করল। নেহালের নেত্রযুগল হতে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু মেহুলের হাতে পতিত হলো। মেহুল তার নিকাব সরানোর চেষ্টা করতেই নেহাল বাঁধা প্রদান করে বলল,

‘ মেহুল তোমাকে কেউ চিনে ফেলুক আমি চাই না। ওটা ওভাবেই থাক। আর তোমার অশ্রুসিক্ত মুখ খানা দেখে আমার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয়। কতটা অপদার্থ আমি যে কিনা নিজের সন্তান আগমনের খবরটা পরিবারের সাথে থেকে উৎযাপন করতে পারল না। ‘ এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নেহাল। আর মেহুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নেহাল মেহুলের হাত শক্ত করে ধরে বলল,

‘ মেহু তোমাকে আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য, সর্বোপরি নিজের জন্য কঠোর হতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়া চলবে না। আমার যদি কিছু হয়েও যায় সত্যের সাথে কখনো আপস করবে না। জানি না এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব কিনা? তবে জানি তুমি আমায় ছাড়া নিজেকে সামলে নেবে। কী নেবে না? ‘

মেহুল মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। নেহাল বলল,

‘ তুমি ফিরে যাও আর নিজের পরিচয় গোপন রেখে সত্য ভের পথে লড়াই চালিয়ে যাও। বিজয়ী আমাদের হতেই হবে। ইনশাআল্লাহ আমরা বিফল হব না। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য রেখ আমাদের এই গোপন অভিযান সম্পর্কে যেন কেউ না জানে। এমনকি আমাদের পরিবারও না। আর নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে। অবশ্যই আমাদের সন্তান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোনো অবহেলা চলবে না। ‘ কথাগুলো ফিসফিসিয়ে বলল নেহাল। যেন দেয়ালেরও কান আছে। মেহুল কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই কারারক্ষীর আগমন ঘটল। নেহালের ইশারায় মেহুল কোনো কথা বলল না। কিছু সময়ের মাঝেই রায়হান ও মিহিরের আগমন ঘটল। তাই কোনো উপায়ন্তর না দেখে মেহুলকে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই হলো। কিন্তু তার মন যে কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। বারংবার পিছে ঘুরে নেহালকে দেখছিল মেহুল। কারারক্ষী একটা কটুক্তি করেই বসলেন,

‘ এহ্ পিরিত এক্কারে উতলায় উঠতাছে? অপরাধীর লাইগা এত পিরিত আসে কইত্তে? ‘

মেহুল প্রতিবাদ করার পূর্বেই মিহির ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আপাই তুই বাড়াবাড়ি করলে ভাইয়ার ক্ষতি হবে। প্লিজ কিছু বলিস না। ক্ষমতা আর পরিস্থিতি দুটোই কিন্তু আমাদের হাতের বাইরে। ‘

মেহুলের আরো একবার নেহালের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে মিহিরের হাত ধরে জোর কদমে কারাগার থেকে বেরিয়ে এল। সরাসরি গাড়িতে উঠেই থামল সে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো মেহুল। প্রতিটা অপরাধীকে দেখে নেবে মেহুল। কঠোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। নেহালের প্রতি যারা অবিচার করেছে তাদের একচুল পরিমাণ ছাড় দেবে না মেহুল। নেহালের প্রতি করা অন্যায়, মিহিরের প্রতি করা অন্যায়ের যথাযোগ্য শাস্তি যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধীরা পাবে না, মেহুলের শান্তি নেই।

_________
সমাপ্তি

[ কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ। ভুলক্রটি মার্জনীয়। রিচেক হয়নি। ]

[ ঘটনা প্রবাহ কিন্তু এই অবধি সীমাবদ্ধ নয়। আরও অনেকটা পথ বাকি রয়েছে। খুব শীঘ্রই ফিরে আসব ২য় পরিচ্ছেদ নিয়ে। ২য় পরিচ্ছেদেই সব রহস্য উন্মোচিত হবে। আর আগামী দুমাস হয়ত লেখালেখিতে নিয়মিত হতে পারব না। স্বল্প বিরতি নিতে চাচ্ছি। সেই পর্যন্ত সকলে সুস্থ থাকার চেষ্টা করবেন, যদিও এর মালিক আল্লাহ। তবুও চেষ্টা করতে তো মানা নেই! আমার জন্য দোয়া করবেন। আশা রাখব কেউ ভুলে যাবেন না। মনে রাখবেন তো? মন্তব্য প্রত্যাশী। যদিও আপনারা সাইলেন্ট রিডার। তাই জানি কেউ কিছু জানাবেন না। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here