তুমি_আমি_দুজনে #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান পর্ব- ২

0
1189

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২

ধপ করে কিছু পরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আহানের, চোখ খুলে তাকাতেই লাইটের কড়া আলোতে চোখ মুখ কুচকে এলো। নিজেকে ধাতস্ত করে উঠে বসতেই সামনে তাকিয়ে ভ্রু কুটি হয়ে এলো। ওর সামনেই তুরা উপুর হয়ে পরে আছে, কোনো নড়চড় নেই
আহান উঠে গিয়ে তুরার পাশে হাটু গেড়ে বসে বলে

-এই মেয়ে? তুমি এখানে কি করছো? আর এভাবে উপুড় হয়ে পরে আছো কেনো

ভারী আওয়াজ টাতে বুক কেঁপে উঠলো তুরার,হুট করে কিভাবে পরে গেলো বুঝতেই পারিনি, কোনো ভাবে উঠে মুখ কাচুমাচু করে গুটিয়ে বসে আহানের দিকে টিপটিপ করে তাকালো

-কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? তোমার সাহস কি করে হয় আবারও আমার ঘরে আসার?

এমন রূ’ঢ় ধ’মকে আরও গুটিয়ে গেলো তুরা,এমন গাম্ভীর্যতায় তুরার খুব অসস্থি হচ্ছে। তুরার এমন চুপ করে থাকায় আহানের রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো,এমনিতেই কাল থেকে মেজাজ টা বিগড়ে আছে, সারা রাত ঘুমাতে পারেনি,তাও এই মেয়েটার জন্যেই। এই মেয়ে কি কথা বলতে পারে নাহ?

-আর ইউ ডাম্ব? কথা বলতে পারো নাহ? যাস্ট গেট আউট ফ্রম হেয়ার!!

হুংকারের স্বরে তুরা আবারও কেঁপে উঠে, এই লোকটা এমন কেনো? তাকে তো কথা বলার সুযোগ ই দিচ্ছে নাহ, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে নাহ। পারা হুরো করে উঠতে নিলে জামায় টান লেগে ধপ করে পরলো একদম আহানের বুকের উপর। তুরার জান উড়ে গেছে! এবার কি হবে, লোকটা যেমন জ’ল্লাদ তাকে গি’লে না ফেলে,
ছিটকে সরে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো , আহান ওকে কড়া কিছু বলতে নিবে তখনই খেয়াল করলো হাঁটু গেড়ে সে মেয়েটার জামার উপর ই বসেছে তাই উঠতে গেলে পরে গেছে, তুরার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নেবে তখনই চোখ যায় ওর ঘাড়ের দিকে
জামার গলাটা অত্যাধিক বড় হওয়ায় কাধ বেয়ে নেমে গেছে, ফর্সা কাধে কালো রঙের তিলটা জ্বলজ্বল করছে। আহানকে এভাবে এক ধ্যানে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকাতেই আতঁকে ওঠে, এক হাতে খামচে ধরে ঘাড় বেয়ে পরর যাওয়া জামা। আহান তুরার এমন আ’তংকিত চেহারা দেখে ওকে কিছু বলতে নিলেই তুরা ধপ করে উঠে এক হাতে ব্যাগ নিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
তুরার যাওয়ার পানে হা করে চেয়ে থাকে আহান, কি হলো!

-শিট! আমি কেনো তাকাতে গেলাম ওভাবে, পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি, ডিসগাস্টিং

বলেই তোয়ালেটা হাতে নিয়ে গটগট করে হাঁটা ধরলো ওয়াসরুমের দিকে

~~

ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বুকে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো,,

-উফ বড় বাচা বেচেছি, জ’ল্লাদ লোকটার শকুন চোখ দেখলেই ভয়ে গায়ে কাটা দেয়।

সাত পাচ ভেবেই ব্যাগ থেকে কাপড় আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে যায়,সকালে গোসল করার অভ্যাস টা তার ছোট থেকেই,,সকালে গোসল করে তার বাবা তাকে নিজে তৈরি করে দিতো স্কুলের জন্য,
আগের কথা মনে হতেই তুরার চোখ ভরে আসে। মা তো জন্মের কয়েক বছর পরেই তাকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার দেশে, তারপর থেকে তার কাছে পুরো পরিবার টাই শুধু তার বাবা, ছোট থেকে তার বাবা কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি, মাথায় তুলে রেখেছে একমাত্র সন্তান তুরাকে, এক বছর আগে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে তার বাবা নামক ছায়া টাও মাথা থেকে সরে যায়,আপন বলতে এক চাচা আফ ফুফু ই ছিলো। তুরার ফুফু লন্ডনে থাকে পরিবার সমেত,,ভাইয়ের মৃত্যুর পর তুরাকে আর এখানে রাখতে চাইনি নিজের সাথেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তুরাই যায়নি,,এই বাড়িটা জুড়ে তার আর তার বাবা স্মৃতি, এগুলো ছেড়ে যাওয়ার মতো পা’ষাণ সে হতে পারেনি,,, খুব স্বচ্ছলতায় তার জীবন কাটলেও বাবার মৃত্যুর মাস দুয়েক পর তা হয়ে ওঠে দূর্বিষহ,, যেই চাচার ভরসায় থেকে গেলো এখানে সেই চাচা তাকে মোটামুটি ভালোবাসলেও সে ছিলো চাচির দু চোক্ষের বি’ষ। বাড়ির সবরকম কাজ করানো, কড়া কথা শোনানো আর কোনো ভুল হলে অ’মানবিক অ’ত্যাচারে ভরে গেছিলো ছোট্ট তুরার জীবন।
এক বছর কষ্ট করে পড়াশোনা করলেও তার পরে আর তা ভাগ্যে জোটেনি, এইচএসসি তে গোল্ডেন পাওয়া সত্ত্বেও তার আর ভার্সিটিতে পড়া হয়নি, পরীক্ষার কয়েক দিনের মাথায় চাচি কোত্থেকে এক ছেলে যোগাড় করে আনে তুরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য, লোকটাকে দেখেই তুরার গা গুলিয়ে এসেছিলো৷ কেমন বি’শ্রি চাহনি, আর অ’শ্লীল কথাবার্তা বলেছিলো তাকে দেখতে এসেই,একদিনের দেখায় তুরা তার চাচীকে হাজারো বিনতি করেছিলো যাতে বিয়েটা না দেয়,তবুও তার পাষাণ মন গলেনি।
কিন্ত উপওয়ালা হয়তো তুরার কথা রেখেছে, বিয়ের দিনই হঠাৎ পুলিশ এসে তার সেই লোককে ধরে নিয়ে যায় মার’পিট মেয়ে’বাজি আর জু’য়া খেলার দায়ে,
তুরা যেনো হাফ ছেড়ে বেচেছিলো,,
কিন্ত বিয়েতে আসা লোকের ভীড়ের মাঝে হঠাৎ একজন বলে ওঠে বিয়ে হবে, আর এখনই হবে৷ ইনসাফ আংকেল, লোকটাকে সে বছর খানেক আগে দেখেছিলো বাবার মৃত্যুর সময়,, বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলো, কিন্তু তার পরে আর কখনো দেখা হয়নি, উনি এক প্রকার বাধ্য করেন তার ছেলেকে এই বিয়েটা করতে,,,চাচীও তুরাকে ঘাড় থেকে নামাতে রাজি হয়ে যায় এক কথায়। আর তারপর থেকেই তো…ভারী এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তুরার ভেতর থেকে, এক অনাকাঙ্ক্ষিত,, ভরসাহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে,, আগে কি আছে তার জানা নেই।

গোসলে সেরে বেরিয়ে এসে দেখে বিছানা ফাঁকা,তার মানে রাইমা আপু উঠে গেছে? কিন্ত সে এখন কি করবে? নিচে যাবে? যদি আবারও ওই লোকটার সাথে দেখা হয়? চুপ করে বসে পরলো খাটের উপর, না সে কিছুতেই যাবে না বাইরে যতক্ষণ না ওই লোক বাড়ি থেকে বের হবে। কিন্তু তুরার এই ভাবনা টা হয়তো উপওয়ালার পছন্দ হলো না, সেই মুহূর্তে আগমন ঘটলো রাইমার

-তুরা? হয়ে গেছে তোমার?

মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকিয়ে হালকা হাসলো তুরা, রাইমা এগিয়ে এসে বললো

-তুমি ওয়াসরুমে দেখেই আমি নিচে গিয়েছিলাম, এখন চলো তো বাবা তোমায় ডাকছেন নিচে

বলেই তুরার হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে আসলো। তুরা মুখে কিছু না বললেও কাচুমাচু মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যদি আবারও লোকটার সামনে পরতে হয়?
নিচে ডাইনিং এ আসলেই তাকে দেখে ইনসাফ মাহবুব গাল প্রসারিত করে হেসে বললো

-তুরা,এদিক আই মা, বস।

এই লোকটার কথায় যেনো বাবার মতো স্নেহ পায় তুরা,,ভীষণ ভাল্লাগে। বাবার পরে এতো যত্ন করে কেও ভাবেনি তুরার কথা, তুরা বাধ্য মেয়ের মতো ইনসাফ মাহবুব এর কথা অনুযায়ী তার পাশের চেয়ার টাতে বসে।
ইনসাফ মাহবুব তুরার প্লেটে রুটি তুলে দিয়ে বলে

-আমিকি তোকে ভার্সিটি ভর্তি করিয়ে দেবো, পডবি?

এহেন কথা শুনে তুরা কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেশ জোরেই বললো

-সত্যিই বলছেন আংকেল?

-হ্যাঁ বলছি,কিন্ত একটা শর্তে

শর্তের কথা শুনে মুখ চুপসে গেলো তুরার, মিনমিনিয়ে বললো

-কি শর্ত?

-আহান আর রাইমার মতো তোকেও আমায় বাবা বলতে হবে

এহেন কথা সে শুনবে আশাও করেনি তুরা। নিজের অজান্তেই এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো তুরার গাল বেয়ে,তার বাবা মারা যাওয়ার পর আর কখনো বাবা ডাকার সৌভাগ্য হয়নি,নিজের আপন চাচাও তাকে এভাবে বলেনি।
তুরার এমন মলিন মুখ দেখে ইনসাফ তুরার মাথায় হাত রেখে বললেন

-মা রে, আমি জানি তোর মনের অবস্থা টা,, হয়তো তোর বাবার মতো বেস্ট বাবা হতে পারবো নাহ কিন্তু বেটার বাবা হওয়ার চেষ্টা করবো কিন্তু

তুরার এক গাল হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,খাওয়ার মাঝেই সিড়ির দিকে চোখ যেতেই খাবার আটকে যায় গলায়,খুক খুক করে কেশে এক গ্লাস পানি শেষ করে সামনে তাকায় তুরা
লম্বা চওড়া লোকটা একটা কালো জিন্স আর নেভি ব্লু শার্ট পরে,হাতা গোটাতে গোটাতে নামছে সিড়ি দিয়ে,, তুরা আহান কে দেখে খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহান নিঃশব্দে এসে বসে চেয়ারটাই, পাউরুটি জ্যাম লাগয়ে এক কামড় দিতেই তার বাবা প্রশ্ন করলো

-কোথায় যাচ্ছো?

-যেখানে যাই,ভার্সিটিতে

দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো আহান। ইনসাফ মাহবুব গলা খাকারি দিয়ে বললো

-তুরাকেও নিয়ে যাও

-হোয়াট!! এই মেয়েকে আমি কেনো নেবো আমার সাথে?

-ওকে তোমার ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবে তাই

-ইমপসিবল,এই মেয়েকে আমি কিছুতেই আমার ভার্সিটিতে ভর্তি করাবো নাহ

-কেনো ওকে নিয়ে কি সমস্যা তোমার, ও কি তোমার মাথায় চড়ে থাকবে? লাগবে না তোমাকে আমিই ভর্তি করিয়ে দেবো ওকে

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন ইনসাফ মাহবুব। আহান চোয়াল শক্ত করে বসে আছে, সব দোষ এই মেয়েটার,এই মেয়েটার জন্যেই তার বাবার সাথে এরকম ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। অগ্নিশর্মা হয়ে তুরারা দিকে তাকালো আহান
আহানের এমন চাহনি দেখে তুরা শুকনো ঢক গিললো, সামনের গ্লাস টা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে দৌড় দিলো, এখানে আর এক মুহূর্ত নয়, এই জ’ল্লাদ লোকটা শেষে সব রাগ তার উপর ঝাড়বে। সিড়ি বেয়ে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে বড় বড় শ্বাস ফেললো

-উফ বড় বাচা বেচেছি, ওই লোকটা মানুষ না,কেমন রাক্ষসের মতো চেয়ে থাকে

বিকট শব্দে দরজা লাগানো তে কেঁপে উঠলো তুরা, পেছন ঘুরেই দেখে আহান তাকিয়ে আছে তার দিকে,,চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আজ আর নিস্তার নেই,, ঢক গিলে পিছাতে নিলেই আহান বিদ্যুতের বেগে এসে তুরাকে চে’পে ধরলো দেওয়ালের সাথে। শক্ত করে হাতটা চেপে ধরায় যন্ত্রণা’য় আর্তনা’দ করে ওঠে তুরা, এই লোকটার এমন রাগের কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না তুরা এক হাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here