#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব নয়
৯.
অবশেষে আড়াই ঘন্টার মিটিং শেষ হলো।মিটিং টা হয়েছে এক রেস্টুরেন্টে। আলোচনা শেষে একে একে সবাই বেরিয়ে গেল।এবার নীতি সব ফাইল গুছিয়ে উঠে দাড়ালো বেরোবে বলে।কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ফারাজ।
‘মিস নীতি এখানে ট্যারেসে খুব সুন্দর বসার জায়গা আছে।’
নীতি ফারাজের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো এখন আবার কি কাজ।সে একবার ফাইলের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফারাজের দিকে তাকাচ্ছে। ফারাজ বোধ হয় বুঝতে পারলো। সে হেসে দিয়ে বলল,
‘আরে না না। এখন কাজ করাবো না। একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার।চলুন এক কাপ কফি হয়ে যাক!’
ছাদে বসলো তারা। আসলেই ট্যারেস টা খুব সুন্দর। গাছগাছালি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে এখানের অথোরিটি। আশেপাশে তাকিয়ে তাই দেখছিল নীতি।
ফারাজ নীতির দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য গলা খাকারি দিল।নীতি ফারাজের দিকে মনোযোগী হলো।ফারাজ খুবি সিরিয়াস ভঙ্গিতে শক্তভাবে বলল,
‘দেখুন নীতি কাল আপনি যে কাজটা বলেছেন আর করেছেন তা ঠিক করেন নি। আপনার গীটার বাজানোর শখ থাকলে আমাকে বলতেন আমি দিতাম তো।এভাবে গোপনে গোপনে গীটারের মান ইজ্জত টানাটানি করার কোনো দরকার ছিল না। বলেছিলেন কয়েকটা তার লাগালেই হবে!সিরিয়াসলি!!’
ফারাজ নীতির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।নীতিও তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই জোড়ে হেসে দিল।
ফারাজ হাসতে হাসতে বলল,
‘আপনি পারেনও নীতি। হুটহাট অঅদ্ভুত কান্ড।আবার উলটা ঘুড়ে দৌড়ও দিয়েছিলেন।ওহ মাই গুডনেস!’
নীতিও হাসছে। কোনোরকম হাসি কন্ট্রোল করে বলল,
‘জানিনা স্যার বাট হুট করে মাথায় আসলো।আপনি জিজ্ঞেস করায় বলে তো দিয়েছিলাম কিন্তু বলে দিয়ে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। তাই দৌড় দিয়ে ফেলেছি।’
ফারাজ এখনো হাসছে। যেন সে খুব মজা পেয়েছে। নীতির হাসি থেমেছে৷ সে ফারাজকে দেখছে। লোকটা হাসে না তেমন না। ইনফ্যাক্ট সবার সাথেই হাসি খুশি চেষ্টা করে। কিন্তু কোথাও যেন একটা কিছু মিসিং থেকে যায়। হঠাৎ হঠাৎ যেন সে খুব একা হয়ে যায়। কেন হয় তা জানা নেই নীতির। নীতির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে হাসি থামালো ফারাজ। জিজ্ঞেস করলো,
‘কি?’
‘কিছু না স্যার।আপনাকে প্রানখোলা হাসিতে আজ প্রথম দেখলাম।’
অন্তরে বিধলো কথাটা ফারাজের।আসলেই তো কতোদিন হয়েছে মন থেকে হাসে না সে। হাসতে গেলে মনে হয় হাসির কারনটাই তো নেই। অথচ সে তো এমন ছিল না। চঞ্চলতা ছিল তার স্বভাব।কারনে অকারনে হাসতো সে।
ফারাজ হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ কাম অন মিস নীতি!হাসি না আবার কবে? কফি শেষ আমার।বিল টা দিয়ে আসি।’
চলে গেল।নীতির এবার মন টা খারাপ হয়ে গেল।এতো কিসের কষ্ট উনার! কষ্ট তো নীতির কোনো দিকে কম না। এই ভীনদেশে নিজের মা বাবা কে হারিয়ে একা বেঁচে থাকা কি সহজ নাকি?
সেদিন বাবা-মা এর সাথে কোথাও যাচ্ছিল সে। পথিমধ্যে এক্সিডেন্ট হলো।সেই এক্সিডেন্ট তাকে এতিম বানিয়ে দিয়ে গেল। তার মায়ের স্পট ডেথ হয়েছিল।বাবাকে হসপিটাল আনার পর মারা গিয়েছে।তার খুবই গুরুতর অবস্থা ছিল। তার জ্ঞান ফিরেছিল তিন দিন পর। জ্ঞান ফিরে সামনে ফারাজকে পেয়েছিল সে। ফারাজই নাকি উদ্ধার করেছিল তাদের। মা বাবার কথাও ফারাজের থেকেই জানা।
মা-বাবার কথাটা মনে পড়তেই বুকটা হু হু করে উঠলো। মনে পড়ে গেল এই পুরো দুনিয়ায় তার কেউ নেই। সে ভীষণ একা।
অফিসে পৌছানোর পর থেকে নীতি চুপচাপ কাজ করছে। কোনো কথা বলছে না।
ফারাজ নীতিকে ডেকে পাঠালো।
‘কি হয়েছে আপনার?’
‘কিছু হয় নি স্যার’
ফারাজ খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
‘আরে বাহ আপনি আমার সাথে অভিনয় করছেন’
নীতি কিছু বলল না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ নীতির সামনে এসে তার মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বলল,
‘নীতি নিজেকে একা ভাববেন না। একাকিত্ব এর চেয়ে খারাপ অনুভূতি আর হয় না। আপনি আমাকে ভরসা করে যে কোনো কিছু বলতে পারেন। আমাকে ফ্রেন্ড ভাবুন। বিশ্বাস করুন এই ভীনদেশে আমি আপনি বাদে কারো সাথে এতোটুকুও ভাব বিনিময় করি নি। হারানোর কষ্ট কেমন আমি জানি নীতি। হয়তো আপনার মতো মা বাবা হারায় নি আমার।তবে আমি আমার খুব মুল্যবান কিছু হারিয়েছি। তাই ব্যথার অনুভবটা জানা আছে।আপনি আমাকে নিজের যে কোনো বিপদে পাশে পাবেন।আমাকে ফ্রেন্ড ভাবতে পারবেন না?’
মাথা তুলে ফারাজের দিকে তাকালো নীতি।এক ফোটা অশ্রু তার গাল বেয়ে নেমে গেল। এতোটুকু ভরসাই তো দরকার ছিল তার এখন। মানুষটা তার মাথায় হাত রেখেছে। নেই কোনো চাওয়া পাওয়া, আছে শুধু এক টুকরো শ্রদ্ধা। মা বাবা ছাড়া পুরো দুনিয়াটাই তো আধার তার কাছে। সেখানে যদি কেউ বন্ধুত্ব নামের একটু ভরসা হতে চায় তাহলে ক্ষতি কি! এই মানুষটা না থাকলে হয়তো আজ এতো ভালোভাবে বাঁচা টাও মুশকিল হয়ে যেত।
————
ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে না। পুরো একমাস লাগিয়ে অবশেষে শেষ হলো অপরাজিতার পরীক্ষা। নিজেকে কি যে হালকা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে মাথা থেকে বোঝা নেমে গিয়েছে আপাতত। বাকিটা পরে দেখা যাবে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসার পর থেকে অপরাজিতা এখনো বাসা থেকে বের হয় নি।
তাই আজ বিকেলে বের হলো। কোথায় যাবে তার জানা নেই কারন আজ ফারাজের বন্ধের দিন। সে ফারাজ কে ফোন দিল। ফোন ধরতেই বলল,
‘আপনার বাসার এড্রেস টা দিন তো’
‘what??’
দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিল ফায়াদ। হঠাৎ করে অপরাজিতার এমন কথায় অবাকই হয়েছিল।
অপরাজিতা চ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘এমন করার কি আছে? আপনার বাসায় মূল্যবান কিছু আছে নাকি? যদিও আপনি নিজেই মূল্যবান। বাপরে দারুন হ্যান্ডসাম।উফফ!ইচ্ছে তো করে… আচ্ছা বাদ দেন, ধমকি দিয়েন না। আপনার ধমকি শুনলে কান্না আসে আমার। আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। পার্কে আছি। আপনার অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি আসেন। টাটা’
এক নিশ্বাসে বলেই কলটা কেটে দিল সে। খট করে ফোন টা কেটে যেতেই ফায়াদ ফোন এর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বড় এক নিশ্বাস ছেড়ে গেল রেডি হতে।মেয়েটা শান্তি দিল না!অবশ্য শান্তি ফারাদের চাই কিনা তাও সন্দেহ!
ফায়াদ পার্কে এসে দেখলো অপরাজিতা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গুনগুন করছে আর পাইচারি করছে।সে বিরক্তিকর এক শ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েকে কতোদিন মানা করেছে বাহিরে ফোন চালাতে না। তাও শিক্ষা হয় না। ফায়াদ পিছন থেকে ফোনটা টান দিল।
হুট করে ফোন কেউ টান দেওয়াতে অপরাজিতা ভরকে গেল। মনে হলো তার কলিজাটা কেউ টান দিয়ে দৌড় দিচ্ছে। ফোন টান খাওয়ায়ার সাথে সাথে সে পিছন ঘুড়ে কোথাও না তাকিয়ে দিল দৌড়।উদ্দেশ্য চোরের পিছনে দৌড়ানো। কিন্তু এক কদম ও দৌড়াতে পারলো না। ধাম করে মাথায় বারি খেলো একটা।
‘উফফ’
মাথা ডলতে ডলতে মাথা উচু করে দেখে ফায়াদ দাঁড়িয়ে আছে খুব বিরক্ত নিয়ে। আর সে বারি খেয়েছে ফায়াদের বুকের সাথে।
ফায়াদ অপরাজিতার কান্ডে অবাক৷ মেয়েটা এমন কেন? দিন দিন বড় হচ্ছে নাকি ছোট হচ্ছে ভেবে পায় না সে।
অপরাজিতার হাত ধরে হাটা শুরু করলো ফায়াদ। এদিকে অপরাজিতা এখনো মাথা ডলছে।ফায়াদ যে তার হাত ধরে হাটছে এখনো খেয়াল করে নি সে। খেয়াল করলে খুশিতে বোধহয় সে লাফানো শুরু করে দিত।
পাশের এক ক্যাফ এ পাশাপাশি বসেছে তারা।
‘বেশি ব্যথা পেয়েছো?’
‘না! এক একদমই না!’
ত্যাড়ামো দেখে ফায়াদ শান্ত সোজা দৃষ্টি তে তাকালো অপরাজিতার দিকে। অপরাজিতার ভয়েরা যেন ভয় পেয়ে গেল দৃষ্টি দেখে। ঢোক গিলে বলল,
‘একটু পেয়েছি।’
ফায়াদ এবার তাকে কিছু না বলে। কিছু খাবার অর্ডার দেওয়া তে ব্যস্ত হলো। অপরাজিতা ফায়াদের দিকে আড়চোখে বার বার তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ভাবলো ‘ধুর!লুকিয়ে দেখার কি আছে। আমি কি চোর নাকি?’ তারপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটা কে এতো মুগ্ধতা ছড়াতে হবে কেন? নাকি সে ভালোবাসে বলে মুগ্ধ হচ্ছে!
অর্ডার দেওয়া হলে ফায়াদ অপরাজিতার দিকে ফিরে বসলো। অপরাজিতা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।আশে পাশে যেন ফায়াদ আর ফায়াদ।
ফায়াদ বাকা হেসে বলল,
‘আজকাল ফ্লার্ট ও করা হচ্ছে তাই না?’
‘হ্যা। হ্যা??’
প্রথমে ঘোরের মধ্যে হ্যা বললেও পরে প্রশ্ন বুঝতে পেরে অবাক হলো।অবাক হয়ে বলল,
‘ফ্লার্ট করেছি? আমি? কখন?’
ফায়াদ ভ্র নাচিয়ে বলল,
‘ভীষণ হ্যান্ডসাম! উফ! তারপর কি জানি বলেছিলে?’
অপরাজিতা এবার বুঝতে পারলো। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে গেল। ফার্ট তো সে করেছে তাই বলে এভাবে লজ্জা দিবে? ভীষণ খারাপ তো লোকটা!
অপরাজিতা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকে আস্তে করে বলল,
‘ওটা ফার্ট ছিল না তো!’
ফায়াদ হাত বাড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে অপরাজিতার সামনের ছোট চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিল।অপরাজিতা ফায়াদের কান্ডে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার পানে। এই মুহুর্তটা নতুন তার কাছে।নিশ্বাস ধরে রাখছে সে অনুভূতির উত্তেজনায়। ফায়াদ অপরাজিতার গালে হাত বুলিয়ে সোজা তাকালো তার চোখে।কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল,
‘হুম হুম! ওটা ফ্লার্ট ছিল না। ফ্লার্ট তো এখন আমি করছি, তাই না?’
(চলবে)