মরিয়ম বেগম বাড়ির সব সদস্যদের খাইয়ে দিয়ে লতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— মেজো বউমা!
— জ্বী মা।
— সবার খাওয়া শেষ, তুমি বড়ো বউমাকে সাথে করে খেয়ে নিও আর সব কিছু গুছিয়ে শুয়ে পইড়ো তাড়াতাড়ি। সকাল সকাল উঠতে হবে রাত জেগোনা।
— আচ্ছা মা।
কথা গুলো বলেই মরিয়ম বেগম রান্না রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
লতা এ বাড়ির মেজো বউ আর অথৈ বাড়ির বড়ো বউ। অথৈ বিয়ে হয়ে মাত্র কিছু দিন হলো এ সংসারে এসেছে। লতা এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আগে এসেছে, তাই দায়িত্বটা মেজো বউকেই দেয়া হলো। সুমন বাড়ির বড়ো ছেলে, সে দেশের বাইরে থাকার কারনে মেজো ছেলে সুজনকেই আগে বিয়ে করিয়েছিলেন মরিশম বেগম। কারন বাড়িতে একটা লোকের প্রয়োজন ছিলো। লতার কোল জুড়ে আট বছরের একটা ছেলেও আছে। ছোটো ছেলে সৈকত মাত্র কলেজে উঠেছে, লেখাপড়ার সুবাদে বেশিরভাগ সময় শহরেই থাকতে হয় তাকে। আর বাকি রইলো দুই বোন। বড়ো বোনের বিয়ে হলেও স্বামী সন্তান নিয়ে বছরের বেশির ভাগ সময় এ বাড়িতেই থাকে। ছোটো মেয়ে এবার এস এস সি পরীক্ষা দিবে।
বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলে সংসারের হাল ধরায় রহমান সাহেব সমস্ত কাজ কর্ম থেকে অব্যাহত নিয়েছে। টুকটাক গ্রামের সালিশ আর ময়মুরুব্বিদের নিয়েই তার সময় কাটে।
সংসারের সব কাজ শেষ করে লতা আর অথৈ রাতের খাবার খেতে বসেছে। দু’জন দু প্লেট ভাত নিয়ে তরকারির বাটি গুলোর ঢাকনা খুললো লতা। তরকারি বলতে একটা বাটিতে সামান্য কিছু লাল শাক ভাজি, আরেকটা বাটিতে ৩/৪ পিস আলু আর এক পিস মাছের পেটির অর্ধেক রাখা আছে আর একটা পাতিলে কিছুটা ডাল।লতা কিছুটা লাল শাক আর দু পিস আলু সহ মাছের টুকরোটা অথৈ এর প্লেটে তুলে দিতে দিতে বললো,
— আপা, ওই যে ওই পাতিলে ডাল আছে তুলে নিও।
— আচ্ছা আপা। কিন্তু মাছের টুকরাটা আপনি আমার পাতে কেনো দিলেন? আপনি বড়ো আপনাকে রেখে আমি খাই কি করে।
— বড়ো আপা, তুমি বাড়িতে নতুন বউ তাছাড়া আমি এ বাড়িতে আগে আসলেও আমি এ বাড়ির মেজো বউ। তুমি বড়ো তোমাকে রেখে আমি খাই কি করে বলো? আর তাছাড়া আমার ছেলেটা তো খেয়েছে ও খেলেই আমার খাওয়া হয়ে যায়। তোমার তো বাচ্চা কাচ্চাও নাই। আবার তুমি যদি না খাও তাহলে তো পুরো ভাগ টাই তো হারিয়ে গেলো। আপা আর কথা বলোনাতো খেয়ে নাও। অনেক রাত হয়ে গেছে ঘুমাতে হবে কাল সকাল সকাল আবার উঠতে হবে।
— আপা আমি বাড়ির বড়ো বউ হলেও আপনি এ বাড়িতে আগে এসেছেন। আমার থেকে আপনার অধিকারটা বেশি এবং বয়সেও আপনি বড়ো তাই আমি আপনাকে রেখে কি করে খাই!
অর্ধেক টুকরা মাছ নিয়ে লতা এবং অথৈ একে অপরের সাথে বেশ কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলির এক পর্যায়ে এসে সীদ্ধান্ত হলো ওই অর্ধেক টুকরা মাছের মধ্যে অর্ধেক করে ভেঙে নিয়ে দুজনে খাবে। লতা মাছের টুকরোটা ভাঙতে যাবে এমন সময় সুমন রান্নাঘরের দরজা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
— থামো মেজো বউ, মাছ ভাঙবেনা।
সুমনের আচমকা কথাতে দুজনেই চমকে উঠে সুমনের দিকে তাকালো। লতা আর অথৈও একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে লতা বললো,
— কেনো ভাইয়া।
সুমন এগিয়ে এসে বললো,
— তরকারির বাটিটা আমার হাতে দাও।
— তরকারির বাটি দিয়ে কি করবেন আপনি।
— আমি দিতে বলেছি দাও, এতো প্রশ্ন কেনো করছো?
সুমন অনেক রাগি এবং বদমেজাজি তাই বাড়ির সবাই তাকে অনেক ভয় পায়। লতাও এর বাইরে না। লতা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কিছু বলতে যাবে এমন সময় সুমন লতাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই তরকারির বাটি দুটো হাতে তুলে নিলো। আর সাথে ওদের প্লেটে থাকা তরকারি টুকুও তুলে নিলো দুই বাটিতে। এবার বাটি দুটো হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সুমন। লতা বুঝতে পেরেছিলো এটা নিয়ে সুমন আজ একটা ঝামেলা করবে তাই অথৈকে ইশারা করে সুমনকে আটকাতে বললো। অথৈ পিছন থেকে বললো,
— তুমি তরকারির বাটি নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
— কোথায় যাচ্ছি সেটা কি তোমার কাছে এখন কৈফিয়ত দিতে হবে?
— না আমি সেটা বলিনি। এতো রাতে কোনো ঝামেল করোনা। সবার খাওয়া তো শেষ আমরা দুজনেই আছি ওগুলো দিয়ে আমাদের দুজনের খাওয়া হয়ে যাবে। তরকারি গুলো আমাকে দাও।
কথা গুলো বলে সুমনের দিকে এগিয়ে যেতেই সুমন জোর পায়ে ওখান থেকে রহমান সাহেবের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
লতা এবং অথৈ দুজনেরই মুখ শুখিয়ে গেছে। হয়তোবা তাদের শাশুড়ী ধারনা করবে দুই বউ মিলে সুমনের কাছে নালিশ করেছে তাদের খাওয়া নিয়ে। ওরা দুজনও এগিয়ে গেলো তাদের শশুরের রুমের দিকে।
সুমন রহমান সাহেব এর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— আব্বা রুমে আছেন?
— হ্যাঁ আছি বাবা, আয় ভিতরে আয়।
সুমন রুমে ঢুকে খাটের পাশে রাখা টেবিলের উপর তরকারির বাটি দুটো রাখতে রাখতে বললো,
— ওহ, মা-ও আছো দেখছি!
— কিরে সুমন তুই হঠাৎ তরকারির বাটি নিয়ে এখানে কেনো?
— মা, এ বাড়িতে আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর কয়জন লোক খেতে বাকি ছিলো?
— লতা আর অথৈ বাকি ছিলো শুধু।
— লতা আর অথৈ এ বাড়ির কে মা?
— এ আবার কেমন প্রশ্ন?
তরকারির বাটি দুটো রহমান সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আব্বা, এখানে যা তরকারি আছে তা দিয়ে কি দুটো মানুষের ভাত খাওয়া হবে? আপনি আপনার দিক থেকে বিবেচনা করে বলবেন!
— হওয়ার তো কথা না, কি হয়েছে খুলে বল তো!
মরিয়ম বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললেন,
— আমি যখন রান্নাঘর থেকে আসলাম তখন তো তোর বউ বললোনা যে ওই তরকারিতে তাদের দুজনের খাওয়া হবেনা! তাহলে তোকে ডেকে কেনো বিচার দিলো?
— মা, না জেনে শুনে কারো সম্পর্কে কিছু বলা ঠিক না। আমি কি তোমাকে একবারও বলেছি যে আমার বউ আমাকে বিচার দিয়েছে!
— যদি তাই না হয় তাহলে হাঁড়ির খবর তুই কি করে জানলি?
সুমন তার মায়ের সাথে আর তর্কে জড়াতে চাইলোনা তাই রহমান সাহেবের দিকে মননিবেশ করলো।
— কি হলো আব্বা কিছু বলেন!
— কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবি?
— আব্বা, আমার পানি খাওয়ার দরকার ছিলো তাই আমি পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম এই অর্ধেক পিচ মাছের টুকটা নিয়ে লতা আর অথৈ ঠেলাঠেলি করছে যে কে কাকে রেখে খাবে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো এই টুকু মাছ দু’জন ভাগ করে খাবে। মাছ যতটুকুই হোক না কেনো এই শাক ভাজি আর এই তরকারি টুকু দিয়ে কি একটা পরিপূর্ণ মানুষের ভাত খাওয়া হবে আব্বা? সেখানে তারা দুজন তাহলে কিভাবে দুজন মানুষের ভাত খাওয়া হবে আব্বা! আমাকে একটু বোঝান তো।
— মরিয়ম তুমি এমনটা কেনো করলে? সত্যিই তো যেটুকু তরকারি তুমি রেখেছো তাতে তো একজনেরই ঠিকঠাক মতো খাওয়া হবেনা সেখানে দুজন মানুষের কিভাবে খাওয়া হবে?
— ডাল রান্না তো আছে। তারা তো ডাল দিয়ে খেয়ে নিতে পারতো। এগুলো পুরুষ মানুষের কানে দেয়ার কি আছে। আর মেয়ে মানুষের এতো বাচবিচার করা ঠিক না। যা আছে তাই দিয়ে খেয়ে নিতে হয়।
সুমন বললো,
— আমি যে এতক্ষণ কথা গুলো বললাম তার মধ্যে কি কোথাও বলা ছিলো যে লতা বা অথৈ আমাকে এসে জানিয়েছেন?
— তোকে কি বললেই তুই এখন স্বীকার করবি?
— মা, তুমি খুব ভালোই জানো আমি কোন ধরনের ছেলে। আর কি বললে তুমি! মেয়ে মানুষের এতো বাচবিচার করতে নেই। আমি যতদূর জানি তোমার দুই মেয়ের এক মেয়েও কিন্তু ডাল খায়না। এ বাড়িতে কি শুধু মাত্র ওরা দুজনই মেয়ে আছে? তুমিও তো আছো! তোমার দুই মেয়েও তো আছে! যদি এমন নিয়মই হয় যে বাড়ির পুরুষরা আগে খেয়ে যাবে তারপর মেয়েরা খাবে তাহলে তুমি এবং তোমার মেয়েদের খাওয়া হলো আগে কি করে? তুমি কি পারতেনা তোমরা পাঁচটা মানুষ একসাথে বসে খেতে? কম বেশি যেটাই থাকুক মিলেমিশে ভাগ করে খেতে পারতে। কিন্তু সেটা করে তোমরা সবাই খেয়ে তাদের জন্য তলানি গুলো রেখে দিয়েছো কারন তারা দুজন এ বাড়ির বউ, মেয়ে না। তাই তো?
— তুই কি তোর বউ এর হয়ে উকালতি করতে এসেছিস এখানে?
— মা এবার তুমি একটু বেশিই বলে ফেলছো। আমি এখানে কারো উকালতি করতে আসিনি। আমি শুধু জানাতে এসেছি এই কাজটা তোমাদের সাথে হলে কেমন লাগতো?
লতা এবং অথৈ দুজনেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অথৈ বুঝতে পারছে এবিষয়টা যদি বাড়তে থাকে তাহলে এর ইফেক্ট তাদের দুই বউ এর উপর এসেই পড়বে। কিন্তু সাহস করে সুমনের সামনে কিছু বলতেও পারছেনা। তবুও সাহস করে দরজার ভিতরে এক পা রাখলো অথৈ।
চলবে….
#আমার_সংসার
পর্বঃ ১
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)
(রেসপন্স এর উপর ভিত্তি করে পরের পর্ব আসবে, তা না হলে এখানেই শেষ।)