#আমার_সংসার
পর্বঃ ৯ শেষ
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)
অথৈ ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাতে ঘুম না হওয়ার কারনে মাথাটাও খুব ধরেছে। তাই চোখ বুজে শুয়ে রইলো। যদি একটু ঘুম আসে তাহলে হয়তো মাথা ধরাটা কিছুটা কমবে। চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যেনো ঘুম এসে গেছে। কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আচমকা উঠে বসে অথৈ। তাকিয়ে দেখে সুমন পাশে বসে।
— তুমি কখন এলে?
— এইতো কিছুক্ষণ হলো এসেছি।
— এতক্ষণ ডাকোনি কেনো? আর ব্যাংকের কাজ হয়েছে?
— হ্যাঁ হয়েছে, কাল রাতে তো তোমার ঘুম হয়নি তাই আর ডাকিনি।
— আচ্ছা তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসি।
অথৈ বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো খাবার আনার জন্য। বাইরে বের হতেই চেচামেচির আওয়াজ পেলো অথৈ। সুজনের ঘর থেকে আসছে। অথৈ এর বুঝতে বাকি রইলোনা সুজন আর লতার মাঝে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। অথৈ এক পাশে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করলো কি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। ভিতর থেকে লতার কান্নার আওয়াজ আসছে। নিশ্চয় সুজন লতাকে মেরেছে। কি নিয়ে মেরেছে সেটা বুঝতে পারলোনা। অথৈ সুজনের ঘরের দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে মনে ভাবলো, এটা ওদের স্বামী স্ত্রীর সমস্যা সেখানে হয়তো আমার না যাওয়াই উচিৎ। তাই অথৈ আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রান্না ঘরে চলে গেলো সুমনের জন্য খাবার আনতে। সুমনকে খেতে দিয়ে অথৈ পাশে বসে আছে। সুমনের খাবার যেনো গলা নামতে চাইছে না। সেটা অথৈ বুঝতে পেরে সুমনের মাথায় হাত দিয়ে বললো,
— খেয়ে নাও, এতো চিন্তা করোনা আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে তোমার ছোটো ভাই বোনেরা কি করবে বলো!
— চিন্তা তো করতে চাইছিনা, তাও তো চিন্তা চলেই আসছে। মা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে তো অথৈ! আমার মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।
— আল্লাহ ভরসা, মায়ের কিচ্ছু হবেন। মা ঠিক সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে আমাদের মাঝে।
হঠাৎ সুমন অথৈ এর দু হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
— অথৈ, মা তোমাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছে আমি জানি। কারনে অকারণে তোমাদের কথা শুনিয়েছে তোমাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে। তুমি মাকে ক্ষমা করে দিও অথৈ। আমি মায়ের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে।
— এসব কি বলছো তুমি? মা কি তোমার একার? উনি তো আমাদেরও মা আর মায়েরা ওমন একটু আধটু বলেই থাকে। সবাইযে এমনটা করে সেটা বলবোনা, কিন্তু আমাদের তো এটা বুঝতে হবে যে, সব মানুষ এক রকম না। একেকজনের চালচলন কাজ কর্ম একেকরকম তাই বলে কি তাদের খারাপ সময় গুলোতে তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে! আর মা যা করেছে তা যদি আমরা এখন মায়ের সাথে করি তাহলে আমাদের আর মায়ের মধ্যে পার্থক্য হলো কি!
অথৈ কথাগুলো বলে সুমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সুমন কাঁদছে। আসলে মা তো মা’ই হয়, সে যেমনই হোকনা কেনো। মা যেমনই হোক তবুও তো উনি সুমনের মা, মায়ের জন্য কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমি সুমনের চোখ মুছিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলতে বললাম,
— তুমি এতো কষ্ট পেওনা। আল্লাহ পাককে ডাকো উনি সব ঠিক করে দিবে। আর সন্তানের দোয়া সবার আগে আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তুমি মায়ের জন্য দোয়া করো তোমার সেই দোয়া টুকুই আল্লাহ কবুল করবেন। মা ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। আর তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও হাসপাতালে যেতে হবে। আমরা গেলে তবেই আব্বা আর তমা বাড়ি আসতে পারবে।
সুমন আর কোনো কথা বললোনা। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে নিলো। খাওয়া শেষ করে উঠতেই খেয়াল করলো সুজন ডাকছে বাইরে থেকে। সুমন বাইরে এসে দেখলো সুজন রেডি হয়ে একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো লতা। সুজনকে সুমনের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও চুপ করে থাকলো কারন এই সময় সুজনের সাথে তর্ক করার কোনো ইচ্ছে সুমনের নাই। সুমন চুপচাপ এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। সুমন বললো,
— কিছু বলবি?
— ভাইয়া বের হচ্ছি। আমার আসতে কিছুদিন দেরি হবে।
— ঠিক আছে দেখে শুনে ভালোভাবে থাকিস।
কথাটা বলেই সুমন ঘরে চলে গেলো। সুমন ঘরে ঢুকেই অথৈকে বললো
— তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আমরা বের হবো।
— মেজো ভাই কেনো ডাকছিলো?
— সে চলে গেলো সেটা বলতেই ডাকছিলো।
অথৈ সুমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাগে সুমনের দু চোখ লাল হয়ে আছে। তাই অথৈও আর কথা বাড়ালো না। অথৈ সুমনের রাগকে খুব ভয় পায়। সুমন আর অথৈ লতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে পৌঁছে তমা আর রহমান সাহেবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো সুমন।
আজ সাত দিন হলো অথৈ আর সুমন হাসপাতালে পড়ে আছে। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে দুজন সেবা করে চলেছে তাদের মায়ের। মরিয়ম বেগম আগের থেকে অনেকটা ভালো। টুকটাক কথা বলে কিন্তু এক হাত আর এক পা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। পুরো অকেজো হয়ে গেছে শরীরের এক পাশ। পুরোপুরি সেরে উঠতে বেশ কয়েকমাস সময় লাগবে। নিজে কিছুই করতে পারেনা সব সময় একটা লোক লাগে তার কাছে। আজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। তারা মরিয়ম বেগমকে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে।
বাড়ির দরজায় এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পেয়ে লতা বেরিয়ে এলো বাড়ির ভিতর থেকে। । সবাই ধরাধরি করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়া হলো মরিয়ম বেগমকে। আশপাশের বাড়ি থেকে কেও কেও এসেছে দেখতে। মরিয়ম বেগম টুকটাক কথাও বলছে তাদের সাথে।
প্রায় মাস খানিক হয়ে গেলো মরিয়ম বেগমের অসুস্থতার। হাসপাতাল থেকে আসার পর রিমা একদিন এসে শুধু দায় মিটিয়ে গেছে। ইদানীং লতাও খুব একটা মরিয়ম বেগমের কাছে আসতে চায়না। যদি কখনো অথৈ ডাক দেয় ধরার জন্য শুধু তখনই আসে। নিজে থেকে কখনো এসে দেখেনা কিছু লাগবে কি না। হয়তো পুরনো রাগের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু অথৈ কখনো অবহেলা করেনা। সুমন অথৈ আর তমা এরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করে মরিয়ম বেগমের খেয়াল রাখার।
অথৈ শাশুড়ীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় মরিয়ম বেগম এক হাত দিয়ে অথৈ এর একটা হাত ধরে বলে,
— আমাকে মাফ করে দিও বড়ো বউমা। আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমাদের সাথে।
— ছিঃ ছিঃ মা এ আপনি কি বলছেন! আপনি মাফ চাইছেন কেনো? আমরা আপনার ছেলেমেয়ে আপনি যা করেছেন তা হয়তো আমাদের ভালোর জন্যই করেছেন। আমরাই হয়তো বুঝতে পারিনি। এসব কথা আর কখনো বলবেন না।
দুজনের কথার মাঝে সুমন এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর তমাও এসে মায়ের পাশে বসলো। মরিয়ম বেগম আচমকা বলে উঠলো,
— আমার দিক থেকে তো সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার পিছনে টাকা খরচ করতে হবে বলে একজন পালিয়েছে আর একজন সেবা করার ভয়ে এ বাড়িতে আর পা রাখেনা। আর মেজো বউমা তো থেকেও কাছে আসেনা তেমন একটা। তুমি কেনো পড়ে আছো আমার কাছে বড়ো বউমা? আমার একটা অসুখেই আমার সংসারটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেলো। তুমিও তোমার মতো গুছিয়ে নাও বড়ো বউমা। এভাবে আমার পিছনে পড়ে থেকোনা।
— কিচ্ছু ভাঙ্গেনি মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এ সংসার কারো একার না। এ সংসার আমারও, আর আমি এই সংসার ছেড়ে কোথায় গিয়ে কি গুছিয়ে নেবো? আমার সংসারে আমি সবইকে নিয়ে একসাথে থাকবো মা।
মরিয়ম বেগমের দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। অথৈ তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মরিয়ম বেগমের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
সমাপ্ত
(শেষের দুই পর্বে আপনাদের অনেক অপেক্ষা করিয়েছে, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গল্পটা কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। আপনাদের মতামত পেলে হাজির হবো নতুন এক গল্প নিয়ে কোনো এক সময়ে। সবাই ভালো থাকবেন।)